Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Universal News

ফ্লার্টিংয়ের অপমৃত্যু

ঘাতক: ‘মিটু’ আন্দোলন। চলচ্চিত্র থেকে শিক্ষাঙ্গন, কর্পোরেট দুনিয়া সবাই জেরবার। এই ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ দুনিয়ায় নারী-পুরুষের মিঠেকড়া রঙ্গরসিকতা হারিয়ে যাচ্ছে না তো? ঘাতক: ‘মিটু’ আন্দোলন। চলচ্চিত্র থেকে শিক্ষাঙ্গন, কর্পোরেট দুনিয়া সবাই জেরবার। এই ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ দুনিয়ায় নারী-পুরুষের মিঠেকড়া রঙ্গরসিকতা হারিয়ে যাচ্ছে না তো?

ছবি: কুনাল বর্মণ

ছবি: কুনাল বর্মণ

ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

ঘড়া আর দিঘির জলের ফারাক চলত সেই রবি ঠাকুরের আমলে। এ কালে অত সহজে নিষ্কৃতি নেই। লাবণ্য আর কেতকীর মধ্যে টানাপড়েনে শেষে মোক্ষম সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শ্রী অমিত রায়। কেতকীর সঙ্গে ভালবাসা নাকি ঘড়ায় তোলা জল। রোজ ব্যবহার করার। আর লাবণ্য দিঘি। ঘরে আনার নয়। শুধু মন তাতে সাঁতার দেবে।

গত কয়েক মাসে দুনিয়া জুড়ে ‘মিটু’ আন্দোলনের ধাক্কায় সেই দিঘি উপচে ঘরে ঢোকার উপক্রম। এত দিন হাতের স্মার্টফোন যন্ত্রটির ভিতর-ঘরে হোয়াট্‌সঅ্যাপ-মেসেঞ্জারের কুঠুরিতেও মোটামুটি নিরাপদ ছিল তার টলটলে উপস্থিতি। সেই একান্ত পরিসরটুকু অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের নায়কের মানস-সাঁতারের মতো নিরামিষ নয়। সত্যি-মিথ্যে কথার কিংশুকে সামাজিক অনুশাসন-ভাঙা কিছু স্পর্ধা, উল্লাস, কামনার ফুলকিও তাতে মিশে আছে। মিটু-র সুনামির তোড়ে আচমকাই সেই কমলবন মত্ত হস্তীর দাপটে ছারখার হতে বসেছে।

হলিউডি প্রযোজক হার্ভে উইনস্টাইনের গোপন কর্মের খবর পর পর প্রকাশিত হতেই গোলযোগ। ‘আমিও অপমানিতা’ জানিয়ে রোজই #মিটু বা #আমিও বলে মুখ খুলছেন নামী-অনামী কোনও নারী। অপকীর্তির প্রমাণ সব সময়ে মেলেনি। তবে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতিবাদী স্বরে খান-খান সম্মান, আদর, ভালবাসায় মোড়া নায়কপ্রতিম সব বিগ্রহ।

ছাপোষা গেরস্ত জীবনে একটু মরূদ্যান-সন্ধানী বন্ধুটিরও দেখছি জীবন রাতারাতি আলুনি। সাহেবদের কেচ্ছার খবর ফাঁস হতেই কলকাতার বাঙালির খুচরো প্রেমের সুখটুকুরও দফারফা! ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলেন, ‘‘একটু ফ্লার্টই তো করতুম বল! ফ্রেন্ড লিস্টের মিশুকে উচ্ছল মেয়েটির পিঠখোলা জামার ছবিটায় ‘লাভ’ দিয়েছি কখনও। তার পরে ইনবক্সে লিখলুম, এই তো ‘পিঠস্থান’! জবাবে মেয়েটিও হয়তো ইমোজি মারফত চোখ মেরেছে।’’ ইদানীং এটুকুতেও টেনশন, ভয়। কখন কোথায় কেস খাই!

‘কেস খাওয়া’র লিস্টি হলিউডি তারকাতেই শেষ নয়! নোবেলের সাহিত্য পুরস্কারের নির্ণায়ক সুইডিশ অ্যাকাডেমি অবধি জনৈক সদস্যার প্রভাবশালী স্বামীর কেচ্ছায় বেসামাল। ডামাডোলে এ বারের পুরস্কারটাই গেল ভেস্তে। পত্রপত্রিকায় নির্যাতিতাদের গোপন কথা মেলে ধরা ‘স্টোরি’ সত্যকে বেআব্রু করে পুলিৎজার পুরস্কার ছিনিয়ে নিয়েছে। শিক্ষিত বাঙালির গর্বের সারস্বত সমাজের নক্ষত্রদের নিয়েও বিতর্ক সরগরম। আমাদের কাছেপিঠের শিক্ষাঙ্গন থেকে কান চলচ্চিত্র উৎসবের রেড কার্পেট অবধি প্রতিবাদে উত্তাল!

এত দিন কানের আসরও ছিল ‘মিটু’-র খলনায়ক উইনস্টাইনের লীলাভূমি! তাই কার্যত গলায় গামছা দিয়ে ক্ষমা চাইছেন সংগঠকেরা। গ্ল্যামারের মহাভোজেও বিপদের আশঙ্কায় তাল কাটছে সাবধানতার গুমোট। ফ্রান্সের তরুণী মন্ত্রী মার্ল্যান শিয়াপ্পা অবশ্য বুঝিয়েছেন, ‘‘সিনেমা হল কামনার সৌধ। প্রযোজক-পরিচালক-অভিনেতা-দর্শকদের কামনার ককটেলে ক্ষমতা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, টাকার ছোঁয়াচ! তাই কিছু বাড়াবাড়ি ঘটেই।’’ উৎসব বা কার্নিভ্যালের ফুরসতেও তো সমাজের বেড়া-ভাঙা বল্গাহীন কামনারই প্রকাশ। ক্ষমতার জোরে নারীলোলুপতা আর শোষণের কাহিনির নীচে সে-তত্ত্ব চাপা পড়ে যাচ্ছে।

তবু ফ্রান্সের ‘ল্য মঁদ’ পত্রিকাতেই অভিনেত্রী কাতরিন দ্যনোভ-সহ ১০০ জন মহিলা বলেছেন, মুড়ি মিছরির এক দর করা ঠিক হচ্ছে না। ধর্ষণ অপরাধ। ঘ্যানঘেনে ফ্লার্টিং বা শিভালরি-র নামে আদিখ্যেতা বিরক্তিকর হলেও এক গোত্রের নয়। ‘‘তা হয়তো নয়। তবে গায়ে-পড়া একতরফা ফ্লার্টিংও হয়রানি বা হেনস্থার নামান্তর।’’— বললেন দিল্লির একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত জনৈক পরিচিতা। ‘সিঙ্গল’ তকমাধারী মহিলার কথায়, ‘‘এ দেশের ছেলেদের আদ্ধেকেরই ফ্লার্টিংটা হজম হয় না!’’ সামান্য মনোযোগেই আকাশকুসুম কল্পনা। আর মেয়েটি একান্তে কোনও আমিষ রসিকতা করলে বা দু’পাত্তর খাওয়ার প্রস্তাব দিলে তো রক্ষে নেই! যেন এ-নারী নির্ঘাত তাঁর শয্যাগামিনী হতে মুখিয়ে আছেন! আবার সেই রবি ঠাকুরেরই শরণ নিই। ‘ল্যাবরেটরি’-র সোহিনী কবে বলেছিলেন, ভড়ং করতে করতে প্রাণ বেরিয়ে গেল এ দেশের মেয়েদের। দ্রৌপদী-কুন্তীদের খামোকা সীতা-সাবিত্রী সেজে থাকতে হয়। পরিচিত মেয়েটি বলেন, ‘‘আমি কার সঙ্গে কী করব সেটা আমার ব্যাপার। কিছু তেতো অভিজ্ঞতার পরে ডেটিং-ফ্লার্টিংয়েই অরুচি ধরে যায়।’’

বসন্তসেনার দেশে এ সব শুনলে মন খারাপ হয়! নিজের শরীরের দাবিদাওয়ার একচ্ছত্র মালিক স্বাধীন বারাঙ্গনাই একদা দেশের সব থেকে বিদগ্ধ নারীর মর্যাদা পেতেন। আমাদের কালচারে কামসূত্র থেকে কবীর সুমনেও মর্যাদায় স্থিত, অসঙ্কোচ কামনা। সুমন গান বেঁধেছিলেন, ‘তুমিও স্বাধীন, কামনাও স্বাধীনতা, স্বরাজ চাইল শরীরের কথকতা!’ ‘মিটু’-র অভিঘাতে নারী-পুরুষের মেলামেশায় এই স্বভাব-স্বাধীনতাটাই কি আমরা বলি দিতে চলেছি? তার বদলে ক্রমশ দ্বিধা আর অবিশ্বাসের গর্তে ঢুকে পড়ছি মেয়েপুরুষ নির্বিশেষে? পোড়খাওয়া কর্পোরেট কর্ত্রী পরমা রায়চৌধুরী এর প্রতিবাদ করবেন। ‘মিটু’-র সদর্থক দিকটাই বেশি। কত জন সাহস করে মুখ খুলছেন। কত অন্যায়ের শাস্তি হচ্ছে। এ তো স্বাধীনতায় অনধিকার হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ। একই সুর নারী অধিকার রক্ষা কর্মী শাশ্বতী ঘোষেরও।

কিন্তু সেই সঙ্গে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রী-শিক্ষক বা কর্পোরেট অফিসে সহকর্মীদের ছিটেফোঁটা ঘনিষ্ঠতা ঘিরেই সন্দেহের কাঁটা তীক্ষ্ণতর হচ্ছে। ক্ষমতার ছায়া যে সম্পর্কে, সেখানে কথায়-কাজে এতটুকু বেলাগাম হলেই বিপদ। বিশ্ববিদ্যালয়ে গাইডের আচরণ নিয়ে বিস্তর সতর্কতাবিধি। কর্পোরেট অফিসে পুরুষ বসের সঙ্গে অধস্তন তরুণীটির ঘন ঘন কফি খেতে যাওয়া নিয়েও প্রশ্নচিহ্ন। পরমার ব্যাখ্যা, ‘‘পরে কাজ নিয়ে বসের সঙ্গে সংঘাত ঘটলে এই মেলামেশাটাই হয়তো বুমেরাং হবে।’’ এই ‘তাসের দেশ’-এ চিত্ত মাতাল হলেও মধ্যবিত্ত থাকাটাই অতএব ভবিতব্য!

পেশাগত পরিসর থেকে সোশ্যাল মিডিয়া— কতটা কাম্য এমন শান্তিকল্যাণ? সর্বোচ্চ আদালতে লিভ-ইন সম্পর্কের জয়গান, বিস্তর ডেটিং অ্যাপ, ভারতেও যে কোনও যুগলের রাত কাটানোর ডেরার ফেসবুক পেজের যুগেই থাকছে দ্বিধাদ্বন্দ্বের সহাবস্থান। বাৎস্যায়নের মতে, নারীমন জয়ের চাবিকাঠি পুরুষের কথার জাদুতেই। মিটু জমানার অজস্র তিক্ত অভিজ্ঞতা শেখাচ্ছে, অসম্মান না করে রসিকতা, গায়ে-পড়া না হয়ে অন্তরঙ্গতা বা অস্বস্তিতে না ফেলে রসালাপের তাগিদ। সর্বত্র ‘হার্ট না করে ফ্লার্ট’ রপ্ত করার মাথাব্যথা। পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় হাসছেন, ‘‘একটা কথা ২৫ রকম ভাবে বলা যায়! দু’জনে মিলে বুদ্ধিদীপ্ত ফ্লার্টিং বেশ তো!’’

তবে যে কোনও ফ্লার্টিংই কিন্তু যৌনতার কূলে তরী বাঁধবে না। ঘনিষ্ঠতার কোন পর্যায়ে থামতে হবে, বোঝাটা জরুরি। আবার দু’জনের সম্মতিতে যৌনতার ঠিক-বেঠিক নিয়ে না-ভেবে বুঝতে হবে যৌনতা মানেই বিচিত্র প্রত্যাশার জন্মভূমি নয়। মুহূর্তটুকুর বাইরে আর কী পেলুম ভাবাটা অবান্তর!

এটা মানতে না-পেরেও বহু জীবন জটিল হয়। মিটু-র হাত ধরে অজস্র মুখ মুখর হওয়ার দিনে এই পরিণত বোধটুকুও সময়েরই দাবি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Flirting Sex Me Too Harvey Weinstein
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE