Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
পান্তাভাতে…

ওঁর জন্য আলাদা চিত্রনাট্য

নি উ থিয়েটার্স-এ যখন রেগুলার কাটিং চা খেতাম, তখন এক এক দিন একটা হাওয়া চলত। চার দিকে বেশ সাজো সাজো রব, তটস্থ সবাই। ‘মিসেস সেন আসছেন’,‘মিসেস সেন আসছেন’। কী যেন একটা সবাইকে সিধে করে দিত। এমন গ্রেস ছিল তাঁর, এমন রাজত্ব। আমিও তখন দু’এক বার দেখেছি।

গুলজার
শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

নি উ থিয়েটার্স-এ যখন রেগুলার কাটিং চা খেতাম, তখন এক এক দিন একটা হাওয়া চলত। চার দিকে বেশ সাজো সাজো রব, তটস্থ সবাই। ‘মিসেস সেন আসছেন’,‘মিসেস সেন আসছেন’। কী যেন একটা সবাইকে সিধে করে দিত। এমন গ্রেস ছিল তাঁর, এমন রাজত্ব। আমিও তখন দু’এক বার দেখেছি। মুগ্ধও হয়েছি। এর আগে তাঁকে স্ক্রিনে তো দেখেইছি। ‘দেবদাস’-এ দিলীপ সাব-এর সঙ্গে টক্কর দিয়ে অভিনয়, উনিই পেরেছিলেন। অমন আলো করা স্ক্রিন প্রেজেন্স, ওঁরই ছিল। ‘দীপ জ্বেলে যাই’ দেখে তো সিনেমা-হলেই বোধবুদ্ধিহীন হয়ে পড়েছিলাম মনে হয়, আর ‘সাত পাকে বাঁধা’র মতো অত ম্যাচিয়োর অভিনয় সুচিত্রা সেনের আমি দেখিনি। হ্যাঁ, পরে অবশ্য ‘আঁধি’তে ওঁর অভিনয়ের একটা অন্য ডায়মেনশন পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু ‘দীপ জ্বেলে যাই’ আর ‘সাত পাকে বাঁধা’, এই সিনেমা দুটোতেই গ্ল্যামার-সমৃদ্ধ নায়িকার ডি-গ্ল্যাম অভিনয়, তাঁর সাদামাটা প্রেজেন্স, তাঁর অপূর্ব অভিনয় তাঁকে একেবারে আলাদা চোখে চিনিয়েছিল।

এক বার প্রযোজক সোহনলাল ঠিক করলেন, সুচিত্রা সেনকে নিয়ে একটা সিনেমা করবেন। সেই মতো আমি স্ক্রিপ্টও তৈরি করলাম। বেশ সময় নিয়েই করলাম। যতই হোক, সুচিত্রা সেন করবেন সিনেমাটা। তার পর এলাম কলকাতা, বালিগঞ্জ প্লেস, মিসেস সেনের বাড়ি। স্ক্রিপ্ট পড়ে শোনালাম। শোনার পরই উনি বলতে লাগলেন, স্ক্রিপ্টের এখানটা বদলান, ওখানটা বদলান, এই চরিত্রকে দিয়ে এই জিনিসটা করান। শুনে তো আমার মেজাজ গেল গরম হয়ে। আমি বললাম, আমি অনেক খেটে, অনেক ভাবনাচিন্তা করে স্ক্রিপ্টটা লিখেছি। আমি বদলাব না। আর আমার মনে হয় না আপনি বিরাট এক জন লেখক, যিনি কিছু ক্ষণ স্ক্রিপ্ট শুনেই বুঝে যাবেন, কোথায় কোথায় কী বদল দরকার, কোন চরিত্রের ঠিক কী করা উচিত। সোহনলাল কুমারজি’কে বললাম, আপনি অন্য কাউকে দিয়ে লেখান, আমি লিখব না। অথবা মিসেস সেনকেই বলুন লিখতে। বলে বেরিয়ে এলাম। সিনেমাটি ভেস্তে গেল। এই হল সুচিত্রা সেনের সঙ্গে আমার প্রথম মোলাকাত। এ দিকে সোহনলালজি তো খুব মুষড়ে পড়লেন। আক্ষেপ করতে লাগলেন, ‘আমি তো সাইনিং অ্যামাউন্টও দিয়ে দিয়েছিলাম, তুমি ভেস্তে দিলে!’ আমার তখন তরুণ রক্ত। আমার লেখা নিয়ে যুক্তি দিয়ে কথা না বললে, আমি মোটেই মানি না।

এর বেশ কিছু দিন পর জে ওমপ্রকাশ আমায় ডেকে পাঠালেন একটা সিনেমা পরিচালনা করার জন্য। বললেন, শচীন ভৌমিকের গল্প। একটা থ্রিলার। নায়িকা মিসেস সেন। আর সঞ্জীবকুমারের বড্ড ইচ্ছে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে অভিনয় করবে। আরেরেরেরে, সঞ্জীবের যে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে অভিনয় করার কী ইচ্ছে ছিল, সেই কবে থেকে! তো আমরা এক দিন গল্প নিয়ে বসলাম। আমি সব শুনেটুনে বললাম, যদি সুচিত্রা সেনকে নিয়ে ছবি করতে হয়, তা হলে থ্রিলার কেন? আরে ভাই, সুচিত্রা সেনের মতো এক জন অভিনেত্রীকে নিয়ে কাজ করবে, একটা তেমন জম্পেশ গল্প হতে হবে তো। সঞ্জীবও দেখি একই কথা বলছে। আর সবচেয়ে আশ্চর্য, শচীন ভৌমিক নিজেই বললেন, ‘সত্যি, সুচিত্রা সেনকে নিয়ে যদি কাজ করতে হয়, তা হলে ওঁর জন্য কিছু একটা ক্রিয়েট করতে হবে।’ তখন প্রোডিউসার বললেন, ‘ঠিক আছে, একটা গল্প তুমি ভাবো তা হলে।’ আমি একটা ছোট গল্প হিসেবে ‘আঁধি’টা লিখে শোনালাম সবাইকে। মনে হল, সবাই যেন এই গল্পটার জন্যই অপেক্ষা করছিল।

এর মধ্যে আবার আর একটা ঘটনা ঘটল। বিখ্যাত লেখক কমলেশ্বরজি আমাকে বললেন, ওঁর খুব ইচ্ছে, উনি একটা গল্প লিখবেন, সেটা থেকে আমি আর উনি মিলে একটা স্ক্রিপ্ট করব, আর তার পর আমি ফিল্মটা পরিচালনা করব। ছবিটা প্রযোজনা করবেন মল্লিকার্জুন রাও। প্রযোজকের সঙ্গে কথা বলতে তখন আমরা মাদ্রাজ গেলাম। মুশকিল হল, কমলেশ্বরজির গল্পটা প্রযোজক খারিজ করে দিলেন। তখন আমার সহকারী ভূষণ বনমালী করল কী, এ জে ক্রোনিন-এর ‘দ্য জুডাস ট্রি’ গল্পটা শোনাল (যেটা থেকে পরে আমি ‘মৌসম’ বানিয়েছিলাম)। সেটা মল্লিকার্জুন রাওয়ের খুব পছন্দ হয়ে গেল। উনি বললেন, এই গল্পটার স্ক্রিপ্ট করো। আমরা তো খুব লজ্জায় পড়ে গেলাম। কমলেশ্বরজি আমাদের নিয়ে গেলেন, অত বড় লেখক, আমার বন্ধু, তাঁর গল্প খারিজ হয়ে গেল, আর এই গল্পটা সিলেক্ট হয়ে গেল! যাকগে, ঠিক হল, মহাবলীপুরম-এ গিয়ে কমলেশ্বরজি আর আমরা মিলে স্ক্রিপ্ট লিখব। আমি কমলেশ্বরজিকে বললাম, এই গল্পের স্ক্রিপ্টটা আপনি লিখুন। আর মনে মনে ঠিক করলাম, ‘আঁধি’র স্ক্রিপ্টটা শেষ করব।

কিন্তু মহাবলীপুরম-এ রোজই দেদার গল্পগাছা, চিংড়ি মাছের সঙ্গে মদ্যপান, আর এই স্ক্রিপ্টের মাঝে ওই স্ক্রিপ্ট নাক গলিয়ে দেয়। ফলে আদতে ব্যাপারটা কিছুই দাঁড়াল না। অথচ আমি ভেতরে ভেতরে ছটফট করছি যে আমায় সুচিত্রা সেনের জন্য এমন কিছু লিখতে হবে, এমন একটা সিনেমা তৈরি করতে হবে, যা মানুষ মনে রাখবে আজীবন।

তখন ধুত্তোর বলে একা দিল্লি চলে গেলাম। আকবর হোটেলের ঘরে বসে শেষ করলাম ‘আঁধি’র স্ক্রিপ্ট। হোটেলে যে ছেলেটা আমার খাবারদাবার, চা-জলখাবার, ফাইফরমাশের দায়িত্বে ছিল, তার নাম ছিল জে কে। সিনেমায় সঞ্জীব যে চরিত্রটা করেছিল, তার নাম আমি রেখেছিলাম জে কে। সেই আকবর হোটেলের একটা ঘর থেকে শুরু হয়েছিল সুচিত্রা সেনের ‘আঁধি’, সঞ্জীব কুমারের ‘আঁধি’, আর ডি বর্মনের ‘আঁধি’ আর গুলজারের ‘আঁধি’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE