Advertisement
০১ মে ২০২৪

বৃন্দাবনের বিদ্রোহী

মন্দিরের দেওয়ালে কে এই বন্দুকধারী সন্ন্যাসী? যোদ্ধা ও নৃপতি অনুপগিরি? ইতিহাসের নতুন তথ্য। অশ্বঘোষ বস্ত্রহরণের আড়ালেই বন্দুক! এ দৃশ্য দেখতে হলে বৃন্দাবনে যমুনার ধারে চীরঘাটে যেতেই হবে। চীরঘাট মানে, গোপিনীদের স্নানের সময় বালক শ্রীকৃষ্ণ যেখানে তাঁদের চীর বা বস্ত্রখণ্ড চুরি করে একটা বড় গাছের মগডালে ঝুলিয়ে রাখতেন। সেই চীরঘাটের পাশেই শাহজি মন্দির। ১৮৭৬-এ লখনউয়ের মণিকার শাহ কুন্দন লাল এই মন্দির তৈরি করেছিলেন, ভিতরে কালো কষ্টিপাথরের যুগল রাধারমণ মূর্তি।

সন্ন্যাসী রাজা: বন্দুক হাতে অনুপগিরি। ছবি: সুমন চৌধুরী

সন্ন্যাসী রাজা: বন্দুক হাতে অনুপগিরি। ছবি: সুমন চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

বস্ত্রহরণের আড়ালেই বন্দুক! এ দৃশ্য দেখতে হলে বৃন্দাবনে যমুনার ধারে চীরঘাটে যেতেই হবে। চীরঘাট মানে, গোপিনীদের স্নানের সময় বালক শ্রীকৃষ্ণ যেখানে তাঁদের চীর বা বস্ত্রখণ্ড চুরি করে একটা বড় গাছের মগডালে ঝুলিয়ে রাখতেন।

সেই চীরঘাটের পাশেই শাহজি মন্দির। ১৮৭৬-এ লখনউয়ের মণিকার শাহ কুন্দন লাল এই মন্দির তৈরি করেছিলেন, ভিতরে কালো কষ্টিপাথরের যুগল রাধারমণ মূর্তি।

এই শাহজি মন্দিরের পিছনে এক জায়গায় কৃষ্ণের পাশেই সেই ছবি। শ্মশ্রুগুম্ফসমন্বিত দশাসই চেহারা, হাতে বন্দুক। পূজারী বলেন, এটি রাজস্থানের এক রাজার পোর্ট্রেট।

বছর দশেক আগে এই রাজার পরিচয় ফাঁস করেছেন আমেরিকার ওয়েসলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ উইলিয়াম পিঞ্চ। নাগা সন্ন্যাসী, ব্রিটিশ আমলের বিদ্রোহী সাধু ও চাষিদের ওপর গবেষণা করে তিনি বিখ্যাত। পিঞ্চ জানাচ্ছেন, এটিই অনুপগিরির একমাত্র ছবি। নদীর ধারে এই দোতলা শাহজি মন্দিরই ছিল তাঁর প্রাসাদ।

বুন্দেলখন্ডের অনুপগিরি আসলে সন্ন্যাসী রাজা। এক দিকে বৈরাগী, আবার সশস্ত্র সেনা দলের সেনাধ্যক্ষ ও জায়গিরদার। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মুঘল সম্রাটের হয়ে মরাঠাদের বিরুদ্ধে লড়ছেন, আবার বক্সারের যুদ্ধে মির কাশিম আর অযোধ্যার নবাব সুজাউদদৌল্লার পাশাপাশি ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে। শেষ দিকে চার হাজার অশ্বারোহী, ৮ হাজার পদাতিক ও ১৫০০ ঘোড়সওয়ার নিয়ে মরাঠাদের বিরুদ্ধে যোগ দিচ্ছেন লর্ড ওয়েলেসলির সঙ্গে। কখনও তথাকথিত নীতির বালাই রাখেননি। যে দিকে পাল্লা ভারী, ক্ষমতা বাড়াতে সে দিকেই ঝুঁকেছেন। এটাই সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকের প্রাক-আধুনিক হিন্দু সন্ন্যাসীর চরিত্র। টাকার জন্য কখনও হিন্দু পেশোয়ার সঙ্গে, কখনও আবার নবাবের সঙ্গে। আধুনিক হিন্দুত্বের হিন্দু বনাম মুসলমান দ্বৈরথে সেই ইতিহাসকে বোঝা যায় না। অনুপগিরির আর একটি নাম ছিল হিম্মত বাহাদুর। বক্সারের যুদ্ধে গুরুতর আহত হওয়ার পর নবাবের দেওয়া উপাধি। উর্দু হিম্মত শব্দ অনুপগিরির কাছে আদৌ অন্ত্যজ নয়।

এই অনুপগিরির জন্ম ১৭৩৪ সালে বুন্দেলখন্ডের কুলপাহাড় গ্রামে। জন্মের পরেই বাবার মৃত্যু। অনুপ ও তাঁর দাদা উমরাওগিরিকে তাঁদের মা তখন রাজেন্দ্রগিরি নামে মঠবাসী এক শৈব সন্ন্যাসীর কাছে নিয়ে আসেন। রাজেন্দ্র মঠাধীশ এবং ঝাঁসি অঞ্চলের ১১৪টি গ্রামের জমিদার। পিঞ্চ জানাচ্ছেন, অসহায় দুই শিশুকে মা আখড়ায় বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এটি তখনকার প্রথা। আখড়ার সন্ন্যাসীরা শিশুদের কিনে তাদের যুদ্ধবাজ চেলায় পরিণত করেন।

এই যুদ্ধবাজ চেলাবাহিনী ছাড়া রাজেন্দ্রগিরিদের অন্য রাস্তা ছিলও না। ঝাঁসির রাজা নাড়ুশঙ্করের জমিতে দুর্গ গড়ার অপরাধে রাজা তাঁকে বিতাড়িত করেন, রাজেন্দ্রগিরি অযোধ্যার নবাবের কাছে আশ্রয় নেন। কোম্পানির গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস এই সশস্ত্র সন্ন্যাসীদের দু’চোখে দেখতে পারেন না, রাজধানী কলকাতার রাস্তায় নাগা সন্ন্যাসীদের প্রবেশ বন্ধ করেছেন। মুঘল দরবারে তাঁর দূত জেম্স ব্রাউনকে বলছেন, অনুপগিরিকে চোখে চোখে রাখতে।

কিন্তু রাজনীতি অতি বিষম বস্তু। অনুপগিরি, উমরাওগিরিরা এই সময় মথুরা, বৃন্দাবনসহ বুন্দেলখন্ডের একটা বড় অংশ জয় করেছেন, মরাঠাদের যুদ্ধে হারিয়েছেন। অনুপগিরির দাদা উমরাওগিরি এক বার ইংরেজ দূতকে রেগে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি কেরানি নই। হাতে তরবারি, যুদ্ধ করি। ওটাই আমার ধর্ম।’

স্বত্ববিলোপ নাতির স্রষ্টা লর্ড ওয়েলেসলি এই সুযোগ কাজে লাগিয়েছিলেন। নাগা সন্ন্যাসী নিয়ে ওয়ারেন হেস্টিংসের মতো ছুঁতমার্গ তাঁর ছিল না। তিনি জানতেন, এরা বন্দুক থেকে রকেট অনেক কিছুই ছুড়তে জানে। ওয়েলেসলির হয়ে তাই যুদ্ধে গেলেন অনুপগিরি। আহত হয়ে ১৮০৪ সালের ৩ জুন মারা গেলেন। বুন্দেলখন্ড, রোহিলাখন্ডের একটা অংশ দখল করতে ইংরেজদের আর বাধা থাকল না।

সন্ন্যাসীরাও শোধ তুলেছিল। আনন্দমঠের সন্ন্যাসী বিদ্রোহই সব নয়। সিপাহি বিদ্রোহের লখনউ, কানপুর বা অওধে বিদ্রোহী সিপাহিদের পাশাপাশি সমান তালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়েছিল অনুপগিরি, উমরাওগিরিদের শিষ্য-প্রশিষ্যরাও। শৈব গোঁসাই এবং বৈরাগী বৈষ্ণব দুই তরফই তখন সৈন্য পোষেন, ভাগাভাগি নেই। শৈব অনুপগিরি তাঁর প্রাসাদ তৈরি করেন যমুনার ধারে বৃন্দাবনে। শ্রীকৃষ্ণের প্রপৌত্র বজ্রনাভ তো মথুরা, বৃন্দাবনে শুধু কৃষ্ণমূর্তি স্থাপন করেননি। বৃন্দাবনে গোপেশ্বর, মথুরায় গোপেশ্বর শিবলিঙ্গ তাঁরই প্রতিষ্ঠিত।

সেই ইতিহাস আজ তাঁর ছবির মতোই ধূসর। পিঞ্চ জানিয়েছেন, অনুপগিরির ছবিটি আবিষ্কার করার থেকেও তাঁকে চমকে দিয়েছিল অন্য একটি তথ্য। উত্তরপ্রদেশের স্থানীয় আধিকারিকেরা তাঁকে ১৯৭৮ সালের একটি দলিল দেখিয়েছিলেন। সেখানে লেখা, যমুনার ধারে শাহজি মন্দির সংলগ্ন পরিত্যক্ত দুর্গটি তৈরি করেছিলেন সিন্ধিয়া হিম্মতরাও বাহাদুর।

সিন্ধিয়া? মুঘল আমলের শেষে হিন্দুরা যে হিন্দু মারাঠার বিরুদ্ধে লড়ত, হিন্দু সন্ন্যাসী ভাড়াটে সৈন্য হিসাবে অওধের নবাবের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে লড়ত, আধুনিক ভারত তা বিস্মৃতির আড়ালেই রেখে দিতে চায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Anup Giri
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE