Advertisement
E-Paper

নীল লাল রিহার্সাল

মহড়ার ফাঁকে জমে ওঠে খুনসুটি, প্রেমও। কেউ দৌড়ে আসেন অফিস-ফেরত, কেউ বা গোটা চাকরিটাই ছেড়ে দিয়ে।সদ্য স্কুল পেরিয়ে কলেজ। বন্ধুরা মিলে আচমকাই তৈরি হয়ে গেল নাটকের দল। কলেজ ফ্রেশার্স-এ নাটক করার তোড়জোড় শুরু। খুঁজে খুঁজে যে নাটকটি সবার খুব পছন্দ হল, সেটায় একটি মহিলা চরিত্র প্রয়োজন। সাত জন ছেলে আর একটি মেয়ের গল্প। আশির দশকের কথা, তখন ফার্স্ট ইয়ারে সবে ভর্তি হওয়া মেয়ে চট করে সাত জন অপরিচিত ছেলের সঙ্গে অভিনয় করবে এবং দিনের পর দিন রিহার্সাল দেবে— ব্যাপার সহজ ছিল না।

ঋকসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৫ ০০:০৫
ছবি: সুমিত্র বসাক।

ছবি: সুমিত্র বসাক।

সদ্য স্কুল পেরিয়ে কলেজ। বন্ধুরা মিলে আচমকাই তৈরি হয়ে গেল নাটকের দল। কলেজ ফ্রেশার্স-এ নাটক করার তোড়জোড় শুরু। খুঁজে খুঁজে যে নাটকটি সবার খুব পছন্দ হল, সেটায় একটি মহিলা চরিত্র প্রয়োজন। সাত জন ছেলে আর একটি মেয়ের গল্প। আশির দশকের কথা, তখন ফার্স্ট ইয়ারে সবে ভর্তি হওয়া মেয়ে চট করে সাত জন অপরিচিত ছেলের সঙ্গে অভিনয় করবে এবং দিনের পর দিন রিহার্সাল দেবে— ব্যাপার সহজ ছিল না। বরং একটি ছেলেকে খুঁজে পাওয়া গেল। একটু সরু গলার স্বর, দাড়ি-গোঁফ তুলনায় কম, গায়ের রং-ও ফর্সা। ঠিক হল, সে-ই হবে নায়িকা। শুরু হল রিহার্সাল। চরিত্রের ভিতর ঢুকে যাওয়ার জন্য ছেলেটিকে নির্দেশ দেওয়া হল, অভিনয়-সময়ের বাইরেও আচরণ করে যেতে হবে মেয়েলি। ট্রেনিং-এর অঙ্গ হবে: ক্লাসে মেয়েদের সঙ্গে বসা, মেয়েলি আড্ডায় যোগ দেওয়া, এমনকী বাড়ি ফেরার সময় পারলে বাসে-ট্রামে লেডিস সিটে বসা আর আড়চোখে ছেলেদের দেখা। নাটকের রিহার্সালের পাশাপাশি সারা দিন জুড়েই চলত তার রিহার্সাল। অবস্য এই ভয়ানক কষ্টকর ‘মেথড অ্যাক্টিং’-এর তৈয়ারি তাকে বেশি দিন করতে হয়নি। ক্লাসেরই অন্য একটি মেয়ে বিষয়টা জানতে পেরে নিজেই প্রস্তাব দিল, সে অভিনয় করতে চায়। কিন্তু নাটকের দলের সবাইকে তার বাড়ি গিয়ে বাবাকে রাজি করাতে হবে। যথারীতি সবাই বাবাকে রাজি করিয়ে ফেলল।

কিন্তু এ বার সমস্যা হল অন্য জায়গায়। এত দিন নাটক এবং তার রিহার্সালেই সবাই মগ্ন হয়ে ছিল, মেয়েটি আসার পর থেকে ফোকাস হয়ে গেল সে। যে ছেলেটি ভাল ক্রিকেট খেলে, সে এ বার রিহার্সালের রুমেই ডাইভ দিয়ে ক্যাচ লোফা দেখাতে লাগল, যে ক্যারাটে বিশারদ, সে বন্ধ জানলা খুলতে গিয়ে রদ্দা মেরে জানালার কাচ ভাঙল, হাতও কাটল। ভাল গান গাইত যে ছেলেটি, গুনগুন করতে করতে মাঝেমধ্যেই জোরে গেয়ে উঠল ‘বেকারার করকে হামকো’। মোট কথা, নাটকের রিহার্সাল ছাড়া ঘরটা হয়ে উঠল বহুমুখী প্রতিভার কর্মশালা। সে বার ফ্রেশার্স ওয়েলকামে আর নাটকটা করা হয়ে ওঠেনি।

অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলে নাটক করতেন কেয়া চক্রবর্তী। সারা দিন ছাত্র পড়িয়ে তিনি ক্লান্ত থাকতেন, চোখেমুখে ধরা পড়ত তার ছাপ। এক দিন নাকি বেশ বিরক্ত হয়ে রিহার্সালে অজিতেশবাবু বকাবকি করেন, বাকিদের এনার্জিতে ঘাটতি পড়ছে দেখে। সে দিন আর রিহার্সাল হয়নি। পর দিন আবার শুরু হয় এবং নির্ধারিত সময়ের আগেই পৌঁছে যান কেয়া দেবী। কারণ জানতে চাইলে তিনি শুধু বলেন, চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে এসেছেন। অজিতেশবাবু নাটকে অজস্র কাঁচা অভিনেতাদের জায়গা দিতেন। কারণ, তিনি বিশ্বাস করতেন, রিহার্সাল দিয়ে তাদের তৈরি করে নেওয়া সম্ভব। এ রকমই এক জন সরকারি অফিসের করণিক নাটকে একটি মাত্র দৃশ্য করবেন, পড়ে যাওয়ার। রোজ রিহার্স করেন, কিন্তু অজিতেশবাবুর পড়ে যাওয়ার ধরনটা কিছুতেই ভাল লাগে না। নাটকের দিনও এগিয়ে আসছে। এ বার সেই ভদ্রলোক রিহার্সালে এমন পড়া পড়লেন যে সোজা ডাক্তারখানা।

যাদবপুরের ভিতর থেকে ছোট ক্লাব বা অনেক বাড়িতেই বিভিন্ন নাটকের দল সান্ধ্য রিহার্সালের আসর বসায়। সেখানে একটি দলে নতুন একটি ছেলে যোগ দেয়। অভিনয় ভাল করে, কিন্তু ছেলেটি সম্পর্কে গুঞ্জন: সে সমকামী। এই নিয়ে ফিসফিস আলোচনা হচ্ছে দেখে, পরিচালক সবাইকে ধমকান, ছেলেটি আসার আগে। তার পরেও একটি ভিতু-টাইপের ছেলেকে খেপাবার জন্য নাটকের দলের বাকিরা সমানে বলতে থাকে, ‘ওই নতুন ছেলেটা তোর প্রেমে পড়েছে।’ নতুন ছেলেটির সঙ্গে এই ছেলেটির সিনও রয়েছে। সেই সিনে আবার নতুন ছেলেটিকে তার একটি কবিতা শোনানোর কথা। প্রেমের কবিতা। কী হবে? ওই কবিতা শুনে প্রেম যদি গাঢ় হয়ে যায়? তখন ভিতু ছেলেটি রিহার্সালে প্রত্যেক দিন প্রেমের কবিতার বদলে একটা ওজস্বী দেশাত্মবোধক কবিতা বলে যেতে থাকে (‘ওটা এখনও মুখস্থ হয়নি, এটা দিয়েই কাজ চালিয়ে নে না, কবিতাই তো!’)। নাটকে অবশ্য সে আসল কবিতাটাই বলেছিল।

রিহার্সাল দেওয়ার ঘর অনেকটা ছুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোনোর মতো। সবাই এক মাস রিহার্সাল দেবে বলে আবদার করে কারও বাড়ির এক তলা বা মামার বাড়ির ছাদের ঘর আদায় করে নিল। কিন্তু এক মাসের পরেও ওই ঘরে চলতে থাকে আনাগোনা। পরের নাটকের রিহার্সাল হয় ওই ঘরেই। এমনকী রিহার্সাল না থাকলেও, হ্যাঁ হ্যাঁ রিহার্সাল আছে বলে দু’দণ্ডের জন্য এক ছাদের তলায় নিরিবিলি খুঁজে নেয় অনেক যুগল। বাড়ির মালিক গজগজ করলেও ওই ঘরগুলো থেকে যায় রিহার্সাল রুম বলেই। নতুন নতুন মুখ আর সারি সারি চটি থাকে বাইরে।

বর্ধমানের এক নাটকের দলের গল্প। ৫০-এর ওপর বয়স এক অভিনেতা, রিহার্সাল দেওয়ার জন্য অফিস থেকে ফিরেই দৌড় লাগাতেন। নাটক-পাগল বরকে চিনলেও বাড়ির কাজের মাসির কাছ থেকে ওঁর স্ত্রী খোঁজ নিয়ে জেনেছিলেন, নাটকের দলে নতুন এক মহিলা এসেছেন, যিনি কুহকিনী। রিহার্সাল চলছে, ভদ্রলোক আর ওই মহিলা কী একটা কথায় হেসে প্রায় গড়াগড়ি যান, এমন সময় ভদ্রলোক দেখেন দরজায় স্ত্রী। রিহার্সাল এবং নাটক দুই-ই চলেছিল, কিন্তু এই ভদ্রলোকের স্ত্রী ওই নাটকে পার্শ্বচরিত্র এবং ক্রমে ওই দলেরই অংশ হয়ে গেলেন।

ব্রেখ্ট-এর নাটকের ফর্মুলা মেনেই প্রতিটি সিনের আগে ঘোষক সিনের সারাংশ পাঠ করেন। স্বাভাবিক ভাবেই রোজ রিহার্সালে ঘোষক আর পাঠ করেন না, শুধু অভিনয়ের অনুশীলন হয়। কাণ্ডটা ঘটল ঘোষককে নিয়েই। ‘গ্যালিলিও’ নাটকের অভিনয় চলছে মঞ্চে। নতুন দৃশ্য শুরু হবে, তার আগে অন্ধকার থেকে আলোয় আসতে গিয়ে পাতার হিসেব গন্ডগোল হয়ে গেল। ঘোষকের পাঠ আর মঞ্চের অভিনয় মিলল না। দর্শকাসনে দিকপাল সব অভিনেতা আর নাট্যকার। ঘোষক নাটক শেষ হতেই উধাও। বেশ কয়েক দিন দেখা নেই। পরে স্বয়ং শম্ভু মিত্র ঘোষককে ডেকেছিলেন রিহার্সালে। কাঁচুমাচু মুখ করে ভুলের কথা বলতে যেতেই শম্ভু মিত্র বলেছিলেন, ‘ও ভুল তুমি এক বারই করেছ। আর কখনও হবে না। রিহার্সাল থেকে তোমার পালিয়ে বেড়ানোই তার প্রমাণ।’

মেগাসিরিয়ালের মতো গতিশীল ধমাকায় রিহার্সালের সময়টুকু নেই। তবুও মেগার পরিচিত মুখ এক নায়িকা বললেন, এক বার বাংলাদেশের এক অভিনেতার সঙ্গে একটি দৃশ্য নিয়ে বেশ কয়েক বার রিহার্স করার পরেও কিছুতেই ঠিকঠাক হচ্ছে না। পরে আসল কারণটা স্পষ্ট হল। সংলাপে ‘ঝেড়েছি’ অর্থাৎ বকুনি দিয়েছি এই অংশে কিছুতেই সহজ হতে পারছিল না বাংলাদেশের ছেলেটি। কারণ, বাংলাদেশে ঝেড়েছি অর্থে ‘ঝাড়ি মেরেছি’ বোঝায়।

শুনেছিলাম, আমাদের পাড়ার নতুদা সব নাটকেই মৃত মানুষের চরিত্রে অভিনয় করত। সত্যি যে দিন নতুদা মারা গেল, কোন ফক্কড় ঠিক বলে উঠল, রিহার্সাল দিচ্ছে না তো?

banerjeeriksundar@gmail.com

rik sundar banerjee rabibasariya anandabazar Sombhu Mitra ajitesh bandopadhyay keya chakraborty homo sexual
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy