Advertisement
E-Paper

দেশ বাধা হয়নি ভালবাসায়

চিরন্তন প্রেম সময়কে নিজের মধ্যে মিশিয়ে নেয় উপাদান হিসেবে। আর বুনে চলে অলৌকিক। সে অলৌকিক কারও কাছে রূপকথা, কারও কাছে বেদনার উপাখ্যান। একে অন্যকে চাওয়ার ও পাওয়ার ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি— চেয়েও না চাওয়ার, পেয়েও না পাওয়ার। 

শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০১৮ ০০:০২
প্রণয়ী: ‘দ্য প্রফেট’ (২০১৪) ছবির দৃশ্য।

প্রণয়ী: ‘দ্য প্রফেট’ (২০১৪) ছবির দৃশ্য।

মেরি এলিজ়াবেথ হাসকেল। খ্রিস্টান। লেবাননের ছেলে, দশ বছরের ছোট খলিল জিব্রানকে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন প্যারিসে। বিয়েতে বাঁধা পড়েননি, কিন্তু নিবিড় সম্পর্কে দুজনে জড়িয়ে ছিলেন আজীবন। সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়

চিরন্তন প্রেম সময়কে নিজের মধ্যে মিশিয়ে নেয় উপাদান হিসেবে। আর বুনে চলে অলৌকিক। সে অলৌকিক কারও কাছে রূপকথা, কারও কাছে বেদনার উপাখ্যান। একে অন্যকে চাওয়ার ও পাওয়ার ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি— চেয়েও না চাওয়ার, পেয়েও না পাওয়ার।

এমনই এক না-পূর্ণ-হওয়া, না-শূন্য-থাকা প্রেমের বাঁধন ছিল খলিল জিব্রান আর মেরি হাসকেল-এর। খলিল জিব্রান, কবি, শিল্পী, চিন্তক। তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘দ্য প্রফেট’ বিশ্ববন্দিত। ১৮৮৩ সালে উত্তর লেবাননে জন্ম। ১৮৯৫ সালে মায়ের সঙ্গে চলে যান আমেরিকা। থাকতে শুরু করেন দক্ষিণ বস্টনে। ১৯০৪ সালে নিজের ছবির এক প্রদর্শনীতে জিব্রানের দেখা হয় মেরি এলিজ়াবেথ হাসকেল-এর সঙ্গে। বয়সে জিব্রানের চেয়ে দশ বছরের বড় মেরি তখন একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। সম্পন্ন পরিবারের মেয়ে। আশ্চর্য এক সম্পর্ক গড়ে ওঠে মেরি আর জিব্রানের মধ্যে। বয়সের তফাত ভালবাসার পথে বাধা হয়নি, হবেই বা কেন। খলিল তখন উঠতি শিল্পী। তাঁর আঁকা অসামান্য ছবি দেখে মেরি খলিলকে পাঠিয়ে দেন প্যারিস, পেন্টিং নিয়ে পড়াশোনা করতে, শিল্প শিখতে। মাসে ৭৫ ডলার স্টাইপেন্ড দিয়ে। খলিল প্যারিস যাওয়ার আগে এক বন্ধুকে চিঠিতে মেরি হাসকেল সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘সে আমার কাছে দেবদূতের মতো এসেছে, আমার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল এবং আমার মননকে ঋদ্ধ করার জন্য এবং আমায় অর্থনৈতিক সাফল্যের দিকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য।’ কিন্তু প্যারিসে পৌঁছনোর কিছু দিন বাদেই তিনি লেখেন, ‘এক দিন আসবে যখন আমি বলতে পারব, আমি মেরি হাসকেল-এর মধ্যে দিয়ে এক জন শিল্পী হয়ে উঠেছি।’

কিন্তু হাসকেল-এর ঔদার্য কেবলমাত্র টাকাপয়সার সাহায্যেই সীমিত থাকেনি। সেই উদার মানুষটির মধ্যে মিশে ছিল একটা সহজ স্নিগ্ধতা, যা খলিলকে মুগ্ধ করেছিল। খলিলও তাঁকে নিছক এক জন সাহায্যকারিণী হিসেবে দেখেননি। কোথায় যেন মেরির সঙ্গে তিনি আত্মিক একটা যোগ অনুভব করতেন। মেরির মধ্যে ছিল আশ্চর্য এক সহমর্মিতা। খলিল অনুভব করেছিলেন, মেরি তাঁর আত্মার মধ্যে ডুব দিয়ে গভীরতম স্থানটি ছুঁতে পারেন, আবার স্পর্শ করতে পারেন তাঁর আত্মার শিখর। এবং খলিল মনে করতেন, ভালবাসা মাপতে গেলে এমন ভাবেই মাপা উচিত। এক দিকে মেরির ঔদার্যের কল্যাণেই তিনি শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন, অন্য দিকে মেরির সর্বস্ব দিয়ে ভালবাসার মধ্যে তিনি নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলেন এক জন সত্যিকারের মানুষ হিসেবে।

খলিল জিব্রানের তুলিতে মেরি এলিজ়াবেথ হাসকেল ও তাঁর আত্মপ্রতিকৃতি

খলিল এবং হাসকেলের দীর্ঘ প্রেম-জীবন ধরা রয়েছে বহু অমূল্য চিঠির মধ্যে। সেই চিঠিগুলি সংকলিত হয়েছে একটি গ্রন্থে— ‘বিলাভেড প্রফেট: দ্য লাভ লেটার্স অব খলিল জিব্রান অ্যান্ড মেরি হাসকেল, অ্যান্ড হার প্রাইভেট জার্নাল’। এই সব চিঠিপত্রের মধ্যে দিয়ে বোঝা যায়, একে অপরের সঙ্গে বন্ধনে আবদ্ধ না হয়েও, একে অপরের মধ্যেই উদ্ভাসিত হয়েছেন, প্রস্ফুটিত হয়েছেন দুটি মানুষ। যেন জীবনকেই আঁজলা আঁজলা করে তুলে নিয়ে তাঁদের প্রেমে ঢেলে দিয়েছেন।

এমনই একটি চিঠিতে খলিল ধরে রেখেছেন মেরিকে অদেখার বেদনা। ১৯০৮ থেকে ১৯১০ সাল প্যারিসে ছিলেন জিব্রান। তখনই সুদূর প্যারিস থেকে তিনি লিখছেন, ‘আমি যখন বিষণ্ণ থাকি, তখন তোমার দু-তিনটে চিঠি বের করে পড়ি মেরি। এরা আমার আসল সত্তাটার কথা মনে করিয়ে দেয়। জীবনে যা কিছু অসুন্দর, সে সব জিনিসকে গ্রাহ্য না করতে শেখায়। আমাদের প্রত্যেকের একটা বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা চাই। আমার সেই জায়গাটা হল, মনের ভেতর যেখানে তুমি বাস করো।’

সে বছরই (সম্ভবত ১৯০৮-১৯০৯ সাল) ক্রিসমাস-এ তিনি মেরি হাসকেলকে লিখছেন, ‘প্রিয় বন্ধু, যে ভাবে আজ আমি তোমার কথা ভাবছি সে ভাবে আর কারও কথা ভাবি না। তোমার কথা যখন ভাবি, আমার জীবন তখন আরও ভাল, আরও উন্নত, আরও সুন্দর হয়ে ওঠে। প্রিয় মেরি, আমি তোমার হাতে চুম্বন করি, আর সেই চুম্বনের মধ্যে দিয়ে নিজেকে ধন্য করি।’

এর পরের কয়েকটা বছরে মেরি এবং খলিলের প্রেম আরও গভীর হয়। ১৯১০ সালে মেরি তাঁর জন্মদিনের আগের দিন ডায়রিতে লিখছেন, ‘খলিল সন্ধেটা আমার কাছেই ছিল। বলল, আমায় ভালবাসে, সম্ভব হলে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু আমি বললাম, আমার বয়স এই বিয়েতে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। এবং সেই কারণে বিয়ের প্রশ্নই ওঠে না। ‘ও বলল, ‘‘মেরি, যখনই আমি তোমার সঙ্গে একটু অন্তরঙ্গ কথা বলতে চাই, কথার মধ্যে দিয়ে তোমার আর একটু কাছে যেতে চাই, তখনই তুমি যেন দূরবর্তী কোনও ভুবনে উড়ে যাও, ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাও।’’

‘আমি বললাম, ‘‘কিন্তু আমি তো তোমাকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাই।’’ এবং আমি ওকে বোঝালাম যে, আমি চাই আমাদের বন্ধুত্বটা স্থায়ী হোক, আমার ভয় করে পাছে একটা মামুলি প্রেম এসে একটি সুন্দর বন্ধুত্বকে নষ্ট করে দেয়! খলিল নিজের মনের কথা বুঝিয়ে বলার পরেই এই কথা ওকে বলেছিলাম আমি।

‘পরের দিন বিকেলে খলিল এখানে কিছুক্ষণ ছিল, আর তখনই আমি ওকে ‘হ্যাঁ’ বললাম।’

সেই বসন্তকালে (সম্ভবত ১৯১০ সাল) মেরি ও খলিল-এর সম্পর্ক চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছল। তাঁরা এক বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন যা ভাবাও প্রায় অসম্ভব ছিল। তাঁরা ঠিক করলেন, নিবিড়তম সম্পর্কে থাকবেন, কিন্তু বিয়ে করবেন না। কেন? হাসকেল তা বুঝিয়েছেন প্রায় কবিতার ভঙ্গিতে— ‘আমার মনে হল, সেই মুহূর্তে খলিলের সামনে একটা পৃথিবীর দরজা খুলে যাচ্ছে, যে পৃথিবী তাকে ভালবাসবে এবং যার অন্তরে সে নিজের সৃষ্টিকে অর্পণ করতে চাইবে। আমি মনে করি ওর ভবিষ্যৎ এখন আর দূরবর্তী নয়।’

‘মন স্থির করলাম, যা আমি ঈশ্বরের চূড়ান্ত নির্দেশ বলে মনে করি, তাকেই অনুসরণ করব— ওর স্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনাকে নিশ্চিত ভাবে নিজের সামনে রাখলাম।’ এবং মেরি সিদ্ধান্ত নিলেন, তাঁরা বিয়ে করবেন না। ‘তার পর থেকে যদিও প্রতিটি জাগ্রত মুহূর্তে আমি মনে মনে চোখের জলে ভিজেছি, তবু জানি আমি ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছি, আর ওই অশ্রু আনন্দের, বেদনার নয়, সে আনন্দ ভবিষ্যতের কথা ভেবে।’ এই সিদ্ধান্তের একটা আপাত-কারণ ছিল বয়সের এতটা ফারাক। কিন্তু মেরির আপত্তির আসল কারণ সেটা নয়, আসলে তিনি জানেন, ‘খলিলের জন্য অপেক্ষা করে আছে অন্য এক ভালবাসা, আমার প্রতি ওর যে প্রেম, তা থেকে সেই ভালবাসা স্বতন্ত্র। সেই ভালবাসা থেকেই উঠে আসবে ওর মহত্তম সৃষ্টি— ওর শ্রেষ্ঠ পরিতৃপ্তি, ওর নতুন, পরিপূর্ণ জীবন। এবং তা খুব দূরে নেই। সেই ভালবাসার মেয়েটির সন্ধানে আমি কেবল একটা পদক্ষেপ। আমার দুর্বল চোখ দুটি অশ্রুপাত করে বটে, কিন্তু আমি ওর সেই দয়িতার কথা ভেবে আনন্দিত হই— আমি খলিলকে অধিকার করতে চাই না, কারণ আমি জানি ওর মধ্যে কোথাও একটা সেই মেয়ে পূর্ণ হয়ে উঠছে, আর তারই জন্যে পূর্ণ হয়ে উঠছে ও নিজেও।’

কথাগুলো পড়ে মনে প্রশ্ন জাগে, নিজেকে সমর্পণের মধ্যেও তা হলে প্রেম থাকে!

পরের দিন হাসকেল তাঁর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন খলিলকে। বলেন, ‘‘আমার হৃদয় চাইছে খলিল-এর প্রেমে ডুব দিতে কিন্তু আমার মস্তিষ্ক চাইছে তাঁর প্রেমে প্রভাবিত না হতে।’’ তিনি লিখছেন, ‘ও কাঁদতে লাগল। আমি ওকে একটি রুমাল এগিয়ে দিলাম। ও কোনও কথা বলতে পারছিল না। কেবল, আমার কথার শুরুর দিকে বহু বিরতির একটির অবকাশে ও ভাঙা ভাঙা ভাবে বলেছিল, ‘‘মেরি, তুমি জানো, এ রকম অবস্থায় আমি কথা বলতে পারি না...’’ এবং তার পরে আর প্রায় একটা কথাও ও বলল না, শুধু জানাল ও আমাকে ভালবাসে। কথা শেষ হলে আমি ওর দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দিলাম, কিন্তু অচিরেই ওর দুই বাহুর মধ্যে আমি হারিয়ে গেলাম... অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পরে ওর ডান হাতের তালুটিকে আমার ঠোঁটে ছোঁয়ালাম, আর তখনই দু’চোখ ভেঙে কান্না এল, সেই কান্না আমাকে ওর আরও কাছে নিয়ে গেল।... দরজার কাছে পৌঁছে আমি আবার একটু কাঁদলাম, ও আমার চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে কেবল বলতে লাগল, ‘‘মেরি, মেরি, মেরি...’’ চলে যেতে যেতে ও বলল, ‘‘তুমি আজ আমাকে একটা নতুন হৃদয় দিয়েছ।’’

আমরা অনেক সময় নিঃস্বার্থ প্রেম বা ভালবাসার কথা কেবল মুখে বলি, কিন্তু দৈনন্দিন, ওঠা-পড়ার ভালবাসার সম্পর্কে সেটা অধিকারবোধের একটা প্রসার মাত্র। কিন্তু খলিল জিব্রান এবং মেরি হাসকেলের প্রেমের সম্পর্ক ছিল আশ্চর্য শান্ত দিঘির মতো। নিস্তরঙ্গ, গভীর। উথালপাথাল হওয়ার পর ফের শান্ত। সেই সম্পর্কে স্থিতি ছিল। এবং ছিল একটা উত্তরণ। যে সম্পর্ক দুটো মানুষকে বেঁধে রাখেনি, মুক্ত করেছিল। সেই মুক্তিই তৈরি করেছিল দুজনের স্ব-স্ব চরিত্র। যে চরিত্রে কোনও বন্ধনের ছাপ নেই। যে চরিত্র নিজে নিজেই গড়ে উঠেছিল। এবং তাই সেই চরিত্রে একটি সম্পূর্ণ মানুষকে পাওয়া গিয়েছিল।

মেরি হাসকেল কিন্তু বিয়ে করেছিলেন আর এক জনকে। খলিল জিব্রানের জীবনেও এসেছেন বহু নারী। তাঁদের সঙ্গে নিয়মিত সম্পর্ক ছিল খলিলের। কিন্তু মেরির সঙ্গে এই চিরন্তন প্রেম ছিল এক অন্য স্তরের। যেখানে কেবল খলিল আর মেরিই পৌঁছতে পারতেন। পরস্পরের সান্নিধ্য এবং দূরত্বকে নিজেদের মতো যাপন করতে পারতেন তাঁরা, তুলে রাখতে, ধুয়ে-মুছে চকচকে করে নিতে পারতেন। দুজনের প্রেম যেন বাস্তব জীবনের সঙ্গে একটা সরলরেখায় চলত। দুটো জীবন একসঙ্গে আবার একত্রে নয়ও, একটা জীবন আর একটাকে স্পর্শ করতে পারে না। সেই প্রেম-জীবন কেবল তাঁরা দুজনেই ছুঁতে পেরেছেন, সবার ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে।

জালালউদ্দিন রুমি থেকে হাফিজ়, নিজ়ামি, বেশির ভাগ ফারসি কবিই তাঁদের কাহিনিতে অনিন্দ্যসুন্দর এক নারীকে নিয়ে আসেন, সেই নারীই পবিত্র অন্তরাত্মা! ‘আলামাত-ই-পাকিজগি’ বা পবিত্রতার চিহ্ন। খলিল জিব্রান ইংরেজিতে ‘দ্য প্রফেট’ লিখলেও সেই ঐতিহ্যেরই উত্তরসূরি।

The Prophet Khalil Gibran
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy