Advertisement
১৯ মে ২০২৪

শামিমের প্রেম

থ্রিলার ছবির চেয়ে কোনও অংশে কম ছিল না ‘শামিম রহমানি খুনের মামলা’।

ছবি: কুনাল বর্মণ

ছবি: কুনাল বর্মণ

শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:১৭
Share: Save:

মুসলমান মেয়ে শামিমের গুলিতে নিহত হলেন এক হিন্দু ডাক্তার। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হল মেয়েটি। কিন্তু বিপুল সংখ্যক জনতার সমর্থন তারই দিকে। ঊর্মি নাথ

লখনউ। ১৯৬৮ সালের ১১ জুলাই। ২৩ নং কান্দহারি লেন। ‘মির মঞ্জিল’ বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল পাড়ারই দর্জি কালিকা। হঠাৎ, গুড়ুম! এক বার নয়, পর পর দু’বার গুলির শব্দ। আড্ডায় ছেদ পড়ল। ঘোর কাটতেই শব্দের সূত্র ধরে কালিকা ছুটল মির মঞ্জিলের সদর দরজার দিকে। আর তখনই শুনতে পেল নারীকণ্ঠ, ‘‘ডাক্তার আমাকে ঠকিয়েছে। আমার জীবন নষ্ট করে দিয়েছে। ওকে খুন করে আমি কোনও ভুল করিনি।’’ কান্না-জড়ানো এই কণ্ঠস্বর কালিকার পরিচিত। এ কণ্ঠস্বর শামিম রহমানির, যে শুধু মির মঞ্জিলই নয়, সারা এলাকার সবচেয়ে আকর্ষণীয়া। তার লম্বা ঘন চুল আর মধুরঙা চোখের সম্মোহনে ঘায়েল গোটা মহল্লা। বাঁধভাঙা কান্নার শব্দের মধ্যেই কালিকার আবার কানে এল, ‘‘ভাইয়া, এই বন্দুকটা দিয়ে আমাকে মেরে ফেলো। আমি আর বাঁচতে চাই না।’’

থ্রিলার ছবির চেয়ে কোনও অংশে কম ছিল না ‘শামিম রহমানি খুনের মামলা’। এই মামলা ষাটের দশকে গোটা দেশে হইচই ফেলে দিয়েছিল। হইচই ফেলার অন্যতম কারণ, খুনি এক মহিলা।

তখনও সমাজ বিশ্বাস করত, খুন শুধু পুরুষই করতে পারে। তাই হয়তো পরের দিনের খবরের কাগজের প্রথম পাতায় হেডলাইন হয়, “ছাত্রীর গুলিতে নিহত সরকারি ডাক্তার: দোষীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’’

শিক্ষিত, সুন্দরী, সপ্রতিভ, ধনী পরিবারের বছর বাইশের মেয়ে শামিম। কলেজের পড়াশোনা শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। ইসলামি রক্ষণশীলতা ছিল না তাঁর পোশাকে বা মনে। ষাটের দশকে এক জন মুসলিম রমণী হিসেবে যথেষ্ট ব্যতিক্রমী ছিলেন তিনি। কারণ তাঁর বাবা রাজা আজিজুর রহমানি। মেয়ে-অন্ত-প্রাণ আজিজুর ছিলেন উত্তরপ্রদেশের লখিমপুর খেরির তালুকদার। পঞ্চাশের দশকে জমিদারি প্রথা লুপ্ত হয়। ভূস্বামীরা জমিদারি হারালেও তাঁদের প্রতিপত্তি ও সম্মান অটুট ছিল। অনেকেই চলে এসেছিলেন রাজনীতিতে। আজিজুর রহমানি ছিলেন এমনই এক জন। ক্ষমতা হারিয়েও ক্ষমতাবান।

১৯৬৮ সালের ১১ জুলাইয়ের পটভূমি তৈরি হয়েছিল কিন্তু দু’বছর আগে। ১৯৬৬ সালের মে মাসে, আজিজুর বাড়িতেই হঠাৎ হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হন। তড়িঘড়ি তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় লখনউয়ের বলরামপুর হাসপাতালে। ভিআইপি ওয়ার্ডে তাঁর চিকিৎসার জন্য ডাক্তারদের নিয়ে তৈরি হল একটা মেডিক্যাল টিম। সর্বক্ষণ নজরে রাখা হল আজিজুরকে। সুচিকিৎসা পেয়ে কয়েক দিন পরে তিনি সুস্থ হয়ে ফিরে এলেন বাড়িতে। আজিজুরের এই মেডিক্যাল টিমেই ছিলেন ডাক্তার হরি ওম গৌতম। বছর তেত্রিশের সুপুরুষ। ডাক্তার হিসেবেও মন্দ ছিলেন না। কিন্তু তাঁর নামডাক ছিল অন্য কারণে। মেয়েদের মন জয় করতে জুড়ি নেই। গৌতমের আসল চেহারা বলরামপুর হাসপাতালের ডাক্তার থেকে নার্স বা অন্য কর্মচারীদের জানতে বাকি ছিল না। হাসপাতালে আজিজুরের চিকিৎসা চলাকালীন প্রথম বার ডাক্তার গৌতমকে দেখেন শামিম। আর উল্টো দিকে ওই প্রথম দিনই শামিমের উপর চোখ আটকে গেল গৌতমের।

হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার পর প্রথম প্রথম দু’-এক দিন অন্তর আজিজুরকে দেখে যেতেন গৌতম। তাঁর দায়িত্বজ্ঞানে তখন মুগ্ধ আজিজুর ও তাঁর পরিবার। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছিলেন গৌতম। ধীরে ধীরে দু-এক দিন পরিণত হল প্রতি দিনে। প্রতি দিন থেকে দু’বেলা! আজিজুরের স্বাস্থ্য তখন উপলক্ষ মাত্র। ডাক্তারকে চোখে হারাচ্ছেন শামিম। গৌতম হিন্দু। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। তায় বিবাহিত এবং দুই সন্তানের পিতা। কিন্তু প্রেমে অন্ধ শামিম। ডাক্তারের সম্পর্কে লোকশ্রুতিতেও তাঁর হুঁশ ফিরল না। শামিমের জগৎ জুড়ে তখন শুধুই হরি ওম গৌতম। ডাক্তারও তাল দিয়ে চলছিলেন সেই প্রেমে। শুধু শামিমকেই নয়, ব্যবহার, ব্যক্তিত্ব, ভালবাসা দিয়ে তিনি মন জয় করে ফেলেছিলেন রহমানি পরিবারের অন্য সদস্যদেরও। শামিম কখনও তাঁদের প্রেমকে গোপন করতে চাননি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে, গৌতমের স্কুটারের পিছনে বসে রঙিন ওড়না উড়িয়ে তিনি মহল্লার সকলের সামনে দিয়ে চলে যেতেন। তার পর এক দিন, শামিম গৌতমের মনের প্রেম অতিক্রম করল শরীর।

শামিম-গৌতমের সম্পর্ক তখন মহল্লার সকাল-সন্ধের মুচমুচে খবর। প্রতিবেশীর মধ্যে অনেকেই পছন্দ করতেন না শামিমের এই উদ্দাম জীবন। তাদের ঘরেও যুবতী মেয়ে আছে, এই সম্পর্ক যদি তাদের মনেও বিষ ঢোকায়? কিন্তু প্রতিবাদ করবে কে? জমিদারি না থাক, রাজনীতির যোগাযোগে তখনও তুমুল প্রতিপত্তি আজিজুরের।

শামিম ছাড়া সকলেই বুঝতে পেরেছিলেন ডাক্তার গৌতমের মনের কথা। তাঁর কাছে শামিম খেলনাই ছিল। খেলনা ক্রমে একঘেয়ে হল। ডাক্তার গৌতম আসা-যাওয়ায় হ্রাস টানলেন। শামিম পরিবর্তনটা টের পেয়েছিলেন। অন্য এক মেয়ের সঙ্গে নির্জনে ঘুরতে দেখা গিয়েছে গৌতমকে— খবরটা কানে এলেও প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেননি শামিম। কিন্তু একবার নয়, এমন খবর বারবার আসতেই থাকে শামিমের কানে। একটা প্রমাণের অপেক্ষা করছিলেন শামিম। সে সুযোগও এল। গৌতম অন্য মেয়ের হাত ধরে বসে আছে, দেখে ফেলেন তিনি। শামিম গিয়ে সপাটে চড় মারলেন ডাক্তারের গালে। প্রকাশ্যে চড় খেয়েও গৌতমের কোনও হেলদোল নেই। কয়েক দিন পর শামিম আবার খবর পেলেন, স্কুটারের পিছনে অন্য এক মেয়েকে নিয়ে গৌতম উড়ে বেড়াচ্ছেন। শামিম ভেঙে পড়লেন কষ্টে, ঘেন্নায়।

১১ জুলাইয়ের সেই সন্ধ্যায় গৌতম সপরিবার নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়েছিলেন এক অনুষ্ঠানবাড়িতে। রাত ঘনিয়েছিল। হঠাৎ ওই ভিড়ের মধ্যে দেখতে পেলেন শামিমের পরিচারককে। চুপিচুপি এসে সে গৌতমের হাতে ধরিয়ে দিল চিরকুট। শামিম লিখেছেন, গৌতম যেন একটি বার মির মঞ্জিলে আসে। অত রাতে শামিমের চিরকুট! একটু হতবাক গৌতম। পরক্ষণেই মনে এল, সম্পর্কে চিড় ধরার আগে শামিম চেয়েছিলেন, তাঁর এমএসসি ফর্ম ফিল-আপটা গৌতমই যেন করেন। শামিমের বিশ্বাস, গৌতমই তাঁর লাকি চার্ম। সম্ভবত সে দিন গৌতম মনে মনে হেসেছিলেন, সেই তো তাঁকে ডাকতেই হল! ভাগ্যও বুঝি হাসছিল অলক্ষে।

মির মঞ্জিলে গিয়ে শামিমের সঙ্গে দেখা করলেন গৌতম। মিনিট কুড়ি থাকার পর বেরিয়ে এলেন। কিন্তু নিজের স্কুটারে ওঠার আগে আবার শামিমের ডাক। ফিরে আসতে হল তাঁকে। কিন্তু এ বার চৌকাঠ পেরোতেই গর্জে উঠল বন্দুক! প্রথম গুলি ফসকালেও পরের গুলিতে লুটিয়ে পড়লেন ডাক্তার। তাঁর শরীরের একটা অংশ পড়ল ঘরের ভিতর, বাকিটা বাইরে। গুলির আওয়াজ পেয়েই ছুটে এসেছিল কালিকা।

খুনের দিনই পুলিশের কাছে গৌতমকে হত্যা করার কথা স্বীকার করেন শামিম। প্রতারক প্রেমিককে ক্ষমা করতে পারেননি তিনি। কিন্তু ঘোর কাটতেই উপলব্ধি ফিরল, এ কী সর্বনাশ করে ফেলেছেন আবেগের বশে! পুলিশের কাছে স্বীকার করলেও ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে খুনের কথা অস্বীকার করলেন শামিম। বললেন, গৌতমকে বাইরে থেকে অন্য কেউ খুন করেছে। তিনি নন। বিধি বাম। কিন্তু এই মিথ্যা ধোপে টেকেনি। মির মঞ্জিলের ঘরের ভিতর থেকে পাওয়া গিয়েছিল দু’টি কার্তুজ। সেগুলো ২০ বিএনই ডিবিবিএল বন্দুকের। এই বন্দুকের লাইসেন্স ছিল শামিমের ভাই শিকান্দর জাহানের নামে। বোনকে বাঁচানোর জন্য শেখু ওরফে শিকান্দরও মিথ্যে সাক্ষ্য দিয়েছিল। শেখুও গ্রেফতার হল।

শামিম ও গৌতমের প্রেমকাহিনির চেয়েও শিহরন বেশি ছিল খুনের বিচারে। ছ’বছর ধরে মামলা চলেছিল। সেই সময় বিবিসি কভার করেছিল এই মামলা। আইনজীবী কে এল গৌবা পরবর্তী কালে বই লিখেছিলেন, ‘শামিম রহমানি কেস অ্যান্ড আদার ফেমাস ট্রায়ালস’। সেশন কোর্টে শামিম দোষী সাব্যস্ত হন। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় তাঁর। একই শাস্তি বহাল ছিল নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত অবধি। শামিম আশা করেছিলেন, তাঁর শাস্তি মকুব হবে। কিন্তু আশার দীপ নিভে গেল। কালিকা যে এই মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী! প্রত্যক্ষদর্শী। গুলির শব্দ শোনার পর কালিকা শামিমের বাড়ির দিকে ছুটে গিয়ে দেখে, মির মঞ্জিলের ড্রয়িংরুম থেকে পশ্চিমের দিকের ঘরে শামিম ছুটে চলে যাচ্ছেন। গৌতমের দেহ পড়ে আছে, রক্তে মাখামাখি। আদালত রায় দিল, গৌতমকে খুন করার উদ্দেশ্যগুলো খুব পরিষ্কার। শামিম ও গৌতমের প্রেম, তার অগ্রগতি, প্রেমের মৃত্যু, প্রতিশোধস্পৃহা ও প্রেমিককে হত্যা। প্রতিটি পর্যায় আদালতের কাছে জলের মতো স্বচ্ছ। তাই হয়তো নিম্ন থেকে উচ্চ বিচারালয় কোথাও রায় বদলায়নি।

ডাক্তার গৌতম কেমন মানুষ ছিলেন তা সকলেই জানতেন। হয়তো যাঁরা প্রতারিত হয়েছিলেন, তাঁরাও খুশি হয়েছিলেন পরিণতিতে। ফিসফিসানি উঠল, শামিম উচিত শিক্ষা দিয়েছিলেন গৌতমকে। তাই হয়তো খুনি হয়েও শামিম সমর্থন পেয়েছিলেন অনেকেরই। যাতে তাঁর যাবজ্জীবন শাস্তি মকুব করে দেওয়া হয় তার জন্য কমিউনিস্ট পার্টির পার্বতী কৃষ্ণার কথায় অনেকেই শামিমকে সমর্থন করেছিলেন। চেয়েছিলেন, মেয়েটার সাজা রদ করা হোক। যদিও ছ’বছর ধরে মামলার চাকা গড়ালেও মাত্র দু’বছর শামিম জেলে ছিলেন। বুকে সংক্রমণ হওয়ার জন্য ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত তিনি জামিনে ছাড়া পান। সেই সময়ই রাজ্যপাল সি রেড্ডি বাকি সাজা ক্ষমা করেন।

সেই অর্থে জেলের ঘানি টানতে হয়নি শামিমকে। বরং যে দাপটের সঙ্গে তিনি বাঁচতেন, সেই গরিমা আমৃত্যু বজায় রেখেছিলেন। জেল থেকে বেরিয়ে অন্য জীবন শুরু হয় তাঁর। সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। সতীশ কউর, রাকেশ পাণ্ডের সঙ্গে হিন্দি ছবিতে অভিনয়ও করেছিলেন।

কান্দহারি লেনের ২৩ নম্বরে ‘মির মঞ্জিল’ এখন আর নেই। কিন্তু ‘শামিম কা হাত্তা’, মানে ‘শামিমের বাড়ি’ কোথায় ছিল খোঁজ করলে জায়গাটা নির্ভুল দেখিয়ে দেবে সকলে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Shamim Er Prem Urmi Nath
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE