Advertisement
২৯ এপ্রিল ২০২৪
Lila Majumdar

অন্দরের মেয়েদের আঁচলেই বাঁধা আছে বিপ্লবের মুক্তি

ভদ্রমহিলা সংসার সামলেছেন বিমার চাকরি করে।  আবার রাজপথে, মিছিলে তিনিই প্রতিবাদের মুখ । আজীবন সিপিআই (এম) দলের বিশ্বস্ত সদস্য।  এ-হেন লীলা মজুমদার শুধু চারু মজুমদারের জীবনসঙ্গিনীই নন, প্রধান উৎসাহদাতাও।ভদ্রমহিলা সংসার সামলেছেন বিমার চাকরি করে।  আবার রাজপথে, মিছিলে তিনিই প্রতিবাদের মুখ । আজীবন সিপিআই (এম) দলের বিশ্বস্ত সদস্য।  এ-হেন লীলা মজুমদার শুধু চারু মজুমদারের জীবনসঙ্গিনীই নন, প্রধান উৎসাহদাতাও।

অশোককুমার মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

পঙ্কজদি। মা ওই নামেই ডাকতেন। বাবা ‘দি’ যোগ করতেন কি না মনে নেই। তবে, ক্লাস টু, বড়জোর থ্রি-তে পড়া আমিও ডাকতাম ‘পঙ্কজদি’। শুনেই ওই তামার বরন, পাড়ওয়ালা সাদা শাড়ি ভদ্রমহিলা হেসে আমার মাথার চুল এলোমেলো করে দিতেন। মোটা কালো ফ্রেমের চশমার ওপারে চোখ দুটি ঝলমল করত। বাঁ কাঁধে দুলতে থাকা কাপড়ের ঝোলা থেকে বেরোত ‘ঘরে বাইরে’, পিঠের মলাটে নানা আলপনার ছবি। মা’র হাতে তুলে দিতে-দিতে কখনও বলতেন, ‘‘পরশু মনুমেন্ট ময়দানে মিটিং, দেড়শো রুটি আর তরকারি, অবশ্য তরকারির জায়গায় গুড় হলেও চলবে...।’’ তাঁকে চেয়ারে বসতে দেখিনি কোনও দিন, জল-মিষ্টি খেলেও, দাঁড়িয়ে খেতেন। কী এক তাড়ার মধ্যে থাকতেন সারা ক্ষণ।

মা আর পিসি বানিয়ে রাখতেন রুটি-তরকারি। এক জন এসে নিয়ে যেতেন সেই খাবারের ঠোঙা। এ নিশ্চয়ই ১৯৬৩ সালের গল্প। পরে জেনেছি, ওঁর নাম পঙ্কজ আচার্য। কমিউনিস্ট। স্বামী গোপাল আচার্য। ব্যস ওইটুকুই। ভাবতে শেখার মতো লায়েক হলে কল্পনা করার চেষ্টা করেছি ওই ভদ্রমহিলার ছোটবেলা, বড়বেলা। কিসের জোরে তিনি এমন মেতে থাকতেন সারা ক্ষণ, কী করেই বা এমন নির্মল হাসতে পারতেন!

যাঁর কথায় এই পঙ্কজদির কথা মনে পড়ল, সেই ভদ্রমহিলার জন্ম ১৯২১। ডাক্তার হরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত আর বিজনবালা দেবীর পাঁচ সন্তানের দ্বিতীয় এবং একমাত্র কন্যা। নাম রাখা হয়েছিল আশালতা, পরে লীলা। লীলা এগারো বছর বয়সেই বড় হয়ে যায়। কারণ, বিজনবালা আর একটি সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা গিয়েছেন। নবজাতকও বেশি দিন বাঁচেনি। বাবা, দাদা আর তিন ভাইয়ের সংসারে লীলাই কর্ত্রী। দায়িত্ব নিতেই হবে, কারণ বাবা ঘুরে-ঘুরে ডাক্তারি করেন আর একেবারে ছোট ভাই তখন মাত্র আড়াই বছরের।

রান্নাঘর সামলানোর ফাঁকে তাঁর ম্যাট্রিক এবং আইএ পাশ। বাবার অমতে স্কুলে পড়ানোর কাজ নেওয়া। ইতিমধ্যে জলপাইগুড়িতে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সদস্য হয়ে শিখে নিয়েছেন লাঠিখেলা, ছোরাখেলা। আঠারো বছর বয়স থেকেই পরতে শুরু করেছেন পাড়ওয়ালা সাদা শাড়ি।

মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি তো কমিউনিস্ট পার্টির মহিলাদের সহোদরা। অতএব লীলা সেনগুপ্ত যে অচিরেই নিজ যোগ্যতায় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ পাবেন তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। যা আশ্চর্যের, সেই ১৯৪৪-৪৫ সালে, যখন কমিউনিস্ট পার্টির কাজ সহজ নয়, মহিলা সংগঠকদেরও মেয়েদের কাছে পৌঁছতে অনেক সংশয়-সন্দেহের কাঁটাতার পেরোতে হয়, হেঁটে হেঁটেই করতে হয় কাজ— মিল্ক ক্যান্টিন চালানোর সংগঠন, তাঁত চালানোর দল, চাঁদা তোলা, সমিতির সদস্য জোগা‌ড়, পাঠচক্রে উপস্থিতি, বাড়ি-বাড়ি প্রচার— লীলার মতো স্বল্পভাষী মেয়ে তা একদিন-প্রতিদিন করলেন কী করে! কমরেডের সাক্ষ্য, ‘লোকের সাধারণ ধারণা মেয়েরা পরচর্চাপ্রিয়... আমি লীলাদির মুখে কোনও দিন কারও কোনও দুর্বলতার কথা শুনিনি। দৃঢ়তা ছিল যার প্রধান হাতিয়ার, হার না মানার সংকল্প ছিল যার মেরুদণ্ড, সেই লীলাদি কত যে আর্থিক অনটন, কত যে প্রতিকূলতা সহ্য করেও মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি, পার্টির বিভিন্ন কাজ করে গিয়েছেন সর্বদা মুখে একটা মৃদু হাসি নিয়ে, আমি বারবারই অবাক বিস্ময়ে ভেবেছি।’

লীলা মজুমদার এবং চারু মজুমদার

হরেন্দ্রনাথের চাকরির সুবাদে লীলাকেও উত্তরবঙ্গের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হত। ১৯৪৬-এর সূচনায় হরেন্দ্রনাথ মারা গেলে, দাদা আর ভাই-সহ লীলা আসেন জলপাইগুড়ি। ইতিমধ্যে দাদার বিবাহ সম্পন্ন, সেজো ভাই ফুসফুসের অসুখে মৃত।

জলপাইগুড়িতে এসে লীলার প্রাণশক্তি তুঙ্গে। শিশুমহল নামে একটি প্রাইমারি স্কুলে পড়ানো শুরু। পাশাপাশি চলছে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি ও কমিউনিস্ট পার্টির কাজ। সমিতির মুখপত্র ‘ঘরে বাইরে’-র (যা মেয়েরাই চালায়, মেয়েরাই লেখে, মেয়েরাই বিজ্ঞাপন আনে, টাকার অভাব হলে শো করে টাকা তোলে) প্রচার বাড়ানোয় মন দেন লীলা।

১৯৪৬-এর শেষ দিকে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কিষাণ সভার ডাকে গ্রামে গ্রামে তেভাগার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। উৎপন্ন ফসলের দুই-তৃতীয়াংশের ভাগ চাই ভাগচাষিদের— অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে এর পক্ষে প্রচার চালান লীলাও।

১৯৪৮-এ পার্টি নিষিদ্ধ হল, মহিলা আত্মরক্ষা সমিতিও। লীলা প্রথম বারের জন্য গ্রেফতার হলেন। মুক্তির পর স্কুলের চাকরি আর করার উপায় নেই, বিমা কোম্পানির সাধারণ চাকরি জুটল। এই-ই তাঁর আয়ের উৎস, যত দিন সক্ষম ছিলেন, এই কাজও মন দিয়ে করেছেন লীলা। ‘টার্গেট’ পূরণ করেছেন প্রতি বার। নেননি দুর্নীতির, চালাকির গলিপথ, ন্যায়সঙ্গত দাবির পক্ষে দাঁড়িয়েছেন।

১৯৫০-এ আবার কারাগারে। জেলে রাজবন্দির মর্যাদার জন্য, অন্য কমরেডদের সঙ্গে অনশন আন্দোলন শুরু হল। লীলা নিলেন নির্জলা অনশনের রাস্তা। তিনিই একমাত্র মহিলা বন্দি।

তেভাগা আন্দোলনের সময় আলাপ হয়েছিল যে যুবকটির সঙ্গে, ১৯৫২-তে বিয়ে করলেন তাঁকে। ছেলেটির নাম চারু মজুমদার।

বিয়ের পর শিলিগুড়িতে দেখা গেল একের মধ্যে বহু লীলাকে। সংসার সামলে, শ্বশুর বীরেশ্বর মজুমদারকে বলেকয়ে পার্টির কাজে বেরোন। তরাই শ্রমিকদের চাঁদায় কেনা পার্টির গাড়িতে মিটিঙে চলেছেন সবাই, সুভাষ মুখোপাধ্যায় সাক্ষ্য দিচ্ছেন, ‘একবার করে শব্দ হয় ‘হৈ’ আর জীপটা অমনি থেমে পড়ে। কখনও একজন, কখনও দুজন করে লোক ওঠে। কারো হাতে হাট থেকে শস্তায় কেনা বোয়াল মাছ; কারো হাতে ধুলোসুদ্ধু শাকডাঁটা; কেউ নেশা করেছে, মুখে ভকভক করছে গন্ধ। যার যার বাড়ির কাছে এসে লোকে নেমে পড়ছে। কিন্তু আবার উঠছেও তেমনি। কেউ সাঁওতাল, কেউ ওরাঁও, কেউ মুণ্ডা, কেউ কোল। ছত্রিশ জাতের লোক। চা-বাগানের কুলি। গাড়ির মধ্যেটা সারাক্ষণ ঠাসাঠাসি হয়ে আছে। থামলে, মদ, মাছ আর গায়ের দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে। চললে দমকা হাওয়ায় তবু কিছুটা সোয়াস্তি... কোলে মেয়ে নিয়ে এককোণে বসে থাকা বন্ধুর স্ত্রীর দিকে তাকালাম। কোন ভাবান্তর নেই। ভিড়ের মধ্যে দিব্যি সহজ নির্বিকার হয়ে বসে আছেন...’ এই ‘বন্ধুর স্ত্রী’ই লীলা মজুমদার। বিয়ের পরেও তিনি পার্টির কাজে আগের মতোই সহজ। গাছকোমর করে বাঁধা, পাড়ওয়ালা সাদা শাড়ির মহিলা কর্মী অনায়াস ক্ষিপ্রতায় মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশে ছুড়ে দিতেন তেভাগা আন্দোলনের মিছিলে, সেই আবেগ চা-বাগান আন্দোলনেও অটুট। বরং কাজের পরিধি বেড়েছে।

সংসারের কাজও অনেক। মজুমদারদের যে অল্প কিছু জমি ছিল, তাতে আধিয়াররা চাষ করত। বছরের ধান ওঠালে তার কিছু তারা দিয়ে যেত লীলার কাছে। তাতে সংসার চলে না। ‘আমাদের বাড়ির উঠোনে গোবর লেপে মা ধান সেদ্ধ করে পা দিয়ে মেলে দিচ্ছেন’, সে ছবি বেশ মনে আছে বড় মেয়ে অনিতার। পরবর্তী সময়ে, আধিয়াররা এক বার এসে বলল, ‘‘মা, আমরা তো আর জমিতে চাষ করতে পারছি না। পাশের জমির জোতদার জুলুম চালাচ্ছে।’’ লীলা জানতে চাইলেন, তাকে কী করতে হবে। ‘‘আমাদের নামে জমি লিখে দাও। আমরাও অল্প কিছু টাকা দিচ্ছি, তুমি বাকিটা দিয়ে খাজনা শোধ করে রেজিস্ট্রি করে দাও।’’ লীলা তা-ই করলেন। কোনও হইচই নয়, কোনও প্রচার নয়, তিনি নীরবে যে কাজটি করলেন, তা করতে অনেক আলোকিত কমিউনিস্টও ভিরমি খাবেন।

প্রথম দিকে লীলাকে নিয়ে আপত্তি থাকলেও, পরবর্তী সময়ে তাঁর উপর নির্ভরতা বেড়ে গেল বীরেশ্বর মজুমদারের। দেখা গেল, লীলাকে ‘মা’ বলে ডাকতে শুরু করেছেন তিনি।

পক্ষাঘাত এবং প্রস্টেট জনিত শল্য চিকিৎসায় শয্যাশায়ী মানুষটিকে কেমন ভাবে সেবা করতেন লীলা? বড় মেয়ে অনিতা বলছেন, ‘‘সকালবেলায় উঠে প্রথমে দাদুর বেডপ্যান নিয়ে সেটা পরিষ্কার করতেন। তার পর দাদুর বিছানা চেঞ্জ করতেন এবং সেগুলি কেচে, স্নান করে রান্নাঘরে ঢুকতেন। তাঁর কোলে তখন আড়াই বছরের অভি...’’

এ সেই সময়কার কথা, যখন লীলা এবং চারুর তিন সন্তান— অনিতা, মধুমিতা আর অভিজিৎ। এর মধ্যেই লীলা সাংসারিক সব কাজ নিজ সামর্থ্যে চুকিয়ে, চা-বাগানে ঘুরে-ঘুরে সংগঠনের কাজ করছেন, পার্টির মহিলা ফ্রন্টের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, দার্জিলিং জেলা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়েছেন। এত কিছুর মধ্যে চলেছে পরিবারের অন্ন জোগাড়ের কাজ— জীবনবিমা করানো। এই অতিমানবিক চারিত্রবৈশিষ্ট্যের জন্যই চারু মজুমদারের চিরবন্ধু, চির নির্ভরতা— লীলা।

সরকার ঠিক করেছে, রাজনৈতিক কারণে জেলবন্দিদের পরিবারকে ভাতা দেওয়া হবে। নিয়মমতো টাকা গেল চারুর মহানন্দা পাড়ার টিনের চালওয়ালা কাঠের বাড়িতে। তার পর? সেই ১৯৬৩ সালে লীলার উদ্দেশে জেল থেকে লিখছেন চারু মজুমদার: ‘তুমি family allowance এর টাকা ফেরৎ দিয়ে ভাল কাজই করেছ। ও টাকা নেওয়ার কোনও অর্থ হয় না। সরকারের family allowance এর ব্যাপারে কোনও নীতি আছে বলে মনে হচ্ছে না...’

অথচ মহানন্দা পাড়ার বাড়িতে তখন চরম দারিদ্র। একই ঘটনা ঘটল দু’বছর পরে আবারও। তখনও চারু কারাগারে। আবারও সেই ‘ভাতা’র প্রশ্ন। আবারও লীলাকে লেখা চারুর চিঠি: ‘family allowance বাবদ ১১৫ টা. দেবে 19.9.65 থেকে। কোনও উত্তর দিই নি দিতেও পারব না। তোমরা যা বিবেচনা হয় কোর।.....আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে তোমাদের স্বপ্ন দেখি। তোমাদের ওখানে annular eclipse দেখা গিয়েছে।’

এই কয়েকটি উচ্চারণই তো দুজনের সম্পর্কের সব কিছু হাট করে দেয়। জেলের মধ্যে যখন খুব অসুস্থ, কর্তৃপক্ষও ভয় পেয়ে গিয়েছে, দরকার পড়লে কী করে হুট করে অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা হবে সেই নিয়ে, চারু তখন নিশ্চিন্ত গলায় বলেছেন, ‘‘আমার স্ত্রীকে খবর দিন, উনি আমাকে নিয়ে গিয়ে সব ব্যবস্থা করে দেবেন।’’

১৯৬৬-৬৭ সালে চারু যখন নতুন রকম ভাবনাচিন্তা শুরু করেছেন, লীলা ছিলেন তাঁর প্রধান উৎসাহদাতা। মানুষ চিনতে লীলার জুড়ি নেই। এ-কথা মানতেই হয় চারুকে। অনেক তথাকথিত কমিউনিস্ট বাড়িতেই দেখা যায়, পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা চলছে। মহানন্দা পাড়ার বাড়িতে তেমনটা ছিল না কখনওই। মজুমদার দম্পতির সম্পর্কটি দাঁড়িয়ে ছিল পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের নিখাদ
শক্ত জমিতে। সেখানে কোনও ভেজাল নেই। একাধিক প্রতিবেশীর সাক্ষ্য পাওয়া যাবে এই কথার সমর্থনে। পাড়ায় তাদের ‘চারুদা’ যেমন, ‘লীলাদি’ও তেমনই প্রিয়জন।

চারুর মতো তার সন্তানদেরও অগাধ ভরসার জায়গা লীলা। মা যেন সবাইকে আগলে রেখেছিলেন দুর্গের মতো, এমনই অনুভব তাঁদের।

তাঁর স্নেহ-মমতার পরিচয় পেয়েছেন ‘আত্মগোপনকারী’ নিমাই ঘোষ। তিনি বলেছেন, ‘‘কমরেডরা আত্মগোপন করে গোপনে চারুদার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন, লীলাদি জানতেন কতটা সতর্ক থাকা দরকার। সে সব বিষয়ে লক্ষ রেখেও কোন কমরেড কী খেতে ভালোবাসেন, তাদের জন্য সেই পদ তৈরি করতেন।’’

এক বার ধুম জ্বর নিয়ে নিমাইবাবু ছিলেন মজুমদার বাড়িতে। ‘ঘুমের মধ্যেই আমার মুখ দিয়ে কোনও গোঙানির শব্দ লীলাদির কানে গিয়েছিল। হঠাৎ মনে হল কে যেন আমার মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। ঘোরের ভিতর ভাবলাম মা বোধহয়।...আমার তখন তন্দ্রা ভেঙে গেছে। চোখ খুলে দেখি লীলাদি আর চারুদা (চারুর শরীরও সে সময় বেশ খারাপ)। আমি উঠে বসতে যাচ্ছিলাম। লীলাদি বললেন, উঠো না, আমি ওষুধ দিচ্ছি। সেদিন প্রায় অনেক রাত পর্যন্ত লীলাদি আমার মাথার গোড়ায় বসেছিলেন। সেদিনের সেই স্মৃতি আজও আমার মনকে নাড়া দেয়।... চারুদা এক বুক স্বপ্ন নিয়ে, ওই অসুস্থ অবস্থাতে, কোন মানসিক দৃঢ়তার সঙ্গে মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে, সারা ভারতবর্ষকে নতুন পথের দিশা দেখাবার প্রয়াসে সচেষ্ট হয়েছিলেন! লীলাদির মতো সাথী পাশে থাকলেই তা সম্ভব।’

স্নেহময়ী লীলা প্রয়োজনে কড়া হতেও জানতেন। ছত্রিশ রকম কাজের মধ্যে একটি বড় দায়িত্ব ছিল শিলিগুড়ির শিশু বিদ্যাপীঠের সম্পাদকের দায়ভার পালন। সেখানে শিক্ষিকাদের আচরণে প্রয়োজনে কঠোর হয়েছেন, বলেছেন: ‘‘এমন ভাবে কাজ করবি না যাতে তোদের নামে আমাকে নালিশ শুনতে হয়!’’

এমনই দাপট বাড়িতেও। ‘‘কোনও খাতা কিনতে হলে মাকে শুক্রবার বলতে হত, তবে মা সোমবারের মধ্যে সেটা কেনার ব্যবস্থা করতেন।
এর অন্যথা হলে বকাবকি শুনতে হত। তখন সংসারে খুবই অনটন,’’ অনিতা জানিয়েছেন। যেই কানে এল তাঁর ননদের (চারুর একমাত্র বোন বেলা) ছেলের নানা স্খলনের খবর, লীলা তাকে জোর করে নিয়ে এলেন মহানন্দা পাড়ার বাড়িতে। জুড়ে দিলেন ইনশিয়োরেন্স কোম্পানির নানা কাজে। সে ছেলে সোজা পথে এল। এমনই সহৃদয় আন্তরিকতায় যুক্ত ছিলেন প্রতিবেশীদের সঙ্গেও। চারু মজুমদারের মৃত্যুর পর নিজস্ব একান্ত শোক গোপন করে, শোকবিহ্বল সন্তানদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। যত দিন না তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে, অবলম্বন দিয়েছেন তাদের।

চারু মজুমদারের রাজনীতি নিয়ে কোনও বাক্য উচ্চারণ করেননি কোনও দিন পরবর্তী সময়ে। এমনকী ঘরোয়া হালকা আলোচনাতেও নয়। সব কিছুই কি তাঁর পছন্দ ছিল? তাও জানার উপায় নেই। তবে তিনটি ঘটনা মনে রাখবার। হরেকৃষ্ণ কোঙার যখন জনসভায় নকশালবাড়ি আন্দোলনের নিন্দেমন্দ করছেন, কিশোরী অনিতাকে নিয়ে সভা ত্যাগ করেন লীলা। সত্তরে যখনই সশস্ত্র পুলিশ বাড়িতে তল্লাশিতে এসেছে, সমস্ত অস্ত্র সদর দরজায় মাটিতে রাখলে, তবেই ঘরে ঢুকতে দিয়েছেন তাদের। আবার গুনে গুনে প্রতিটি অস্ত্র ফেরত নেওয়ার পর তবে তাদের রেহাই। ঘরের মধ্যে অকস্মাৎ ‘অস্ত্র আবিষ্কার’ বন্ধ করতে এ তাঁর চমৎকার প্রতিরোধ।

আবার ১৯৭১-এ যখন তাঁর বাবার কমরেড সৌরেন বসু অনিতাকে বলছেন, পরীক্ষা বয়কট করো, লীলা মেয়েকে বলছেন, পরীক্ষা দাও। তাঁর মতামত স্পষ্ট, চিন্তা স্বাধীন। এরই পাশাপাশি তাঁর লেটারপ্যাডে নিজের নামের তলায় লেখা: কেয়ার অব লেট চারু মজুমদার! অথচ, কেউ তাঁকে বৌদি বলে ডাকেনি। হয় ‘লীলা’, নয় ‘লীলাদি’!

পঙ্কজদির জীবনকাহিনি জানার ইচ্ছে হত মাঝে মাঝে। এখন লীলা মজুমদারের কথা জানার পর, তা পূর্ণ হয়েছে। নিশ্চয়ই এমনই কিছু হবে তা। কলকাতার রাস্তায় ২৭ এপ্রিল ১৯৪৯ শহিদ হওয়া লতিকা, প্রতিভা, অমিয়া, গীতা কিংবা ‘স্তালিন-নন্দিনী’ ইলা মিত্র এবং লীলা— এঁরা সবাই একই গোত্রের। এমনকী এই ক’দিন আগে পদ্মশ্রী পেলেন যিনি, সেই সুবাসিনী মিস্ত্রি, তিনিও— খাতায়-কলমে কমিউনিস্ট হোন চাই নাই হোন— এই রকমই এক মানবী।

ঘরে ঘরে অন্দরে এঁরা আছেন। খুঁজে দেখতে হবে শুধু। অন্দরের দিকে ফিরে তাকিয়ে, এই সব শক্তিরূপিণীদের খুঁজে বার করলে দেখা যাবে, এক ফুঁয়ে উড়ে যাচ্ছে নারী নির্যাতন আর অবমাননার সব মুখ কালো করা খবর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE