Advertisement
১৮ জুন ২০২৪

শীতের স্নানের ছ্যাঁক

আমার মাসি শীতে স্নান করার আগে ওয়ার্ম আপ করে। ঘুম থেকে উঠে খুব খানিক ছোটাছুটি করে নেয় ঘরগুলোয়। ধোঁয়া ওঠা জলে ভাল করে হাত-মুখ ধুতেই, চানের জন্য নেট প্র্যাকটিসটুকু হয়ে যায়। তার পর চা, পাঁউরুটির কল্যাণে একটু গ্যাসে, একটু টোস্টারে, একটু মাইক্রোওয়েভে নিজেকেও হালকা হালকা সেঁকে নেয়।

চিরশ্রী মজুমদার
শেষ আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:০৪
Share: Save:

আমার মাসি শীতে স্নান করার আগে ওয়ার্ম আপ করে। ঘুম থেকে উঠে খুব খানিক ছোটাছুটি করে নেয় ঘরগুলোয়। ধোঁয়া ওঠা জলে ভাল করে হাত-মুখ ধুতেই, চানের জন্য নেট প্র্যাকটিসটুকু হয়ে যায়। তার পর চা, পাঁউরুটির কল্যাণে একটু গ্যাসে, একটু টোস্টারে, একটু মাইক্রোওয়েভে নিজেকেও হালকা হালকা সেঁকে নেয়। শরীরের খিল ছাড়ানোর পর শুরু হয় মনের কন্ডিশনিং। পর্বটা শুরু হয় সকাল সাতটা নাগাদ। তোমরা বাজারে চলে যাও চটপট, আমি চান করতে ঢুকব। টুয়া, কাগজটা নিয়েছিস নাকি? দে দেখি, পড়ে চানটা করে আসি। মা, তুমি তেলের কৌটোটা রোদ্দুরে বসিয়ে দাও গো, আমি যে চান করতে যাব। অ্যাই খুকু, তুই ওটা কী মাখছিস রে মুখে? দে শিগগিরি... ও বাবা, আমার তো চান করা বাকি। আমি তখন গুনতে শুরু করে দিয়েছি। ফিফটিন। ও বাসন্তী, কাল মাছের ঝালে বড় নুন হয়ে গিয়েছিল, আজ নামাবার সময় একটু চেখে নিও নিজে। আমি চানে ঢুকছি কিন্তু। থার্টি ফাইভ। খানিক ক্ষণ পর মাসি চমকাল। অ্যাই কী গুনছিস বল তো তখন থেকে? চানের দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার।

ফর্টি সিক্স।

শোন আমার ফোন এলে বলবি আমি চান করতে গিয়েছি-ই-ই (সুধা তাকে ভোলেনি-র স্বরতরঙ্গে) বলে, শেষে সত্যিই সাবান তোয়ালে হাতে বাথরুমে ঢুকল, তখন ঘড়িতে বারোটা বাজতে দশ। আমি চান করতে যাচ্ছি-র সেঞ্চুরি হতে মাত্তর দশ বাকি।

আমার দূর সম্পর্কের কাকা থাকতেন আমাদের বাড়ির বেশ কাছে। পেশায় শিক্ষক, সাবজেক্ট ও জীবন অঙ্ক, দিল্লি থেকে পাশ দিয়ে এসেছেন, ভালই নামডাক। ক্লাস নাইনে উঠতেই তাঁর কাছে সকালের ব্যাচে আমাকে ভরতি করে দেওয়া হল। নোংরা কুটকুটে ফতুয়া, ময়লা আঙুল, কপালঢাকা চিটচিটে চুল নিয়েই এই স্যর-কাকুকে জন্ম ইস্তক দেখেছি, সামনে বসে পড়ার সুবাদে আরও কাছ থেকে দেখবার সৌভাগ্য হল। এক দানে গোটা এক্সারসাইজ পারলে নাইন টু বিএসসি সক্কলকে টু-বি পেনসিল উপহার দেন, স্টুডেন্টরা চায়ে ডেঁয়ো পিপড়ে ফেলে দিলেও অম্লানবদনে খেয়ে নেন। তা, নভেম্বর পড়া মাত্র স্যরের টেবিল থেকে কম করে দু’হাত বেশি ফাঁক রাখত সকলে। কারণ, সকলেই জানত, তিনি মেরু-ফর্মুলায় চলেন। বলতে, ছ’মাস স্নান, ছ’মাস শুখা।

তবে রোশনির ধারণা ছিল অন্য। ও বলত, স্যর দিল্লি কি সর্দিতে থেকে অঙ্কের সঙ্গে চান করাও শিখে এসেছেন রে। এ থিয়োরেম কলকাতার লোকের তেল, সাবান, গরম জল ও গ্লিসারিনের আইডিয়ার সঙ্গে মিলবে না। কী রকম? ও বলেছিল, চার রকম আছে। একটা হল, ‘জলাঞ্জলি স্নান’। স্যর বাথরুমে গিয়ে, গরম জল হাতের তেলোয় নিয়ে মাথায় ছিটিয়ে, কাকিমার দেওয়া পরিষ্কার তোয়ালে দিয়ে মাথা ও মুখ মুছে নেবেন।

অন্য আর এক রকম হল, বালতিতে জল ভরবেন, তার পর মগে করে সেই জল বালতির চতুর্দিকে আহুতি দেবার মতো করে ঢালবেন। কিছুটা জল দেওয়ালেও ছুড়বেন। এত জলের আওয়াজ শুনে কাকিমা ভাববেন, স্যর শুধরে গেছেন। তার পর শূন্য বালতিকে করজোড়ে নমস্কার করে স্যর বেরিয়ে আসবেন।

এর পর আসছে ‘ঘ্রাণেন অর্ধস্নানম্’। এতে বাথরুম-মুখো হওয়ারই প্রয়োজন নেই। যে ব্যক্তি তেল জলে টইটম্বুর পূর্বক শ্যাম্পু আদি ঢালিয়া স্নান করিয়া ক্রিম, পাউডার, পারফিউমে ভূষিত হইয়া ফ্রেশনেসে ডগমগ করিতেছে, তাহাকে ধরিয়া বার কয়েক শুঁকিয়া লইলেই স্নানের অর্ধেক ফল লাভ করা যায়।

চতুর্থটা সাংঘাতিক! ডিসেম্বরে পৌষ কালী, জানুয়ারিতে সরস্বতী আর রোববারের ইতুপুজোর সকালে স্যর ব্রহ্মস্নান করেন। এতে কম্বলের ভেতরে ঢুকে, মাথায় হনুমান-টুপি চাপিয়ে, মোজায় পা ঘষতে ঘষতে মনে করতে হয়, মানস সরোবরের সদ্য সদ্য বরফগলা টলটলে জলে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। যখন পরম ভক্তি ভরে মনে মনে তিন ডুব দেওয়া যায়, দেবতারা সাধু সাধু বলে ওঠেন। শঙ্খ বাজে, ঘণ্টাধ্বনি হয়, মাথায় ফুলের বদলে খুশকি বৃষ্টি হয়। বরুণদেব এসে তিলকে-চন্দনে বরণ করেন। তাকেই সাদা চোখে দেখে গবেট লোকে ‘তোর গায়ে খড়ি ফুটেছে’ বলে দুয়ো দেয়।

আর এক জন দিল্লি-ফেরতকে দেখেছি শীতে কণামাত্র কাতর নয়, শুধু সকালে স্নানের নামে জগদ্দল পাথর। তাঁর স্নান-মাহাত্ম্য বর্ণনের আগে, তাঁর ঘড়ি সম্পর্কে দু-চার কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন। সেই ঘড়িতে দিন দুপুর দুটো নাগাদ শুরু হয়। শেষ হয় ভোর পাঁচটায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই মানুষটি সারা জীবনে এমন একটিও স্কুল-কলেজ-অফিস খুঁজে পাননি যারা এই আশ্চর্য ঘড়ির খোঁজ জানে। ফলে ডিগ্রি এবং পেটের দায়ে তাঁর জীবনটা কিঞ্চিৎ ঘণ্ট পাকিয়ে গেছে। তিনি প্রতি দিন ন’টায় ঘুম থেকে উঠে, ন’টা পনেরোর মধ্যে অফিসের জন্য বেরিয়ে যান। তাঁকে দেখে রাস্তার লোক হাঁ বুজতে পারে না। চুল উসকোখুসকো, চোখ টকটকে, গালে ঘাসের মতো দাড়ি লেগে (শেভ করেছেন, কাটা পড়া কুচো দাড়িদের মোছার সময় হয়নি)। তাড়াহুড়োয় জুতোর ফিতে আধবাঁধা ও মোজার মধ্যে প্যান্টের শেষভাগ গোঁজা, ফলে অফিস ড্রেস হয়ে গিয়েছে রাজ কপূরের আওয়ারা বেশ। কাঁধে অফিসের ব্যাগ, এক হাতে ইস্ত্রি করতে দেওয়ার জামাকাপড়ের ঝোলা, অন্য হাতে জ্যাম লাগানো পাঁউরুটি। এঁর বাড়িতে গেলে দেখা যাবে আলমারিতে থইথই করছে পঞ্চান্নটা নতুন শার্ট ও আঠেরোটা ঝকঝকে ট্রাউজার্স। কিন্তু ইনি সময়ের অভাবে প্রতি দিনই লন্ড্রি বাস্কেট থেকে আগের দিনের খুলে কাচতে দেওয়া জামা তুলে পরে নেন। বলা বাহুল্য, এই ব্যক্তিটির সকালে বাথরুমে ঢোকারই সময় হয় না। তাই বলে ইনি স্নান স্কিপ করেন, এমন কক্ষনও ভাববেন না। ইনি বাথরুমে ঢোকেন অফিস থেকে ফিরে, ডিনার করার পরে। যখন রাস্তায় বাস-ট্রাম কমে আসে, ঘরবাড়ির আলো নিভু নিভু হয়, লোকে ভাল করে লেপ-কম্বল জড়িয়ে বিছানায় সেঁধোতে শুরু করে ও দু-এক জন কুকুর ভুকভুক করে জাগা-মানুষদের ধমকাতে শুরু করে, তখন এঁর বাথরুমের আলো জ্বলে ওঠে। শীতের রাত এগারোটা এঁর মতে স্নান করার সর্বোৎকৃষ্ট সময়। বলেন, শীতের সকালে সময় বাঁচানোর এর থেকে ভাল রাস্তা আর হয় না। চান করে, বাথরুমের কাজ মিটিয়েই তক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়ো। উঠেই, জামা পরে যেখানে যাওয়ার নিশ্চিন্তে চলে যাও।

তবে শীতকালের টাইম ম্যানেজমেন্ট শেখা উচিত ছিল রিমঝিম ম্যামের কাছে। আমার কলেজে অনার্সের টিচার। এক ডিসেম্বরের ঘটনা। সে দিন এক ম্যাডামের বিয়ে। গোটা ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের নেমন্তন্ন। ছুটি ছুটি ভাব। আমরা ক্লাসে বসে সন্ধেয় কে কী সাজব, ভাবছি। এমন সময় আর-সি অর্থাৎ রিমঝিম চক্রবর্তী ম্যাম ক্লাসে ঢুকলেন। দেখি, তিনি কলপ করেছেন, তার পর মাথা না ধুয়েই ক্লাস নিতে চলে এসেছেন! হাসব কী, আমরা বাকরুদ্ধ। আমাদের রসগোল্লা মুখ-চোখ দেখে নিজেই বললেন, ‘বুড়ো হও, বুঝবে। এই শীতে চুলে রং করা কি কম ঝক্কি? এক বার চুলে শ্যাম্পু করো, তার পর শুকিয়ে চুলে রং করো, তাই আবার শুকোও, ধোও রে। ধুর ধুর। এই তো তোমাদের জেমস জয়েস পড়াতে পড়াতে আমার চুল শুকিয়ে যাবে। বাড়ি গিয়ে ধুয়ে নেব। ব্যস। এই গার্লস, প্লিজ গো টু পেজ নম্বর...’

এক জন তা-ও বলে ফেলল, ‘কিন্তু ম্যাম, এই মাথা নিয়ে আপনি বাস, অটো করে এত দূর কলেজে ক্লাস করাতে চলে এলেন?’ উনি বই থেকে চোখ তুলে বললেন, ‘অটো আর বাসের হাওয়ায় চুলটা কেমন মড়মড়ে হয়ে শুকিয়ে গেল দেখো দেখি। ন্যাচারাল ড্রায়ার। ইট সেভস ইয়োর টাইম, অ্যান্ড ইলেকট্রিসিটি।’

শীতের সঙ্গে আমার নিজেরও নাৎসি-ইহুদি সম্পর্ক। কলকাতার এই চুনোপুঁটি শীতও আমাকে তিন মাস ধরে প্রবল বক দেখায়। নভেম্বর আসতেই বেরিয়ে আসে জ্যাকেট, টুপি, মাফলার, মোজা, লেপ, বালাপোশ। সকালবেলায় ঈষদুষ্ণ গরম জলে আমলকীর রস, ভিটামিন সি ট্যাবলেট, আড়াই দাগ চ্যবনপ্রাশ। কিন্তু আসলি গ্যাসচেম্বারটা হল স্নানাগার। এ দিকে স্নান না করে থাকতেও পারব না। সেডিস্ট শীতও ছক কষতে থাকে। সে দিন গিজারের সুইচ জ্বালাতে গেলাম, ফটাসসে পাওয়ার কাট। আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করলাম। কিন্তু, জরুরি কাজ আছে, তায় তেল মেখে মাথা ধরে গেছে, আর বসে থাকা গেল না। ইষ্টনাম জপ করতে করতে, গঙ্গাসাগরে পুণ্যি করছি মনে করে, চুল ধুয়ে ফেললাম। ওমা! বাথরুম থেকে বেরনো মাত্র লাইট ফেরত! ইয়ার্কি? আর সেই এক বার শীতের লেজ রইল ভ্যালেন্টাইনস ডে পর্যন্ত। সে দিন অ্যাড দেখে কেনা নতুন শ্যাম্পুটা উদ্বোধন করলাম। কথা দিয়েছিল ‘গিফ্‌ট অব দ্য ম্যাজাই’-এর নায়িকার মতো জলপ্রপাত-চুল হবে। শুকোনোর পরে দেখলাম, মাথায় উইয়ের ঢিবি বসানো মনে হচ্ছে। এই নিয়ে ডেট-এ যাব? মাকে লুকিয়ে বিকেল চারটেয় আবার স্নান। সঙ্গে সঙ্গে ম্যাজিকের মতো ‘২৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, সানি ক্লিয়ার স্কাই’ ভোল পালটে ‘১৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, ক্লাউডি, চিলি উইন্ডস’। সন্ধেবেলা বয়ফ্রেন্ড ক্যান্ডললাইট ডিনার ছেড়ে উঠে ওষুধের দোকান খুঁজতে গেল। তত ক্ষণে আমি গোটা পঁচিশ হেঁচে পুরো রেস্তরাঁর সাউন্ডট্র্যাক বদলে দিয়েছি।

শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা আমার দিদা বরাবর দিনে তিন বার করে স্নান করে। একদম ছ্যাঁক-ঠান্ডা জলে। প্রথম বার ভোর পাঁচটায়। স্নান করে পুজো করে। তার পর বেলা হলে আর এক বার। শেষে ভাত খাওয়ার পর। তার পর ছাদে উঠে রোদে মাদুর পেতে বসে ক্রিম মাখে, কাগজ পড়ে। আশি পেরিয়েও দিদার স্বাস্থ্য টকটকে। তেমনি কর্মঠ, টগবগে। কিন্তু গত বছর খালি জ্বর। আমরা সবাই মিলে ধরলাম। বয়স তো হচ্ছে। রোজ স্নান আর নয়। ছাড়ান দাও এ বার। দিদা শুনবে না। শেষে ছোট্ট একটা হার্ট অ্যাটাক। তখন কালীপুজো। বর্ষা চলে যায়নি পুরোপুরি। অথচ শহরে শীত আসব আসব করছে। ডাক্তারও বিধান দিলেন। বাড়িতেই থাকুন। সাবধানে। আর, নতুন ঠান্ডা পড়ছে। আজ থেকে স্নান বন্ধ। গা স্পঞ্জ করিয়ে দিন বরং।

ব্যস। পর দিন সকালেই দিদা মরে গেল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

chirasree majumder winter
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE