Advertisement
E-Paper
BB_2025_Lead Zero Banner

আইনস্টাইনের মগজ

শেষকৃত্যের সময় অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের মাথায় মগজটাই ছিল না। মৃত্যুর পরেই নিপুণ হাতে তাঁর মস্তিষ্ক গবেষণার উদ্দেশ্যে বার করে নিয়েছিলেন এক প্যাথোলজিস্ট। আজই আপেক্ষিকতাবাদের উদ্ভাবকের মৃত্যুদিন।

আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের সেকশন। লন্ডনে অনুষ্ঠিত মস্তিষ্ক প্রদর্শনী, ২৭ মার্চ, ২০১২।

আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের সেকশন। লন্ডনে অনুষ্ঠিত মস্তিষ্ক প্রদর্শনী, ২৭ মার্চ, ২০১২।

প্রসেনজিৎ সিংহ

শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২১ ০৫:৫২
Share
Save

যা  ঘটল শুরুতে, তাকে কাকতালীয়ই বলা যায়, তবু উল্লেখ না করে পারছি না। ফিলাডেলফিয়া শহরের বিখ্যাত মাটার মিউজ়িয়াম দেখতে যাওয়ার দিনক্ষণ আগে থেকেই ঠিক ছিল। যে মিউজ়িয়ামে বছর নয়েক আগে যুক্ত হয়েছে এক বিশেষ দ্রষ্টব্য, যা এ যাবৎকাল সংরক্ষিত অন্য সমস্ত আকর্ষণকে ছাড়িয়ে গিয়েছে।

মার্কিন চিকিৎসাশাস্ত্রের জন্মস্থান ‘দ্য কলেজ অব ফিজ়িশিয়ানস অব ফিলাডেলফিয়া’। এ মিউজ়িয়াম সেটিরই অংশ। ১৮৬৩ সাল থেকে যেখানে জমা হয়েছে পঁচিশ হাজারেরও বেশি ব্যতিক্রমী মানবদেহ, বিরল স্পেসিমেন, চিকিৎসা সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি-সহ হরেক জিনিসপত্র। কিন্তু সে সব কিছুকে ম্লান করে দিয়েছে এই ‘স্পেশাল এগজ়িবিট’। কারণ সেটি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক।

তা সেই মিউজ়িয়াম দেখতে বেরব, ইন্টারনেটে জানতে পারলাম, সে দিনটা আইনস্টাইনের জন্মদিন। ১৪ মার্চ। আর বছর তিনেক আগে এই দিনেই আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন বিশ্বের আর এক কৃতী বিজ্ঞানী, স্টিফেন হকিং।

কাকতালীয় বলতে এটুকুই। আসলে আইনস্টাইনের জন্মদিনেই তাঁর মস্তিষ্ক দেখার এই সমাপতনে মোটেও তত রহস্য নেই। যা রয়েছে বিজ্ঞানীর মৃত্যুর ৫৭ বছর পর, এই মিউজ়িয়ামে কী ভাবে শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছেছিল তাঁর মস্তিষ্কের খণ্ডাংশ, সেই বিচিত্র কাহিনির মধ্যে। সে জন্য একটু পিছনে তাকাতে হবে।

খবরটা বেরিয়েছিল একটা ছোট কাগজে। সময়টা ১৯৭৮ সালের বসন্ত।

চারিদিকে তোলপাড়। ‘দ্য নিউ জার্সি মান্থলি’র ২৭ বছরের সাংবাদিক স্টিফেন লেভি নিজেই রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন। জেরবার হয়ে গেলে‌ন বিশ্বের তাবড় খবরের কাগজ, টেলিভিশন, রেডিয়োয় সাক্ষাৎকার দিতে দিতে। ওই সাংবাদিকের দাবি, তিনি আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক দেখেছেন।

মনে রাখতে হবে, ওই খবর প্রকাশের ২৩ বছর আগে প্রিন্সটনে মারা গিয়েছেন বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী, আপেক্ষিকতাবাদের জনক অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। মৃত্যুর প্রায় আড়াই দশক পরেও এমন একটা খবরে সারা বিশ্ব নড়েচড়ে বসেছিল। কারণ, তিনি আইনস্টাইন। বিংশ শতাব্দীর সেরা বিস্ময়।

আরও কারণ এই, ব্রহ্মাণ্ডের অদৃশ্য নিয়মকানুন যে মস্তিষ্কে ধরা দিয়েছিল, সেটি যে সংরক্ষণ করা হয়েছে, সেটাই অনেকে জানতেন না। তবে সবচেয়ে বড় কথা, মস্তিষ্কটি যে আসলে চুরি হয়েছিল, সে সম্বন্ধে গোটা বিশ্ব ছিল অন্ধকারে।

চুরি মানে যেমন তেমন নয়। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। সিন্দুক থেকে সোনাদানা টাকাপয়সা বার করে নেওয়ার মতো বিজ্ঞানীর মাথা থেকে মস্তিষ্কটি বার করে নেওয়া হয়েছিল সন্তর্পণে। এতটাই নিঃশব্দে যে, নিউ জার্সির ট্রেনটনে একটি ক্রিমেটোরিয়ামে যখন তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হচ্ছে, তখনও পর্যন্ত আত্মীয়স্বজনেরা জানতেনই না, মৃতদেহের মাথা পুরোপুরি ফাঁকা। আইনস্টাইনকে দাহ করা হয়েছিল তাঁর ইচ্ছে অনুসারেই। কারণ তিনি চাননি মৃত্যুর পর তাঁর দেহের উপর স্মৃতিসৌধ তৈরি হোক বা সেটা তীর্থে পরিণত হোক। সেই ইচ্ছে অনুসারেই গোপনে ডেলাওয়্যার নদীর জলে তাঁর দাহভস্ম ছড়িয়ে দেন বন্ধু ওটো নাথন।

মৃত্যুর পরদিন মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা হবে— ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’ সংবাদপত্রে অবশ্য এমন একটা খবর বেরিয়েছিল। পরে তা নিয়ে আর কেউ নাড়াচাড়া করেননি। লেভি যে কাগজে কাজ করতেন, তার সম্পাদক বিষয়টার ইঙ্গিত পেয়েছিলেন আইনস্টাইনের অন্যতম জীবনীকার ওয়াল্টার আইজ্যাকসনের লেখায়। কিন্তু কোথায়, কী ভাবে তা সংরক্ষণ করা হয়েছে তার উল্লেখ লেখায় ছিল না। কৌতূহলী সম্পাদক ফোন করেছিলেন আইনস্টাইনের সমস্ত সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক তথা সুহৃদ ওটো নাথনকে। ওঁর সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারেন, মস্তিষ্কের হালহদিস দিতে পারেন একমাত্র টমাস হার্ভে। প্রিন্সটন হাসপাতালে আইনস্টাইনের যিনি ময়নাতদন্ত করেছিলেন। অতএব তরুণ সাংবাদিক লেভির উপর ভার পড়ল, হার্ভেকে খুঁজে বের করার।

লেভি তো কাজ শুরু করলেন। কোথায় রয়েছে দুনিয়া ওলটপালট করা সেই মস্তিষ্ক? হার্ভেই বা কোথায়? এত দিন এ নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য ছিল না কেন? কারা পরীক্ষানিরীক্ষা করলেন সেই মস্তিষ্ক নিয়ে? সবচেয়ে বড় কথা, যদি পরীক্ষানিরীক্ষাই হবে, তার ফলাফলে কী জানা গেল? আইনস্টাইনের মস্তিষ্কে কি এমন কিছু ছিল, যা সাধারণের চেয়ে অনেকটা আলাদা? যে কারণে তিনি জিনিয়াস!

হার্ভের খোঁজে হাসপাতাল, স্বাস্থ্য দফতর তন্নতন্ন করে খুঁজে ফেললেন লেভি। অনেক কষ্টে জোগাড় হল ঠিকানা। কাকুতিমিনতি করে তাঁকে রাজি করালেন কথা বলার জন্য। তত দিনে প্রিন্সটন হাসপাতালের চাকরিটি খুইয়েছেন হার্ভে। কানসাসের উইচিটায় একটা রক্ত-মল-মূত্র পরীক্ষার ল্যাব খুলে বসেছেন।

এক শনিবার সকালে হার্ভের মুখোমুখি হলেন লেভি। কী ভাবে পুরো ঘটনাটি ঘটিয়েছিলেন হার্ভে, শুনলেন তাঁরই মুখ থেকে। দৃশ্যতই সে দিন হার্ভে একটু নার্ভাস। কতটা বলবেন, আর কতটা লুকোবেন, তা নিয়ে প্রবল দ্বন্দ্ব মনের ভেতরে। আর, তরুণ সাংবাদিক তখন উত্তেজনায় টগবগ করছেন। নানা ভাবে প্রশ্নে প্রশ্নে বার করে আনার চেষ্টা করছেন আসল ঘটনা। যে কোনও সাংবাদিকের কাছেই সেটা ভীষণ চ্যালেঞ্জিং একটা মুহূর্ত। সে দিনের কথোপকথন, লেভি লিখেছেন, যেন ‘সেভেন্থ সিল’ সিনেমার দাবা খেলার দৃশ্য।

প্রশ্নোত্তর পর্বের শেষে, অনেক পীড়াপীড়ির পর সংরক্ষিত মস্তিষ্কটি হার্ভে তাঁকে দেখিয়েছিলেন। কাচের জারে ফর্ম্যালিনে ডোবানো সেই জিনিসটি দেখেই সাড়া জাগানো খবরটি প্রকাশ করেন লেভি।

কী দেখেছিলেন সে দিন?

ছোটখাটো সেই ল্যাবের একটি বিয়ার কুলার থেকে কাচের জারটি বার করেছিলেন হার্ভে। ভেতরে তরলের মধ্যে মস্তিষ্কের ছোট ছোট টুকরো তখনও ভাসছে। এ যে অবিশ্বাস্য! শতাব্দীসেরা মস্তিষ্কের এই পরিণতি!

বিখ্যাত মানুষদের মস্তিষ্ক বা দেহাংশ সংরক্ষণের ঘটনা নতুন নয়। মস্কো শহরের রেড স্কোয়্যারের মসোলিয়ামে লেনিনের পুরো দেহটিই আজও সংরক্ষিত। জর্জ ওয়াশিংটনের দাঁত থেকে শুরু করে সংরক্ষিত হয়েছে নেপোলিয়নের পুরুষাঙ্গ পর্যন্ত। তবে গুরুত্বের বিচারে এর কোনওটার সঙ্গেই তুলনীয় নয় আইনস্টাইনের ‘জিনিয়াস’ মস্তিষ্ক।

সেই মস্তিষ্কই চুরি করেছিলেন হার্ভে। প্রিন্সটন হাসপাতালের কর্তব্যরত প্যাথোলজিস্ট। বার করেই কিছু ছবি তুলেছিলেন। বিজ্ঞানীর অখণ্ড মস্তিষ্কের সে-ই শেষ ছবি। পরিমাপও করেছিলেন। ওজন হয়েছিল ১২৩০ গ্রাম।

১৯৫৫ সালের ১৫ এপ্রিল শুক্রবার অসুস্থতা নিয়ে প্রিন্সটন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন আইনস্টাইন। সোমবার রাত সোয়া একটা নাগাদ জার্মান ভাষায় দু’টি কথা বলে চিরদিনের মতো নীরব হয়ে যান। সে সময় কর্তব্যরত নার্সরা কেউই জার্মানভাষী ছিলেন না। ফলে এই মহান বিজ্ঞানীর শেষ দু’টি কথা হারিয়ে যায় চিরকালের মতো।

সংবাদমাধ্যমে খবর পৌঁছনোর আগেই হার্ভে দ্রুত ময়নাতদন্ত সারেন এবং সরিয়ে ফেলেন বিজ্ঞানীর মস্তিষ্কটি। হার্ভে আইনস্টাইনের চোখ দুটিও তুলে নেন। চোখ দুটি তিনি দেন আইনস্টাইনের চোখের ডাক্তার হেনরি আব্রামসকে। চোখ দু’টি আজও নিউ ইয়র্কে নিরাপদ স্থানে রাখা রয়েছে।

হার্ভে নিজে প্যাথোলজিস্ট। কাজেই মস্তিষ্ক সংরক্ষণ করতে তাঁর বিশেষ অসুবিধে হয়নি। পেনসিলভ্যানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রোটোম যন্ত্রে ২৪০টি খণ্ড করা হয় মস্তিষ্কের। তৈরি হয় স্লাইডও। মস্তিষ্কের বাকি অংশ হার্ভে রেখে দেন নিজের কাছে।

তবে মৃত্যুর পর কেন আইনস্টাইনের ময়নাতদন্ত হয়েছিল, কে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তা আজও রহস্যে ঢাকা। এখন আর জানারও উপায় নেই কারণ, সেই সময়ের বেশ কিছু সরকারি নথি গায়েব। এমনকি, হার্ভে নিজেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকমের কথা বলেছেন। কখনও বলেছেন, তিনি ভেবেছিলেন অনুমতি রয়েছে। কখনও আবার কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন, তাঁর গুরু হ্যারি জিমারম্যানকে। আইনস্টাইনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন জিমারম্যান। শোনা যায় তিনিই নাকি এ কাজে উৎসাহ জুগিয়েছিলেন হার্ভেকে।

অনেকের ধারণা, লেনিনের মস্তিষ্ক নিয়ে জার্মান বিজ্ঞানী অস্কার ভগ্‌টের গবেষণাই হার্ভেকে প্রাণিত করেছিল। তবে লেনিনের মস্তিষ্কের উপর গবেষণা নিয়েও সোভিয়েট রাশিয়ায় পার্টির ভেতরে কম টানাপড়েন হয়নি। মায়াকোভস্কি, পাভলভের মতো মানুষের সঙ্গে লেনিনের মস্তিষ্কের তুলনা না করে কেন ভগ্‌ট সাধারাণ মানুষ বা অপরাধীর
সঙ্গে সেটির তুলনা করেছেন, কেনই বা এক জন বিদেশির হাতে মহামতির মস্তিষ্ক তুলে দেওয়া হল,তা নিয়েও তুমুল তর্কবিতর্ক হয়েছিল পার্টির অন্দরে। গবেষণা কোন পথে এগোবে সে-ও পার্টি নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছিল বিজ্ঞানীদের টপকে। সে অবশ্য অন্য গল্প।

বলে রাখা ভাল, হার্ভে কিন্তু আইনস্টাইনের একেবারে অপরিচিত ছিলেন না। প্রিন্সটন হাসপাতালে তাঁর প্যাথোলজিক্যাল ল্যাব থেকেই মহিলাকর্মীরা যেতেন আইনস্টাইনের নিয়মিত রক্ত-সহ অন্যান্য পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য। হার্ভে নিজেও একাধিক বার গিয়েছেন। শেষ দিন মহিলার বদলে পুরুষ দেখে আইনস্টাইন ঠাট্টা করে হার্ভেকে বলেছিলেন, ‘আপনি কি সেক্স চেঞ্জ করে এলেন?’ তার পরে বলতে গেলে আইনস্টাইনের সঙ্গে হার্ভের মুখোমুখি দেখা লাশকাটা ঘরে।

আইনস্টাইনের শেষ ইচ্ছের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে, তথা ঘোরতর অপরাধ করেও যে হার্ভে পার পেয়ে গিয়েছিলেন, তার কারণ বিজ্ঞানীর বড় ছেলে হান্স অ্যালবার্টের উদাসীন উদারতা। বিজ্ঞানের গবেষণায় বিজ্ঞানীর মস্তিষ্ক ব্যবহৃত হবে, এই শর্তে রাজি হয়ে যান হান্স। মহত্তর উদ্দেশ্যের ঝকঝকে তকমা গায়ে লাগতেই শতাব্দীসেরা চুরিটা শেষ পর্যন্ত একটা যৌক্তিকতা পেয়ে গিয়েছিল বলে অনেকের ধারণা।

তবে এর পরেও হার্ভের প্রিন্সটন হাসপাতালের চাকরিটা গিয়েছিল। ওই ঘটনার পাঁচ বছর পর। তবে সেটা চুরির কারণেই কি না, স্পষ্ট নয়। চুরিটাই যদি এর কারণ হত, তা হলে তা আরও আগেই যেত। সম্ভবত, চাকরিটা গিয়েছিল দীর্ঘ সময় পরেও কোনও গবেষণাপত্র দাখিল করতে পারেননি বলে। আবার শোনা যায়, মস্তিষ্কটি প্রিন্সটন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ফেরত দিতে অস্বীকার করায় তাঁকে চাকরি খোয়াতে হয়েছিল।

হার্ভে নিজে এক জন প্যাথোলজিস্টের বেশি কিছু ছিলেন না। মানুষের মস্তিষ্ক নিয়ে তাঁর বিদ্যেবুদ্ধি ময়নাতদন্ত বা ছোটখাটো রোগ নির্ণয়ের বেশি কিছু নয়। তিনি একক ভাবে কোনও গবেষণা করে উঠতে পারেননি। যখনই প্রশ্ন উঠেছে, হার্ভে বলেছেন আর বছর খানেকের মধ্যেই তিনি তাঁর গবেষণাপত্র প্রকাশ করে ফেলবেন। আইনস্টাইনের মৃত্যুর পর চল্লিশ বছর ধরে একই উত্তর দিয়ে গিয়েছিলেন মানুষটা। আসলে এমন একটা জিনিসে কামড় বসিয়েছিলেন, যেটা তাঁর পক্ষে হজম করাই দুঃসাধ্য।

তবু বিজ্ঞানের ইতিহাসে এমন এক বিখ্যাত চুরির সঙ্গে যাঁর নাম চিরদিনের মতো জুড়ে গেল, সেই মানুষটা ব্যক্তিগত ভাবে কতটা লাভবান হয়েছিলেন?

আইনি জটিলতার পাশ কাটাতে পারলেও চুরির কলঙ্ক জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বয়ে বেড়াতে হয়েছে হার্ভেকে। সেই জটিলতা তাঁর ব্যক্তিগত জীবনকেও ছাড়েনি। বাড়ির বেসমেন্টে অনেক দিন রাখা ছিল সেই মস্তিষ্কভর্তি জার। স্ত্রীর প্রবল আপত্তি ছিল ওই মস্তিষ্ক বাড়িতে রাখায়। এক পর্যায়ে টানাপড়েন এমন তীব্র আকার নিল যে, হয় স্ত্রী, নয় আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক— একটাকে বেছে নিতে হবে।

জিনিয়াসের মস্তিষ্ককেই বেছে নিলেন তিনি। বাধ্য হলেন বিবাহবিচ্ছেদে। জীবিকার খোঁজে আমেরিকার শহর থেকে শহরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। আর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ঘাড়ে বয়ে বেড়িয়েছেন তাঁর জীবনের বিতর্কিত মাইলফলকটি।

হার্ভে কানসাসের উইচিটায় এক বায়োল্যাব খুলেছিলেন। সেখান থেকে মিসৌরির ওয়েস্টনে গিয়েও কিছু কাল প্র্যাকটিস করেন। এখানেই ১৯৮৮ সালে তিনি তাঁর মেডিক্যাল লাইসেন্সটিও খোয়ান। পাশ করতে পারেননি পরীক্ষায়। ফিরে গেলেন কানসাসে। তবে অন্য শহর, লরেন্সে। শেষটায় কাজ নিলেন এক প্লাস্টিক কারখানায়। কর্মজীবনের পরিণতিটাও দেখারই মতো বটে!

এর মধ্যে হার্ভে এক সময় ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক মাইকেল প্যাটারনিটিকে নিয়ে গিয়েছিলেন আইনস্টাইনের নাতনির বাড়ি। তাঁকে দিতে চেয়েছিলেন দাদুর দেহাংশ। হার্ভে সে দিন তার বুইক স্কাইল্যার্ক গাড়ির পিছনে ট্রাঙ্কে বাসিয়ে নিয়েছিলেন মস্তিষ্ক সমেত দুটি জার। স্টিয়ারিং হাতে প্যাটারনিটি সে দিন হার্ভে আর আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক নিয়ে নিউ জার্সি থেকে দু’হাজার আটশো মাইল পাড়ি দিয়েছিলেন। যার ফসল ‘ড্রাইভিং মিস্টার অ্যালবার্ট’ নামে বইটি। সেখানে মাইকেল হার্ভেকে বর্ণনা করেছেন এক জন ছিটেল লোক হিসেবে, যার অনেক বদভ্যেসের মধ্যে একটি, অসময়ে হেসে ওঠা। এই যাত্রার দলিল হিসাবে বই প্রকাশিত হলেও তাঁদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি। আইনস্টাইনের নাতনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন হার্ভের প্রস্তাব।

শেষে আবার ফেরেন প্রিন্সটনে। যেখান থেকে এক সময় তার যাত্রা শুরু হয়েছিল।

তা হলে এতগুলো বছর ধরে হার্ভে কি শুধু নিজের কাছেই আগলে রেখেছিলেন বিজ্ঞানীর মস্তিষ্ক? না, দিয়েছিলেন অনেককেই। মস্তিষ্কের একটা অংশ তিনি দিয়েছিলেন তাঁর মেন্টর জিমারম্যানকে। যিনি বিজ্ঞানীর মস্তিষ্ক কাটাছেঁড়া করে অস্বাভাবিক কিছু খুঁজে পাননি। আরও অনেক গবেষককেই দিয়েছিলেন মস্তিষ্কের টুকরো এবং স্লাইড।

’৮০-র দশকের শেষভাগ থেকে নয় নয় করে বেশ কিছু গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের উপর। কোথাও বলা হয়েছে, আইনস্টাইনের মস্তিষ্কে নিউরোন বা স্নায়ুকোষের তুলনায় গ্লিয়াকোষ বেশি ছিল, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে কমই দেখা যায়। কেউ দেখিয়েছেন, বিজ্ঞানীর মস্তিষ্কের ডান এবং বাম গোলার্ধের মধ্যে সংযোগরক্ষাকারী করপাস ক্যালোসাম সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক সুগঠিত। কেউ পেয়েছেন, বিজ্ঞানীর মিডফ্রন্টাল লোবে চতুর্থ ভাঁজের অস্তিত্ব। সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে যা তিনটি।

অনেক তথ্য, অনেক স্পেকুলেশন, অনেক গবেষণাপত্রের জন্ম হয়েছে, হচ্ছেও— ওই মস্তিষ্ককে ঘিরে। উঠে আসছে কিছু তত্ত্ব, কিছু ধারণা, কিছু দাবিও। তবে কেন আইনস্টাইন জিনিয়াস ছিলেন, তার ব্যাখ্যায় এখনও পর্যন্ত এমন কিছু পাওয়া যায়নি, যা দেখে সোল্লাসে চিৎকার করে ওঠা যাবে ‘ইউরেকা’।

পেস বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোলজির প্রফেসর টেরেন্স হাইন এই ধরনের গবেষণার অসারতার কথা উল্লেখ করে একটা ভাল কথা বলেছিলেন। প্রতিটি মানুষের মস্তিষ্ক কোনও না কোনও ভাবে অন্যের চেয়ে আলাদা। কাজেই আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক অন্যদের চেয়ে কতটা আলাদা, কেন তিনি জিনিয়াস, এই প্রশ্নের উত্তর অধরাই থেকে যাবে।

আশ্চর্য মেধার এই মানুষটির মস্তিষ্কের পরিণতি তাহলে কী হল?

বেশ কিছু বিজ্ঞানীর সংগ্রহে হয়তো রয়ে গিয়েছে মস্তিষ্কের খণ্ডাংশ কিংবা স্লাইড। যাঁরা বিভিন্ন সময়ে হার্ভের পাঠানো টুকরো টুকরো মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা করেছেন। আর আছে জাপানের এক গণিত-অধ্যাপক কেনজি সুগিমোতোর কাছে।

সুগিমোতো একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন। আসলে তিনি বেরিয়েছিলেন আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের খোঁজে। কেমন করে তিনি হার্ভের কাছে পৌঁছলেন এবং কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি দেখতে পেলেন, সেটাই তথ্যচিত্রের উপজীব্য। ওই অধ্যাপকের অনুরোধে রান্নাঘরের আনাজ-কাটা ছুরি দিয়ে আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের এক টুকরো হার্ভে তাঁকে উপহার দিচ্ছেন, এমন দৃশ্যও সেই তথ্যচিত্রে ধরা আছে।

তবে সব কিছুর পরেও হার্ভের কাছে রয়ে গিয়েছিল অখণ্ড মস্তিষ্কের কিছু ছবি, আর মস্তিষ্কের অবশিষ্টাংশ। ২০০৭ সালে হার্ভের মৃত্যুর পর সেগুলি তার উত্তরাধিকারীরা দান করেন নিউ জার্সির স্প্রিং ফিল্ডে অবস্থিত ‘ন্যাশনাল মিউজ়িয়াম অব হেলথ অ্যান্ড মেডিসিন’-এ। কালেভদ্রে সেগুলো প্রদর্শিতও হয়।

তবে জনসাধারণের দেখার জন্য ফিলাডেলফিয়ার মাটার মিউজিয়ামে আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের যে ৪৩টি স্লাইড রয়েছে, সেগুলি দান করেছেন লুসি রোরকে অ্যাডামস। ফিলাডেলফিয়ার বিখ্যাত শিশু হাসপাতালের নিউরো-প্যাথোলজিস্ট।

তিনি সেগুলো কোথায় পেলেন?

ফিলাডেলফিয়ায় যাঁর ল্যাবে স্লাইডগুলি তৈরি করা হয়েছিল, সেই উইলিয়াম এরিখকে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ স্লাইডগুলি দিয়েছিলেন হার্ভে স্বয়ং। ১৯৬৭ সালে এরিখের মৃত্যু হলে তাঁর স্ত্রী স্লাইডগুলি দেন আর এক স্থানীয় চিকিৎসক অ্যালান স্টেনবার্গকে। অ্যালানের হাত ঘুরে সেগুলি পেয়েছিলেন লুসি। ২০১২ সালে লুসিই স্লাইডগুলো মিউজ়িয়ামকে সংরক্ষণের জন্য দান করেন।

মাটার মিউজিয়ামের লবি পেরিয়ে বড় ঘরের ডান দিকে গত ছ’বছর ধরে স্লাইড-ভর্তি কাঠের বাক্সটা রাখা আছে। যে স্লাইডে আক্ষরিক অর্থেই ইতিহাস হয়ে আছে বিংশ শতাব্দীর ‘মোস্ট বিউটিফুল মাইন্ড’। যাঁরা বিজ্ঞানীর প্রত্যক্ষ সান্নিধ্য অনুভব করেছেন, তাঁরা কি আদৌ অনুভব করতে পারেন সেই চরম মুহূর্তটাকে? যখন দুঃসাহস আর কিছুটা খামখেয়ালের ডানায় সওয়ার হয়ে এক অখ্যাত নগণ্য মানুষও অবলীলায় এক ঐতিহাসিক অঘটনের নায়ক হয়ে যান— কারণ তিনিই ঘটনাচক্রে বার করে নিয়েছিলেন সেই মহাবিজ্ঞানীর মস্তিষ্কটি!

অ্যালবার্ট আইনস্টাইন।

অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। ছবি: গেটি ইমেজেস।

হার্ভের খোঁজে হাসপাতাল, স্বাস্থ্য দফতর তন্নতন্ন করে খুঁজে ফেললেন লেভি। অনেক কষ্টে জোগাড় হল ঠিকানা। কাকুতিমিনতি করে তাঁকে রাজি করালেন কথা বলার জন্য। তত দিনে প্রিন্সটন হাসপাতালের চাকরিটি খুইয়েছেন হার্ভে। কানসাসের উইচিটায় একটা রক্ত-মল-মূত্র পরীক্ষার ল্যাব খুলে বসেছেন।

এক শনিবার সকালে হার্ভের মুখোমুখি হলেন লেভি। কী ভাবে পুরো ঘটনাটি ঘটিয়েছিলেন হার্ভে, শুনলেন তাঁরই মুখ থেকে। দৃশ্যতই সে দিন হার্ভে একটু নার্ভাস। কতটা বলবেন, আর কতটা লুকোবেন, তা নিয়ে প্রবল দ্বন্দ্ব মনের ভেতরে। আর, তরুণ সাংবাদিক তখন উত্তেজনায় টগবগ করছেন। নানা ভাবে প্রশ্নে প্রশ্নে বার করে আনার চেষ্টা করছেন আসল ঘটনা। যে কোনও সাংবাদিকের কাছেই সেটা ভীষণ চ্যালেঞ্জিং একটা মুহূর্ত। সে দিনের কথোপকথন, লেভি লিখেছেন, যেন ‘সেভেন্থ সিল’ সিনেমার দাবা খেলার দৃশ্য।

প্রশ্নোত্তর পর্বের শেষে, অনেক পীড়াপীড়ির পর সংরক্ষিত মস্তিষ্কটি হার্ভে তাঁকে দেখিয়েছিলেন। কাচের জারে ফর্ম্যালিনে ডোবানো সেই জিনিসটি দেখেই সাড়া জাগানো খবরটি প্রকাশ করেন লেভি।

কী দেখেছিলেন সে দিন?

ছোটখাটো সেই ল্যাবের একটি বিয়ার কুলার থেকে কাচের জারটি বার করেছিলেন হার্ভে। ভেতরে তরলের মধ্যে মস্তিষ্কের ছোট ছোট টুকরো তখনও ভাসছে। এ যে অবিশ্বাস্য! শতাব্দীসেরা মস্তিষ্কের এই পরিণতি!

বিখ্যাত মানুষদের মস্তিষ্ক বা দেহাংশ সংরক্ষণের ঘটনা নতুন নয়। মস্কো শহরের রেড স্কোয়্যারের মসোলিয়ামে লেনিনের পুরো দেহটিই আজও সংরক্ষিত। জর্জ ওয়াশিংটনের দাঁত থেকে শুরু করে সংরক্ষিত হয়েছে নেপোলিয়নের পুরুষাঙ্গ পর্যন্ত। তবে গুরুত্বের বিচারে এর কোনওটার সঙ্গেই তুলনীয় নয় আইনস্টাইনের ‘জিনিয়াস’ মস্তিষ্ক।

সেই মস্তিষ্কই চুরি করেছিলেন হার্ভে। প্রিন্সটন হাসপাতালের কর্তব্যরত প্যাথোলজিস্ট। বার করেই কিছু ছবি তুলেছিলেন। বিজ্ঞানীর অখণ্ড মস্তিষ্কের সে-ই শেষ ছবি। পরিমাপও করেছিলেন। ওজন হয়েছিল ১২৩০ গ্রাম।

১৯৫৫ সালের ১৫ এপ্রিল শুক্রবার অসুস্থতা নিয়ে প্রিন্সটন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন আইনস্টাইন। সোমবার রাত সোয়া একটা নাগাদ জার্মান ভাষায় দু’টি কথা বলে চিরদিনের মতো নীরব হয়ে যান। সে সময় কর্তব্যরত নার্সরা কেউই জার্মানভাষী ছিলেন না। ফলে এই মহান বিজ্ঞানীর শেষ দু’টি কথা হারিয়ে যায় চিরকালের মতো।

সংবাদমাধ্যমে খবর পৌঁছনোর আগেই হার্ভে দ্রুত ময়নাতদন্ত সারেন এবং সরিয়ে ফেলেন বিজ্ঞানীর মস্তিষ্কটি। হার্ভে আইনস্টাইনের চোখ দুটিও তুলে নেন। চোখ দুটি তিনি দেন আইনস্টাইনের চোখের ডাক্তার হেনরি আব্রামসকে। চোখ দু’টি আজও নিউ ইয়র্কে নিরাপদ স্থানে রাখা রয়েছে।

সংগ্রহালয়: মাটার মিউজ়িয়াম, ফিলাডেলফিয়া।

সংগ্রহালয়: মাটার মিউজ়িয়াম, ফিলাডেলফিয়া।

হার্ভে নিজে প্যাথোলজিস্ট। কাজেই মস্তিষ্ক সংরক্ষণ করতে তাঁর বিশেষ অসুবিধে হয়নি। পেনসিলভ্যানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রোটোম যন্ত্রে ২৪০টি খণ্ড করা হয় মস্তিষ্কের। তৈরি হয় স্লাইডও। মস্তিষ্কের বাকি অংশ হার্ভে রেখে দেন নিজের কাছে।

তবে মৃত্যুর পর কেন আইনস্টাইনের ময়নাতদন্ত হয়েছিল, কে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তা আজও রহস্যে ঢাকা। এখন আর জানারও উপায় নেই কারণ, সেই সময়ের বেশ কিছু সরকারি নথি গায়েব। এমনকি, হার্ভে নিজেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকমের কথা বলেছেন। কখনও বলেছেন, তিনি ভেবেছিলেন অনুমতি রয়েছে। কখনও আবার কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন, তাঁর গুরু হ্যারি জিমারম্যানকে। আইনস্টাইনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন জিমারম্যান। শোনা যায় তিনিই নাকি এ কাজে উৎসাহ জুগিয়েছিলেন হার্ভেকে।

অনেকের ধারণা, লেনিনের মস্তিষ্ক নিয়ে জার্মান বিজ্ঞানী অস্কার ভগ্‌টের গবেষণাই হার্ভেকে প্রাণিত করেছিল। তবে লেনিনের মস্তিষ্কের উপর গবেষণা নিয়েও সোভিয়েট রাশিয়ায় পার্টির ভেতরে কম টানাপড়েন হয়নি। মায়াকোভস্কি, পাভলভের মতো মানুষের সঙ্গে লেনিনের মস্তিষ্কের তুলনা না করে কেন ভগ্‌ট সাধারাণ মানুষ বা অপরাধীর
সঙ্গে সেটির তুলনা করেছেন, কেনই বা এক জন বিদেশির হাতে মহামতির মস্তিষ্ক তুলে দেওয়া হল,তা নিয়েও তুমুল তর্কবিতর্ক হয়েছিল পার্টির অন্দরে। গবেষণা কোন পথে এগোবে সে-ও পার্টি নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছিল বিজ্ঞানীদের টপকে। সে অবশ্য অন্য গল্প।

বলে রাখা ভাল, হার্ভে কিন্তু আইনস্টাইনের একেবারে অপরিচিত ছিলেন না। প্রিন্সটন হাসপাতালে তাঁর প্যাথোলজিক্যাল ল্যাব থেকেই মহিলাকর্মীরা যেতেন আইনস্টাইনের নিয়মিত রক্ত-সহ অন্যান্য পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য। হার্ভে নিজেও একাধিক বার গিয়েছেন। শেষ দিন মহিলার বদলে পুরুষ দেখে আইনস্টাইন ঠাট্টা করে হার্ভেকে বলেছিলেন, ‘আপনি কি সেক্স চেঞ্জ করে এলেন?’ তার পরে বলতে গেলে আইনস্টাইনের সঙ্গে হার্ভের মুখোমুখি দেখা লাশকাটা ঘরে।

আইনস্টাইনের শেষ ইচ্ছের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে, তথা ঘোরতর অপরাধ করেও যে হার্ভে পার পেয়ে গিয়েছিলেন, তার কারণ বিজ্ঞানীর বড় ছেলে হান্স অ্যালবার্টের উদাসীন উদারতা। বিজ্ঞানের গবেষণায় বিজ্ঞানীর মস্তিষ্ক ব্যবহৃত হবে, এই শর্তে রাজি হয়ে যান হান্স। মহত্তর উদ্দেশ্যের ঝকঝকে তকমা গায়ে লাগতেই শতাব্দীসেরা চুরিটা শেষ পর্যন্ত একটা যৌক্তিকতা পেয়ে গিয়েছিল বলে অনেকের ধারণা।

তবে এর পরেও হার্ভের প্রিন্সটন হাসপাতালের চাকরিটা গিয়েছিল। ওই ঘটনার পাঁচ বছর পর। তবে সেটা চুরির কারণেই কি না, স্পষ্ট নয়। চুরিটাই যদি এর কারণ হত, তা হলে তা আরও আগেই যেত। সম্ভবত, চাকরিটা গিয়েছিল দীর্ঘ সময় পরেও কোনও গবেষণাপত্র দাখিল করতে পারেননি বলে। আবার শোনা যায়, মস্তিষ্কটি প্রিন্সটন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ফেরত দিতে অস্বীকার করায় তাঁকে চাকরি খোয়াতে হয়েছিল।

হার্ভে নিজে এক জন প্যাথোলজিস্টের বেশি কিছু ছিলেন না। মানুষের মস্তিষ্ক নিয়ে তাঁর বিদ্যেবুদ্ধি ময়নাতদন্ত বা ছোটখাটো রোগ নির্ণয়ের বেশি কিছু নয়। তিনি একক ভাবে কোনও গবেষণা করে উঠতে পারেননি। যখনই প্রশ্ন উঠেছে, হার্ভে বলেছেন আর বছর খানেকের মধ্যেই তিনি তাঁর গবেষণাপত্র প্রকাশ করে ফেলবেন। আইনস্টাইনের মৃত্যুর পর চল্লিশ বছর ধরে একই উত্তর দিয়ে গিয়েছিলেন মানুষটা। আসলে এমন একটা জিনিসে কামড় বসিয়েছিলেন, যেটা তাঁর পক্ষে হজম করাই দুঃসাধ্য।

তবু বিজ্ঞানের ইতিহাসে এমন এক বিখ্যাত চুরির সঙ্গে যাঁর নাম চিরদিনের মতো জুড়ে গেল, সেই মানুষটা ব্যক্তিগত ভাবে কতটা লাভবান হয়েছিলেন?

আইনি জটিলতার পাশ কাটাতে পারলেও চুরির কলঙ্ক জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বয়ে বেড়াতে হয়েছে হার্ভেকে। সেই জটিলতা তাঁর ব্যক্তিগত জীবনকেও ছাড়েনি। বাড়ির বেসমেন্টে অনেক দিন রাখা ছিল সেই মস্তিষ্কভর্তি জার। স্ত্রীর প্রবল আপত্তি ছিল ওই মস্তিষ্ক বাড়িতে রাখায়। এক পর্যায়ে টানাপড়েন এমন তীব্র আকার নিল যে, হয় স্ত্রী, নয় আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক— একটাকে বেছে নিতে হবে।

জিনিয়াসের মস্তিষ্ককেই বেছে নিলেন তিনি। বাধ্য হলেন বিবাহবিচ্ছেদে। জীবিকার খোঁজে আমেরিকার শহর থেকে শহরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। আর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ঘাড়ে বয়ে বেড়িয়েছেন তাঁর জীবনের বিতর্কিত মাইলফলকটি।

হার্ভে কানসাসের উইচিটায় এক বায়োল্যাব খুলেছিলেন। সেখান থেকে মিসৌরির ওয়েস্টনে গিয়েও কিছু কাল প্র্যাকটিস করেন। এখানেই ১৯৮৮ সালে তিনি তাঁর মেডিক্যাল লাইসেন্সটিও খোয়ান। পাশ করতে পারেননি পরীক্ষায়। ফিরে গেলেন কানসাসে। তবে অন্য শহর, লরেন্সে। শেষটায় কাজ নিলেন এক প্লাস্টিক কারখানায়। কর্মজীবনের পরিণতিটাও দেখারই মতো বটে!

এর মধ্যে হার্ভে এক সময় ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক মাইকেল প্যাটারনিটিকে নিয়ে গিয়েছিলেন আইনস্টাইনের নাতনির বাড়ি। তাঁকে দিতে চেয়েছিলেন দাদুর দেহাংশ। হার্ভে সে দিন তার বুইক স্কাইল্যার্ক গাড়ির পিছনে ট্রাঙ্কে বাসিয়ে নিয়েছিলেন মস্তিষ্ক সমেত দুটি জার। স্টিয়ারিং হাতে প্যাটারনিটি সে দিন হার্ভে আর আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক নিয়ে নিউ জার্সি থেকে দু’হাজার আটশো মাইল পাড়ি দিয়েছিলেন। যার ফসল ‘ড্রাইভিং মিস্টার অ্যালবার্ট’ নামে বইটি। সেখানে মাইকেল হার্ভেকে বর্ণনা করেছেন এক জন ছিটেল লোক হিসেবে, যার অনেক বদভ্যেসের মধ্যে একটি, অসময়ে হেসে ওঠা। এই যাত্রার দলিল হিসাবে বই প্রকাশিত হলেও তাঁদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি। আইনস্টাইনের নাতনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন হার্ভের প্রস্তাব।

শেষে আবার ফেরেন প্রিন্সটনে। যেখান থেকে এক সময় তার যাত্রা শুরু হয়েছিল।

তা হলে এতগুলো বছর ধরে হার্ভে কি শুধু নিজের কাছেই আগলে রেখেছিলেন বিজ্ঞানীর মস্তিষ্ক? না, দিয়েছিলেন অনেককেই। মস্তিষ্কের একটা অংশ তিনি দিয়েছিলেন তাঁর মেন্টর জিমারম্যানকে। যিনি বিজ্ঞানীর মস্তিষ্ক কাটাছেঁড়া করে অস্বাভাবিক কিছু খুঁজে পাননি। আরও অনেক গবেষককেই দিয়েছিলেন মস্তিষ্কের টুকরো এবং স্লাইড।

’৮০-র দশকের শেষভাগ থেকে নয় নয় করে বেশ কিছু গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের উপর। কোথাও বলা হয়েছে, আইনস্টাইনের মস্তিষ্কে নিউরোন বা স্নায়ুকোষের তুলনায় গ্লিয়াকোষ বেশি ছিল, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে কমই দেখা যায়। কেউ দেখিয়েছেন, বিজ্ঞানীর মস্তিষ্কের ডান এবং বাম গোলার্ধের মধ্যে সংযোগরক্ষাকারী করপাস ক্যালোসাম সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক সুগঠিত। কেউ পেয়েছেন, বিজ্ঞানীর মিডফ্রন্টাল লোবে চতুর্থ ভাঁজের অস্তিত্ব। সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে যা তিনটি।

অনেক তথ্য, অনেক স্পেকুলেশন, অনেক গবেষণাপত্রের জন্ম হয়েছে, হচ্ছেও— ওই মস্তিষ্ককে ঘিরে। উঠে আসছে কিছু তত্ত্ব, কিছু ধারণা, কিছু দাবিও। তবে কেন আইনস্টাইন জিনিয়াস ছিলেন, তার ব্যাখ্যায় এখনও পর্যন্ত এমন কিছু পাওয়া যায়নি, যা দেখে সোল্লাসে চিৎকার করে ওঠা যাবে ‘ইউরেকা’।

পেস বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোলজির প্রফেসর টেরেন্স হাইন এই ধরনের গবেষণার অসারতার কথা উল্লেখ করে একটা ভাল কথা বলেছিলেন। প্রতিটি মানুষের মস্তিষ্ক কোনও না কোনও ভাবে অন্যের চেয়ে আলাদা। কাজেই আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক অন্যদের চেয়ে কতটা আলাদা, কেন তিনি জিনিয়াস, এই প্রশ্নের উত্তর অধরাই থেকে যাবে।

আশ্চর্য মেধার এই মানুষটির মস্তিষ্কের পরিণতি তাহলে কী হল?

বেশ কিছু বিজ্ঞানীর সংগ্রহে হয়তো রয়ে গিয়েছে মস্তিষ্কের খণ্ডাংশ কিংবা স্লাইড। যাঁরা বিভিন্ন সময়ে হার্ভের পাঠানো টুকরো টুকরো মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা করেছেন। আর আছে জাপানের এক গণিত-অধ্যাপক কেনজি সুগিমোতোর কাছে।

সুগিমোতো একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন। আসলে তিনি বেরিয়েছিলেন আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের খোঁজে। কেমন করে তিনি হার্ভের কাছে পৌঁছলেন এবং কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি দেখতে পেলেন, সেটাই তথ্যচিত্রের উপজীব্য। ওই অধ্যাপকের অনুরোধে রান্নাঘরের আনাজ-কাটা ছুরি দিয়ে আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের এক টুকরো হার্ভে তাঁকে উপহার দিচ্ছেন, এমন দৃশ্যও সেই তথ্যচিত্রে ধরা আছে।

তবে সব কিছুর পরেও হার্ভের কাছে রয়ে গিয়েছিল অখণ্ড মস্তিষ্কের কিছু ছবি, আর মস্তিষ্কের অবশিষ্টাংশ। ২০০৭ সালে হার্ভের মৃত্যুর পর সেগুলি তার উত্তরাধিকারীরা দান করেন নিউ জার্সির স্প্রিং ফিল্ডে অবস্থিত ‘ন্যাশনাল মিউজ়িয়াম অব হেলথ অ্যান্ড মেডিসিন’-এ। কালেভদ্রে সেগুলো প্রদর্শিতও হয়।

তবে জনসাধারণের দেখার জন্য ফিলাডেলফিয়ার মাটার মিউজিয়ামে আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের যে ৪৩টি স্লাইড রয়েছে, সেগুলি দান করেছেন লুসি রোরকে অ্যাডামস। ফিলাডেলফিয়ার বিখ্যাত শিশু হাসপাতালের নিউরো-প্যাথোলজিস্ট।

তিনি সেগুলো কোথায় পেলেন?

ফিলাডেলফিয়ায় যাঁর ল্যাবে স্লাইডগুলি তৈরি করা হয়েছিল, সেই উইলিয়াম এরিখকে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ স্লাইডগুলি দিয়েছিলেন হার্ভে স্বয়ং। ১৯৬৭ সালে এরিখের মৃত্যু হলে তাঁর স্ত্রী স্লাইডগুলি দেন আর এক স্থানীয় চিকিৎসক অ্যালান স্টেনবার্গকে। অ্যালানের হাত ঘুরে সেগুলি পেয়েছিলেন লুসি। ২০১২ সালে লুসিই স্লাইডগুলো মিউজ়িয়ামকে সংরক্ষণের জন্য দান করেন।

মাটার মিউজিয়ামের লবি পেরিয়ে বড় ঘরের ডান দিকে গত ছ’বছর ধরে স্লাইড-ভর্তি কাঠের বাক্সটা রাখা আছে। যে স্লাইডে আক্ষরিক অর্থেই ইতিহাস হয়ে আছে বিংশ শতাব্দীর ‘মোস্ট বিউটিফুল মাইন্ড’। যাঁরা বিজ্ঞানীর প্রত্যক্ষ সান্নিধ্য অনুভব করেছেন, তাঁরা কি আদৌ অনুভব করতে পারেন সেই চরম মুহূর্তটাকে? যখন দুঃসাহস আর কিছুটা খামখেয়ালের ডানায় সওয়ার হয়ে এক অখ্যাত নগণ্য মানুষও অবলীলায় এক ঐতিহাসিক অঘটনের নায়ক হয়ে যান— কারণ তিনিই ঘটনাচক্রে বার করে নিয়েছিলেন সেই মহাবিজ্ঞানীর মস্তিষ্কটি!

Albert Einstein Prasenjit Sinha

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে আপনার সাবস্ক্রিপশন আপনাআপনি রিনিউ হয়ে যাবে

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।