Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Bengali Feature

হারিয়ে যাচ্ছে প্রেক্ষাগৃহ ও তার অন্দরসজ্জা

থিয়েটার হলগুলির অনুকরণে মেট্রো, মিনার্ভা, মিত্রা, রূপবাণী, রক্সি, প্যারাডাইস, স্টার— প্রতিটি হলই সেজে উঠেছিল আলাদা আলাদা শিল্পসুষমায়। তখন স্বদেশি যুগ। সাহেব শিল্পীদের বদলে সুযোগ পান সুধাংশুশেখর চৌধুরী, অর্ধেন্দুপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রণয়রঞ্জন রায়, ব্রিজমোহননাথ জিজ্জার মতো গুণী শিল্পীরা। মাল্টিপ্লেক্সের যুগে সবই এখন অতীত।

art.
সোমা সেন
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০২৩ ০৯:২৪
Share: Save:

সত্তরের দশকের আগেই, আমরা যখন স্কুলে, তখনই সিনেমা দেখার আগ্রহ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বাড়িতে বড়রা সিনেমা দেখে এলে তাঁদের মুখে গল্প শুনতাম। আমরাও ‘মানিক’, ‘বাদশা’, ‘বালিকাবধূ’, ‘ছুটি’, ‘হাটারি’, ‘সাউন্ড অব মিউজ়িক’— এই সব সিনেমা দেখে ফেলেছি। আর চেনা হয়ে গিয়েছিল সিনেমা হলগুলি, তাদের অঙ্গসজ্জা সমেত। তার পর সিনেমা দেখার গতি যেমন বেড়েছে, হলগুলির অন্দরসজ্জাও মুখস্থ হয়েছে। মনে মনে তুলনা করতাম কোন হলের ছবি আর সাজ ভাল লাগে বেশি। ধীরে ধীরে সিনেমার জায়গা নিল টেলিভিশন। তার পর আমরা এসে দাঁড়ালাম ইলেকট্রনিক যুগের দোরগোড়ায়। তত দিনে বড় বড় বহুতল বাড়ি উঠেছে, শপিং মল তৈরি হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন বাড়িগুলো ভেঙে। সিনেমা হলগুলিও এই কৃষ্ণগহ্বরে মিলিয়ে যেতে লাগল। যখন আমাদের টনক নড়ল, তত দিনে বহু সিনেমাঘরই তাদের অন্দরসজ্জা নিয়ে স্বর্গগত।

সিনেমা হলের তুলনায় থিয়েটারগুলি ছিল বেশি জমকালো। সাহেবরা নাটক বিষয়ে অত্যন্ত আগ্রহী হওয়ায় দ্বারকানাথ ঠাকুর একটি থিয়েটার হলের শেয়ার কেনেন। সে সময় কলকাতায় থিয়েটারের পীঠস্থান ছিল ‘প্রাইভেট সাবস্ক্রিপশন থিয়েটার’, যার অন্য নাম ছিল ‘পুরাতন চৌরঙ্গী থিয়েটার’। সাহেব শিল্পীদের স্থাপত্য আর অন্দরসজ্জা মিলে চোখ-ধাঁধানো ব্যাপার। অনেক দিনের জমা দেনা মেটাতে না পেরে থিয়েটারের মালিকরা চৌরঙ্গী থিয়েটার নিলামে বেচে দেয়। দ্বারকানাথ সিন সিনারি পোশাক-আশাক ছাড়াও থিয়েটারের সব জিনিসপত্তর সমেত বাড়িটি কিনে নেন ১৮৩৫ সালের ১৫ অগস্ট। বন্ধু ডেম্পিয়ার্স-কে চিঠিতে লেখেন, “থিয়েটার এখন প্রায় সম্পূর্ণতঃ আমার একার সম্পত্তি। পার্কার, পামার ও আরও কয়েকজন অভিনেতা চোদ্দদিন অন্তর অন্তর থিয়েটারে হাজির থাকতে বদ্ধপরিকর। মার্চ মাসে প্রয়োজনীয় মেরামতির কাজে হাত দেওয়া হবে। আমাদের গ্রীষ্মপ্রধান দেশে যতটা আরামদায়ক করা সম্ভব, আমরা সেইভাবে থিয়েটার ঢেলে সাজাতে লেগেছি।” প্রসঙ্গত এই রাস্তাটির নামই ছিল থিয়েটার রোড (এখন শেক্সপিয়র সরণি)। ‘ঘরোয়া’ বইয়ে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লেখেন, “দ্বারকানাথ ঠাকুরের থিয়েটার ছিল চৌরঙ্গীতে, এখন যেখানে মিসেস মস্কের গ্রান্ড হোটেল।” তৎকালীন গ্র্যান্ড হোটেলের অবস্থান আমাদের অজানা।

সিনেমা হল অপেক্ষাকৃত নবীন। ভারতে প্রথম সিঙ্গল স্ক্রিন মুভি থিয়েটার হল ‘মিনার্ভা’ (থিয়েটার নয়)। ৫/১ চৌরঙ্গি প্লেস-এ ১৯০৭ সালে এটি তৈরি করেন জামশেদজি ফ্রামজি ম্যাডান। এই সিনেমা হলটিও যথাযথ সুসজ্জিত ছিল। সিনেমা হলগুলি সাজানোর মূলেও ছিল থিয়েটার হলগুলির অঙ্গসজ্জা আর চাকচিক্য।

চৌরঙ্গিতে মেট্রো সিনেমা হলটি নির্মিত হয় ১৯৩৫ সালে। স্থপতি ছিলেন টমাস ল্যাম্ব। অঙ্গসজ্জার ভার ন্যস্ত হয় ভারতীয় শিল্পীদের ওপর। স্বদেশি হাওয়া তখন প্রবল। তা ছাড়া দেশি শিল্পীদের দিয়ে কাজ করালে কম খরচেও হবে, তাই দায়িত্ব পড়ল সুধাংশুশেখর চৌধুরীর ওপর। ক্ষিতীন্দ্রনাথ মজুমদারের অধ্যক্ষ থাকাকালে ‘ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্ট’-এ তাঁর চিত্রবিদ্যা শিক্ষা। ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ‘বার্মা গান রানিং’-এর সঙ্গে যুক্ত থাকায় তাঁর কারাদণ্ড হয়, প্রমাণাভাবে ছাড়া পেয়ে যান। কয়েক বছর অন্তরিন থাকেন। দেশে ফেরার পর তিনি লন্ডনে ‘ইন্ডিয়া হাউস’-এর দেওয়ালে মুরাল করার ডাক পান তৎকালীন ভারত সরকারের পক্ষ থেকে। ললিতমোহন সেন, রণদাচরণ উকিল, ধীরেনকৃষ্ণ দেববর্মণ প্রমুখের সঙ্গে তিনি লন্ডন যান। সেখানে ‘রয়াল কলেজ অব আর্ট’-এ স্যর উইলিয়াম রথেনস্টাইনের তত্ত্বাবধানে এক বছর মুরাল আঁকার পদ্ধতি শেখেন। তার পর দশ মাস ধরে ইন্ডিয়া হাউসে মুরাল করেন। তাঁর কাজগুলির মধ্যে আনারকলি, ষষ্ঠীপূজা, সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের মহিলা দেহরক্ষীদের অভিবাদন গ্রহণ উল্লেখযোগ্য।

তখন লন্ডনে স্যর উইলিয়াম রথেনস্টাইন একটি ভাষণে বলেছিলেন— “আজকাল যে সব সভাগৃহ, সিনেমা হাউস, বিশ্ববিদ্যালয় ও ধর্মমন্দির ইত্যাদি বড় বড় বাড়ি হচ্ছে, তাতে প্রথম থেকেই যেমন বসবার ঘর, লাইব্রেরি, ভাষণ-কক্ষ, নির্বাচন করা হয় ঠিক তেমনই কতকগুলো দেওয়ালেও দেওয়ালচিত্র আঁকবার উপযুক্ত করে দেওয়াল প্রস্তুত করা উচিত। স্থাপত্য শিল্পের যেমন একটা প্রয়োজন আছে, বাড়িটাকেও সুন্দর ভাবে গড়ে তোলায় তেমনই দেওয়াল চিত্রেরও প্রয়োজন আছে।” ধীরেনকৃষ্ণ দেববর্মণ লিখেছেন, “আমাদের দেশেও পুরাকালের মত আবার রাজপ্রাসাদ থেকে আরম্ভ করে সামান্য কুটিরও ভারতীয় অভিরুচিতে শিল্পীর রঙ ও রেখার টানে যাতে সুন্দর হয়ে উঠতে পারে তারই চেষ্টা করতে হবে।”

দেশে ফেরার পর সুধাংশুবাবু মেট্রো প্রেক্ষাগৃহ সাজানোর দায়িত্ব পান। বন্ধুশিল্পী অর্ধেন্দুপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রণয়রঞ্জন রায়, ব্রিজমোহননাথ জিজ্জা-র সহায়তায় এই কাজ শেষ হয়। ‘লাইট হাউস’ তৈরি হয় ১৯৪০ সালে। সেখানেও এই শিল্পীরাই অন্দরসজ্জার দায়িত্ব পান।

সেই সময়ই পর পর বহু চলচ্চিত্র প্রদর্শনশালা তৈরি হয়। তার মধ্যে চিত্রা (পরে যার নাম হয় মিত্রা), রক্সি, প্যারাডাইস, ওরিয়েন্ট, বসুশ্রী, রাধা, উজ্বলা, স্টার-সহ আরও অনেক প্রেক্ষাগৃহ তাঁর পরিকল্পনায় সেজে উঠেছে। সুধাংশুশেখর পরে কলকাতায় নিজের চিত্র-কর্মশালা স্থাপন করেন। গৃহের অভ্যন্তর-সজ্জার এটি প্রথম দেশি সংস্থা। রঙ্গমঞ্চ সজ্জাও তিনি অনেক করেছেন। দেশের মধ্যে বিহার, ওড়িশা ছাড়াও নেপাল, সিকিম, মেঘালয়, ভুটানের একাধিক প্রেক্ষাগৃহের ভিতরে ও বাইরে সজ্জার মধ্যে সুধাংশু চৌধুরী আর তাঁর সঙ্গীদের কাজ আছে।

রূপবাণী সিনেমা হলের অঙ্গসজ্জা করেছিলেন অর্ধেন্দুপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ষোলো বছর বয়সে কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলে ভর্তি হন, তখন অসিতকুমার হালদার সেখানকার উপাধ্যক্ষ। অসিতকুমার শান্তিনিকেতনে সদ্য প্রতিষ্ঠিত কলাভবনের অধ্যক্ষের কাজ নিয়ে চলে আসায় অর্ধেন্দুপ্রসাদও সেখানে চলে আসেন। ১৯১৯ সালে ব্রহ্মচর্যাশ্রমে ভর্তি হয়ে অসিতকুমারের অধীনে চিত্রকলা শিখতে থাকেন তিনি। কলাভবনের প্রথম দশ জন ছাত্রদের মধ্যে তিনি অন্যতম।

প্রণয়রঞ্জন রায় একই সময় লখনউ-এর সরকারি আর্ট কলেজে ভর্তি হন। তিনি ললিতমোহন সেন, বীরেশ্বর সেন প্রমুখের কাছে পাশ্চাত্য এবং ভারতীয় ধারায় চিত্রবিদ্যা শেখেন। প্রথমে নব্যবঙ্গীয় ধারাতেই আঁকতেন। পরে তাঁর কাজে ইউরোপীয় প্রভাব দেখা যায়। এই ধারার ছবিগুলিও সাহেবপাড়ার সিনেমা হলে দেখা গেছে।

ব্রিজমোহননাথ জিজ্জা-র জন্ম বারাণসীতে। ১৯২৮ সালে অসিতকুমার হালদার অধ্যক্ষ থাকাকালে তিনি লখনউয়ের সরকারি আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। অসিতকুমার এবং বীরেশ্বর সেনের কাছে প্রাচ্যশিল্প ও ললিতমোহন সেনের কাছে পাশ্চাত্য চিত্রাঙ্কন শেখেন ব্রিজমোহন।

চিত্রা (পরে মিত্রা, ১৯৬৩) প্রেক্ষাগৃহের অঙ্গসজ্জা করেছিলেন শিল্পী চারুচন্দ্র রায়। দু’দিকের খোদাইচিত্র আঁকেন শিল্পী কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। চারুচন্দ্র ‘ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্ট’-এ অবনীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে আসেন। তিনি ব্যঙ্গচিত্রে ‘সি রায়’ নামেও পরিচিত ছিলেন। বম্বে টকিজ় খ্যাত হিমাংশু রায়ের ডাকে ১৯২৫ সালে চলচ্চিত্রশিল্পে যোগ দেন চারুচন্দ্র। তিনি নির্বাক ও সবাক চিত্রপরিচালক রূপে খ্যাতি পান। বাংলা ভাষার প্রথম চলচ্চিত্র সাময়িকী ‘বায়স্কোপ’ (দ্বিভাষিক)-এর সম্পাদক ছিলেন তিনি।

অপেক্ষাকৃত নবীন শিল্পী সুনীলকুমার পাল কাজ করেন মিনার এবং বিজলী সিনেমা হলে। তাঁর আঁকা চিত্র এবং ভাস্কর্য সমন্বিত চিত্রগৃহটি আজও টিকে আছে। শুধু সিনেমা হল নয়, তাঁর কাজ নিয়ে সেজে উঠেছে পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলও।

ছবি আর ভাস্কর্য ছাড়াও এই সব প্রতিভাবান শিল্পীরা অভ্যন্তর সজ্জার সব রকম কাজই করতেন। এই কাজগুলিকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে তাঁদের জীবনীতে কোনও দিনই লেখা হয়নি। শিল্পসমূহ রক্ষা করার চেষ্টাও করা হয়নি।

তথ্যঋণ: ঘরোয়া: অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর; ভারতশিল্প ও আমার কথা: অর্ধেন্দ্রকুমার গঙ্গোপাধ্যায়; দ্বারকানাথ ঠাকুর: কৃষ্ণ কৃপালনী; ভারতের ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী: কমল সরকার; ৫। প্রবাসী পত্রিকা (কার্তিক, ১৩৩৯)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Feature Bengali Story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE