Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব-১
Bengali Novel Ep-1

খরস্রোত

প্রকাণ্ড এই বাড়িটার ভিতরে যেতে খুব ইচ্ছে হয় শশিকান্তর। সে কল্পনা করে, ভিতরে অনেকগুলো ঘরে সে দৌড়োদৌড়ি করে বেড়াচ্ছে। এক দিন সে নিশ্চয়ই পাঁচিল টপকে ভিতরে ঢুকে পড়বে।

ছবি: কুনাল বর্মণ।

ছবি: কুনাল বর্মণ।

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০২৪ ০৯:০৫
Share: Save:

লোকটাকে প্রায়ই দেখে শশিকান্ত। লম্বা, রোগা, হাড়-জিরজিরে চেহারা। গায়ের রং কালো। লোকটা কখনও একা আসে, কখনও বা সঙ্গে দু’-এক জনকে নিয়ে। শশিকান্ত দূর থেকে লক্ষ করে লোকটাকে। ধুতির উপর একটা হাফহাতা শার্ট। পায়ে সস্তার জুতো। শশিকান্ত জানে লোকটা কী করবে। কালো রংচটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এ-দিক ও-দিক তাকাবে। তার পর দরজায় ঠিক তিন বার শব্দ করবে। তিন বার শব্দ করে লোকটা দাঁড়িয়ে থাকবে। দু’পাল্লার দরজা একটু উন্মুক্ত হবে। লোকটা ভিতরে ঢুকে যাবে।

শশিকান্তর খুব ইচ্ছে করে, দরজার ভিতরের মানুষটাকে দেখার। কিন্তু সাহসে কুলোয় না। তার ধারণা, এই বাড়িতে কেউ থাকে না। জরাজীর্ণ এই বাড়িটাকে দেখলে কেউ বলবেও না যে, এই বাড়িতে প্রাণের চিহ্ন আছে। এ বাড়ির লম্বা লম্বা খড়খড়ির জানালাগুলো কবে যে শেষ খোলা হয়েছিল, কেউ জানে না। শশিকান্ত এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেখান থেকে এই বাড়িটাকে স্পষ্ট দেখা যায়। বাগান-ঘেরা বাড়ি। যে কালো রংচটা দরজার সামনে লোকটি এখন দাঁড়িয়ে, তার থেকে ভিতরে খানিকটা এগোলে এ বাড়ির মূল ফটক।

প্রকাণ্ড এই বাড়িটার ভিতরে যেতে খুব ইচ্ছে হয় শশিকান্তর। সে কল্পনা করে, ভিতরে অনেকগুলো ঘরে সে দৌড়োদৌড়ি করে বেড়াচ্ছে। এক দিন সে নিশ্চয়ই পাঁচিল টপকে ভিতরে ঢুকে পড়বে। কিন্তু একা এই কাজ করতে পারবে না সে। সঙ্গে বিশু আর ঈশানকে নিতে হবে। বন্ধুদের মধ্যে এরাই সাহসী। দু’জনেই শশিকান্তর চেয়ে বয়সে একটু বড়। যে কোনও দুঃসাহসিক কাজে এই জুড়ির সমকক্ষ মেলা ভার। তবু শশিকান্তর মনে সন্দেহ দানা বাঁধে, সত্যি সত্যি কি এই বাড়ির ভিতরে ঢুকতে ওরা রাজি হবে। এই প্রকাণ্ড বাড়িটা যে ভূতুড়ে! অনেক রাতে এ বাড়ির ভিতর থেকে কার কান্না শোনা যায়। সেই কান্নার শব্দ বনজঙ্গল পেরিয়ে আশপাশের বাড়িতেও পৌঁছয়। আধোঘুমে সেই কান্না শুনে শশিকান্তর পিসিমা রামনাম জপ করেন। কাঁথাটা ভাল করে টেনে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েন।

সত্যি এ বাড়ির বদনাম আছে। শশিকান্ত পিসিমার মুখেও শুনেছে যে, এই বাড়িতে ভূত আছে। একটি মেয়ের বিদেহী আত্মা নাকি আজও ঘুরে বেড়ায় এ বাড়ির আনাচে কানাচে। অথচ শশিকান্ত রোজ দেখে, একটি লোক চট করে বাড়ির মধ্যে ঢুকে যায়। রোজই যে এক লোক আসে এ বাড়িতে তা নয়। শশিকান্ত লক্ষ করেছে, গতকাল যে লোকটি এসেছিল, সেই লোকটি এই লোক নয়। তার চেহারা আজকের লোকটির মতো কৃশকায় নয়। তার চোখে আজকের লোকটির মতো চশমা ছিল না। শশিকান্ত লক্ষ করে, গতকালের লোকটির মতো আজকের লোকটিও দরজায় তিনটে শব্দ করে। তার পর খানিক ক্ষণ অপেক্ষা করে। এ-দিক ও-দিক তাকায়। এক সময় দরজা খুললে, ভিতরে ঢুকে যায়। লোকটা ভিতরে ঢুকলেই দরজা বন্ধ হয়ে যায়। দরজা বন্ধ হয়ে গেলেও, বেশ খানিক ক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে শশিকান্ত। তার পর হাঁটতে শুরু করে। হাঁটতে হাঁটতে ভাবে, কে এই লোকগুলো। এরা এ বাড়িতে আসে কেন রোজ? সূর্যাস্তের পরেই বা আসে কেন? সকালবেলায় তো কোনও দিন কাউকে দেখেনি শশিকান্ত! তা হলে কি যাদের দেখে, তারাও তেনাদের দলে? কী রকম একটা ভয়-ভয় করতে লাগল, শশিকান্ত হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল। মনে হল লোকগুলো যেন তার পিছু নিয়েছে। সে একটা দৌড় লাগাল তাদের বাড়ির উদ্দেশে।

শশিকান্তদের মস্ত বাড়ি। বেলঘরিয়া অঞ্চলে এত বড় বাড়ি খুব কম লোকেরই আছে। ও পাড়ার গাঙ্গুলিদের বাড়িটাও বেশ বড়। ওটা শশিকান্তর মাসির বাড়ি। মাকে চোখে দেখলেও, মনে পড়ে না একটুও। মাত্র সাত মাস বয়সে যে-মাকে সে হারিয়েছে, তাকে মনে পড়ার কথাও নয়। তাই মাসির মুখের আদলে নিজের মাকে কল্পনা করে শশিকান্ত। মাসি ভালও বাসেন শশিকান্তকে। মাসির দুই ছেলে যতীন আর মানবেন্দ্রর সঙ্গে খুব সখ্য তার। বাড়ির ভিতর দুটো পুকুর, অনেকটা ধান জমি, আর অনেকটা ফাঁকা জায়গা। তিন ভাই মিলে এখানে ফুটবল খেলে। অন্য ছেলেরাও এসে এখানে ভিড় জমায়। তারাও খেলায় অংশগ্রহণ করে। খেলার পর মাসি নিজের হাতে শশিকান্তকে খাইয়ে দেন। শশিকান্ত বাড়ি ফেরে। মাঝেমধ্যে সে কাছাকাছি সাগর দত্ত মাঠেও খেলতে যায়। মাঠ লাগোয়া স্কুলে সে পড়াশোনা করে। স্কুলটি অবৈতনিক। শশিকান্তর কাকা এই স্কুলে তাকে ভর্তি করে দিয়েছে। শশিকান্তর বাবা রমানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তখন মজফ্ফরপুরে, শ্বশুরালয়ে। স্ত্রীবিয়োগের সাত বছর পরেও শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ অটুট। শশিকান্তকেও নিয়ে গেছেন সেখানে।

মজফ্ফরপুরের এই বাড়িতেও অনেক লোক। মনে হয় সব সময় একটা যজ্ঞি লেগে আছে। এখানে এসে খানিকটা দিশেহারা লাগে শশিকান্তর। দিদি সঙ্গে এলে, দিদির সঙ্গে আমবাগান আর লিচুবাগানে ঘুরে ঘুরে সময় কাটে। না হলে, ভীষণ একা একা লাগে। বাড়ির সবাই শশিকান্তকে ভালবাসেন, বিশেষত দাদামশাই অঘোরনাথ মুখোপাধ্যায়। বাড়ির সামনে প্রশস্ত উঠোন চত্বরে গড়গড়ায় তামাক টানতে টানতে নাতির পড়াশোনার খোঁজ নেন বৃদ্ধ। সাগর দত্ত অবৈতনিক স্কুলে নাতি পড়ে শুনে, উষ্মা প্রকাশ করেন অঘোরনাথ। রমানাথকে ডেকে বলেন, “তুমি কি অর্থ উপার্জন করা ছেড়ে দিয়েছ, রমানাথ? শুনেছিলুম তো পাটের ব্যবসায় তোমার ভালই আয় হচ্ছে।”

“কেন এ কথা বলছেন বাবা? আপনি তো ঠিকই শুনেছেন। বড়বাজারে পাটের গদি থেকে আমার উপার্জন এখন মন্দ নয়,” দীর্ঘদেহী রমানাথ বিনীত ভাবে বলেন।

গড়গড়ার নলটা এক পাশে সরিয়ে রেখে অঘোরনাথ বলে ওঠেন, “তা-ই যদি হয়, তবে ছেলেকে ওই বিনেপয়সার স্কুলটায় ভর্তি করেছ কেন? ওর পড়ার খরচের টাকা লাগলে, তুমি আমার কাছ থেকে নিতে পারো।”

ফর্সা সুডৌল মুখ রক্তাভ হল। ঘন ভ্রুযুগল কুঞ্চিত। রাগ সংবরণ করলেন রমানাথ। বললেন, “গত শীতে আমি যখন আপনার শরীর খারাপের সংবাদ পেয়ে এখানে এসেছিলাম, তখন ভাই ওকে ওখানে ভর্তি করে দেয়। আশপাশের অনেক ছেলেই ওখানে পড়ে। স্কুলটিও মন্দ নয়। স্কুলের হেডমাস্টার আমার বিশেষ পরিচিতও বটে।”

অঘোরনাথের কণ্ঠস্বর কিঞ্চিৎ নরম হল। বললেন, “মা-মরা ছেলে। ওর লেখাপড়ার যাতে কোনও অসুবিধে না হয়, সেই কথাই বলছিলাম। তুমি কিছু মনে কোরো না বাবা। ভাই মানে, তোমার সেই অকালকুষ্মাণ্ড ভাইটি তো? কী যেন নাম তার?”

“উমানাথ,” রমানাথ জানান।

“হ্যাঁ, উমানাথ। মনে পড়েছে এই বার। সে নিজেও তো পড়াশোনার ধার ধারেনি। শুনেছি, ইয়ার-বন্ধুদের নিয়ে ফুর্তি করে বেড়ায়। তার কাছে ভাল স্কুলও যা, মন্দ স্কুলও তাই। যাক, শ্যালকের সঙ্গে দেখা হয়েছে?”

“না, হয়নি এখনও। দেখলাম, লেখায় মন। আর বিরক্ত করলাম না।”

“যাও, দেখা করে এসো। তোমার কথা প্রায়শই সে বলে।”

বৃদ্ধ গড়গড়ার নলের প্রান্তমুখে ঠোঁট ছোঁয়ান। বুক ভরে তামাক টানতে থাকেন। ভুরভুর করে শব্দ হয় গড়গড়ায়। সকালের মিঠে রোদ এসে পড়ে প্রশস্ত বারান্দায়। অঘোরনাথ চোখ বুজে ভাবেন তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা রাখোমণির কথা। যাওয়ার কি বয়স হয়েছিল তার? কেন ঈশ্বর এত নির্দয়? জামাইকে দোষ দিতে পারেন না তিনি। সে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল। কত বড় বড় ডাক্তার কবরেজকে বাড়িতে নিয়ে এসে দেখিয়েছিল রাখোকে। কিন্তু, যে যাওয়ার সে যাবেই। কর্কট অতি ভীষণ রোগ। দেখতে দেখতে সাত বছর হয়ে গেল। বৃদ্ধের চোখের প্রান্তে জলের আভাস দেখা গেল। কাপড়ের খুঁট দিয়ে সেই জল মুছে অঘোরনাথ আবার গড়গড়ায় মন দিলেন।

এ বাড়িতে এক জনকে দেখলেই কেমন ভয় করে শশিকান্তর। ছোটমামা উষাপতি মুখোপাধ্যায়। গম্ভীর স্বভাবের লোক। কম কথা বলেন। খাতার পাতায় কলম দিয়ে কী সব লিখে চলেন। মাঝে মাঝে লেখা থামিয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকেন। কী দেখেন ভগবান জানেন। কখনও নিজের মনে কথা বলেন। আবার লিখতে শুরু করেন। দিদির কাছে শশিকান্ত শুনেছে যে, ছোটমামা নাকি লেখক। পাতার পর পাতা গল্প লেখেন। কলকাতার নামকরা পত্রপত্রিকায় সেই সব গল্প ছাপা হয়। কলকাতার নামকরা লেখকরাও ছোটমামার গল্পের প্রশংসা করে। শশিকান্তর দিদি কনকবালার সঙ্গে উষাপতির খুব ভাব। সে এলেই উষাপতি তাকে তার নতুন গল্পের বই দেখান। কনকবালা বইখানি নেড়েচেড়ে দেখে ফেরত দেয়। তার খুব গর্ব হয়। সে কথা ছোটমামাকে বললে, উষাপতি উত্তর দেন হাসতে হাসতে, “দূর পাগলি! গল্প লেখা কোনও ব্যাপার নাকি? তুইও পারবি, চেষ্টা করলে। কঠিন কাজ হল কবিতা লেখা। শব্দ বাছো, ছন্দ মেলাও, পঙ্‌ক্তি ঠিক রাখো— সে অনেক ঝামেলা।”

“ওই জন্যই কি তুমি কবিতা লেখো না?” কনকবালা বলে।

“লিখি না বললে, তোকে মিথ্যে বলা হবে। লিখি। আসলে, কবিতা দিয়েই তো শুরু করেছিলাম। ওইটা ভিতরে আছে। শুনবি, আচ্ছা তোকে শোনাই একটা কবিতা— মনে পড়ে সাধের সে গেহ,/ আহা কত সুখের আলয়;—/ ক্রমে ক্রমে সেদিন আসিল/ যেদিনেতে না আসিলে নয়।/ নয়নের নিভে গেল জ্যোতি/ বয়ানের হাসি গেল ঝরে,/ গৃহ ছাড়ি রহিতে হইবে/ পরদেশে দীর্ঘকাল ধরে।”

“বাহ্ খুব সুন্দর!” কনকবালা বলে।

“সত্যি বলছিস?” উষাপতি কনকবালাকে জিজ্ঞেস করেন।

“হ্যাঁ, মিথ্যে বলব কেন? তবে মিল দেওয়াটা সহজ কাজ নয়।”

“যারা কবি, তাদের কাছে এটা কঠিন কাজ নয়। আমার কাছেও নয় ততটা। তবে এখন আর খুব একটা কবিতা লিখি না। গল্পেই মন দিয়েছি বেশি। কেন জানিস?”

“কেন?”

“ওই বুড়োটার নির্দেশে। ও যে আমার দেবতা।”

“বুড়ো? তুমি কার কথা বলছ বল তো?”

উষাপতি গেয়ে ওঠেন—“তোমারই নামে নয়ন মেলিনু পুণ্য প্রভাতে আজি,/ তোমারই নামে খুলিল হৃদয়শতদলদলরাজি।/ তোমারই নামে নিবিড় তিমিরে ফুটিল কনকলেখা/ তোমারই নামে উঠিল গগনে কিরণবীণা বাজি।”

“রবিঠাকুরের গান। তার মানে তুমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা বলছ। তুমি চেনো ওঁকে?” বিস্ময়ে কনকবালার চোখ দুটো গোল গোল হয়ে গেছে।

উষাপতি হাসেন। একটা সিগার ধরান। এই বস্তুটি ইদানীং একটু বেশি খাওয়া হয়ে যাচ্ছে। খাওয়া শুরু লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়তে গিয়ে। তখন একটা-দুটো চলত সারা দিনে। এখন দিনে দশটার বেশি হয়ে যায়। ইদানীং একটা কাশি হয় তার। বিশেষত ভোরের দিকে। কবরেজমশাই ওষুধ দিয়েছেন। বলেছেন, ধূমপান ত্যাগ করতে। কিন্তু এ এমন এক নেশা, সহজে ত্যাগ করা যায় না। তবে কমিয়ে দিয়েছেন সংখ্যায়।

এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে উষাপতি বলেন, “উনি আমাকে স্নেহ করেন। ওঁর নির্দেশেই আমি গল্প লিখি। আমার গদ্য, রচনাশৈলী ওঁকে মুগ্ধ করে।”

“আচ্ছা ছোটমামা, তুমি যে ছদ্মনামে লেখো, ওটা তো মায়ের নাম, না?” কনকবালা হঠাৎ
জিজ্ঞেস করে ওঠে।

উষাপতি কোনও উত্তর দেন না। তার পর হঠাৎ বলে ওঠে, “রাখোটা যে কেন এত তাড়াতাড়ি চলে গেল! মৃত্যুর সময় এক বার চোখের দেখাও দেখতে পেলাম না। আমি তখন লন্ডনে। তার পেলাম...”

কনকবালার দু’চোখ বেয়ে জল নামতে লাগল।

ক্রমশ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Novel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE