Advertisement
১১ মে ২০২৪

পৃথার বাড়ি

ক্লাস সিক্সের পৃথা পড়েছে মহাবিপদে। পৃথার কাকুমণি থাকেন লস এঞ্জেলেসে। চার বছর পর বাড়িতে এসেছেন। তাই বাড়িতে এখন খুশির হাওয়া। কিন্তু কাল রাতে খাবার টেবিলে কাকুমণি হঠাৎ বললেন, পৃথা তোর কোনও বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলি না তো? তুই ওদের এক দিন বাড়িতে ডাক। পৃথা বলল, ওরা কী করে আসবে! আমরা থাকি বাগবাজারে। স্কুল পার্ক স্ট্রিটে। বন্ধুরা বেশ দূরে দূরেই থাকে।

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

মধুমিতা ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

ক্লাস সিক্সের পৃথা পড়েছে মহাবিপদে। পৃথার কাকুমণি থাকেন লস এঞ্জেলেসে। চার বছর পর বাড়িতে এসেছেন। তাই বাড়িতে এখন খুশির হাওয়া। কিন্তু কাল রাতে খাবার টেবিলে কাকুমণি হঠাৎ বললেন, পৃথা তোর কোনও বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলি না তো? তুই ওদের এক দিন বাড়িতে ডাক।
পৃথা বলল, ওরা কী করে আসবে! আমরা থাকি বাগবাজারে। স্কুল পার্ক স্ট্রিটে। বন্ধুরা বেশ দূরে দূরেই থাকে।
কাকুমণি বললেন, আরে ওরা একা আসবে কেন? সঙ্গে ওদের বাবা-মাকেও ডাক। আচ্ছা তোকে কিছু করতে হবে না। কাল স্কুলে গিয়ে ওদের মা বা বাবার ফোন নম্বরটা নিয়ে আসিস। বউদি বরং ওদের ফোন করে দেবে।
পৃথার মা অপর্ণাদেবী বললেন, ছোট্দা, মুশকিল হচ্ছে যে পৃথা এই বাড়িতে ওর বন্ধুদের ডাকতে চায় না।
কাকুমণি চোখ সরু করে বললেন, মানে? এই বাড়ির আবার কী দোষ হল?
অপর্ণাদেবী মুখ টিপে হেসে বললেন, পৃথা বলে এ বাড়িটা বড্ড পুরনো। ওর বন্ধুদের সবার ঝকঝকে ফ্ল্যাট। না হলে আধুনিক বাড়ি। তাই এ রকম সেকেলে বাড়ি দেখে সবাই নাকি ভিন্টেজ হাউস বলবে। সে জন্যই তো পৃথা ওর বার্থ ডেতে কাউকে ডাকে না।
কথাটা শুনে কাকুমণি হেসে উঠলেন। তার পর পৃথার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ও এই কথা, আচ্ছা এখন তো তুই বড় হয়েছিস। অনেক কিছুই বুঝিস। পুরনো হয়ে গেলে বুঝি সব বাতিল হয়ে যায়? তা হলে তো তোর দিদাও বাতিল। তোর মা-বাবা, আমিও তো ক’বছর পরে পুরনো হয়ে যাব। তখন কি আমাদের নিয়ে তুই লজ্জায় পড়বি?

পৃথা কাকুমণির কথার মাঝেই কিছু বলার চেষ্টা করল। কিন্তু গুছিয়ে বলতে পারল না। ওরা এসে এত উঁচু খাট দেখে বা বড় কাঠের আলমারিটা দেখে নিশ্চয় বলবে, খাটে কি সিঁড়ি দিয়ে উঠিস? আর আলমারিটা তো ছোট জাহাজ রে!

অথচ মেঘনা, প্রেয়সী, সৈমন্তীর বার্থ ডেতে পৃথা ওর মায়ের সঙ্গে গেছিল। কী সুন্দর সাজানো-গোছানো ফ্ল্যাট। সুদক্ষিণাদের সল্ট লেকের বাড়িটা ছোট হলেও ছিমছাম। পৃথাদের মতো মোটা দেওয়াওলা বাড়ি নয়।

কিন্তু কাকুমণিকে তো এ সব কিছু বলা যায় না। অথচ বন্ধুদের আসাটা কেমন করে আটকানো যায় তাই পৃথার বুদ্ধিতে কুলোচ্ছে না। সে জন্যই পৃথা পড়েছে মহাবিপদে।

যথারীতি অপর্ণাদেবী সামনের রবিবার বিকেলে প্রত্যেককে নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন। চোদ্দো জন মতো আসবে।

রবিবার সকাল থেকে কাকুমণি ঘর গুছোতে লেগে পড়েছেন। পৃথাকেও কাজে লাগিয়েছেন। বলছেন, দাঁড়া তোর বন্ধুদের একটু চমকে দিতে হবে। বাগবাজারের সাবেকি বাড়ি আমাদের। অতএব সব কিছুতেই সাবেকিয়ানার ছাপ রাখব, বুঝলি?

পৃথা কিছু না বুঝেই ঘাড় নাড়ল। বসার ঘরে ঢাউস ঢাউস সোফা আছে। পৃথা শুনেছে, পৃথার দাদুর বাবার ছিল এই সোফাগুলো। বাবা শুধু গদিটা বদলেছেন। আর পালিশ করিয়েছেন।

কাকুমণি চিলেকোঠার ঘর থেকে ছোট ছোট কয়েকটা তাকিয়া বার করলেন। সেগুলো সোফার ওপর সুন্দর করে সাজিয়ে রাখলেন। বাসনের একটা বড় ট্রাঙ্ক আছে। সেই ট্রাঙ্ক খুলে কাকুমণি পাথরের ছোট ছোট ডিশ বার করলেন। পৃথা এগুলো কোনও দিন দেখেইনি। লোক জন এলে তো বোনচায়নার ডিশেই খাবারদাবার দেওয়া হয়। তাই পাথরের এই ডিশগুলো যে কী কাজে লাগবে তা পৃথার মাথায় ঢুকল না। রান্নাবান্নাও কাকুমণির তদারকিতেই হচ্ছে।

বিকেলে সবাই একে একে আসতে থাকলেন। সবাইকে নীচের বসার ঘরে বসানো হল। মেঘনার বাবা বললেন, এত বড় ড্রয়িং রুম, এ তো আমার ফ্ল্যাটের অর্ধেকটা! প্রেয়সীর মা বললেন, এত জন গেলে আমাদের ফ্ল্যাটে কোনও ঘরেই তো বসাতে পারব না।

সৈমন্তীর মা হেসে বললেন, আমরা তো ঘরে থাকি না। বলুন পায়রা খোপে থাকি। এত বড় সোফা রাখব ভাবতেই পারি না।

শিবানীমাসিকে সঙ্গে পৃথার মা বড় ট্রে নিয়ে ঢুকলেন। গ্লাসে কোল্ড ড্রিংকস নেই, সেটা পৃথা বুঝল। প্রত্যেকেই শরবতে তৃপ্তির চুমুক দিলেন। পৃথা বুঝল এ দিদার গন্ধ লেবুর শরবত। মশলা-নুন আর চিনি দিয়ে দিদা বানান।

সুদক্ষিণার বাবা বললেন, দেখুন ঘরটায় এসি নেই। অথচ কী ঠান্ডা। হবে না, এত মোটা গাঁথনি। কী উঁচু ছাদ। ভাবা যায়!

দোতলায় এসেও ওঁরা অবাক। আগেকার ফার্নিচার যে কত মজবুত আর কাজের, সে আলোচনাই সবাই করছিলেন। খাবারের মেনুতেও ছিল লুচি, বেগুনভাজা, কুমড়োর ছক্কা, ছোলার ডাল আর মাংস। সবার শেষে পাথরের রেকাবিতে মালপোয়া। আয়োজন দেখে প্রত্যেকেই মুগ্ধ।

পৃথাও ওর বন্ধুদের ভ্যাবাচাকা খাওয়া মুখ দেখে মনে মনে খুব মজা পাচ্ছে। সুদক্ষিণা তো বলেই ফেলল, পৃথা তুই কী লাকি রে। এমন একটা বাড়িতে থাকতে পারছিস। কত স্পেস। সিম্পলি ভাবা যায় না।

ওঁরা যাবার আগে বলে গেলেন, বুঝতে পেরেছি পৃথা সারপ্রাইজ দেবে বলেই এত দিন ডাকেনি। ঠিক আছে, এ বার বাড়িটা চিনে ফেলেছি যখন, তখন কিন্তু মাঝে মধ্যেই এসে বিরক্ত করব। পৃথার বাড়ির সবাই একসঙ্গে ঘাড় নেড়ে বললেন, অবশ্যই। তা হলে আমরাও খুব আনন্দ পাব।

রাতে ঘুমোতে যাবার আগে কাকুমণি পৃথার গাল টিপে বললেন, কী বুঝলি? পুরনো মানেই কিন্তু সব কিছু বাতিলের খাতায় চলে যায় না।

পৃথা লাজুক হেসে ঘাড় নাড়ল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Madhumita Ghosh story school friend
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE