নেক ভুল বোঝাবুঝি, কথা কাটাকাটি, ভায়োলেন্স না হলেও হাতের বদলে মুখ চলেছে। সবাই চুপ করে গেছে এক সময়। কলেজ ছাড়ার পরে এত বছরে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। কম বয়সে একই পরিস্থিতিতে সবাই হ্যাঁ হ্যাঁ করতাম। এখন সেটা আর হচ্ছে না। যারা দাঁড়িয়ে গেছে তাদের গলার জোর বেশি। কিন্তু সফিস্টিকেশনে অভ্যস্ত হওয়ায় তারা কখনওই গলা তুলছে না। জীবনে যারা খুব সুবিধে করতে পারেনি, এই যেমন আমি, নিস্তব্ধতার মধ্যেও শুনতে পাচ্ছি এয়ারকন্ডিশনারের হিসহিস। শীত করছে। ভাল লাগছে না। গরম আপত্তি টপকে দিচ্ছি ই-মেলে। তার উত্তর না দিয়ে কোনও অপ্রাসঙ্গিক রগড় অথবা চিনেরা কেন চাউমিন খায় না তার সমীক্ষা ফেরত আসছে। মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে। ‘তিরিশ বচ্ছর ধরে আমাদের এত বড় ইয়ে, সেটার কোনও দাম নেই?’ শান্ত ভাবে কথাটা বলল প্রশান্ত। ঠান্ডা মাথা, সব সময় ফুরফুরে। বড় কোম্পানির বিশাল কত্তা। মুম্বই থেকে অনেক দূরে পালিতে ফার্মহাউস কিনেছে। এগজটিক ভেজিটেব্লস করছে। দারুণ বাংলো। প্রত্যেক সপ্তায় যায়। ‘এসো এক বার।’ এতটাই আন্তরিক ভাবে বলল যে সবাই রাজি হয়ে গেলাম।
পৌঁছেই মন ভাল হয়ে গেল। দু’একর জমির এক পাশে ছবির মতো একতলা বাড়ি। ঘরের চেয়ে বারান্দা বেশি চওড়া। টালির চাল আড্ডা মারার মতলবে নেমে এসেছে নরম ঘাসের লন পর্যন্ত। ছোট ছোট কাচের ফানুসের মধ্যে আলো আছে। জ্বালার দরকার পড়বে না, কারণ সামনেই পূর্ণিমা। দিনের আলোতেই তারা ঝলমল টিয়ার ড্রপ। হালকা ঠান্ডা আছে ছায়ায়। ফেনা ভরা বিয়ার বট্লের ছোট্ট দিগন্ত দ্রুত নামতে লাগল। তার ওপর দিয়ে কাচের ভেতর দিয়ে দূরের হলুদ সবুজ গাছপালা অ্যাক্রিলিক পেন্টিংয়ের মতো দেখছি। ব্যানার্জি রান্নাঘরে। পাঠক বাগান দেখতে চলে গেছে। সান্যাল মোবাইলে, ভারী গলায় কথা বলছে। গৃহস্বামী সর্বত্র। পুলকের কবিতা এসে গেছে, লিখছে। আমি পা ছড়িয়ে কাঠের বেঞ্চে। কিশোর চুপচাপ। শুধু এক বার বলল, ‘যা আছে, তাতে হয়ে যাবে তো?’ কে যেন চেঁচিয়ে বলল, ‘তখন থেকে কী দৌড়োদৌড়ি করছ! বোসো না!’ ‘নাসিকের ওয়াইনগুলো একদম ডাইলিউট, কেন খায় লোকে? তুমি বসাও এখানে, আঙুর তো পাওয়া যায়’, বললাম। ‘আসছি আসছি, জাস্ট রিল্যাক্স।’ আবার চুপচাপ। খালি হয়ে যাওয়া বিয়ারের বট্লের মুখে চোখ লাগিয়ে দূর তাকালাম আমি।
একটু হাঁটতে বেরলাম রোদ পড়তেই। গাড়ি চলা রাস্তার দু’পাশে পর পর জমি। কোথাও বাড়ি আছে, লোক থাকে, বোগেনভিলিয়াতে বাড়ির সদর দরজা দেখা যায় না। অনেকে কিনেছে। কিন্তু কিছু করেনি। ফেলে রেখেছে। নিয়ম অনুযায়ী লোহার গেট আছে। মরচে পড়ে গেছে। দু’পাশে কোনও পাঁচিল নেই। কোথাও তারকাঁটাগুলো অবধি খুলে পড়ে গেছে। রাতারাতি জমি চুরি বা জবরদখলের ভয় নেই এখানে। অসমান জমিতে লুটোপুটি খাটছে খেয়ালখুশিমত বেড়ে ওঠা অবাধ্য ঘাস, ঝোপ, গাছপালা। দূরে পাহাড়, নিশ্চয়ই ওয়েস্টার্ন ঘাট-এর অংশ। ইলেকট্রিক ট্রান্সমিশন লাইন। তার নীচে একটা ট্রাক্টর ঘুরছে-ফিরছে একই জায়গায়। কোথাও একটা পাইপ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া জলের শব্দ। আমরা এলোমেলো হাঁটছি শুকনো ঝরাপাতার ওপর দিয়ে। কলকাতায় এমন আলো হয় না। পায়ের তলায় এমন স্পর্শ পাই না। গাড়ির হর্ন আর পাখির কিচিরমিচির আলাদা করা যায় না। সিঁটিয়ে থাকি অপ্রিয় কথা শোনার ভয়ে। ফাঁকিবাজ শীতের পরেই ফ্যানের হাওয়া ঝাঁপিয়ে পড়ে গ্রীষ্মের হুমকি নিয়ে। এখানে ও সবের বালাই নেই। কেমন অন্য রকম চার পাশ। আমরা যারা এখন কোনও কথা বলছি না বিশেষ, সবাই হেমন্তের অরণ্যে কিছুটা বেমানান। প্রশান্তকে বললাম, ‘গরমে একা আসব এক বার, থাকব ক’দিন, চুপচাপ।’
বাড়ি ফিরে দেখছি বারবিকিউ-এর আয়োজন সম্পূর্ণ। চারকোলে লাল আগুন ধরে নিয়েছে। অতি যত্নে ম্যারিনেট করা পর্ক রিব্স অপেক্ষা করছে আগুনে যাওয়ার জন্য। এ সব তৈরি করে পাঠিয়েছে জয়দীপ, মুম্বইয়ের বিখ্যাত শেফ, দারুণ ছেলে। চাঁদও পিছলে যেতে যেতে নিজেকে ধরে রাখতে পেরেছে ঢালু টালির চালের ওপরে। ফুঁ দিয়ে দিয়ে আগুনটা একটু তাগড়া করে নিয়ে চকচকে মাংসের টুকরোগুলো সাজাতে শুরু করলাম লোহার জালে, ঢিমে আঁচে তৈরি হবে স্বর্গসুখ। এ দিকে ঘন নীল বোতল থেকে গাঢ় সোনালি শান্তির জল পৌঁছে গেছে সবার হাতে। কেউ খাচ্ছে সরাসরি, কেউ বরফ দিয়ে। চলবে এ সব রাত অবধি, তার আগে কেউ কেউ বাড়ি বা অফিসের সঙ্গে কথাবার্তাও সেরে নিচ্ছে। একটু অন্যমনস্ক, আলাদা থাকায় ডাকলাম, পুলক একটু উদ্বিগ্ন মুখে বলল, ‘এ দিকে এসো, কথা আছে একটু।’
ফিরে এসে দেখলাম আড্ডা জমে উঠেছে। যারা মুম্বইতেই থাকে তারা জোর গলায় বলছে, ‘থাকা যায় না এখানে, এক দিন ফেটে পড়বে।’ ‘তা হলে এখানে থাকার অত আঠা কীসের বাওয়া?’ ‘কাজ না করলে চলবে? কলকাতা তো শেষ, কিস্যু হবে আর ওখানে?’ ‘সেই তো সত্যজিৎ আর সৌরভ শুরু করবে, কী লাভ?’ এরই মধ্যে কিশোর ঢুকে পড়ল, ‘চায়নায় এত লোক কিন্তু কোনও ঝামেলা নেই, অল ফাইন।’ বলতেই, ‘তুমি দেখেছ, অল ফাইন? বেজিং, সাংহাইয়ের বাইরের মডার্নিটি দিয়ে বিচার করলে চলবে? অ্যাপ্ল-এর ফ্যাক্টরির মধ্যে লেবাররা কী পরিস্থিতিতে কাজ করতে বাধ্য হয় জানা আছে?’ প্রথম রাউন্ডের কাবাব রেডি, সার্ভ করলাম সবাইকে, আলোচনাটাও চাপা পড়ল। তৃতীয় রাউন্ডের ড্রিংক্স ফুরোনোর আগে আবার জেগে উঠল মতান্তরের ভিসুভিয়াস। পর্ক-এর পর এ বারে চিংড়ি, আগুনে দিতেই অদ্ভুত সুন্দর পোড়া গন্ধ, নীল ধোঁয়া একটু শুকিয়ে, গুটিয়ে নিচ্ছে নিজেদের। উঠে গিয়ে সব আলো নিভিয়ে দিতেই চার পাশে নীল অন্ধকার, মাথার ওপর চাঁদের স্পটলাইট। কালো চারকোলের সর্বাঙ্গে চাপা লাল আগুন। চিংড়ি পুড়ছে। আমরাও হয়তো পুড়ে যেতাম। বাঁচিয়ে দিল একটা ফোন কল।
মুম্বইতে রেড অ্যালার্ট! অনেক পয়েন্টে জঙ্গি নাশকতার প্ল্যানের খবর পাওয়া গেছে। আগের বার কোলাভায় ব্লাস্ট হয়েছিল, এ বারে নাকি উত্তর মুম্বইতে টার্গেট। ঝপাঝপ ডিসিশন নেওয়া হল, যা হয় হবে, আজই ফেরা হবে। সবার ফ্যামিলি রয়েছে ওখানে। বড় কিছু ঘটে গেলে রাস্তাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। হাতে ঘণ্টা দেড়েক সময়। হুটহাট গাড়িতে চেপে বসলাম সবাই, হাইওয়েতে উঠতে সময় লাগল মিনিট দশেক। টেনশন হচ্ছে, কথাবার্তা নেই বিশেষ। যেটুকু উঠছে, চাপা পড়ে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি। শহরে ঢোকার মুখে পুলিশ চোখে পড়ল, গাড়ি থামিয়ে চেক করছে। আমাদের অবশ্য আটকাল না। বাড়ি পৌঁছে লিফ্টের দরজা খুলতেই কিশোরের বউ-বাচ্চারা হইহই করে, ‘এ কী আজ চলে এলে কেন? দাঁড়াও ভাত বসাচ্ছি।’ পালি-তে যে আড্ডাটা হচ্ছিল, সেটা আর কারুরই মনে নেই। সবাই টিভিতে চোখ রেখেছে। বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়ল। আমরা জেগে রইলাম বেশ কিছু ক্ষণ। বারান্দা দিয়ে মুম্বইয়ের ঝলমলে স্কাইলাইনটা একই রকম রইল।
সকালে একটু দেরিতেই উঠলাম। বাচ্চারা স্কুলে চলে গেল। আমরা ব্রেকফাস্ট সারলাম অনেক ক্ষণ ধরে, টিভিতে বলল, কোথাও কিছু হয়নি। ওটা একটা ড্রিল ছিল, মানুষকে অ্যালার্ট করার জন্যে। পরের দিন ২৬ জানুয়ারি, তাই।
suvolama@gmail.com
ছবি: লেখক।