Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Sudhir Kumar Sen

ভারতে সাইকেল শিল্পের পথপ্রদর্শক

তাঁর উদ্যোগে এবং বিদেশি ‘র‌্যালে’ কোম্পানির সহায়তায় দেশের প্রথম সাইকেল কারখানা স্থাপিত হয় আসানসোলের কন্যাপুরে। উদ্যমী শিল্পপতি সুধীরকুমার সেনকে আমরা মনে রাখিনি। 

sudhir kumar sen

পথিকৃৎ: সুধীরকুমার সেন

অরুণাভ সেনগুপ্ত
শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০২৩ ২২:১৩
Share: Save:

সাইকেল আবিষ্কারের প্রামাণ্য দাবিদার জার্মানির ব্যারন কার্ল ফন ড্রাইস। ১৮১৭ সালে তিনি প্রথম প্যাডেলবিহীন, দু’পা ব্যবহার করে চালানো সাইকেল আবিষ্কার করেন। এর পর বিভিন্ন পর্যায়ে উন্নীত হতে হতে ইউরোপে ‘সেফটি মডেল সাইকেল’-এর নির্মাণ শুরু হয় উনিশ শতকের শেষ দিকে। সাইকেল ভারতের মাটিতে প্রথম চাকা রাখল বিশ শতকের প্রথম দিকে। ভারতে সাইকেল শিল্পের পথিকৃৎ এক বাঙালি, তাঁর নাম সুধীরকুমার সেন। তাঁর উদ্যোগে ১৯৫২ সালে ভারতে প্রথম সাইকেল কারখানা স্থাপিত হয় আসানসোলের কন্যাপুরে।

সুধীরকুমার সেনের জন্ম ১৮৮৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি, অবিভক্ত ভারতের বরিশালের বাসন্ডা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। বাবা চণ্ডীচরণ সেন, মা বামাসুন্দরী দেবী। বিবাহসূত্রে সুধীরকুমার সেন হয়েছিলেন ডা. নীলরতন সরকারের জামাই।

মেধাবী ছাত্র সুধীর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি সাম্মানিক-সহ স্নাতক হন। তখন ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন হ্যারিংটন হিউ মেলভিল পার্সিভাল। অধ্যাপক পার্সিভাল তাঁর ছাত্রদের মনে অনন্য কিছু করার চেতনা সঞ্চারিত করে দিতে পারতেন। সুধীরকুমার সেন যে এক অন্য ধারার স্বপ্নদর্শী মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন এবং সাফল্যও অর্জন করেছিলেন, তার কৃতিত্ব তিনি দেন পার্সিভাল সাহেবকেই।

তিনি তখনকার ‘প্রভিনশিয়াল এগজ়িকিউটিভ সার্ভিস’-এর উচ্চ বেতনের মোহ ছাড়তে পেরেছিলেন। তখন প্রফুল্লচন্দ্র রায় বাঙালিদের ডাক দিচ্ছেন বাণিজ্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করে স্বয়ম্ভর হওয়ার। প্রফুল্লচন্দ্র নিজে ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল’ স্থাপন করেছেন। স্থাপিত হয়েছে সুরেন্দ্রমোহন বসুর ‘ডাকব্যাক’ কোম্পানি, গৌরমোহন দত্তের ‘জি ডি ফার্মাসিউটিক্যালস’। আদর্শ হিসেবে সামনে ছিলেন তাঁরই কলেজের প্রাক্তন ছাত্র শিল্পপতি রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।

সুধীরকুমার সেন রামচন্দ্র পণ্ডিতের সহায়তায় ১৯০৯ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘সেন অ্যান্ড পণ্ডিত কোং’, মাত্র চারশো টাকা মূলধন নিয়ে। কিছু দিনের মধ্যে কোম্পানির একক মালিকানা অর্জন করেন তিনি। তার পর ইউরোপ থেকে বাইসাইকেল ও বাইসাইকেলের খুচরো যন্ত্রাংশ আমদানি শুরু করেন। সাইকেল শিল্পকে ভারতে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্য তাঁর অধ্যবসায়ের অন্ত ছিল না। তিনি ১৯১২ সালে ইংল্যান্ডে যান ইউরোপিয়ান সাইকেল নির্মাতাদের বাণিজ্যিক সম্মেলনে যোগ দিতে। প্রতি বছরই তিনি ইংল্যান্ড, জার্মান,আমেরিকা প্রভৃতি দেশে যেতেন বিপণন কৌশল সম্বন্ধে শিক্ষালাভের জন্য। ভারতে সাইকেল শিল্পকে জনপ্রিয় করার জন্য ১৯১৭ সাল থেকে তিনি ‘ইন্ডিয়ান সাইকেল অ্যান্ড মোটর জার্নাল’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা চালু করেন। তাঁর সঙ্গে বাণিজ্যিক সখ্য ঘটে বিলেতের বিখ্যাত সাইকেল কোম্পানি ‘র‌্যালে বাইসাইকেল কোম্পানি’-র।

ইউরোপে ‘সেফটি মডেল বাইসাইকেল’ নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে র‌্যালে সাইকেল বিপুল জনপ্রিয় হয়েছিল। উদ্যোগী হয়েছিল বিভিন্ন দেশে স্থানীয় কোম্পানির সঙ্গে সহ-উদ্যোগে সাইকেল কারখানা স্থাপনে। দেশের স্বার্থে এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন সুধীরকুমার সেন। তিনি ১৯৫২ সালে প্রায় ১,২৫,০০০ স্কোয়ার ফুট জায়গা নিয়ে ‘র‌্যালে বাইসাইকেল কোম্পানি’-র সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে স্থাপন করলেন সাইকেল কারখানা। দু’লক্ষ সাইকেল তৈরির লক্ষ্য নিয়ে আসানসোলের কন্যাপুরে আধুনিকতম প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি হল কারখানা। তার নাম হয় ‘সেন-র‌্যালে সাইকেল কোম্পানি’। সাইকেলের কিছু কিছু যন্ত্রাংশ প্রথম প্রথম ব্রিটেন, জার্মানি থেকে আনতে হলেও কয়েক বছরের মধ্যে সমস্ত যন্ত্রাংশ তৈরি হতে থাকল এখানেই। সেই অনুসারে বিভিন্ন বিভাগের নাম। যেমন— চেন, প্যাডেল, স্পোক অ্যান্ড নিপলস, উইটকপ (স্যাডেল), প্রেসশপ, ব্যারেলিং ইত্যাদি। প্রায় সাড়ে চার হাজার কর্মী কাজ করেছেন এখানে। পরে সুধীরকুমার সেনের পুত্র অভিজিৎ ও সঞ্জয় সেন কারখানা পরিচালনায় অংশগ্রহণ করেন। এখানে তৈরি ‘র‌্যালে’, ‘রবিনহুড’, ‘হাম্বার’ প্রভৃতি সাইকেল বাঙালি তথা ভারতীয়দের জীবনযাপনের অঙ্গ হয়ে উঠতে পেরেছিল।

কারখানার কর্মীরা বেশির ভাগই ছিলেন বাঙালি। সুধীর কুমার সেনের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছিল ‘সেন র‌্যালে অ্যাথলেটিক ক্লাব’। সে সময়ের বাংলার ক্রীড়া সংস্কৃতিতে তা ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছিল। কারখানার আন্তঃবিভাগীয় নাটক প্রতিযোগিতায় কারখানার বিভিন্ন বিভাগ আলাদা আলাদা নাটকের দল তৈরি করে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করত। নারীচরিত্রে পুরুষদের অভিনয় করার সেই সময়েও শ্রমিকদের পরিবারের মহিলারা এগিয়ে এসেছিলেন অভিনয় করতে।

সুধীরকুমার সেন বাণিজ্যিক পরিষেবাঘটিত উদ্যোগে জার্মানি গিয়েছিলেন ১৯৫৮ সালে। তখন তাঁর বয়স সত্তর বছর। সে বছরের ২৪ অগস্ট সেখানেই তিনি প্রয়াত হন। কয়েক দশক ধরে সাইকেল ব্যবসায় অগ্রণী ভূমিকায় থাকার পর বিভিন্ন কারণে কারখানা ক্রমশ রুগ্ণ হয়ে পড়ে। কেন্দ্রীয় সরকার কারখানাটি অধিগ্রহণ করে। নাম হয় ‘সাইকেল কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া লিমিটেড’। কিন্তু কারখানার স্বাস্থ্য ফেরেনি। ২০০১-এ কারখানা বন্ধ হয়ে যায়।

বর্তমানে সেন-র‌্যালে কারখানা ও কারখানা সংলগ্ন অঞ্চলটি এক ধ্বংসস্তূপ মাত্র। কারখানার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি জাতির গৌরব সুধীরকুমার সেনও আজ বিস্মৃত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cycle Pioneer
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE