Advertisement
২৪ মার্চ ২০২৩

নাচের ছন্দে ভাঙে কারার লৌহকপাট

এ কেবল নাচ নয়, ভালবাসার মন্ত্রে দীক্ষা। এখানকার কারাবন্দিদের উত্তরণের গল্প শুনল আমেরিকা। পেল জীবনের মূলস্রোতে ফিরে আসার প্রেরণা। ঋজু বসু নাচ-নাটকের তালিমের সূত্রে বাঁধা পড়লেও দায়িত্ব ও সম্পর্কটার ব্যাপ্তি তাই আরও ছড়িয়ে পড়ে। আঠাশ বছর ধরে বন্দি অসীম গিরি, মৃত্যুপথযাত্রী মুর্শিদা বা চোদ্দো বছর পার করা আরও অনেকে কেন মুক্তি পাবেন না— সেই দুশ্চিন্তা তাড়া করে অলকানন্দাকে।

শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০১
Share: Save:

Through tatter'd clothes, small vices do appear; Robes and furr'd gowns hide all. (King Lear, Act 4, Sc 6)

Advertisement

কিছু কথা বড় সহজে বলা যায়। কিন্তু বুঝতে সময় লাগে অনেক। শেক্সপিয়রের ‘কিং লিয়ার’ নাটকের উদ্ধৃত সংলাপটি যেমন। ছেঁড়াখোঁড়া পোশাকের ফাঁকে যা চোখে পড়ে, তা আদতে খুব বড় অপরাধ নয়। বরং অভিজাত জোব্বা-উর্দির আড়ালে বহু স্খলন-পতন লুকিয়ে থাকে। রাজ্যপাট থাকাকালীন খোদ রাজা লিয়ার অবধি এই সত্যের আলো দেখতে পারেননি। যখন দেখলেন, তখন তিনি সর্বহারা। আপাত-উন্মাদ। কাছের মানুষ, সম্পদ, সুরক্ষা হারিয়ে জীবনের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছেন। জেলখানার জগৎটাও কারও কারও কাছে এমনই চোখ খোলার আকাশ। প্রাত্যহিকতার আলোয় যা সহজে দেখা যায় না, কারান্তরালের বদ্ধ পরিসরের আবছায়া সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

ঘরের কাছের নরেন্দ্র সিংহ বা সাগর পারের ড্যামিয়ন ব্রাউনদের মুখ ভাবলে এখন সেটাই মনে হয় অলকানন্দা রায়ের। ‘‘বড় বড় দোষ করেও কত লোক বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু জেলখানায় একবার ঢুকলে কলঙ্কের তকমটা জীবনভর বইতে হবে!’’ বাইরের বহু নিষ্কলঙ্ক মানুষের সঙ্গে তাঁর ছেলে বা মেয়ে, সেই নাইজেল, নরেন্দ্র, লক্ষ্মী, মুরশিদা, জগৎ, শুভাশিসদের ফারাক নেই, ছিল না! এখন জীবন দেখেই সেটা জানেন বর্ষীয়ান নৃত্যশিল্পী।

Advertisement

সেই কবে কারাগারে বন্দিদের জীবনে আলো ফেরাতে নাচ-গান-নাটক-আবৃত্তি-রংতুলি আঁকড়ে ধরার কথা ভাবলেন পশ্চিমবঙ্গের আইজি বংশীধর শর্মা। আর জেলের ভেতরের ছবিটা পাল্টে গেল। তাঁর সেই তাগিদের সূত্র ধরেই এক নারী দিবসের দুপুরে প্রথম প্রেসিডেন্সি জেল-চত্বরে পা রাখা অলকানন্দার। পরের গল্প ইতিহাস! জেলখানাকে এখন তাঁর ‘সেকেন্ড হোম’ বলেন তিনি। আর আলিপুর, প্রেসিডেন্সি, মেদিনীপুর বা দমদমের সংশোধনাগার থেকে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে গিয়েছেন কিংবা এখনও মুক্তির দিন গুনছেন, এমন অজস্র বন্দির কাছে অলকানন্দা মানে ‘মা’। জেলবন্দিদের জন্য সংস্কৃতি-চর্চার দাওয়াই বা কালচারাল থেরাপি হল এক ধরনের ‘ভালবাসার গল্প’!

আমেরিকার সান দিয়েগো শহরে তখন দুপুর গড়াচ্ছে। গ্লোব থিয়েটারে এই বাংলার সংশোধনাগারগুলিতে ‘লাভ থেরাপি’ বা ‘ভালবাসার মলম’-এর গল্প বলছিলেন অলকানন্দা। নাচে-গানে-অভিনয়ে হারানো আত্মসম্মানবোধ ফিরে পাওয়া বন্দিরা ট্রেনে চেপে শো করতে যাচ্ছেন দূরের শহরে। বিডি শর্মা বলেছিলেন, ওঁদের মানুষের সম্মান দিতে। বন্দিদের উপরে বিশ্বাস না-হারাতে! সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা তাই টুরিস্ট বাসে বা মুক্ত নাগরিকদের কামরায় ট্রেন সফর করছেন। নিজেদের মতো করে ঘুরছেন, দেখছেন, গান গাইতে গাইতে চলেছেন। দেশের তাবড় মন্ত্রীর নৈশভোজে খাতির পাচ্ছেন। এটাই মূল স্রোতের সঙ্গে সেতুবন্ধন! ‘মা’ অলকানন্দা বলছিলেন, ‘‘আমার এই ছেলেমেয়েদের থেকে আমিও ডিসিপ্লিন শিখেছি! মুম্বই, পুণে, দিল্লি, ভুবনেশ্বরের রাস্তায় ওরাও বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষা করেছে অক্ষরে অক্ষরে।’’

শুনতে শুনতে সভাকক্ষে স্যামি, ড্যামিয়ন, জনি স্টালিংদের তখন চোখে জল। এমনও হতে পারে! ওঁরা তিন জনেই মার্কিন মুলুকের জেলের মানবিক প্রকল্প ‘শেক্সপিয়র ইন জেল্স’-এর সঙ্গে জড়িয়ে। উদ্যোগটি বহু পুরনো। কিন্তু কলকাতার মতো বন্দিদের নাটক জেল-চত্বরের বাইরে সাধারণের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার স্পর্ধা দেখাতে পারেনি আমেরিকা। এই ‘কারাগারে শেক্সপিয়র’-প্রকল্পের তৃতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন উপলক্ষেই কলকাতা থেকে ডাক পেয়েছিলেন অলকানন্দা। তাঁর ছোট্ট উপস্থাপনা শেষে, কারাগারের অপরাধীদের নিয়ে শেক্সপিয়ারের নাট্য প্রযোজনায় অভিজ্ঞ পরিচালক স্টালিং এগিয়ে এলেন। দু’চোখে জল টলটল।

ছন্দময়: আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেসে ‘ওয়াল্ডেন হাউস’-এর বন্দিদের নিয়ে নাচের কর্মশালায় অলকানন্দা রায়

দীর্ঘদেহী, কৃষ্ণাঙ্গ স্যামি ও ড্যামিয়নের মাঝে দাঁড়িয়ে তখন বাঙালি নৃত্যশিল্পী। ৩১ বছরের কারাবাসের পরে ২০১৪-য় মার্কিন কারাগার থেকে প্যারোলে বেরোন স্যামি। জেলের শেক্সপিয়র প্রযোজনার প্রথম বছর থেকেই একাত্ম কুশীলব তিনি। স্যামি জেলে ঢুকেছিলেন তাঁর ‘রক্ষিতা’কে খুন করে। ডেসডিমোনার হন্তারক ওথেলোর জীবনের সঙ্গে অনেক কিছুই মিলে যায় তাঁর জীবনের। মঞ্চে ওথেলোর ভূমিকায় নিজেকে মেলে ধরার পরে স্যামির বুকের ভেতর থেকে একটা গ্লানির পাহাড়ের ভার নেমে আসে। ঠিক যেমন ‘বাল্মীকি’ নাইজেল-নরেন্দ্রদের ‘পাষাণ-হৃদয়’ এক দিন গলতে শুরু করেছিল কলকাতায়, রবীন্দ্র-নৃত্যনাট্যের সোনার কাঠির স্পর্শে। ‘মাম্মা রয়’ বলে নরেন্দ্রদের ‘মা’কে জড়িয়ে ধরলেন স্যামি-ড্যামিয়নরা। সুপুরুষ ড্যামিয়নও স্যামির পরের প্রজন্মের ‘ওথেলো’। অলকানন্দার মনে হচ্ছিল, কলকাতায় তাঁর ছেলেমেয়েদের নিয়ে ‘ধ্রুবজ্যোতি তুমি জিশু’তে দারুণ মানাত ড্যামিয়নকে। নাইজেলের পরে নরেন্দ্রও বেকসুর মুক্তি পেয়ে বাড়ি ফিরেছেন। জিশুর পার্টটায় মানানসই ছেলের এখন বড়ই অভাব।

রামপ্রসাদের গানের ‘এমন মানব-জমিন রইল পতিত, আবাদ করলে ফলত সোনা’র মর্মার্থ এখনও হাড়ে-হাড়ে টের পাওয়া যাবে আমাদের দেশের কারাগার দেখলে। অথচ গাঁধী কবেই বলেছিলেন, বন্দিদের অসুস্থ রোগী হিসেবে ভাবতে। কারাগার হবে তাঁদের আরোগ্যভবন। স্রেফ সাজা আর ঘৃণার বদলায় এই সমাজের অপরাধমনস্কতা পাল্টাতে পারে না! অলকানন্দার কাছে এই বোধ জন্ম নিয়েছে বন্দিদের সঙ্গে যাপনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে। তখন পুরোদমে চলছে নাচের ক্লাস। সচরাচর কে কেন জেলে এসেছে, সে-সব পুরনো কাসুন্দি না-ঘাঁটারই পক্ষপাতী ছিলেন অলকানন্দা। তবু কোথা থেকে উড়ে এল খবরটা, ওই ছেলেটা রেপ কেসে এসেছে।

বিডি শর্মার কাছে নিজেই ছেলে-মেয়ে সব বন্দিকে নাচ শেখানোর আর্জি জানিয়েছিলেন অলকানন্দা। কিন্তু ধর্ষণে অভিযুক্তকে স্বচক্ষে দেখে ভেতরটা কেমন গুলিয়ে উঠল। হঠাৎ ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, ‘‘কী করে পারলে এ সব করতে? এক বারও নিজেকে মানুষ বলে মনে হল না!’’ সেই এক বারই তাল কেটেছিল নাচের ছন্দে। অভিযুক্ত পরে বললেন, আর আমার সঙ্গে কী হয়েছে, সে-খবর কি কেউ কখনও নিতে চেয়েছে? অলকানন্দা বলেন, ‘‘তার পর থেকেই মনে হয়, কার কী ইতিহাস, ছোটবেলার নির্মাণ যখন জানি না, তখন কাউকে দূরে ঠেলারও অধিকার আমার নেই!’’

কয়েক মাস আগে অলকানন্দা আমেরিকা থেকে ফেরার পরই জানাজানি হয় কাঠুয়ার বালিকা ধর্ষণের ঘটনা। সদ্য তরুণ কয়েকটি ছেলের চরম নৃশংসতার এই ঘটনার পরেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন, সরকারি হোমের নাবালক অপরাধীদের জন্য কিছু করতে হবে। সামনে গোটা জীবন পড়ে থাকা এই কিশোরদের বিপথে ছিটকে যাওয়া রুখতে এটাই পন্থা! অলকানন্দার চোখে, অপরাধী বা আসামি এখন সে, যার জীবনের ছন্দ কোনও ভাবে টালমাটাল হয়েছে। নাচের শৃঙ্খলা, ছন্দের তালে তাকে ফের সমে ফেরাতে হবে! ২০০৫-এ প্রথম বার জেলের দায়িত্বে আসার পরে বিডি শর্মারও এটাই ধ্যানজ্ঞান ছিল।

তত দিনে খাতায়-কলমে দেশের জেল গালভরা ‘সংশোধানাগার’ হয়েছে। কিন্তু কয়েদিদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা হিসেবে ব্রিটিশ আমলের ঢঙে ক্রীতদাসের মতো খাটানো পুরোটা বন্ধ হয়নি। মানসিক রোগ বা আত্মহননের প্রবণতার শিকার বহু বন্দিই। নতুন কারা আইনে বলা হয়েছে, পুনর্বাসনের লক্ষে বন্দিদের গঠনমূলক কাজ শেখানো রাষ্ট্রের দায়িত্ব, আর কাজ শেখার সুযোগ পাওয়াটা বন্দিদের অধিকার। বাস্তবে বৃত্তিমূলক কর্মশিক্ষা তখনও সুতোকলের মজুরগিরি, মোমবাতি-ফিনাইল তৈরি করা বা স্রেফ রান্নাবান্না, জেল ঝাড়পোঁছের মতো কায়িক শ্রমের গোত্রভুক্ত। অথচ গিয়াসুদ্দিনের মামলায় সুপ্রিম কোর্টও কবেই বলেছিল, বন্দিদের একঘেয়ে তালিমে বদল এনে সৃষ্টিশীল বৌদ্ধিক চর্চায় এ বার জোর দেওয়া হোক। বিডি শর্মা প্রথমে বহরমপুরের নাট্যব্যক্তিত্ব প্রদীপ ভট্টাচার্যকে দিয়ে সেই কাজটাই শুরু করলেন। ২০০৭ এর মে মাসে দর্শকে ঠাসা রবীন্দ্রসদনে বন্দিদের ‘তাসের দেশ’ দেখলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। অলকানন্দার ক্লাসও তত দিনে চলছে কলকাতার সংশোধনাগারে। বন্দিদের সৃষ্টিশীলতা তথা উত্তরণের আখ্যানটিও পূর্ণতার পথে এগোল।

গোটা দেশের লোকায়ত নৃত্য ঘরানার মিশেলে ‘ব্রাদারহুড বিয়ন্ড বাউন্ডারিজ়’, ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’, অশোকের রূপান্তরের কাহিনি ‘মোক্ষগতি’, নজরুল অবলম্বনে ‘গাহি সাম্যের গান’ বা জিশুর জীবনের মতো এক-একটি ভাবনা পরপর রূপ পেয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মঞ্চে। আমেরিকায় গিয়ে পুরো গল্পটাই এ বার শুনিয়েছেন অলকানন্দা! ‘‘নিজের হাতে কস্টিউম তৈরি থেকে ব্যাকস্টেজ সামলানো, সব ওরা করেছে। প্রতিটা কাজে এমন গোছগাছ— আমার জেলের আর্টিস্টদের মতো আর দেখিনি।’’ ভিন শহরে কোথাও ঘুরতে গেলে, আধ ঘণ্টার জন্য বেড়িয়ে আসার অনুমতি দেওয়া হলে সেটা আধ ঘণ্টাই। শহুরে ট্র্যাফিকে সড়গড় নন, বন্দিরা চার-পাঁচ জন মিলে রাস্তা পেরোচ্ছেন হাত ধরাধরি করে— ছবিটা পরম আদরে লেগে থাকে অলকানন্দার চোখে। ২০১০-এ ভুবনেশ্বরে কারাকর্মীদের সর্বভারতীয় মিটে পশ্চিমবঙ্গের বন্দিদের অনুষ্ঠান তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। বন্দি-শিল্পীরা বাহবা কুড়িয়ে সাধারণ টুরিস্টদের কোচে কোনার্কের মন্দির দেখতে গিয়েছেন। পরপর অভিনয়ে বন্দিদের কল্যাণ তহবিলেও কোটি টাকার উপরে জমা হয়েছে অচিরেই।

আমেরিকার জেল বন্দিদের চেতনার মুক্তির আশায় শেক্সপিয়রকে আঁকড়ে ধরেছিল। অলকানন্দার এক-একটি প্রোডাকশনের থিম ভেবেচিন্তেই ঠিক করা। বাল্মীকি, অশোক, বুদ্ধ, জিশুর গল্পগুলোর মধ্যে অহিংসা, শান্তি, ক্ষমা, দয়া, সহিষ্ণুতার বোধ চারিয়ে দেওয়াও লক্ষ্য ছিল। তবে সব থেকে কাজে এসেছে মানুষের মতো সম্মান আর ভালবাসার ছোঁয়াটুকু! নাটকের গুরুগম্ভীর মুডে কারও স্বাভাবিকতাটুকু ক্ষুণ্ণ হয়নি। অলকানন্দা হাসতে হাসতে শোনান, তাঁর ‘দুষ্টু ছেলে’ কৃষ্ণ সাউয়ের গল্প। জিশুর অভিনয়ের সময়ে ক্রুশবরণের দৃশ্যে ভয়ানক অত্যাচারে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কৃষ্ণের বেজায় আপত্তি। শেষে বলেই ফেললেন, ‘‘দেখো মা, জিশুর মতো এত মার কিন্তু সহ্য করতে পারব না। অত মারলে একটু হাত চালিয়ে দেব, কিছু মনে কোরো না প্লিজ়!’’

এখনও মা বলতে অজ্ঞান বহু ছেলেমেয়েই। যাঁরা ছাড়া পেয়েছেন, তাঁরা এখনও মায়ের বাড়ি হাজির হন মাঝেমধ্যে। সঙ্গে নিয়ে আসেন খেতের নতুন আলু, পুকুরের মাছ। দশ বছরে তাঁর নাতি-নাতনির প্রাপ্তিযোগও কম নয়। যাঁরা ছাড়া পাননি তাঁদের কারও ছোট্ট ছেলে হয়তো ফোন করল, ‘‘দিদুন তুমি একটু বলে দাও না, আমার মা অসুস্থ, বাবাকে ক’টা দিন প্যারোলে ছাড়বে তো ওরা!’’ মা বা দিদুন হওয়ার দায় বড়ই বিচিত্র! এখন বন্দি মায়েদের সঙ্গে থাকা ছেলেমেয়েদের নিয়ে জেলে ‘হার্টপ্রিন্ট’ বলে স্কুল চালাচ্ছেন অলকানন্দা। আগে নরেন্দ্রপুরের কাছে কিছু দিন চেষ্টা করেছিলেন একটা হোমে বাচ্চাদের রাখার। সেখানে নাতি-নাতনিদের সঙ্গে দেখা করার আগে ঠোঁটে গাঢ় প্রলেপে চাপ-চাপ লিপস্টিক মাখতে হত ‘দিদুন’কে। সবার একটাই আবদার, গালে চুমুর দাগটা ঠিকঠাক পোক্ত হওয়া চাই।

নাচ-নাটকের তালিমের সূত্রে বাঁধা পড়লেও দায়িত্ব ও সম্পর্কটার ব্যাপ্তি তাই আরও ছড়িয়ে পড়ে। আঠাশ বছর ধরে বন্দি অসীম গিরি, মৃত্যুপথযাত্রী মুর্শিদা বা চোদ্দো বছর পার করা আরও অনেকে কেন মুক্তি পাবেন না— সেই দুশ্চিন্তা তাড়া করে অলকানন্দাকে। বুঝতে অসুবিধে হয় না, মুক্তির বছর দু’তিন বাদেও ‘বাল্মীকী-প্রতিভা’র প্রথম দস্যু জগৎ সরকার বা পরবর্তীকালের বাল্মীকী-জিশু নরেন্দ্র সিংহ কেন এখনও এমন মা-ন্যাওটা। অধুনা ফল-ব্যবসায়ী নরেন্দ্র এখন হরিয়ানাবাসী। ফোনে বাংলা ছাড়া কিছু বলবেনই না। বলেন, ‘‘আমায় তিন বছর ধরে বেঙ্গলি শেখাতে মা যা কষ্ট করেছেন, বলে বোঝাতে পারব না! আবার জন্মালে আমি অলকানন্দা রায়ের ছেলে হয়েই জন্মাতে চাই!’’

আমেরিকায় সান দিয়েগোর পরে লস অ্যাঞ্জেলেসের ওয়ালডেন হাউস-এও বন্দিদের ‘অ্যাক্টর্স গ্যাং’-এর সঙ্গে ভাব জমিয়ে এসেছেন অলকানন্দা। ছোট্ট ভিডিয়োয় বন্দিদের নিয়ে দু’টি নাচের অনুশীলনে আনন্দ চারিয়ে যাচ্ছে তাঁদের মধ্যেও। প্রথমে একটি সুফি গান, তার পরে ‘টাইটানিক’ ছবির ‘মাই হার্ট উইল গো অন’-এর তালে তালে বন্দিদের নাচ শিখিয়েছেন তিনি। সেখানেও তিনি ‘মাম্মা রয়’! জেলের কর্তা জেরেমির মাধ্যমে এই সে দিনও ভিডিয়োয় শুভেচ্ছা পাঠিয়েছেন আমেরিকান বন্দিরা। ড্যামিয়ন মুখিয়ে আছেন ‘ইন্ডিয়া’য় মাম্মা রয়ের সঙ্গে কিছু কাজ করার জন্য। আর অলকানন্দার এখন ইচ্ছে, ওথেলোর অনুতাপের দৃশ্য-সহ এ বার একটু শেক্সপিয়র করাবেন তাঁর কলকাতার ছেলেমেয়েদের দিয়ে।

এই অনন্ত মায়ার সংসারে জড়িয়ে পড়াটাও মাঝেমধ্যে ভাবনার কারণ বটে। বৃহত্তর পরিবারের কেউ না কেউ আকছার ফোন করছে বা সশরীর হাজির হচ্ছেই। নাচ ও ভালবাসার ছোঁয়ায় প্রান্তিক জীবন বদলানোর কাজটা হোমের নাবালক অপরাধী থেকে রূপান্তরকামী মেয়েদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিয়েছেন অলকানন্দা। যে কোনও ঘা-খাওয়া মানুষের জন্য এটাই ওষুধ। কারণ অলকানন্দার মতে, ‘‘নাচ জীবনের ছন্দটা জাগিয়ে তুলে মনের বিটারনেস দূর করে।’’ আর ভাল থাকার মন্ত্রটা একবার শেখার মধ্যেই হতাশা-রাগেরও মৃত্যু। নরেন্দ্র বলেন, ‘‘এখন আর নাচ-গান করার সুযোগ পাই না। তবে মায়ের কাছে যা শিখেছি, তাতে আমার রাগটা পুরো সাফ হয়ে গিয়েছে।’’

কিন্তু অলকানন্দা জানেন, বন্দির জীবন অত সহজ নয়। মুক্তির পরেও সমাজে পরিবারে স্বীকৃতি পেতে পদে পদে ঠোক্কর খেতে হয়। সান দিয়েগোয় স্যামি বায়রনের স্ত্রীও অলকানন্দাকে বলছিলেন, ‘‘আমাদের ছেলে এখনও তার বাবাকে ক্ষমা করতে পারেনি। আপনার কথা শুনলে হয়তো পারত!’’ দেশ-মহাদেশের বেড়া ভেঙে মানুষের বিপন্নতার চেহারাটা কোথাও এক হয়ে যায়। এক বার অপরাধী তকমা লেগে গেলেই জেলের ভিতরে বা বাইরে নিজের সঙ্গে, কাছের লোক বা সমাজের সঙ্গে লড়াইটাও চলে নিরন্তর।

পশ্চিমবঙ্গের সংশোধনাগারে কয়েদিদের নানা সৃষ্টিশীল কাজ কিছু প্রশাসনিক টানাপড়েনে এখন খানিকটা থমকে। কারাগারে নতুন বন্দিদের আনাগোনাও অটুট। আমেরিকায় কলকাতার জেল নিয়ে প্রশংসার আবহেও পুরনো কাজের সৌধটাকে বাঁচিয়ে রাখা তাই চ্যালেঞ্জ। মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর দায়টাই শেষ কথা বলে যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.