Advertisement
E-Paper

ঝাঁকড়া চুল, অপূর্ব হাসি

সমরেশদা’র সঙ্গে আলাপ তো অমৃত দিয়ে। তিনি যে সন্ধানে বেরিয়েছিলেন, আমি তা পড়েই আমার ভাণ্ড পূর্ণ করে ফেলেছি। ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’ ধারাবাহিক ভাবে বেরোত। আর বিমলদা প্রতিটি কিস্তি মন দিয়ে পড়তেন। বিমলদা চেয়েছিলেন ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’ সিনেমাটা ওঁর জীবনের মহান কীর্তি হোক। ম্যাগনাম ওপাস।

গুলজার

শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০১৫ ০০:০২
Share
Save

সমরেশদা’র সঙ্গে আলাপ তো অমৃত দিয়ে। তিনি যে সন্ধানে বেরিয়েছিলেন, আমি তা পড়েই আমার ভাণ্ড পূর্ণ করে ফেলেছি। ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’ ধারাবাহিক ভাবে বেরোত। আর বিমলদা প্রতিটি কিস্তি মন দিয়ে পড়তেন। বিমলদা চেয়েছিলেন ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’ সিনেমাটা ওঁর জীবনের মহান কীর্তি হোক। ম্যাগনাম ওপাস। কিন্তু হয়ে ওঠেনি। এই সিনেমার চিত্রনাট্য থেকে কুম্ভমেলার শুটিং, অনেকটাই আমি করেছিলাম। আর যোগস্নানের দিন বিমলদা আমাদের ছেড়ে গিয়েছিলেন অমৃতলোকে।

এই বইটার সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে ছিলাম। আর তাই কোনও অজানা টানেই সমরেশদার সঙ্গেও জড়িয়ে ফেলেছিলাম নিজেকে। অমৃতকুম্ভ-র অর্ধেক তৈরি হওয়া ও না-হওয়ার অনেক যন্ত্রণা ছিল, বিমলদার চলে যাওয়ার কষ্ট তো ছিলই, সমরেশদার সঙ্গে আলাপ হয়ে যেন সে সব যন্ত্রণার একটু হলেও উপশম হল। দেবু সেন আমায় প্রথম আলাপ করিয়ে দেয় ওঁর সঙ্গে। আমার যে বাঙালি ক্ল্যান ছিল, দেবু ছিল তার মধ্যমণি। ও আমার মধ্যে অনেকটা বাঙালিত্ব ঢুকিয়ে দিয়েছে।

এক মাথা ঝাঁকড়া চুল আর অপূর্ব একটা হাসি, এটাই ছিল সমরেশদা’র ট্রেডমার্ক। ওঁর সম্পর্কে যে সম্মোহিত ছিলাম, সে ব্যাপারটা কাটতে সময় লাগল মিনিট দশেক। তার পরেই বন্ধু-বন্ধু দিশেহারা। অমন সাদাসিধে মানুষ আমি কমই দেখেছি। জমে গেল জীবন আর বন্ধুত্ব যাপন। কলকাতায় এলেই প্রবল আড্ডা। নতুন কী লিখেছেন, কী লিখবেন, কোন ভাবনা কুরে কুরে খাচ্ছে— সব কাটাছেঁড়া চলত।

ওঁর একটা গল্প বেরোল, ‘অকাল বসন্ত’। এক কথায় যাকে বলে, দুরন্ত! আমার ভারী লোভ হল গল্পটা নিয়ে সিনেমা করি। কিন্তু স্ক্রিপ্ট করতে গিয়ে দেখলাম একটু অদলবদল হলে ভাল হয়। সমরেশদা’কে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দাদা, একটু চেঞ্জ করতে পারি কি?’ দরাজ গলায় বলে উঠলেন, ‘আরে হ্যাঁ হ্যাঁ, বায়োস্কোপ করতে গেলে ও-সব একটু-আধটু করতে হয়।’ কিন্তু সেই সিনেমা হতে আরও অনেক দেরি হয়েছিল নানা কারণে। তার আগে আমি সমরেশদার আরও একটা ছোট গল্প ‘পথিক’ নিয়ে তৈরি করে ফেললাম অন্য একটা সিনেমা, ‘কিতাব’। গল্পটা ‘উল্টোরথ’ পত্রিকায় বেরিয়েছিল। ওই সিনেমাটার সূত্রেই প্রথম আমার উত্তমবাবুর সঙ্গে আলাপ।

কিন্তু আমি তো হাল ছাড়িনি। ‘অকাল বসন্ত’ বার বারই আমায় তাগাদা দেয়। শেষে টেলিভিশনে রিলিজ করে দিলাম সিনেমাটা। নাম হল, ‘নমকিন’। আমার জীবনের অন্যতম প্রিয় সিনেমা।

সমরেশদা’র গল্পে যে একটা আশ্চর্য টান আছে, সেটা আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। সমরেশদা’র আরও একটা গল্প আছে ‘আদাব’, পড়ার পর ভাবলাম এটা নিয়ে সিনেমা করতেই হবে। কিন্তু চিত্রনাট্য তৈরি করতে গিয়ে দেখলাম বড্ড ছোট হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি তো ছোড়নেওয়ালা নই। তখন দূরদর্শনে ‘কিরদার’ নামে একটা টেলিসিরিয়াল করছিলাম। আমি ‘আদাব’ গল্পটাকে সেই সিরিয়ালের জন্য বাছলাম।

‘আদাব’ গল্পের শেষে এক জন হিন্দু ও এক জন মুসলিম একে অন্যের থেকে বিদায় নেয় ‘আদাব’ বলে। কিন্তু আসলে তো তা হয় না। কেউ কারও থেকে বিদায় নেওয়ার সময় উর্দুতে ‘খুদা-হাফিজ’ বলে। আমি সমরেশদাকে বললাম, ‘এটা তো হয় না সমরেশদা।’ উনি বললেন, ‘আরে এক জন মুসলিম আর এক জনকে বিদায় জানাচ্ছে, তাই আদাব বলেছে। ওটা তো একটা উর্দু শব্দ, না কি!’ আমি বললাম, তা ঠিক, কিন্তু আদাব শব্দের মানে তো অন্য। মানে তো অভ্যর্থনা। বিদায় নেওয়ার সময় একদম একটা উলটো শব্দ বলা চলে কী করে? সমরেশদার উত্তর, ‘আরে ওই নিয়ে তুমি অত ভেবো না। তোমায় বায়োস্কোপে বদল করতে হলে করে নাও।’

আমিও তা-ই করলাম। গল্পের নাম দিলাম ‘খুদা-হাফিজ’। সেই মর্মে সিরিয়াল হল। পরে ওই সিরিয়ালের চিত্রনাট্য থেকে একটা নাটকও লিখেছিলাম ওই নামে। আমার মনে হয়, আমি বাংলায় যত ছোট গল্প পড়েছি, হিন্দিতে বোধ হয় তত পড়িনি।

সমরেশদার সঙ্গে এই সখ্য আস্তে আস্তে ইয়ার-দোস্তিতে বদলে গেল। কলকাতা গেলেই বেপরোয়া ছুটির আমেজ। আমি যদিও লিমিটেড বেপরোয়া, কিন্তু সমরেশদা ছিলেন সত্যিকারের বেপরোয়া। বাঁধন এক বার ছাড়লে তাঁকে বাগে আনা মুশকিল।

জীবনের প্রতি এই অ্যাটিটিউডই ওঁকে এ রকম অদ্ভুত লেখার ক্ষমতা দিয়েছিল, ভাবনার ইন্ধন দিয়েছিল। ওঁর প্রথম জীবনের কষ্ট করে লেখার কথা শুনেছি। তা-ই ভাবি, লেখার প্রতি যদি ওই বাঁধনছাড়া টান না থাকত, তা হলে বাংলা সাহিত্য গরিব হয়ে যেত অবশ্যই।

সমরেশদা যদি মেপেজুপে জীবন চালাতেন আর লেখার সময় বাঁধ ভাঙতে চাইতেন, তা হলে কোনওটার প্রতি জাস্টিস হত না। সমরেশদা’র মতো মানুষরা আসলে বাউন্ডুলে বলেই জীবনকে কখনও পানাপুকুর থেকে, কখনও জমিদারবাড়ির খিলান থেকে, কখনও ট্রাক ড্রাইভারের ডেরা থেকে তুলে এনেছেন। ভবঘুরে হয়েই যদি সাহিেত্য আরও কিছুকাল আনাগোনা করতেন তো বাংলা সাহিত্য আরও সমৃদ্ধ হত। অন্তত ‘দেখি নাই ফিরে’ শেষ তো হত! এ অপ্রাপ্তি তো মিটবে না কোনও দিন।

Gulzar Samaresh Basu kolkata mumbai bengali writer desh patrika

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}