Advertisement
E-Paper

আম-কাঁঠালি দিন

সারা উঠোন জুড়ে ছড়ানো মুকুল। আমরা বলতাম ‘বউল’। বাউন্ডুলে বাতাস এসে আমগাছগুলোর ঝাঁকড়া চুল এলোমেলো করে দিয়ে যায়। কয়েকটা তো বেশ বড়, দশাসই চেহারা। কয়েকটা নিরীহ— গোবেচারার মতন দাঁড়িয়ে থাকে পুকুরপাড়ে। পশ্চিমের ‘কান্দি’র ধারে যেটা, ওটা ছোড়দার। এই গাছের কাঁচা আমগুলোও বেশ মিষ্টি। ছোড়দার কড়া হুঁশিয়ারি— খবরদার, আমার গাছে হাত দিবি না।

প্রশান্ত চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৫ ০০:০৩

সারা উঠোন জুড়ে ছড়ানো মুকুল। আমরা বলতাম ‘বউল’। বাউন্ডুলে বাতাস এসে আমগাছগুলোর ঝাঁকড়া চুল এলোমেলো করে দিয়ে যায়। কয়েকটা তো বেশ বড়, দশাসই চেহারা। কয়েকটা নিরীহ— গোবেচারার মতন দাঁড়িয়ে থাকে পুকুরপাড়ে। পশ্চিমের ‘কান্দি’র ধারে যেটা, ওটা ছোড়দার। এই গাছের কাঁচা আমগুলোও বেশ মিষ্টি। ছোড়দার কড়া হুঁশিয়ারি— খবরদার, আমার গাছে হাত দিবি না। বড়দার গাছের আমগুলো ঢলঢলে, মোটা মতন, শাঁস-আঁশ নেই। বড়দার স্বভাবের মতোই একটু যেন আলাভোলা, নাদুসনুদুস, ঢিলেঢালা। তবে পোকা আছে পেটে। কুটিদা আর নিলুদার গাছ দুটো পাশাপাশি, জড়াজড়ি। নিলুদারটা সুন্দরী— সিঁদুররঙা। বিকেলে এক পশলা বৃষ্টির পর হঠাৎ মেঘ ফুঁড়ে যখন রোদ বেরোয়— সেই কনে-দেখা মিঠে রোদে সবুজ পাতার ফাঁকে-ফাঁকে লাল টুকটুকে রাঙা-রাঙা আম্রসুন্দরীর মুখ আমরা তন্ময় হয়ে দেখি। কিন্তু অত উঁচুতে বেয়ে ওঠার অনুমতি নেই, তাই খোঁজো ‘কুটা’— ‘কুটা’ মানে লম্বা বাঁশ, আঁকড়া লাগানো। গরম কালের বিকেল হলেই আমাদের আমের সঙ্গে দোস্তি। ইস্কুল থেকে এসেই দু’মুঠো নাকে-মুখে গুঁজে এই গাছ ওই গাছ। দাদারা তরতর করে উঠে যায় মগডালে। পাতার ফাঁকে-ফাঁকে দেখা যায় পা। কোমরে হাফপ্যান্টের উপর দেশি একফালি গামছার ডোরা বাঁধা। তার মধ্যে সন্তর্পণে গুঁজে রাখা ছোট্ট কাটারি বা চাক্কু। নীচে কলাপাতায় নুন আর কাঁচা লংকা নিয়ে অনন্ত প্রতীক্ষায় আমি। দাদাদের গাছের আমে আমার ওইটুকুই অধিকার।

সবার নিজের নিজের গাছ আছে— আমার নেই। ঠাম্মা এই চড়ুইয়ের বুকের ব্যথাটা বোঝেন। ঠাম্মার সঙ্গেই শুই। জড়াজড়ি করে, বুকে। সন্ধে হলেই ঘুমে ঢুলুঢুলু। লণ্ঠনের আলোয় গোল হয়ে বস্তা পেড়ে বড়রা মা সরস্বতীকে ধন্য করছে। পুবের ঢেঁকিঘরের এক ধারে খাটে বসে ঠাম্মা সবে ভগীরথের গঙ্গা আনায় ঢুকলেন, বালখিল্য মুনিকে গরুর খুরের গর্তে আকাশ দেখাবেন... আমি ঠোঁট ফুলিয়ে সুর কাটি— ‘ঠাম্মা, আমার কোনও গাছ নাই।’

ঠাম্মা বলেন— ‘অরে হরুমানু, গুপিয়ে যে দইখ্নর খালর ধারো নয়া গাছ লাগাইছে— ইটা তর। আম দিয়া কিতা করতে? আমি মরলে কাটিয়া জ্বালাইছনে।’ ঠাম্মা আমাকে আদর করে ‘হরুমানু’ ডাকতেন। ‘হরুমানু’ মানে ছোট্ট মানুষ। সন্ধে হলেই শুয়ে পড়তেন, আর গুনগুন করে চলত গান। ‘ভাইবে রাধারমণ বলে...এ গো নিশাকালে আসবে গো শ্যাম সবসখীগণ লইয়া... কুঞ্জ সাজাও গিয়া’...’ বলতেন, ‘বুজছসনিরে, আমি অইলাম তরফর (সিলেটের তরফ পরগনা) গুস্বামি ঘরর পুড়ি (মেয়ে)।’ রাত ভোর হয়-হয়, ফরসা হয়ে আসে চারপাশ। আবার শুরু হত ঠাম্মার মধু-গুনগুন। অস্পষ্ট সেই সুরে ঘুম ভাঙত। চোখ কচলে বারান্দা থেকে নেমেই দে দৌড়। রাতে বিষ্টি হয়েছে। ভোরের বাতাসে হিমেল ছোঁয়া। দৌড়ে যাচ্ছি আম গাছের তলায়-তলায়। বড়দা-ছোড়দা-কুটিদা-নিলুদা— সবার গাছের তলায়ই পাকা-কাঁচা আম পড়েছে। ছোট্ট ছোট্ট হাতে অত্ত আম ধরে না, তাই চটের থলে নিয়েছি। তত ক্ষণে নিলুদা-কুটিদাও এসে হাজির। ভোরের আমে কারও ব্যক্তিগত দাবিদাওয়া নেই। যে আগে আসবে সে পাবে। আমার আম-ভাণ্ডারটি দেখে কুটিদার বুকে জ্বলন, বলে— ‘আগে নিলে বাগে (বাঘে) খায়, পিছে নিলে সুনা (সোনা) পায়’।

বাবার লাগানো দক্ষিণের খালের ধারে আমগাছটা বড় হয়ে ওঠে ক্রমশ— যে গাছটা ঠাম্মা আমাকে একটি শর্তে দিয়ে রেখেছেন। আমি তত দিনে বড় ইস্কুলে পড়ি। গঞ্জের হাটে আমাদের দোকান। রাতে এক জন কর্মচারী শোয়, মাঝেমধ্যে আমাদেরও থাকতে হয়। সে দিনও হাটের দোকানে গিয়ে শুয়েছি, ভোর রাতে পাড়ার বিপিনদা ডেকে তোলেন— ঠাম্মা নেই। শার্টের হাতায় চোখ মুছি আর বাড়িমুখো দৌড়ই। সারাটা পথ আমার প্রভাতী কান্নায় ভেসে যায়। উঠোনে নিথর আমার ইন্দির ঠাকরুন। যেন কত কাল পর পরম শান্তিতে ঘুমিয়েছেন। বাড়ির দুয়ারমুখ থেকেই দেখি— ঠাম্মার শর্ত মেনে আমাকে দেওয়া তাঁর শেষ উপহার ওই আমগাছটা কেটেই চিতাকাঠ সাজানো হচ্ছে।

কাঁঠালের পাতা পেকে গেলে একটা অসম্ভব সুন্দর রং বেরোয়। কাঁঠাল গাছের গোড়ার দিকটা গর্মিকালে ঘড়িয়ালের গায়ের মতন হয়ে যায়। মাঝেমাঝে খাবলা খাবলা চাপড়া উঠে আসে। বাকলের তলা থেকে উঁকি দেয় ওই রকম অসাধারণ একটা রঙিন আবরণ।

দু-তিনটে ছাগল পুষেছেন বাবা। এর মধ্যে একটা গুন্ডা মতন। খাসি। কালো কুচকুচে ঘন লোম সারা গায়ে। মুখে সারা ক্ষণ খচর-খচর। বাবা শখ করে নাম দিয়েছিলেন ‘কালু’। কালো তো, তাই। ছাগল সবই খায়— এই ভেবে এক দিন অংকের খাতাটা ওর মুখে ঠেসে দিয়েও দেখি খায় না। কালুর প্রিয় খাবার কাঁঠালপাতা— তাও বেছে বেছে কাঁচাগুলো খায়।

গরমকালের বিকেল। বাড়ির চার ধারে খাল কাটা। আমাদের নেশা ওই জলে বঁড়শি ফেলে ঠায় বসে থাকা। কালুকে পাশেই গুয়াগাছে বেঁধে কয়েকটা কাঁঠালের ছোট ডাল ভেঙে দিয়েছি; চিবোক। কান্দির পাড়ে পর পর কয়েকটা কাঁঠালগাছ। একটা বেশ পুরনো। অনেকটা সভাপতির মতন ভাবগম্ভীর হয়ে বসে আছে। ওর কাঁঠালগুলো একটু যেন হাবা গোছের। বেঢপ। তবে কম। কাঁঠালি-বুড়ির পাশে যিনি, তিনি ভরা যুবতী। যেন ‘আনন্দ আশ্রম’ ছবির মৌসুমী (আমাদের ছোটবেলায় ওই ছবিটা মুক্তি পেয়েছিল তো...), হাসিখুশি, ঢলঢলে। গাছটার সারা গায়ে অসংখ্য কাঁঠাল, কোলে-কাঁখে-পিঠে...

জষ্ঠির সেই সন্ধেয় অনাথ জামাইবাবু এলেন— চপাস্ চপাস্ চটির আওয়াজ তুলে। বাড়ির ‘ঘাটা’, মানে বাঁশের গেট থেকেই গলা-খাঁকারি। হাতে হাতোয়া-লাঠি। বাঁ হাতে হ্যারিকেন— ম্লান নেশাগ্রস্ত টিমটিমে আলো। বগলে খমক; ভালনাম ‘আনন্দ-লহরী’। উনি এলেই বাড়িময় সাড়া পড়ে যায়। চটজলদি শীতলপাটি পড়ে উঠোনে। গান-বাজনার গন্ধে আমি পুবের ঢেঁকিঘরের ঠাম্মার খাস খাট থেকে চুপিচুপি পালিয়ে আসি। বাবা বুঝতে পারেন তাঁর ছোট্ট গুণধরটির ঘুম আসবে না। গান-বাজনার আসরে সাত খুন মাফ। বাবা বলেন— ‘পিতু নিরে বাবা?’ আমি অস্পষ্ট আলোয়-আঁধারে দাঁড়িয়ে সাড়া দিই—‘ইঁ...আমি।’ বাবা বলেন— ‘করতালটা নে।’ কুররুম, কুররুম...খমকের গমক ওঠে। কীর্তনের ‘হারমনি’ (হারমোনিয়াম) আসে। অনাথ জামাইবাবুর মুখ থেকে ভকভক বিড়ির পানসে-নোনতা-কষা মিশ্রিত একটা ভোটকা গন্ধ বেরোয়। এক সময় ট্রেনে ট্রেনে গান গেয়ে মাদার ইন্ডিয়া আর নাসির বিড়ি বিক্রি করতেন। বিড়ির ফুকফুক টান আর গেল না। দরাজ গলায় খমক বাজিয়ে তিনি ধরেন— ‘ওগো পিরিতি কাঁঠালের আঠা...’

রাত ঘন হয়। গরমটা বেশ ভ্যাপসা। এক সময় গান থামে, আবার বিড়ির ফুকফুক। কিন্তু বিড়ির উগ্র গন্ধ ছাপিয়ে একটা চেনা গন্ধ এসে নাকেমুখে ঝাপটা মারে। বাবাও দেখি ইতিউতি তাকাচ্ছেন, মাথা এ দিক ও দিক ঘুরিয়ে কী যেন শুঁকছেন। হঠাৎ তড়াক করে উঠে বললেন— ‘আয় চাই দেখি।’ হাতে টর্চ। পেছনে লণ্ঠন হাতে জামাইবাবু। আমি মধ্যিখানে। নিশুতি রাতে গা ছমছম করে। মনে হয়, কলাবাগানের ওই ধারটায় ওটা কে? এক গলা ঘোমটা? দাস-বস্তিতে ক’দিন আগে একটা বউ গলায় দড়ি দিয়েছে... সে নয় তো?

কান্দির ধারে মৌসুমী-গাছের তলায় এসে বাবা খাড়া হন। গাছে ওঠেন, আমি টর্চ নিই। বাবার ভয়— এক্ষুনি না-পাড়লে রাত্তিরে বাদুড় এসে ঠুকরে-ঠুকরে খেয়ে যাবে। লামডিং পাহাড় আর জঙ্গলের দিক থেকে কয়েকটা বাদুড় প্রায়ই হানা দিচ্ছে, কয়েকটা চামচিকেও জুটেছে। রোজ সন্ধেয় উৎপাত করে। রাতজাগা কিছু অচেনা পাখিও অাছে। আর, ভোরে নির্ঘাত কাঠবিড়ালিটাও খবর পেয়ে যাবে।

বাবা আস্ত গাছপাকা কাঁঠালটা আলগোছে পেড়ে গামছায় জড়িয়ে ধীরে ধীরে নামিয়ে আনেন। ফাটো-ফাটো অবস্থা। ম-ম গন্ধে চারপাশ ভরে ওঠে। বাবার শখ কাঁঠাল ‘প্যারা’ মুড়ি দিয়ে মেখে খাওয়া। ‘প্যারা’ মানে হল, কোয়া থেকে বিচি বের করে, খেজুরের পাতার ছুঁচালো আগা কেটে ফেলে দিয়ে, পেতলের জামবাটিতে কাঁঠালে-খেজুরের পাতায় কচলে শাঁসটা নিংড়ে রস বের করা।

বাবা খেজুরের পাতা আনতে কুয়োতলার দিকে যান। মা যান মুড়ি আর জামবাটি আনতে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাই। পরিষ্কার যেন দেখতে পাই— কাঁঠাল-সখী মুচকি মুচকি হাসছে আমার দিকে তাকিয়ে।

priyasakha_2009@rediffmail.com

Prasanta Chakraborty breadfruit mango rain
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy