Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

কলকাতার দুর্গা, প্যারিসের গয়না

বারোয়ারি পুজোয় নয়, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। গয়না সমেত সেই প্রতিমা বিসর্জন হয়েছিল দশমীতে। পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুরবাড়িতে পুজোয় আসতেন লর্ড ওয়েলেসলি, হত বাইজিনাচ।বারোয়ারি পুজোয় নয়, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। গয়না সমেত সেই প্রতিমা বিসর্জন হয়েছিল দশমীতে। পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুরবাড়িতে পুজোয় আসতেন লর্ড ওয়েলেসলি, হত বাইজিনাচ।

ভগবতী: যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের বাড়ির প্রতিমা। সৌজন্য: সৌম্যা ঠাকুর

ভগবতী: যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের বাড়ির প্রতিমা। সৌজন্য: সৌম্যা ঠাকুর

বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৭:১০
Share: Save:

বই হাতে বসে ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। হঠাৎ সেখানে প্রবেশ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের। বয়সে তখন তিনি তরুণ। আসার উপলক্ষ, পিতামহ রামমণি ঠাকুরের প্রতিনিধি হয়ে বাড়ির দুর্গোৎসবে রামমোহন রায়কে নিমন্ত্রণ করা। দেবেন্দ্রনাথের আসার কারণ শুনে স্মিত হেসে রামমোহন বললেন, ‘‘আমাকে কেন বেরাদর? তুমি বরং রাধাপ্রসাদকে বলো!’’ রামমোহন যে পৌত্তলিকতাবিরোধী ছিলেন তা বোঝার বয়স তখনও দেবেন্দ্রনাথের হয়নি। তবু দুর্গোৎসব সামাজিক ব্যাপার বলে রামমোহন স্নেহভাজন দেবেন্দ্রনাথকে ফিরিয়ে দেননি, তাঁর পুত্র রাধাপ্রসাদের কাছে যেতে বলেছিলেন। সেই স্মৃতি দেবেন্দ্রনাথের জীবনে গভীর রেখাপাত করেছিল। তার পরের কাহিনি আজ ইতিহাস।

জোড়াসাঁকোর বাড়িতে প্রথম দুর্গাপুজো হয়েছিল নীলমণি ঠাকুরের আমলে। পরে দ্বারকানাথের আমলে সে পুজোর জাঁকজমক অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল। শোনা যায়, দ্বারকানাথ শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও পুজোর ক’দিন সন্ধ্যারতির সময় ঠাকুরদালানের সামনে পুত্রদের নিয়ে উপস্থিত থাকতেন।

সেই সময়কার ঠাকুরবাড়ির পুজো নিয়ে প্রচলিত বহু কাহিনি। শোনা যায়, ঠাকুরবাড়ির প্রতিবেশী শিবকৃষ্ণ দাঁয়ের বাড়িতে প্রতিমার গায়ে শোভা পেত বহুমূল্য ফরমায়েশি গয়না। প্রতি বছর দ্বারকানাথের বাড়ির সামনে দিয়েই গা-ভর্তি গয়না পরে প্রতিমা যেত বিসর্জনে। মা কৈলাস থেকে মর্তে এসে শিবকৃষ্ণ দাঁয়ের বাড়িতে গয়না পরতে যান বলে একটি প্রবাদও চালু ছিল তখন।

বিসর্জনের আগে অবশ্য প্রবাদপ্রতিম এই বাড়িতে, স্বাভাবিক ভাবেই প্রতিমার গয়না খুলে রাখা হত। এতে দ্বারকানাথের দুর্গোৎসব কেমন যেন ম্লান হয়ে যেত। দ্বারকানাথ তাই মনে মনে ঠিক করলেন, এর যোগ্য জবাব দেবেন। তিনিও প্যারিস থেকে বহুমূল্য ফরমায়েশি গয়না আনিয়ে তা প্রতিমাকে পরিয়েছিলেন। আর আভিজাত্যের লড়াইটা জিততে দ্বারকানাথের নির্দেশে সেই সব বহুমূল্য গয়না সমেতই দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল!

জোড়াসাঁকোর পরিবারের দুর্গাপুজোর টুকরো টুকরো ছবি ভেসে ওঠে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনা‌থ এবং অবনীন্দ্রনাথের লেখাতেও। পুজোর সময় ঠাকুরবাড়ির উঠোনে খাটানো হত শামিয়ানা। তিন দিন ধরে বসত সঙ্গীতের আসর। হত যাত্রাও। আর থাকত সঙ। পরিবারের সকল সদস্য ছাড়াও আত্মীয়স্বজন এবং বাড়ির কাজের লোকদেরও নতুন জামাকাপড় দেওয়া হত। পুজোর আগে থেকেই দক্ষিণের বারান্দায় দেখা যেত নানা মানুষের ভিড়। জুতোর মাপ নিয়ে যেত চিনাম্যান। কাপড়ের পুঁটলি নিয়ে হাজির হত আবদুল দর্জি। তার কাছেই জামার মাপ দিতে হত। ছেলেদের জন্য প্রতি বছর বরাদ্দ ছিল একটি চাপকান, জরি দেওয়া টুপি আর রেশমি রুমাল। আসত আতরওয়ালাও। তার কাছে ছোটরা পেত এক শিশি করে আতর। বাড়ির মহিলামহলে আসত তাঁতিনীরা। তারা নিয়ে আসত নীলাম্বরী, গঙ্গাযমুনা— এমন কত রকমের শাড়ি। পুজোর ক’দিন মহিলারা দিনে পরতেন সোনার গয়না, রাতে জড়োয়া।

একেশ্বরবাদের প্রভাব দেবেন্দ্রনাথের জীবনে যত দৃ়ঢ় হয়েছিল, পৌত্তলিকতা থেকে তিনি ততই দূরে সরে গিয়েছিলেন। এমনই এক উপলব্ধি থেকেই তিনি পরিবারে ছোট ভাইদের নিয়ে পৌত্তলিকতাবিরোধী একটি দল গড়েছিলেন। তাঁরা পুজোর সময়ে ঠাকুরদালানে যেতেন না, আর গেলেও প্রতিমাকে প্রণাম করতেন না। পুজোর সময় দেবেন্দ্রনাথ স্বেচ্ছায় প্রবাসী হতেন। দ্বারকানাথের মৃত্যুর মাত্র দশ বছর পর, আনুমানিক ১৮৫৭ নাগাদ ঠাকুরবাড়ির দুর্গোৎসব বন্ধ হয়ে যায়। পরিবর্তে সব আলো শুষে নেয় মাঘোৎসব।

শুধু জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতেই নয়, দুর্গাপুজো হত পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুর পরিবারের কয়েকটি বাড়িতে এবং কয়লাঘাটার রমানাথ ঠাকুরের বাড়িতেও। দর্পনারায়ণ ঠাকুরের আমল থেকেই পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুর পরিবারে দুর্গাপুজোর শুরু। তাঁর পুত্র গোপীমোহন ঠাকুরের আমলে পুজোর জাঁকজমক অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তাঁর দুর্গাপুজোয় যোগ দেওয়ার জন্য উৎসুক হয়ে থাকতেন দেশীয় এবং ইউরোপীয় অতিথিরা। যাঁদের মধ্যে ছিলেন জেনারেল ওয়েলেসলি, চিৎপুরের নবাব। এসেছিলেন ডিউক অব ওয়েলিংটনও। পুজোর তিন দিন তাঁর বাড়ির সামনে এত যানবাহন এবং অতিথিদের যাতায়াত হত যে, সাধারণ মানুষ চলাচল করতে পারতেন না। নাচঘরে বসত বাইজিনাচের আসর। আসতেন সে কালের সেরা বাইজিরা। পুজোর দিনগুলিতে অতিথিদের আমোদপ্রমোদের জন্য নানা ধরনের ব্যবস্থা করলেও, গোপীমোহন নিজে কখনও তাঁদের সঙ্গে খানাপিনায় যোগ দিতেন না। এক বার পুজোর সময় ঘটে গিয়েছিল এক দুর্ঘটনা। জেনারেল ওয়েলেসলির সামনে হঠাৎই ছিঁড়ে পড়ে গিয়েছিল একটি টানা পাখা। কেউ হতাহত হননি, গোপীমোহনের সুনামেও কোনও আঁচ লাগেনি।

ধুমধাম করে পুজো হত কয়লাঘাটার রমানাথ ঠাকুরের বাড়িতেও। অবনীন্দ্রনাথের লেখা থেকে জানা যায়, ষষ্ঠীর আগেই আসত নিমন্ত্রণ। নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে ‘ছোটকর্তা’কে প্রণাম করতে হত। এই উপলক্ষে তাঁর কাছে ‘পার্বণী’ আদায় হত। এক বার অন্যদের চেয়ে কম পার্বণী মেলায় অবনীন্দ্রনাথ বেঁকে বসেছিলেন। বলেছিলেন, চার আনার পরিবর্তে এক টাকাই নেবেন। এতে রমানাথ ঠাকুর সস্নেহ একটি রুপোর সিকি দিয়েছিলেন তাঁকে। রমানাথ ছোটদের প্রতি বেশ স্নেহশীল ছিলেন। যাত্রার আসরে ছোটরা বসত তাঁর ঠিক পিছনে।

আভিজাত্যে ব্যতিক্রমী ছিল পাথুরিয়াঘাটার সঙ্গীতপ্রিয় মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের বাড়ির পুজো। পুজো উপলক্ষে বসত ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসর। আসতেন সে কালের বিখ্যাত শিল্পীরা। সে ধারা অবিচ্ছিন্ন ছিল মহারাজ প্রদ্যোৎকুমারের আমল পর্যন্ত। সন্ধিপুজোর সময়ে ধূপধুনোর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন প্রাসাদ প্রাঙ্গণে ধ্রুপদ গাইতেন সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রতিপদ থেকে নবমী পর্যন্ত চণ্ডীর গান হত। হত যাত্রা, থিয়েটারও। পুজোর ক’দিন রাত পর্যন্ত চলত কাঙালিভোজন। প্রতিমা বিসর্জনের সময় ছাড়া হত নীলকণ্ঠ পাখি। তেমনই দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিটে রাজা প্রফুল্লনাথ ঠাকুরের বাড়িতে পুজো হত দু’বার। বসন্তকালে বাসন্তীপুজো আর শরৎকালে দুর্গাপুজো। প্রতিমার গায়ে শোভা পেত সোনার গয়না, বেনারসি শাড়ি। ঠাকুর পরিবারের অন্যান্য বাড়িগুলিতে পুজো বন্ধ হয়ে গেলেও এখানে অতীতের প্রতিমার একটি ছবির সামনে ঘটস্থাপন করে পুজোর ধারা আজও বয়ে চলেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE