Advertisement
E-Paper

রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০১৬ ০০:০৩

আবার দই

পিনাকী ভট্টাচার্য

আর্যরা এই উপমহাদেশে আসার পর তাদের খাবারের মোদ্দা উপকরণ ছিল ব্রীহি অর্থাৎ ধান, আর যব, ঘৃত, মধু, মশলা আর দই। যবের সঙ্গে দই, আর তার কিছু দিন পরে ভাতের সঙ্গে দই মেখে খাওয়া চল ছিল সেই প্রথম যুগে। ‘ঋগ্বেদ’-এ এই দই-ভাতের নাম ‘করম্ভ’ বলে লেখা। করম্ভ-র কথা আমরা দ্বাদশ শতাব্দীতে লেখা ‘বিমলপ্রবন্ধ’-এও পাই। সবচেয়ে আশ্চর্য হল— এখনকার গুজরাতে এই দই-ভাত মেশানো পদ আজও একই নামে পরিবেশিত হয়। বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো নামের খাবারের তালিকায় ‘করম্ভ’ এক্কেবারে প্রথম সারিতে থাকবে নিশ্চয়ই!

প্রথম যুগে, অল্প কিছু খাবারের ওপরই আর্যরা বেশ নির্ভরশীল ছিলেন। সেই খাবারগুলিকে আর্যরা কৃতজ্ঞ-চিত্তে মনে রেখেছেন, আর সময়ের সঙ্গে যখন ওঁদের মৌরসিপাট্টা কায়েম হয়েছে এই দেশে, সেই পুরনো খাবারগুলোকে ওঁরা পূজা-অর্চনা আর নানান শুভ কাজের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছেন। আর্যদের আদি যুগের সব খাবারের ক্ষেত্রেই এ কথা বলা চলে। কিন্তু দইয়ের ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব যেন বেশি। দই এক দিকে পঞ্চগব্যের অন্যতম, অন্য দিকে যে কোনও শুভকাজে আবশ্যিক। বিশেষ দিনগুলোয় কপালে মস্ত এক দইয়ের ফোঁটা, বা কোথাও যাওয়ার আগে চামচে করে দই খেয়ে বেরনো রীতি এ দেশে অনেক দিন ধরেই চলছে।

কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’-এ দই বার বার এসেছে। সেখানে ‘মাথাতিক’ বা দইওয়ালার কথা থেকে শুরু করে দইয়ের উপকারিতা বিষয়েও বলা হয়েছে। এখানেই প্রথম মাংসে দই মাখিয়ে রেখে তাকে নরম আর সুস্বাদু করার কথা মেলে, তা আকবর বাদশার রান্নাঘরের গল্পেও লেখা আছে। আকবরের হেঁশেলে এই প্রণালী পৌঁছেছিল সম্ভবত জোধাবাঈয়ের হাত ধরে, কারণ তিনি নিজে নিরামিষাশী হলেও রাজপুত রাজাদের মাংসকে দই-মশলা মিশিয়ে জাঁক দিয়ে সুস্বাদু করার কৌশলটা জানতেন।

দই ঝুলিয়ে রেখে, তার জল ঝরিয়ে, চিনি-মশলা মিশিয়ে এক মিষ্টি পদের কথা সংস্কৃত সাহিত্যে আড়াই হাজার বছর আগে লেখা হয়। তখন তার নাম ছিল ‘শিখরিণী’। ‘শিখরিণী’ ‘শ্রীখণ্ড্‌’ হয়ে উঠেছিল সম্ভবত পার্সিদের পাল্লায় পড়ে। অষ্টম শতাব্দী আর দশম শতাব্দীর মধ্যে তারা ভারতের পশ্চিম কূলে নোঙর করল। তারা মিঠাইকে বলত ‘খণ্ড্‌’। ১০২৫ সালে কন্নড়ে লেখা ‘লোকোপাকর’-এ আমরা শিখরিণীর দেখা পাই, কিন্তু ১৫৯৪ সালে কবি মঙ্গরসের লেখা ‘সূপশাস্ত্র’-এ আমরা উল্লেখ পাই শ্রীখণ্ড্‌-এর।

আর্যরা যখন এ দেশের উদ্দেশে রওনা দেন, আসার পথে তাঁদের অনেক বেরাদর এ দেশ অবধি না এসে মাঝরাস্তাতেই বসতি বানিয়ে নিয়েছিলেন। তাঁদের আমরা দেখতে পাই আফগানিস্তান আর পামির সংলগ্ন অন্যান্য অঞ্চলে। তাই আফগানিদের দইয়ের প্রতি দুর্বলতা প্রায় আমাদেরই মতো; সেই দই সাংঘাতিক টক, তাঁদের সে দেশের ভয়ানক গরমের সঙ্গে যুঝতে শক্তি দেয়। এঁদের দই-প্রীতি এতটাই যে, সে দেশে ভয়ংকর ঠান্ডায় দই জুটবে না বলে তাঁরা ইয়াকের দুধ ঘন করে দই বানান, আর সূর্যের তলায় দিনের পর দিন রেখে তা শুকিয়ে পাথরের মতো শক্ত করেন। ‘কুরুট’ নামের এই খাবার গরম জলে গুলে শীতকালে তা মাংসের মধ্যে দেন, আর মুখের মধ্যে কুরুট রেখে চিউয়িং গামের মতো চিবোতে থাকেন দিন ভর।

ইউরোপের বুলগারিয়ায় বলা হয়, দই মানুষের আয়ু আর সৌন্দর্য বাড়ায়। আর আমাদের বাংলায় ‘কবিকঙ্কনচণ্ডী’-তে আছে ‘স্নান করি দুর্বলা/ খায় দধি খণ্ড কলা/ চিড়া দই দেয় ভারি জনে।’— দই সর্বার্থে সর্বজনীন।

pinakee.bhattacharya@gmail.com

আমরা কিন্তু রাবীন্দ্রিক

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

নজরুলের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা জ্ঞাপন করার জন্য এক সময় অনেকের মুখে নজরুল নয়, ‘কাজীদা’ শুনতাম। কাজীদার কোলে বসে গান শেখার দাবিদার কমপক্ষে তিন জনকে পেয়েছি আমার আকাশবাণীর চাকরির প্রথম জীবনে। (এক জন আবার বলেছিলেন— ‘নুরুদাকে কত পান সেজে দিতাম...।’ নুরু ছিল নজরুলের পারিবারিক ডাকনাম)।

সত্যজিৎ রায় প্রসঙ্গ এনে, মানিকদা না বললে যথেষ্ট মাখোমাখোত্ব প্রকাশিত হয় না। (তেমন ভাবেই সুপ্রিয়া চৌধুরীকে বেণুদি)। মানিকদা বলার লোক সাধারণত পঞ্চাশোর্ধ্ব হয়ে থাকেন। তুলনায় কমবয়সিরা অপর্ণা সেনকে রিনাদি, প্রসেনজিৎকে বুম্বাদা ইত্যাদি। কিন্তু ‘গুরুদেব’ হল রবীন্দ্রনাথের সর্বজনীন ডাকনাম, এবং বয়স নিরপেক্ষ। এই উচ্চারণে মাখোমাখো অন্তরঙ্গতা সহ যথেষ্ট ভক্তিভাবও বিকশিত হয়।

রবীন্দ্রনাথের শতবর্ষ উদ্‌যাপিত হবার পর আরও দশ বছরকাল স্কুল পরীক্ষায় ‘রবীন্দ্রনাথ’ খুব ইম্পর্ট্যান্ট ছিল। রচনায় বিশ্বকবি, মহাকবি ইত্যাদি শব্দ ছিল। রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করার আগে কবিগুরু শব্দটি বলে নেবার নিয়মও ছিল। কিন্তু ‘গুরুদেব’ শব্দটি শুনলাম আমার মামাতো দিদির বিয়ের কিছু দিন আগে। আমাদের বাড়িতেই কনে দেখানোর অনুষ্ঠান। পাত্রর বাবা বললেন, ‘শুনলাম তুমি গান জানো, একটা গুরুদেবের গান গাও তো শুনি...’ আমার বোন ‘ভবসাগরতারণ কারণ হে, গুরুদেব দয়া কর...’ গাইতেই উনি থামিয়ে দিলেন। বললেন এই গান নয় মা, রবীন্দ্রনাথের গান।

তাও দু’চার পিস জানা ছিল ওর। তখন মধ্যবিত্ত ঘরের বিবাহযোগ্য বালাগণের দুটি শ্যামাসংগীত, ক’টি রবীন্দ্রসংগীত, দু’-একটি নজরুলগীতি জানতে হত। প্রেম-পূজা-প্রকৃতি পর্ব ছাড়াও কিছু গান ‘কনে দেখা’ পর্বের মধ্যে ছিল। গীতবিতানে এটা পৃথক পর্বে নেই, তবে গানের মাস্টাররা জানত। যেমন ‘কী গাব আমি, কী শুনাব’, ‘এ মণিহার আমায় নাহি সাজে’ ইত্যাদি। এগুলো প্রিলিমিনারি। দ্বিতীয় দফায় পাত্র নিজে আসত বন্ধু ও জামাইবাবু সহ। তখন অন্য গান। পাত্রের বাবা গান শুনে বলেছিলেন, ‘গলাটি তো ভালই। তৈরি করে নেব। আমি নিজেও গুরুদেবের গান গাই একটু-আধটু। ছেলেকে পাঠিয়ে দেব। আমরা কিন্তু রাবীন্দ্রিক।’

বড় মামা রাঢ়ি শুনেছেন, বারেন্দ্র শুনেছেন, কিন্তু আত্মপরিচয় জ্ঞাপক অচেনা শব্দটি শুনে মস্তক কণ্ডূয়ন শুরু করে দিলে উনি ব্যাখ্যা করলেন— ‘রবীন্দ্র পরিমণ্ডলে থাকি আর কী।’ দ্বিতীয় কিস্তির জন্য যে গানগুলি মাস্টারদের মজুত থাকত তা হল— ‘দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে’, ‘ওগো আমার চির অচেনা পরদেশী’, ‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়’, ‘আমি রূপে তোমায় ভোলাব না, ভালবাসায়...’ তা, এই গানটা দিদির মতো ফরসা মেয়ে গাইবে কেন? ও প্রথমটাই গাইল। বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। আমি তখন সদ্য হায়ার সেকেন্ডারি। ১৯৬৮, দিদির শ্বশুরমশাই শিক্ষক। আমরা কন্যাযাত্রী। লুচি আর বেগুনভাজা খেতে খেতে শুনলাম ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’। কোমরে গামছা বাঁধা একটা ছেলে এল, পিছনে বাগচিবাবু। বললেন, ‘এই আইটেম-টার নাম তিল পটলেশ্বরী। পটলের সঙ্গে তিল বাটা মেশানো ছানা আছে। ঠাকুরবাড়ির রান্না। বেশি করে খান।’

খামকা পটলের তরকারি খেতে যাব কেন? শেষ কালে রসগোল্লা এল। কী আশ্চর্য, তখন গান হচ্ছিল ‘আরো আরো, প্রভু, আরো’। সত্যি! কালো বাক্সের ভিতর থেকে এ কী গভীর বাণী। ও হ্যাঁ, পাত্রর নাম বাণীকণ্ঠ।

দিদিও ক্রমে ক্রমে রাবীন্দ্রিক হয়ে উঠতে লাগল। জানলাকে বলল বাতায়ন। সিঁড়ির কোনার ইঁদুর নাদিকে বলল ইঁদুর গুটি (‘পটি’ শব্দটা তখনও আসেনি)।

এক দিন দিদির শ্বশুর একটা রুপোর কৌটো দেখিয়ে বললেন, ‘এই পেটিকায় কী আছে জানো?’ গেয়ে উঠলেন ‘এই পেটিকা আমার বুকের পাঁজর যে রে...’ খুললেন। একটা লাল ভেলভেট ছাড়া আর কিছু দেখতে পেলাম না। উনি বললেন ‘ভাল করে দেখো, গুরুদেব শুয়ে আছেন।’ তার পর বললেন, ‘তাঁর প্রয়াণের পর অনুগমনে গিয়েছিলুম। দুটি মাত্র কেশ সংগ্রহ করতে পেরেছিলুম। মুখের।’ বলি, ‘দাড়ি? ছিঁড়ে নিয়েছিলেন?’ উনি বললেন, ‘না না। সংগ্রহ।’

দিদির মেয়ে হল। নাম রাখা হল নন্দিনী। ‘রক্তকরবী’র। এক বছরের মধ্যেই বোঝা গেল মেয়েটি মূক ও বধির। উনি মেয়ের নাম পালটে রাখলেন সুভা। বললেন, ‘কী আশ্চর্য সমাপতন দেখেছ? গুরুদেবের গল্পে সুভার বাবার নামও বাণীকণ্ঠ। আমার নাম হরিদাস। এতে আমার কোনও হাত ছিল না। ছেলের রাবীন্দ্রিক নাম দিয়েছিলাম ‘বাণীকণ্ঠ’। কিন্তু বাণীকণ্ঠের কন্যা সুভাকে গুরুদেব মূক ও বধির করেছিলেন— তখন ভাবিনি কেন?’

১৯৮৩-র ৯ ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথের বিবাহের ১০০ বছর পূর্ণ হয়। বাগচিমশাই তাঁর সোনারপুরের সোনাঝুরি গাছ লাগানো, ‘সোনার তরী’ ফলক লাগানো নতুন বাড়িতে রবীন্দ্রবিবাহের শতবর্ষ উদ্‌যাপন করলেন। ভবতারিণী তথা মৃণালিনী ও রবীন্দ্রনাথের যুগল ছবি। বাগচিমশাই বললেন, ‘আমার ৮৪ হল। এই আমার শেষ কাজ।’

ঠাকুরবাড়ির রান্না। সেই কোলাহলে মিষ্টি পানের রেকাবি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল দ্বাদশ বর্ষীয়া মূক ও বধির রাবীন্দ্রিক বালিকা সুভা। শব্দহীনা।

swapnoc@rediffmail.com

Rabibasariya Magazine Magazine Rabibasariya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy