Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

‘কী করে মানবী হলাম’

মার্কিন অ্যাথলিট ব্রুস জেনার লিঙ্গ পরিবর্তন করেছেন, তা নিয়ে টুইটার-এ বিশ্ব রেকর্ড। পশ্চিমবঙ্গের সোমনাথ ‘মানবী’ হয়েছেন অনেক বেশি প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে।আমাকে জীবনে যা সইতে হয়েছে, সেটা ভাবা যায় না। প্রতিনিয়ত মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়েছি। জেনার-এর কাছে এটা হয়তো জীবন নিয়ে একটা ‘এক্সপেরিমেন্ট’, আমার ক্ষেত্রে কিন্তু তা নয়। আমি ট্রান্সজেন্ডার হয়েই জন্মেছিলাম, আর আমাকে সেটা প্রতিষ্ঠা করতে হত। তাই, এটা কোনও পরীক্ষা নয়, এ যেন আমার জীবনটা একটা গন্তব্যে পৌঁছচ্ছে। আমার জীবনই ছিল একটা অ্যাকশন, একটা দৌড়।

সুস্নাত চৌধুরী
শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

আমাকে জীবনে যা সইতে হয়েছে, সেটা ভাবা যায় না। প্রতিনিয়ত মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়েছি। জেনার-এর কাছে এটা হয়তো জীবন নিয়ে একটা ‘এক্সপেরিমেন্ট’, আমার ক্ষেত্রে কিন্তু তা নয়। আমি ট্রান্সজেন্ডার হয়েই জন্মেছিলাম, আর আমাকে সেটা প্রতিষ্ঠা করতে হত। তাই, এটা কোনও পরীক্ষা নয়, এ যেন আমার জীবনটা একটা গন্তব্যে পৌঁছচ্ছে। আমার জীবনই ছিল একটা অ্যাকশন, একটা দৌড়। ব্রুস জেনার অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় দৌড়েছেন, আমার স্ট্রাগলটাই ছিল সেই প্রতিযোগিতা। ওঁর ব্যাপারটা অনেকটা এ রকম: দৌড়ের শেষে উনি হয়তো বসন্ত-বাতাস আনলেন! হয়তো কী ভাবে অবসর-জীবনটা কাটাবেন, ঠিক করলেন। যখন আর ঘাম-ঝরানো পরিশ্রম নেই, সেই সময়টা উনি নারীত্বকে দিলেন।’ ফোনে বলছিলেন মানবী, যিনি সোমনাথ থেকে হয়ে উঠেছেন মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়।
এই মুহূূর্তে দুনিয়া তোলপাড় হচ্ছে আমেরিকার ব্রুস জেনার-কে নিয়ে, যিনি হয়ে উঠেছেন কেটলিন জেনার। ১৯৭৬-এর সামার অলিম্পিকে ডেকাথলন-এর পুরুষ বিভাগে গোল্ড মেডালিস্ট যিনি, তিনিই এই সপ্তাহে ‘ভ্যানিটি ফেয়ার’ পত্রিকার সুন্দরী কভার-গার্ল! লিঙ্গ পরিবর্তন করে, আর তা খোলাখুলি দাপিয়ে ঘোষণা করে, দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন পঁয়ষট্টি বছরের এই ‘সদ্য তরুণী’। তাঁকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন বারাক ওবামা। টুইটারে রেকর্ড সময়ে তাঁর এক মিলিয়ন ফলোয়ার হচ্ছে, যা বিশ্বে আজ অবধি কারও হয়নি! সারা বিশ্বের মিডিয়া হামলে পড়ে বলছে, ধন্যি মেয়ে! কী সাহস! কেউ কেউ অবশ্য ভুল করে ‘ধন্যি ছেলে’ বলে ফেলছে, তারা আবার বকুনি খাচ্ছে!

কিন্তু মার্কিন এই অ্যাথলিটের ঢের আগেই তো এমন কাণ্ড ঘটেছে এই পোড়া বাংলায়। সামাজিক প্রেক্ষিত বিচার করলে, লোকজনের হ্যাটা দেওয়ার হিসেব কষলে, ঘরে-বাইরে নানা প্রতিবন্ধকতার গোদা দেওয়ালগুলোয় চোখ রাখলে, ‘সোমনাথ’ থেকে ‘মানবী’ হওয়ার সেই লড়াইকে কোনও অংশে কম তো বলা যায় না-ই, বরং আরও এগিয়ে রাখতে হয়। ব্রুস জেনার ছেলে থেকে মেয়ে হয়ে উঠছেন আমেরিকায়, ভারতের তুলনায় যে-সমাজ অনেকটা উদার ও প্রগতিশীল। তা ছাড়া তিনি বিখ্যাত মানুষ। তাঁর অনুরাগীর সংখ্যাও প্রচুর। আর সোমনাথ ছেলে থেকে মেয়ে হয়ে উঠছেন এমন একটা সমাজে, যেখানে সেই রূপান্তরের পর দেশের রাষ্ট্রপতির অভিনন্দন জানাবার প্রশ্ন ওঠে না, প্রতিবেশীর টিটকিরির সম্ভাবনাটা তিনশো গুণ বেড়ে যায়!

মানবীকে প্রশ্ন করলাম, জেনারের খবরটা শুনে কেমন লাগছে? বললেন, ‘এক জনের কতটা পৌরুষ থাকলে তিনি অন্য পুরুষদের হারিয়ে একটা খেলায় জিততে পারেন! সেই রকম এক জন মানুষ যখন পরিবর্তিত হন, নারী হয়ে ওঠেন, তখন তো সত্যিই ভাবায় ব্যাপারটা। এই রকম একজন হার্ডকোর পুরুষ, জীবনে একটা পর্যায়ে এসে মেয়ে হয়ে গেলেন, এটা বোধহয় ওদের দেশ বলেই সম্ভব।’

আর এই দেশে? এই রাজ্যে? কী ধরনের প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে, রক্তক্ষরণের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল সোমনাথ/মানবীকে? ‘উচ্চশিক্ষার পর আমি যখন শিক্ষকতায় গিয়েছি, জানি না কেন আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে গ্রামের একটি কলেজে। আমার বাড়ির কাছাকাছিও অনেক কলেজ ছিল, সেখানেও আমি চাকরি পেতে পারতাম। পাইনি। কর্মস্থলে প্রতিনিয়ত আমার যে লড়াইটা, সেটা কোনও মনুষ্য-সমাজে ঘটে বলে আমার মনে হত না— শিক্ষিত সমাজ তো ছেড়েই দিন! আমার অধ্যাপনা-জীবনে আমাকে প্রতিটা মুহূর্তে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে তুমি মরো! আর যদি না মরো, আত্মহত্যা যদি না করো, তাহলে তোমার এই বেঁচে থাকাটা হবে চরম দুর্বিষহ একটা যন্ত্রণা। আমি যে কলেজে পড়াতাম, সেই কলেজের অধ্যাপকরা দলবদ্ধ ভাবে সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন। মানে, সব কিছুতেই যেন আমি অচল, কোনও রকম কমিটিতে আমাকে রাখা হয়নি, এক্সটার্নাল হিসেবে কখনও অন্য কলেজে পাঠানো হয়নি, উপরন্তু আমার সব রকম ন্যায্য প্রাপ্তিতে বাধা দেওয়া হয়েছে। ওখানে পড়াতে গেলে আমাকে বাড়ি ভাড়া করে থাকতে হবে, কিন্তু সেটা যাতে না পাই, তার জন্য জান লড়িয়ে দিয়েছে। ওখানকার একটি ছেলেকে এমন ভাবে তৈরি করেছে, সে আমার সঙ্গে প্রেম করেছে, আমাকে বিয়ে করেছে, তার পর সুপ্রিম কোর্ট অবধি লড়ে গিয়েছে, যাতে আমাকে ফাঁসিয়ে আমার চাকরিটা পেতে পারে, যাতে আমি জেলে ঢুকি। এমন বহু ঘটনা। তারা আমাকে ডাইনি ভাবত। তা প্রমাণ করার চেষ্টাও করত।’

তবে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল অন্য রকম। তারা কী বলে ডাকত, স্যর না ম্যাম, মাস্টারমশাই না দিদিমণি? বললেন, ‘ওখানকার উচ্চারণে এ-কার’এর জায়গায় বসে য-ফলা আ-কার, য-ফলা আ-কার’এর জায়গায় বসে এ-কার। কাজেই আমাকে ‘সের’ বলানোরও চেষ্টা হয়েছে। তবে ছাত্রছাত্রীরা আমায় ‘মেডাম’ বলে ডাকাতেই অভ্যস্ত ছিল।’ বললেন তাঁদের সঙ্গে সম্পর্কের কথাও— ‘একেবারে নিরন্ন গ্রামের ছেলেপুলেরা আমাদের কলেজটায় আসত। সেখানে দুটো ভাগ ছিল। এক দল হল ইউনিয়নের ছাত্রছাত্রী, যে ইউনিয়নটা শিক্ষকরাই চালান গ্রামে। আমি গ্রামের কথা বলছি, শহরে থেকে বিষয়টা বোঝা মুশকিল। আর এক দল ছিল, যাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক পড়াশোনা করতে চায়, তাদের কাছে আমার ভীষণ রকম গ্রহণযোগ্যতা। কিন্তু তাদের কোনও ‘say’ নেই, তারা কোনও প্রতিবাদ করতে পারে না। তারা শুধু চোখের জল ফেলতে পারে। সে রকম একটা মান্যতা বা সমর্থন আমি তাদের থেকে আদায় করেছিলাম।’

ছোটবেলা থেকেই এই স্ট্রাগলের শুরু? ‘যখন ছোট ছিলাম, যখন যৌনতা বুঝতাম না, কোনও মানুষের দুই ঠ্যাঙের ফাঁকে যে একটা জিনিস থাকে, যাকে এক্সটার্নাল জেনিটাল বলে, যেটা আমাদের জন্মের কারণ, সে নিয়ে ভাবতাম না, কারণ সে বিষয়ে আরও অনেক পরে আমার উৎসাহ জন্মানোর কথা— আমার চেয়ে বড় যারা, তারা কিন্তু আমার সেই শৈশবেই খেলার ছলে সে কথা দিব্যি জানিয়ে দিয়েছিল। যখন পিছন ফিরে দেখি, বুঝি, কী সমাজে আমি জন্মেছিলাম। তার পর ক্রমশ যখন আমার কৌতূহল বাড়ল এবং আমার একটা যৌন অভিমুখ তৈরি হল, তখন আবার সেই বড়রাই বলল, এটা ভুল। তখন আমার মনে হল, এটা কি আমার ভুল? না কি গোটা পরিবারের ভুল, গোটা সমাজের ভুল, গোটা রাষ্ট্রের ভুল, দেশের ভুল? এ বার রাষ্ট্র এক দিকে, আর আমি এক দিকে হলাম। শুরু হল আমার নিজের অনুসন্ধান। আমার কথা যাতে কেউ শোনে, তার জন্য যে ক্ষমতার দরকার, সেই ক্ষমতা পাওয়ার জন্য যে পথের দরকার, তার খোঁজ। নিজের সঙ্গেই নিজের অনেক কথাবার্তা, তর্ক-বিতর্ক চলতে থাকল। তার পর একটা জায়গায় এসে পৌঁছলাম, যেখানে আমি প্রতিটা মুহূর্তেই তথাকথিত যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, তার আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে উঠলাম। তারা আমাকে ক্রমাগত বলল, তুমি এত কথা বলছ কেন? নিজেকে লুকিয়ে নাও। তুমি মুখে যা বলবে, সেটা তুমি কখনওই বিশ্বাস করবে না। সমাজের এই শিক্ষাগুলো আমি নিতে পারলাম না। আমি ‘মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয়’ হয়ে উঠলাম...’

তাঁর যাদবপুরের শিক্ষাজীবন অবশ্য ততটা কষ্টের ছিল না, বন্ধু ছিল সেখানে। পেয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষ, নবনীতা দেবসেনের মতো মানুষের আশীর্বাদ। কথায় কথায় বললেন, ‘এই তো আমার যাদবপুরের এক বান্ধবী এসেছিল, ও বলছিল, তোমাকে নিয়ে তখন সবাই বলত, তোর ওই পুরুষ-বন্ধুটা এ রকম মেয়েদের মতো করে কেন! তবে আমার ডিপার্টমেন্টের টিচারদের কাছে সে রকম আঘাত পাইনি। বন্ধুবান্ধব বা আশপাশের লোকজন হয়তো বলার চেষ্টা করেছে, আমি ‘অড’। কিন্তু তখন যাদবপুরে বলা হত— ‘অড ইজ মড’! ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষিত মানুষজন থাকত বলেই হয়তো, কিছুটা হলেও আমি একা থাকার জায়গা পেতাম। লাইব্রেরিতে একটা বই নিয়ে একা বসে থাকতে পারতাম।’

কলেজে পড়াতে পড়াতে কী ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন লিঙ্গ পরিবর্তনের? ‘আমার শরীরটা যে আমার শরীর নয়, সেটা তো আমি অনেক দিনই বুঝতে পেরেছিলাম। তার থেকে মুক্তির একটা প্রয়াস আমার মধ্যে ছিল। পুনর্জন্মে বিশ্বাস করলে নয় চাইতাম, মরে গিয়ে যেন পরজন্মে নারী হয়ে জন্মাই। এর পর শুনলাম, আধুনিক বিজ্ঞানে এর একটা ট্রিটমেন্ট থাকলেও থাকতে পারে। তখন এক চিকিৎসক আমার লেখালিখি দেখে যোগাযোগ করেন। আমাকে বলেন, যাঁদের নিয়ে আমি কাজ করি, লেখালিখি করি, ওঁরা তাঁদের চিকিৎসা করতে পারেন। ট্রিটমেন্টটা কিন্তু সেই অবস্থায় একটা নিরীক্ষার স্তরে ছিল, একেবারেই ফুলপ্রুফ ছিল না। সেই দিক থেকে আমার এই সিদ্ধান্তের ভীষণ একটা গুরুত্ব ছিল, তাকে হয়তো মহানুভবতাই বলা চলে; কারণ আমি ডাক্তারকে বলেছিলাম, আমার শরীরটা নিয়ে আপনি পরীক্ষা করতে পারেন।’

এই পরিবর্তন তাঁর জীবনকে নিজের গন্তব্যে নিয়ে গিয়েছে। তাতে বিভিন্ন ভাবে সুবিধে হয়েছে কি তাঁর জীবন যাপনের? ‘লিঙ্গ পরিবর্তন করার আগে আমি যে ভাবে চলতাম, যে ভাবে সাজতাম, যে ভাবে কথা বলতাম, তাতে লোকে বলত, ছেলেটা খুব মেয়েলি। আর চেঞ্জ করার পর আমি যখন সত্যিকারের মেয়ে হয়ে এলাম, তখন লোকে বলল, বাবা, এ মহিলা তো ভীষণ পুরুষালি! তবে, ‘মেয়েলি পুরুষ’-এর থেকে বোধহয় ‘পুরুষালি মহিলা’-র গ্রহণযোগ্যতা অনেকটা বেশি। কারণ ‘পৌরুষ’ ব্যাপারটাই ভীষণ ‘সম্মানের’! আর আমার রোজকার ইন্টারঅ্যাকশনের জায়গা থেকেও একটা সুবিধে হল— যে টিচাররা ‘সোমনাথ’ থাকার জন্য সুযোগ পেতেন আমাকে শারীরিক নির্যাতন করার, হাত চেপে ধরার, আরও অনেক কিছু করার, তাঁরা ‘মানবী’-কে মহিলা হওয়ার কারণে আর শারীরিক নির্যাতন করতে পারলেন না!’

তবে, সমাজের আঘাত হানার খেলা এত কিছুর পরেও বন্ধ হয়নি, তার রূপ বদলেছে মাত্র। মানবী অবশ্য দমেননি। তাঁর স্পষ্ট কথা— ‘মানুষজন কে কী বলল, আমি কোনও দিনই কান দিইনি। আমি জানি, আমি রোজগার করলে খেতে পারব, পরিবারকে খাওয়াতে পারব। আর রোজগার না করলে উপোস করে থাকব। কাজেই, কে কী বলল, তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আমার প্রেম হয়েছে, তখন আমি বিশ্বাস করেছি, আবার বিশ্বাসভঙ্গও হয়েছে।’

‘অনেকেরই হয়, আমারও হয়েছে। কিন্তু বিশ্বাসভঙ্গের জন্য তো সেই মানুষটা দায়ী, আমি তো দায়ী নই। ব্যাপার হল, আমরা মুখে বলি ‘প্রেম’, আসলে তো যৌনতা। সেটা যা হয়, তেমনই হয়েছে।’ এতটুকু বলে গাইতে শুরু করলেন সুরেলা কণ্ঠে... ‘অলি বারবার ফিরে যায়... অলি বারবার ফিরে আসে...’

সম্প্রতি কৃষ্ণনগর উইমেন্স কলেজ-এর প্রধান হয়েছেন। এক জন ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে বিরলতম ঘটনা। কেমন লেগেছিল এই খবর পেয়ে? ‘যখন জানলাম, একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল— যাক, এ বার হয়তো কুড়ি বছরের দহনজ্বালা থেকে মুক্তি পাব!’ কিন্তু যদি আগের পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি হয়? সাফ কথা তাঁর, ‘যদি বিয়ের পর ডিভোর্স হয়, তার পর আবার বিয়ে হয়, সেই বরটাও যদি খারাপ হয়, তা হলে আবার ডিভোর্স করার চেষ্টা করব! তবে, সেটা হবে না। কারণ আন্তর্জাতিক স্তরে আমি এখন একটি বিরাট বিস্ময়। হলে গোটা পৃথিবীর সাংবাদিকরা ঝাঁপিয়ে পড়বে।’ ঋতুপর্ণ ঘোষ নাকি তাঁকে এক বার জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাঁর পত্রিকার নাম ‘অবমানব’ কেন? ঋতুপর্ণ বলেছিলেন, ‘আপনি কি মনে করেন মানুষগুলো অবমানব?’ তখন মানবী কী বললেন? ‘বললাম, দেখুন, আমি যদি ওঁদের ‘মহামানব’ বলি, ওঁরা কি সেই মর্যাদা পাবেন? কখনও পাবেন না। সামাজিক ক্ষেত্রে যে ভাবে ওঁদের দেখা হয়, সেই অর্থেই অবমানব। অবমানব না হলে তো ওঁদের নিয়ে পত্রিকা করারও কোনও মানে ছিল না!’ বছর কুড়ি হল চলছে ‘অবমানব’। বললেন পত্রিকা শুরু হয়েছিল কী ভাবে— ‘নবনীতা দেবসেন আমাকে বলেছিলেন এ ধরনের বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে। কিন্তু আমি দেখলাম কেউ এ নিয়ে কাজ করাতেই রাজি হচ্ছেন না। কারও কাছে পাত্তাই পাচ্ছি না। তখন আমার পত্রিকাটি করার ভাবনা আসে। সবে কলেজে চাকরি পেয়েছি। সে সময় পত্রিকা প্রকাশিত হল। উনিশটা কমপ্লেন লেটার গিয়েছিল সরকারি স্তরে।’ তার পর পালটা প্রশ্নে জানতে চাইলেন— ‘কেন, আপনার আপত্তি আছে এই নাম নিয়ে?’

বললাম, না, নাম নিয়ে কোনও আপত্তি নেই, কিন্তু আজকের রাস্তাঘাটে অনেক ট্রান্সজেন্ডারের বাড়তি দেখনদারি নিয়ে, হাবভাব নিয়ে প্রশ্ন জাগা, এমনকী বিরক্তি জাগাও কি খুব অস্বাভাবিক? এ কথা ঠিক, তাঁদের ‘মগা’, ‘ছক্কা’ বলে অপমান করার অধিকার কোনও হেটরোসেক্সুয়ালের নেই। কিন্তু, যাঁরা সমকামী বা লিঙ্গ-রূপান্তরিত, তাঁদেরও কি এই আন্ডারলাইন করা উচ্চ গ্রামের আচরণের বাড়তি অধিকার আছে? যৌন সত্তার জন্য অন্যকে নিচু ভাবার মানসিকতা যেমন অশ্লীল, তেমনই সমকামী বা রূপান্তরকামী বলেই যদি কেউ নিজেদের অন্যদের চেয়ে লাউড ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চান, সেটাও কি বৈষম্যের কথাই বলে না? মানবী বললেন, ‘লাউড ব্যাপারটা আপেক্ষিক। কোনও বিধার্মিকের মনে হতে পারে, ধর্ম যখন করছে ওরা, এত চিল্লাচ্ছে কেন! এত দিন ওঁদের অত্যাচার করে এসেছেন তো, এখন ওঁদের স্বাধীনতা দেখলে আপনাদের মনে হবে লাউড।'

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE