Advertisement
E-Paper

তিন্নি এবং তার শিক্ষিত-পোষ্য

ব্যালকনিতে বসে ছিল তিন্নি। কোলে ওর আদরের পোষা বেড়াল ঝুমনি। তার গলায় লাল ফিতে, কপালে লাল টিপ। একটু বাদেই নীচে নামবে ঝুমনির মালকিন। একটা লিকলিকে সাদা ফিতে দিয়ে গলাটা বাঁধা থাকবে ঝুমনির।

ধ্রুবজ্যোতি বাগচী

শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৫ ০১:০৪
ছবি: সুমন চৌধুরী।

ছবি: সুমন চৌধুরী।

ব্যালকনিতে বসে ছিল তিন্নি। কোলে ওর আদরের পোষা বেড়াল ঝুমনি। তার গলায় লাল ফিতে, কপালে লাল টিপ। একটু বাদেই নীচে নামবে ঝুমনির মালকিন। একটা লিকলিকে সাদা ফিতে দিয়ে গলাটা বাঁধা থাকবে ঝুমনির।

তিন্নির সঙ্গে সঙ্গে হাঁটবে ও, যেন পোষা সারমেয়। দূরে দূরে তখন আবাসনের মধ্যে ঘুরে বেড়ানো নেড়িগুলো পরিত্রাহি চেল্লাবে। কিন্তু কার সাধ্যি কাছে ঘেঁষবে? তিন্নির চিলচিৎকারে ওগুলো তখন যে যে দিকে পারে ছুটে পালাবে।

পাপাই সাইকেলে দু’তিনটে পাক খেয়ে তিতাসদের ফ্ল্যাটের নীচে দাঁড়িয়ে বেল বাজায় জোরে। দৃষ্টি ওর চার তলায়। তিতাসদের ফ্ল্যাটের দিকে।

‘দাদান এখন যাবে না।
হোম টাস্ক করছে।’

তিন্নির গম্ভীর আদেশে বিরক্ত পাপাই নীচ থেকে হুকুম করে, ‘তোকে পাকামো করতে হবে না। তুই ওকে ব্যালকনিতে আসতে বল।’

তিন্নির নিশ্চয়ই আঁতে ঘা লাগে। ব্যালকনিতে বসেই দ্বিগুণ জোরে চিৎকার করে, ‘মা দেখো না, পাপাইদাদা দাদানকে ডাকছে। আমি বলছি... ও মা গো...’

পরেরটুকু তিতাসের গাঁট্টার ফলাফল। পাপাই নীচ থেকেই শুনতে পায় তিতাসের হম্বিতম্বি, ‘তুই কী করছিস? নেড়িটাকে কোলে নিয়ে বসে আছিস, তোর টাস্ক হয়েছে?’

‘অ-নে-ক ক্ষণ...। আর ঝুমনিকে তুমি নেড়ি বলবে না দাদান। ও রাস্তার কুকুর নয়। রীতিমত শিক্ষিত-পোষ্য...’

ঠাম্মার কাছ থেকে শেখা বিশেষণটা বেমালুম আউড়ে দিল তিন্নি।

‘তোকে বাবা বলেছে না বেড়াল-টেড়াল কম ঘাঁটাঘাঁটি করতে? লোমটোম পেটে গেলে...!’

‘তোমাকে পাকামো করতে হবে না। ... ও মা, দেখো না...’

দ্বিতীয় বার গাঁট্টা খেয়ে তিন্নি ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে। তিতাস তখন ধাঁ। প্রত্যেকটা বিল্ডিংয়ের নীচে ঢোকার প্যাসেজের এক ধারে আবাসিকদের সাইকেল, স্কুটার রাখবার জায়গা। নিজের সাইকেলটা নিয়ে আবাসন-চক্কর শুরু করে তিতাস। সায়ম, স্নিগ্ধ, অয়ন, ঋক— সবাই তখন বিকেলের ম্লান আলোয় অলিখিত দৈনন্দিন সাইকেল রেসে মেতে উঠেছে। আবাসনের মা-কাকিমারা এ সময় হাঁটেন। তাঁদের পাশ কাটিয়ে দুদ্দাড় চলে যায় তিতাসদের দল। ‘এই তোরা আস্তে চালা তো। অ্যাকসিডেন্ট না করলে চলছে না?’ ইত্যাকার সাবধানবাণী কেয়ার করতে বয়েই গেছে কিশোর বাহিনীর। সকলেরই ক্লাস সেভেন-এইট। হাওয়া কাটিয়ে নেশাড়ুর মতো ওদের সাইকেল রেস চলে। মাঝে মাঝে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষা। কেউ পড়ে গেলেই গলা ফাটিয়ে আওয়াজ, ‘এখনও শিখলি না? কবে আর শিখবি রে?’

এখানে ওখানে বাচ্চারা শীত শেষ হয়ে এলেও ব্যাডমিন্টন খেলছে। গাছগাছালিতে ভরা আবাসন চত্বরে একটা ছোট্ট মাঠ আছে। সেখানে বড়দের একটা দল ক্রিকেটও পেটাচ্ছে। স্নিগ্ধ পাপাইদের দাদুরা বৈকালিক ভ্রমণ সাঙ্গ করে সবাই এখানে ওখানে সুন্দর করে বাঁধানো সিমেন্টের স্ল্যাবে বসে গল্পে মত্ত। অফিস ফেরত কাকু-জেঠুরা একে একে ফিরছেন সব। সন্ধে হয়ে আসছিল তখন...।

তিতাস অনেক ক্ষণ থেকেই লক্ষ করছিল, তিন্নি এখনও নামেনি নীচে। অন্য দিন তো ওর শিক্ষিত-পোষ্যকে নিয়ে ইতিমধ্যে কয়েক বার চক্কর মারা হয়ে যায়। টুয়া, কোয়েল, মিলিদের সঙ্গে ওর দারুণ ভাব। ফোর-ফাইভে পড়ে সব। ঝুমনিকে নিয়ে ওদের আদেখলেপনা দেখলে তিতাসের গা জ্বলে যায়। একটা এইটুকুনি পুঁচকে বেড়ালের জন্য এ রকম ভাবগতিক কাঁহাতক সহ্য হয়? ওর তো নয়ই। বাড়িতে আবার তিনি, তিন্নির কাছ ছাড়া শোবেন না। খাটের নীচে ওর জন্য ছোট্ট বিছানার ব্যবস্থা করে দিয়েছে মা। কিন্তু ওই পর্যন্তই। ঘরের আলো নিভলেই তিনি তিন্নির পাশটিতে, কোলের কাছে ঘেঁষে শোবেন। মায়ের সঙ্গে এই নিয়ে নিত্য বাগ্্বিতণ্ডা। কান্না জুড়ে দেয় ছিঁচকাঁদুনে তিন্নি, ‘আমি কী করব? ও যে একা ঘুমোতে পারে না...’। মাঝ রাতেও বাবার দরাজ গলায় হাসি শুনতে পাওয়া যায় তখন। একরত্তি একটা বাচ্চাকে ধরে নিয়ে এসেছিল তিন্নি। অনেক বকাঝকা, কিছুই শোনেনি। সেই থেকে রয়ে গিয়েছে ওদের বাড়িতে। শীর্ষদা
ওদের গৃহশিক্ষক, যার ‘ঝুমনি’ নামকরণ করেছে।

কিন্তু আজ কী হল? মাও তো নীচে নামেনি! বাবার ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে আটটা, ন’টা। মোটামুটি মায়ের সঙ্গে সঙ্গেই নিত্য দিন ভাই বোন ফ্ল্যাটে ঢোকে।

সাইকেল চালাতে চালাতে তিতাস বার কয়েক তাদের ব্যালকনির দিকে লক্ষ করল। না, তিন্নি নেই সেখানে। একটু চিন্তিতই হল সে। বন্ধুদের কিছু না বলে নীচে সাইকেলটা রেখে ও ওপরে উঠে আসে। দু’বার ডোরবেল বাজতে মা দরজা খোলে। তিতাস লক্ষ করে, মায়ের মুখটা গম্ভীর, থমথমে। ও কিছু বুঝে ওঠার আগেই মা প্রশ্ন করে, ‘তুমি আজও বোনের মাথায় গাঁট্টা মেরেছ? হাজার বার বলেছি তিতু বাচ্চাদের মাথায় মারতে নেই। শরীরটা এমনিতেই ভাল যাচ্ছে না ওর এই ঠান্ডা-গরমে। এখন জ্বর একশোর ওপরে। কোথা থেকে কী হয়ে যায়! তোমার বাবাকে ফোন করলাম। উনি বললেন, শেখরকে ডাকতে। শেখরকে খবর দিয়েছি ও আসছে একটু বাদে। ঘরে গিয়ে দেখো, বোনটা কেমন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। বড় হচ্ছ, জ্ঞানগম্যি আর কবে হবে? ও ছোট এবং দুর্বল বলে ওর ওপর তুমি দাদাগিরি ফলাচ্ছ। এটা শিষ্টাচার নয়। এই কথাটা মনে রেখো।’ একটানা কথাগুলো বলে মা কিচেনে ঢুকে গেল।

শেখরকাকু আবাসনের উল্টো দিকে একটা ওষুধের দোকানে বসেন। জেনারেল ফিজিশিয়ান। আবাসনের সবারই বিপদে-আপদে প্রথম ভরসা। ডাকলেই আসেন। সবারই খুব কাছের।

তিতাস দ্রুত বেডরুমে চলে আসে। ঘরে জিরো পাওয়ারের নীল নাইট ল্যাম্পটা জ্বলছে। একটু আগেই মা সন্ধে দিয়েছে। ঠাকুরের সিংহাসনের কাছে সুগন্ধী ধূপকাঠি। মৃদু সৌরভ সমস্ত ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে। টিভিতে কার্টুন চ্যানেল চলছে। তিন্নির গায়ে হালকা চাদর। কাঁদছিল বোঝা যাচ্ছে। এবং অবধারিত ভাবে ওর মাথার কাছে ঝুমনি বসে আছে।

তিতাস স্পষ্ট দেখল, ওকে দেখে ঝুমনি মুখটা ফিরিয়ে নিল।

ডোরবেল বাজল। শেখরকাকু এল বোধ হয়।

তিতাস ব্যালকনিতে চলে এল। ওর চোখ দুটো কেমন জ্বালা করছিল...। ওর ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। একেই কি অনুতপ্ত হওয়া বলে? সত্যিই তো, বোনটা ছোট এবং দুর্বলও বটে! ওকে মারা বা আঘাত করবার মধ্যে কৃতিত্ব নেই কোনও। মায়ের কথাগুলো ভীষণ কুরে কুরে খাচ্ছিল ওকে। ঝুমনিও যে ওর কৃতকর্ম সমর্থন করেনি, তাও ওর আচরণে বুঝিয়ে দিল। শেখরকাকু কী বলে, তা শোনার জন্য তিতাস ঘরের ভেতর চলে এল তখন। ও বুঝতে পারছিল অপরাধ বোধটা কাটিয়ে ওঠার জন্য শেখরকাকুর সামনে দাঁড়ানো প্রয়োজন। ওষুধ-টষুধ আনতে হবে নিশ্চয়ই। ...বাবার ফিরতে দেরি আছে। প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে ও চটজলদি ওষুধগুলো নিয়ে আসতে পারবে...।

tinni and her pet robibasoriyo anadamela anandamela story dhrubojyoti bagchi
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy