অতনু ফোরে পড়ে। মাঝে মাঝে বিকেলে সে তার দাদুর সঙ্গে বাড়ির সামনের পার্কে যায়। সে কালুকেও চেন দিয়ে বেঁধে নিয়ে যায়। কালু একটা দেশি কুকুরছানা। অতনুর বাবা মা, সমীর আর শিখা, দু’জনেই দেশি কুকুর পছন্দ করেন। বলেন, ভাল ভাবে থাকলে এরাও খুব ভাল হয়। ওরা বড় কষ্টে থাকে। একটা তো অন্তত ভাল থাকুক।
অতনুর সংস্পর্শে এলেই দাদু হারানো শৈশব ফিরে পান। তাঁর ছেলেমানুষি উপচে পড়ে। পার্কে দাদু অনেক গল্প বলেন। এক দিন বললেন, ‘কারও দিকে আঙুল দেখাতে নেই। আমি দেখাব না। তোমাকে যে দিকে বলব সে দিকে তাকাবে।’
‘আচ্ছা।’
‘ডান দিকের বেঞ্চিতে যে বুড়ো ভদ্রলোক বসে আছেন, উনি কিন্তু বুড়ো সেজে আছেন। আসলে খুদে।’ অতনুর চোখ একেবারে ছানাবড়া হয়ে গেল। বলল, ‘কী করে বুঝলে?’
‘বোঝা যাচ্ছে।’
তখনই বুড়ো ভদ্রলোক আইসক্রিমওয়ালার থেকে একটা চকোবার কিনে চুষে চুষে খেতে লাগলেন। জলজ্যান্ত উদাহরণ পেয়ে দাদু সোল্লাসে বললেন, ‘অতনু দেখো।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক বাচ্চাদের মতো করে আইসক্রিম খাচ্ছে। গায়ে পড়ছে। কী আশ্চর্য! তুমি কী করে বুঝলে?’ দাদু বললেন, ‘বাঁ দিকে তাকাও। যে বাচ্চাটা গাছতলায় বসে আছে, ও আসলে খুদে নয়, বুড়ো। বাচ্চা সেজে আছে।’
‘তাই নাকি?’ অবাক চোখে চেয়ে অতনু বলে, ‘কী করে বোঝো তুমি?’
দাদু এখন শৈশবে ভরপুর। অতনু যত অবাক হয়, দাদুর ফুর্তি তত বাড়ে। সেই বাচ্চাটা পকেট থেকে নোটবই আর পেন বের করে খুব ভারিক্কি চালে লিখতে লাগল। অতনু বলল, ‘দাদু, শিগগির দেখো, ঠিক বড়দের মতো করে কী সব লিখছে।’
দাদু মহাখুশি। বললেন, ‘মতো কী? ও তো বড়ই। সীতাহরণের সময় রাবণ সন্ন্যাসীর রূপ ধারণ করেছিল, সে তো তোমাকে বলেছি। এখনও অনেক দুষ্টুলোক ভালমানুষ সেজে থাকে। লোকে না বুঝে বিপদে পড়ে।’
‘সবাই তো সাজতে পারে না।’
‘না। ঠিক বলেছ। যেমন তোমরা পারবে না। তুমি ছোট। আস্তে আস্তে বড় হবে। তোমার বাবা মা বড়। আমি বুড়ো। তবে আমি এক বার বাচ্চা হতে চাই।’
‘কবে দাদু?’
‘সেটা জানি না।’
কালীপুজোর সময় এত বাধানিষেধ সত্ত্বেও অতনুদের পাড়ায় কিছু ছেলে অনেক শব্দওয়ালা বাজি ফাটাল। প্রচণ্ড শব্দে দাদুর আর কালুর খুব কষ্ট হয়। কালু খাচ্ছে না, খাটের তলা থেকে বেরোচ্ছে না। ও তো দেশি, ওদের কষ্টের কথা না ভাবাটাই যেন নিয়ম। কিন্তু ওরা বুড়োদের কথাটাও ভাবে না। দাদুর কানে তালা লেগে গেল। শিখা খাতা-পেন দাদুর ঘরে রাখলেন। লিখে লিখে দাদুর কথার উত্তর দেবেন বলে। দাদু বললেন ‘জানলাটা বন্ধ কেন?’
শিখা লিখতে গেলেন, বন্ধ কারণ...
অমনি দাদু প্রশ্ন করলেন, ‘ওই দরজাটা খোলা কেন?’ শিখা লিখতে চেষ্টা করলেন, দরজাটা এই মাত্র... ব্যস দাদু তক্ষুনি অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন।
কথা বলতে এক মিনিট লাগে। অত তাড়াতাড়ি কিছুতেই লেখা যায় না। হিমশিম ব্যাপার।
রোববার সকালে বালি থেকে ফোন এল, অতনুর বড় পিসিমা খুব অসুস্থ। সমীর কোনও রকমে তাঁর বাবাকে বোঝালেন কথাটা। বললেন, তিনি আর শিখা বেরিয়ে যাবেন। পঞ্চু রোজ এসে রান্না করে দিয়ে চলে যায়। শিখা অতনুকে বললেন, ‘মাছ, সবজি, দই আছে। দাদুকে দেখে রেখো। কালু দুধভাত খাবে। আমরা সন্ধেবেলায় ফিরব।’ অতনুর খাওয়া নিয়ে কোনও বায়নাক্কা নেই। সে দাদুর কাছে বসল। পঞ্চু এল। দাদুকে জিজ্ঞেস করল, ‘শিম আছে, খাবেন?’
‘ডিম?’
‘শিম।’
‘ডিম? না খাব না। শিখা রোজ দই পাতে। ফ্রিজে দেখ, দই আছেই। আমি দইভাত ভালবাসি।’
‘দই টক তো।’
‘দই শক্ত? কস্মিন কালে শুনিনি।’
‘ধুর!’
‘গুড়? কেন, চিনি দিয়েই তো ভাল লাগে।’
‘আলুর তরকারি করব?’
‘কালু? নিশ্চয়ই গেটের সামনে বসে আছে।’
‘উফ, পাগল হয়ে যাব।’
‘ছাগল? না, না। ছাগল ঢুকবে না। কালু আছে না?’
অতনু বুঝেছে, দাদু বলেছিল, এক বার বাচ্চা হবে, হয়েছে। ছোট্ট বাচ্চারা যেমন উলটোপালটা কথা বলে, তেমনি বলছে। অতনু পঞ্চুর ওপর বিরক্ত হয়ে বলল, ‘যা হয় কিছু করো। মাছ করবে, সঙ্গে দাদুকে দইভাত দেবে। কালুকে দুধভাত।’
সন্ধেতে সমীর আর শিখা ফিরলেন। সমীরের বড়দি ভাল আছেন। সমীর তাঁর বাবার জন্য একটা খুব দামি হিয়ারিং এড কিনে এনেছেন। সেটা বাবাকে পরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘বাবা, শুনতে পাচ্ছ? শিখাও একই প্রশ্ন করলেন। সমীরের বাবা একটু হকচকিয়ে গিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ পাচ্ছি। কিন্তু তোমরা এত জোরে কথা বলছ কেন?’ সমীর আর শিখা হইহই করে উঠলেন, ‘বাবা শুনতে পাচ্ছেন।’
অতনু ভাবল, স্কুলের দারোয়ান হীরালাল শুনতে পায় না বলে ‘হাঁ হাঁ, ক্যায়া ক্যায়া’ করে। দাদু তো কখনও ‘অ্যাঁ অ্যাঁ’ করেনি। শুনতে পাচ্ছিল সবই, খালি বাচ্চা হয়েছিল বলেই না যা খুশি বলছিল। মা বাবা এটা জানে না, দাদু তো আমাকেই বলেছে। ওরা না বুঝেই কী একটা মেশিন লাগিয়ে দাদুকে ‘বড়’ বানিয়ে দিল। অতনুর কেমন যেন একটু মনখারাপ হয়ে গেল।