Advertisement
E-Paper

মাইহার ব্যান্ড

বাবা আলাউদ্দিন খাঁ তৈরি করেছিলেন ভারতীয় ধ্রুপদী যন্ত্রসংগীতের ব্যান্ড। এখনও বেজে চলেছে।মা ইহারের নবাববাড়ির পুরনো অংশের ভাঙা পাঁচিলের পাশের মাটির রাস্তা দিয়ে একটু এগিয়ে ডান দিকে ঘুরলে, বিজয় দেব সিংহের হাফ কাঁচা-পাকা বাড়ি। চারি দিকে ছড়িয়ে থাকা গোবর-ঘুঁটে-খড়কুটোর স্তূপ পেরিয়ে বাড়ির কাছে এলে মনে হয়, কোনও গোয়ালঘরে এসেছি। দুটো গরু দু’দিকে বাঁধা— একটা সাদা, একটা কালো। সাদা গরুটিকে ওই বিকেলবেলা গা ধোয়াচ্ছিলেন বিজয়।

জয়দীপ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৬ ০০:০৩
১৯৮৪ সালে কলকাতার কালীঘাট মন্দিরে মাইহার ব্যান্ড। ছবি: তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়

১৯৮৪ সালে কলকাতার কালীঘাট মন্দিরে মাইহার ব্যান্ড। ছবি: তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়

মা ইহারের নবাববাড়ির পুরনো অংশের ভাঙা পাঁচিলের পাশের মাটির রাস্তা দিয়ে একটু এগিয়ে ডান দিকে ঘুরলে, বিজয় দেব সিংহের হাফ কাঁচা-পাকা বাড়ি। চারি দিকে ছড়িয়ে থাকা গোবর-ঘুঁটে-খড়কুটোর স্তূপ পেরিয়ে বাড়ির কাছে এলে মনে হয়, কোনও গোয়ালঘরে এসেছি। দুটো গরু দু’দিকে বাঁধা— একটা সাদা, একটা কালো। সাদা গরুটিকে ওই বিকেলবেলা গা ধোয়াচ্ছিলেন বিজয়। হাফহাতা তেলচিটে গেঞ্জি আর লুঙ্গি। আমাদের দেখে একগাল হেসে জানালেন, কালো গরুটা দিন কয়েক আগে সাতনার মেলা থেকে কেনা। এখনও পোষ মানেনি। কাছে গেলে লাফাঝাঁপি বেশি করে। জিজ্ঞেস করলাম, আপনার যখন বাইরে বা বিদেশে প্রোগ্রাম থাকে, তখন এই গরুগুলোকে কে দেখে? কেন? আমার ছেলে! তার তো অফুরন্ত সময়!

অনেক চেষ্টা করেও বিজয় তাকে সংগীত ধরাতে পারেননি। কালো গরুটিকে পোষ মানানোর জন্য তিনি রোজ সন্ধেবেলা গরুটিকে তাঁর রেওয়াজ শোনান। গল্পে পড়েছি, রাখালরা নাকি বাঁশি বাজায়। আমি অনেক রাখাল দেখেছি, কাউকে বাঁশি বাজাতে দেখিনি। কিন্তু বিজয় তাঁর মনের সুরের আলো মেলে ধরলেন আজকের এই গোধূলিবেলার গোয়ালঘরে। ওঁর যন্ত্রটি হচ্ছে— ‌পশ্চিমি চেলো। মাটির দাওয়ায় বসে অমন চেলো বাদ্যযন্ত্রের ছড়ের টানে গরুটি তো বটেই, আমরাও কেমন যেন তাঁর পোষ মেনে গেলাম।

পর দিন ভোর-ভোর মাইহারের মেন রোডে ব্যান্ডের আস্তানায় চলে গেলাম। তখনও তালা খোলেনি। হিন্দিতে লেখা সাইনবোর্ডটিতে আবছা অযত্নের ছোঁয়া। চারি দিকে অফিসযাত্রী, ব্যবসায়ী, ছাত্রছাত্রী, শ্রমিকের কোলাহল। বিচ্ছিরি আওয়াজ করে যাওয়া হাইওয়ে বাসগুলো আর অটোরিকশ’র ঘড়ঘড়ে শব্দ। সুর কোথায়?

সুর আছে মাইহারে। বাবা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের সাবেকি ডেরা এই শহরেই। এলাহাবাদ থেকে সাতনা যেতে, মধ্যে পড়ে মাইহার। টিলা-জঙ্গল ঘেরা ছোট্ট সুন্দর শহর। দেখার মতো জায়গা চারটে। বাবা আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের বসতভিটে— যেখান থেকে সংগীত শুরু ওস্তাদ আলি আকবর খাঁ, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, পণ্ডিত পান্নালাল ঘোষের মতো প্রবাদপ্রতিমদের। বাড়ির নাম ‘মদিনা মঞ্জিল’। আরও আছে সারদা মন্দির, পাহাড়ের পথে ওই উঁচুতে। আর আছে নবাব ব্রিজনাথ সিংহের ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রাসাদ। আর আছে মাইহার ব্যান্ড।

এই ‘মাইহার ব্যান্ড’, ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীত ব্যান্ড— তৈরি করেছিলেন বাবা আলাউদ্দিন-ই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মাইহারে প্লেগের মড়কে বেঁচে থাকা অনাথ শিশুদের নিয়ে, তাদের ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীতে তালিম দিয়ে, বাবা তৈরি করেছিলেন তাঁর সাধের ব্যান্ড। এখন অবশ্যই, সেই ব্যান্ডের প্রথম বাজিয়েরা আর বাজাচ্ছেন না। উত্তরসূরিরা সেই ঘরানাকেই বহন করে চলেছেন।

রাম সিংহ আবার সুরের কিছু বোঝে না। অথচ ব্যান্ডের দফতরে সে আসে সবার আগে। তালা খোলে। ঝাড়পোঁছ করে। সংগীতের কিছু জানে না, তবু ঘরের ভেতর রাখা প্রতিটি বাজনা পরম যত্নে বাক্স খুলে পরিষ্কার করে, তার পর সাজিয়ে রাখে মাটিতে পাতা এক-এক জনের জন্য বরাদ্দ গদিগুলোর সামনে। এখনই এসে পড়বেন সবাই। ওই তো স্কুটারে চেপে সবার আগে রবীন্দ্র ভাগবত। তবলচি। বিজয় দেব সিংহ— আজ আবার অন্য পোশাক। প্যান্ট-শার্ট। চেলোর সঙ্গে দিব্যি মানানসই। সেতারবাদক গৌতম ভারতিয়া আর সরোদিয়া গুণকর সাওলে। সবাই দিব্যি খোশমেজাজে। পান চিবোতে চিবোতে রাঙা মুখে এলেন এসরাজ-বাজিয়ে (এবং ব্যান্ড মাস্টার) সুরেশ চতুর্বেদী। বেহালার ছড়ায় টান লাগালেন গোকরণ পাণ্ডে। একে একে এলেন অশোক বাদোলিয়া আর প্রভুদয়াল ত্রিবেদী।

প্রভুদয়াল আর পাঁচ জনের মতো সাবেক বাজনা বাজান না। তিনি বাজান বাবা আলাউদ্দিনেরই সৃষ্টি নল-তরঙ্গ। মাইহার ব্যান্ডের প্রধান সম্পদ।

এই যন্ত্রের গল্পটা দারুণ! বাবা আলাউদ্দিন নাকি এক বার তাঁর সরোদ-শিষ্য মাইহার-নবাব ব্রিজনাথ সিংহের সঙ্গে প্রাসাদ-প্রাঙ্গণে চা খাচ্ছিলেন। নবাবের এক সৈন্যের হাত থেকে হঠাৎই একটা বন্দুক সিঁড়িতে গড়িয়ে পড়ে। নবাব এতে খুব অপমানিত হয়ে, ওই সৈন্যটিকে শাস্তি দেব-দেব করছেন, এমন সময়ে বাবার আবদারে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। বাবা নবাবকে বললেন, গোটা বিশেক বন্দুক আনো দেখি! ব্রিজনাথ ব্যবস্থা করে দিলেন। সেই বন্দুকের নল কেটে বিভিন্ন মাপের অংশ দিয়ে তৈরি হল ‘নল-তরঙ্গ’।

সে দিন যেন নল-তরঙ্গটি সুরে বাজছিল না। সেটিং-এ গন্ডগোল হয়েছে? না অন্য কিছু? গ্রুপের সবাই ওটি নিয়ে পড়লেন। ঠিক হল, তাল ফেরাতে সেটিকে নিয়ে যাওয়া হবে কামারশালায়। ক’দিন পরেই এলাহাবাদ আর দিল্লিতে প্রোগ্রাম আছে যে!

তার পর শুরু রিহার্সাল। বাইরের বাস-অটোর বিচ্ছিরি ক্যাঁওম্যাও যেন চুপ হয়ে গেল অপূর্ব সুর শুনে। সবই বাবা আলাউদ্দিনের কম্পোজিশন।

আলি আকবর খাঁ সাহেব বেঁচে থাকতে মাইহারে যত বার আসতেন, ব্যান্ডটাকে ঘষেমেজে দিয়ে যেতেন। এখন আসেন আশিস খান। ফি বছর। আমেরিকা থেকে এসে তালিম দিয়ে যান যন্ত্রীদের।

ব্যান্ডের এক সময়কার নল-তরঙ্গশিল্পী শৈলেন্দ্র শর্মা বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। বাড়ির পাশেই বাগানে দোলনায় চেপে, হারমোনিয়াম কোলে নিয়ে গুনগুন করছিলেন। কলকাতা থেকে এসেছি শুনে বললেন তাঁর প্রথম নল-তরঙ্গ পারফরমেন্সের দিনটার কথা— নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে।

শৈলেন্দ্র বাবার হাতে তৈরি। বাবার কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলছিলেন। বিড়বিড় করে বললেন, বাবা আলাউদ্দিন বলতেন— সংগীত আসে হৃদয়ের পবিত্রতম জায়গা থেকে। তারই অনুরণন ছড়িয়ে পড়ে শ্রোতার মধ্যেও।

তখনও বিকেল। সন্ধে নামেনি। মদিনা মঞ্জিলেই বাবা আলাউদ্দিনের মাজার। শ্রদ্ধা জানাতে এসেছে গোটা মাইহার ব্যান্ড। ধূপ জ্বালিয়ে, চার পাশ ঘুরে, শিয়রের কাছে নতমুখে দাঁড়িয়ে গুরুপ্রণাম সেরে সবাই ছুটবেন রাজবাড়িতে। দরবার হল-এ ফরাস পাতা হয়েছে, ঝাড়বাতি জ্বলে উঠেছে। শ্রোতা: এখনকার রানিমা।

যে দরবার এক সময়ে ব্যান্ডের ঝংকারে স্বর্গ হয়ে উঠত, সেখানে এখন মরা জোছনা। তবু যখন ব্যান্ডের অর্কেস্ট্রেশনে ‘বন্দে মাতরম্‌’ বেজে উঠল, রানিমা’র মুখ গর্বের আলোয় উজ্জ্বল।

jaydip63@gmail.com

Maihar Band Robibashoriya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy