Advertisement
১৪ জুন ২০২৪

মাটির পাত্রে অজানা লিপি

অপরিচিত লিপি, অজানা তার ভাষাও। তবু বহু বছরের পরিশ্রম ও চেষ্টায় তা পাঠোদ্ধার করলেন এক তরুণ। অপরিচিত লিপি, অজানা তার ভাষাও। তবু বহু বছরের পরিশ্রম ও চেষ্টায় তা পাঠোদ্ধার করলেন এক তরুণ।

মাইকেল ভেনট্রিস।

মাইকেল ভেনট্রিস।

সুনন্দনকুমার সেন
শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৮ ০৮:৫০
Share: Save:

মানুষের লেখার ইতিহাস আনুমানিক দশ হাজার বছরের। পৃথিবীর অধিকাংশ ভাষাই ব্যবহার করে অক্ষরলিপি, সাধারণ অর্থে যাকে বলি বর্ণমালা। সীমিত সংখ্যক বর্ণের সাহায্যেই যে কোনও জিনিস লিখে ফেলা যায়। বাংলা বর্ণমালায় ৫০টি বর্ণ; ইংরেজি যে বর্ণমালার সাহায্যে লেখা হয়, সেই রোমক বর্ণমালায় ছোট বড় হরফ মিলিয়ে আছে ৫২টি বর্ণ।

আমরা যখন আমাদের পরিচিত ভাষায় পরিচিত লিপিতে লেখা দেখি, তখন আমাদের লক্ষ থাকে লেখার বিষয়ের প্রতি। কী ভাবে লেখা হয়েছে, অর্থাৎ লিপির সূক্ষ্ম বৈচিত্রের দিকে বড় একটা নজর দিই না। যখন কোনও অপরিচিত লিপি দেখি, সেই লিপি পড়তে পারি না। লেখাটি তখন আমাদের কাছে অনেকটা সাংকেতিক। যেমন হরপ্পা লিপি। গত একশো বছর ধরে বহু চেষ্টা সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে পাঠোদ্ধার করা যায়নি। আবার অনেক সময় আসে অভাবনীয় সাফল্য। উদ্ধার হয় পাথর বা অন্য বস্তুতে খোদাই করা সংকেতের অর্থ। আত্মপ্রকাশ করে অনেক অজানা ইতিহাস।

এই গোয়েন্দাগিরি সহজ নয়। গল্প, উপন্যাসের গোয়েন্দাদের মতো সাত-দশ দিনের মধ্যে সংকেতের অর্থ প্রকাশ পায় না। বছরের পর বছর লেগে থাকার পর হয়তো সাফল্য আসে। বিশেষ করে যদি সংকেতটি জটিলতম হয়। অর্থাৎ শুধু লিপিটাই অজানা তা নয়, ভাষাটাও অজানা। তবু শুধুমাত্র অনুসন্ধিৎসু মনের সাহায্যে এক জটিল লিপির মর্মোদ্ধার করেছিলেন মাইকেল ভেনট্রিস।

উনিশ শতকের শেষ দিকে ও বিশ শতকের গোড়ায় জার্মান পুরাতাত্ত্বিক হাইনরিখ স্লিম্যান ও ইংরেজ পুরাতাত্ত্বিক স্যর আর্থার ইভান্স-এর খননকার্যের ফলে ভূমধ্যসাগরের ক্রিট দ্বীপ ও সংলগ্ন অঞ্চলে বহু পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়। তাতে জানা যায়, ব্রোঞ্জ যুগে গ্রিসে ইজিয়ান সভ্যতা নামে এক সুপ্রাচীন সভ্যতা ছিল। ট্রয়, কনোসা, ক্রিট, পাইলস প্রভৃতি অঞ্চলে খননকার্যের ফলে জানা যায়, ব্রোঞ্জ যুগের অন্তিমপর্বে মাইসেনীয় নামে এক বিশাল সাম্রাজ্য ছিল। মাইসেনীয় রাজারা এক বিশেষ লিপি ব্যবহার করতেন মৃৎপাত্রের গায়ে নিজেদের বিভিন্ন বিষয় লিপিবদ্ধ করতে। হোমারের অন্তত ৬০০ বছর আগে গ্রিসে এই লিপি বহুল প্রচলিত ছিল। গ্রিক অক্ষরলিপির থেকে এটা পুরো আলাদা। আর্থার ইভান্স মনে করেছিলেন যে প্রাচীন গ্রিসে এত বড় ও উন্নত সাম্রাজ্য যখন ছিল তখন সেই সময় নিশ্চিতভাবে লেখার প্রচলন ছিল। ইভান্স পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে এই নতুন লিপির সন্ধান পেয়েছিলেন। লিপিটির নামকরণ হয় ‘লিনিয়ার বি’ লিপি।

‘লিনিয়ার বি’ ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত এক লিপি। যে ভাষাটির জন্য এই লিপি ব্যবহৃত হয়েছিল সেটিও সম্পূর্ণ অজানা, অপরিচিত এক ভাষা। এই রকম লিপির পাঠোদ্ধার অত্যন্ত দুরূহ কাজ। মাইকেল ভেনট্রিস ছিলেন পেশায় স্থপতি, কিন্তু পুরাতত্ত্ব, লিপিতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্বে তাঁর প্রবল অনুরাগ। ধ্রুপদী ভাষা শেখাতেও খুব আগ্রহ। ধ্রুপদী গ্রিক, ল্যাটিন, জার্মান, ফরাসি, রাশিয়ান এমনকি ইজিপ্সিয়ান হিয়ারোগ্লিফিকেও দক্ষতা ছিল তাঁর।

১৮ বছর বয়স থেকেই ভেনট্রিস ‘লিনিয়ার বি’ লিপির প্রতি আকৃষ্ট হন। তখনও পর্যন্ত কেউ তা পাঠোদ্ধার করতে পারেননি। এই লিপির সঙ্গে ‘এট্রুস্কান’ ভাষার সম্পর্ক আছে, এই অনুমানের উপর নির্ভর করে ভেনট্রিস লিপির পাঠোদ্ধারের চেষ্টা করেন। এট্রুস্কান আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকের ইতালির এক প্রাচীন সভ্যতা, যা গ্রিক সভ্যতার দ্বারা অত্যন্ত প্রভাবিত ছিল। ভেনট্রিস বুঝতে পারেন ‘লিনিয়ার বি’ লিপিটির ভাষা এট্রুস্কান নয়। গভীর মনোযোগের সঙ্গে দিনের পর দিন লিপির নিদর্শনগুলি বিশ্লেষণ করে তাঁর মনে হয়, ‘লিনিয়ার বি’ লিপি যে ভাষাটির জন্য ব্যবহৃত হত সেটি খুব সম্ভবত ল্যাটিনের মতো একটি বিভক্তি-নির্ভর ভাষা। ল্যাটিন বা সংস্কৃতে শব্দরূপের শেষে যেমন বিভক্তিগুলি ঘন ঘন পাল্টে যায়, এই ভাষাতেও সম্ভবত তা-ই হয়। এই অনুমানের উপর নির্ভর করে ভেনট্রিস প্রতিটি ছবি ও চিহ্নের জন্য একটি নির্দিষ্ট স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনি চিহ্নিত করতে শুরু করেন। এই ভাবে প্রাথমিক পর্বে স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনির একটি অনুমাননির্ভর তালিকা তৈরি করেন। ক্রমশ প্রকাশ পায়, ‘লিনিয়ার বি’ ভাবলিপি ও দললিপির (সিলেবিক স্ক্রিপ্ট) মিশ্রণ; লিপিটি লেখা হত বাঁ দিক থেকে ডান দিকে।

আবিষ্কার: ‘লিনিয়ার বি’ লিপি।

ভেনট্রিসের সাফল্য এল কিছুটা আকস্মিক ভাবে। ১৯৩০-এর দশকে কার্ল ব্লেগ্যান নামে এক মার্কিন পুরাতাত্ত্বিক পাইলস নামে মূল গ্রিক ভূখণ্ডের একটি শহরে খননকার্যের ফলে প্রায় ছ’শোটি পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কার করেন, যেগুলি ‘লিনিয়ার বি’ লিপিতে লেখা। পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় এই আবিষ্কারের কথা গবেষক মহলে বিশেষ পৌঁছতে পারেনি।

ভেনট্রিসের হাতে এই নতুন তথ্য এলে তিনি তা বিশ্লেষণ করে দেখলেন, এই নব-আবিষ্কৃত মৃৎপাত্রগুলিতে এমন কিছু নতুন চিহ্ন ও ছবি আছে যা স্লিম্যান ও ইভ্যান্সের আবিষ্কৃত নিদর্শনগুলিতে ছিল না। ভেনট্রিস অনুমান করলেন, এই ছবিগুলি সম্ভবত কোনও স্থান-নামকে নির্দেশ করে। সেই কারণে ছবিগুলি পূর্ব-আবিষ্কৃত নিদর্শনে অনুপস্থিত। তাঁর এই অনুমান ছিল অব্যর্থ, এবং সত্য।

ইতিমধ্যেই প্রস্তুত স্বর ও ব্যঞ্জনের তালিকা। এর সাহায্যে ব্লেগ্যানের আবিষ্কৃত নিদর্শনগুলির স্থান-নাম সঠিক ভাবে পাঠোদ্ধারে সক্ষম হলেন ভেনট্রিস। দীর্ঘ ১২ বছরের চেষ্টায় ১৯৫২ সালে খুলল ‘লিনিয়ার বি’ লিপির বন্ধ দরজা। বোঝা গেল, এই লিপিটি যে ভাষার জন্য ব্যবহার করা হত তা গ্রিক ভাষার এক প্রাচীনতম রূপ—‘মাইসেনীয় গ্রিক’। কোনও দোভাষী নিদর্শনের সাহায্য ছাড়াই, সম্পূর্ণ অনুমানের উপর নির্ভর করে পাঠোদ্ধার হল একটি অজানা লিপি ও ভাষা। ১ জুলাই ১৯৫২ ভেনট্রিস এই পাঠোদ্ধারের কথা জানান বিবিসির মাধ্যমে। পরের চার বছর জন চ্যাডউইক-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে সম্পাদনা করেন মাইসেনীয় গ্রিকের উপর একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ। দুর্ভাগ্য, এই বই প্রকাশের অল্প দিনের মধ্যেই এক পথ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ভেনট্রিস। বয়স তখন মাত্র ৩৪।

ছবি: গেটি ইমেজেস

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE