Advertisement
০৮ মে ২০২৪

তালিবানের ডেরায়

সাইকেলে বিশ্বভ্রমণের পথে, আফগানিস্তানে তালিবানদের খপ্পরে পড়েছিলেন। প্রাণ বাঁচাল ঝালমরিচ দিয়ে মাংস রান্নার কেরামতি। কাটল সাড়ে তিন সপ্তাহের ভয়ংকর বন্দিদশা। সাইকেলে বিশ্বভ্রমণের পথে, আফগানিস্তানে তালিবানদের খপ্পরে পড়েছিলেন। প্রাণ বাঁচাল ঝালমরিচ দিয়ে মাংস রান্নার কেরামতি। কাটল সাড়ে তিন সপ্তাহের ভয়ংকর বন্দিদশা।

অগ্নি রায়
শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০১৭ ০৮:২০
Share: Save:

দি ন আর রাতের মধ্যে কোনও ফারাক নেই। ঘুম আর জাগরণের মধ্যেও নয়। শুধুই নিকষ অন্ধকার। পেটের আগুনও একটা পর্যায়ের পর আলাদা করে জ্বালাচ্ছে না আর। দীর্ঘকায় শরীরটা পিছমোড়া করে বাঁধা চেয়ারে। ক্রমশ অবশ হয়ে আসছে চেতনা।

অর্থাৎ, সামনে সাক্ষাৎ মৃত্যু।

জলে কুমির আর ডাঙায় বাঘ দেখে বড় হওয়া সুন্দরবনের সোমেন দেবনাথ সে দিন ধরেই নিয়েছিলেন, আর সূর্যের আলো দেখতে পাবেন না ইহজীবনে। আফগানিস্তানের হিরাটের এক প্রত্যন্ত তালিবান ডেরায় দশ ফুট বাই দশ ফুট ভূগর্ভস্থ অন্ধকূপেই শেষ হবে ভবলীলা। আর সেই সঙ্গে সাইকেলে চড়ে গোটা বিশ্ব পাড়ি দিয়ে তাঁর এডস নিয়ে বিশ্বে সচেতনতা প্রসারের স্বপ্নও।

অবধারিত সেই মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে সে দিন তাঁর প্রাণ বাঁচিয়েছিল ঝালমরিচ!

আজ প্রায় তেরো বছর হতে চলল সোমেন দেবনাথ ঘর ছেড়েছেন সাইকেল সম্বল করে। ইতিমধ্যেই ঘুরে ফেলেছেন ১৯২টি দেশ। সেই চোদ্দো বছর বয়সে পত্রিকায় এক গৃহহীন স্বজনহীন মানুষের ছবি এবং সেই সংক্রান্ত লেখা দেখে আলোড়িত হয়েছিলেন সোমেন। শিরোনাম ছিল, ‘এডস ক্যানসারের চেয়েও মারাত্মক’। ছবিটি ছিল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের সামনে এক জন মুমূর্ষু মানুষের। পরিবার ছেড়ে চলে গিয়েছে সেই এডস আক্রান্ত ব্যক্তিকে। সেই ছবিই নিয়তির মতো তাঁর ভবিষ্যতের রাস্তা গড়ে দেয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জীববিজ্ঞানে স্নাতক হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের এডস নিয়ন্ত্রণ সংস্থায় প্রশিক্ষণ নেন সোমেন। রাজ্যে শুরু করেন প্রচারের কাজ। ২০০৪ সালে বেরিয়ে পড়েন সাইকেলে চড়ে। গত তেরো বছরে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য এবং ১২৯টি দেশ ঘুরে অক্লান্ত সোমেন এখন পেরুর রাজধানী লিমাতে। সেখানে ভারতীয় হাইকমিশনার আর এক বঙ্গসন্তান সন্দীপ চক্রবর্তীর আতিথ্যে কয়েকটা দিন লুচি, ছোলার ডাল আর পায়েস-মিষ্টি খেয়ে বহু দিন ঘরছাড়া রসনাকে একটু ঝালিয়ে নিচ্ছেন! ফোনে বললেন, ‘‘অনেক দেশ যাওয়া এখনও বাকি। লক্ষ্য, উত্তর আমেরিকা, কোরিয়া, জাপান, রাশিয়া, চিন। আর হ্যাঁ, অবশ্যই দক্ষিণ মেরু। ২০২০ সালের মধ্যে ফিরতে চাই। মোট ১৯১টি দেশে যাবার ইচ্ছা।’’ যখন যে দেশে গিয়েছেন ভারতীয় দূতাবাসের কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছেন, জানালেন সোমেন। সাহায্য এবং পুঁজি এসেছে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং অতিথি দেশের কাছ থেকেও।

স্বাভাবিক ভাবেই এই বহুল পর্যটনে তাঁর ঝুলি এখন সাক্ষাৎ গল্পদাদুর আসর! কিন্তু অজস্র অভিজ্ঞতার মধ্যেও যা তিনি আমৃত্যু ভুলতে পারবেন না সেটি হল খাস তালিবানের ডেরায় প্রাণ হাতে করে সাড়ে তিন সপ্তাহের নরকবাস। যা মনে পড়লে এখনও শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে যায় সোমেনের।

শত্রু: হিরাটে সশস্ত্র তালিবান। এরা অবশ্য আত্মসমর্পণ করেছিল প্রশাসনের কাছে। গেটি ইমেজেস

অর্থাৎ সেই ঝালমরিচ প্রসঙ্গ! কী ভাবে বাঁচাল সে যাত্রা বঙ্গসন্তানকে, ঝালমরিচ?

সালটা ছিল ২০০৬। সোমেন বলছেন, ‘‘পাহাড়ের নীচের একটা জনপদ ছিল সেটা। তবে প্রায় পরিত্যক্ত। কাবুল থেকে ১৩৮ কিলোমিটার দূরে ধু-ধু করছে রুখুশুখু সেই জনপদ। আমি খোঁজ করছিলাম খবরের কাগজের অফিস বা কোনও ভারতীয় অফিসারের। হিরাটের মাথামুন্ডুও তো তখন জানি না। জায়গাটি যে বেজায় গোলমেলে, সে জ্ঞানও ছিল না আমার।’’ ঘুরতে ঘুরতে ভুলক্রমে একেবারেই শুনশান একটি গলিতে গিয়ে পড়েছিল সোমেনের সাইকেল। ত্রিসীমানায় কেউ নেই। ‘‘হঠাৎই যেন মাটি ফুঁড়ে উঠল জনা দশেকের একটি দল। তাগড়া জওয়ান সব। আফগানি কুর্তা আর পাগড়ি জড়়ানো। মুখ ঢাকা। চিৎকার করে তারা যা বলছিল, তার বিন্দুমাত্রও বুঝলাম না।’’ বোঝাবুঝির খুব একটা অবকাশও ছিল না সোমেনের। চোখ বেঁধে ফেলা হয়েছিল নিমেষের মধ্যে। ‘‘টানতে টানতে আমায় নিয়ে গিয়ে যেখানে ঢোকানো হল, আন্দাজে বুঝতে পারলাম, সেটা মাটির নীচে। যখন চোখের বাঁধন খুলল, দেখি, একটা চেয়ারে পিছমোড়া করে মোটা তার দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়েছে আমায়। প্রথম তিন দিন ঘরে প্রায় কেউই আসত না। জগে জল আর এক বেলা একটু গরুর মাংস দিয়ে যেত এক জন। খাওয়ার সময়, আর ঘরের পাশেই ঘুপচি একটা বাথরুমে যাওয়ার জন্য দিনে কয়েক বার বাঁধন খোলা হত। কী হতে চলেছে তার কোনও আন্দাজই পাচ্ছিলাম না গোড়ায়।’’

কী ভাবে মুক্তি পেলেন সেখান থেকে, আজ ভাবতে বসলে রূপকথা বলেই মনে হয় এই ভূপর্যটকের। ওই অন্ধকূপে পিছমোড়া অবস্থায় আকাশপাতাল ভাবতেন সোমেন। ফেলে আসা জীবন আর ভবিষ্যতের স্বপ্ন, সব যেন দলা পাকিয়ে উঠত। অন্ধকারের মধ্যে বসে যখন এই সাতপাঁচ ভাবার শক্তিও কমে আসছে, ঠিক তখনই আশার আলো দেখতে পেয়েছিলেন সোমেন। প্রথমে আলো বলে মনে হয়নি অবশ্য। ‘‘তিন দিন পর আমার হাত খুলে দেওয়া হল। ঘরে অভ্যাগতের সংখ্যাও বাড়তে লাগল। ওদের কথা কিছু বুঝতে পারতাম না বলে চড়থাপ্পড়ও খেতে হয়েছে অনেক,’’ জানাচ্ছেন তিনি। পরে একটি লোক এল যে ভাঙা-ভাঙা ইংরেজি বলতে পারে। সে ক্রমাগত প্রশ্ন করতে লাগল। কোরান পড়ি কি না? হিন্দু না মুসলমান? পাকিস্তান থেকে এসেছি কি না। কেন সঙ্গে খাতা নিয়ে ঘুরছি? কী টুকে রেখেছি তাতে? ঘাড়ে যে কোনও সময় তলোয়ার নেমে আসবে জেনেও বলতাম, সব ধর্মকেই সম্মান করি। এমনকী ওদের ধর্মকেও।’’

গলায় শান দেওয়া ইস্পাত নেমে আসেনি ঠিকই, কিন্তু সোমেন ধরেই নিয়েছিলেন, তা শুধু সময়ের অপেক্ষা। দোভাষীর সঙ্গে টুকরো টুকরো কথায় বুঝতে পেরেছিলেন, তালিবানদের পাল্লায় পড়েছেন তিনি। ‘‘এই সময়েই মাথায় একটা ঝলক খেলে গেল। ওরা যে মাংস দিত, তা মুখে দিয়ে মনে হয়েছিল, আরে, এই ঝাল মশলাদার রান্নার সঙ্গে তো আমাদের সুন্দরবন অঞ্চলের রান্নার অনেক মিল রয়েছে!’’

এই মিল খুঁজে পাওয়াটাই যে তাঁর জীবন বাঁচিয়ে দেবে, এমন দূরাশা করেননি তিনি সে সময়। শুধু সাহস করে ওই দলে সামান্য ইংরেজি জানা ব্যক্তিটিকে (যে দোভাষীর কাজ চালাত) বলেছিলেন, তিনি খুব ভাল রান্না জানেন। সবাইকে রেঁধে খাওয়াতে পারেন। প্রথমে আমতা আমতা করলেও পরে রাজি হয় জঙ্গিরা। ‘‘যতটা পারতাম লঙ্কাবাটা আর অন্যান্য মশলা দিয়ে মাংস রাঁধতাম। যে ভাবে দেশে কাঁকড়া, কাছিমের মাংস রান্না হত মায়ের হেঁশেলে, অনেকটা সে রকমই করার চেষ্টা করতাম। ওরাই সব জোগাড়যন্ত্র করে দিত।’’

বঙ্গোপসাগরের সুজলা ব-দ্বীপের রন্ধনশিল্প কিন্তু ম্যাজিক দেখিয়েছিল আফগানিস্তানের ঊষর চরমভাবাপন্ন হিরাটে। ‘‘ওদের ভাল লেগে গেল আমার রান্না। ওই দোভাষী লোকটার কাছে খবর পেতাম, চেটেপুটে খাচ্ছে সবাই! আমার সঙ্গে ব্যবহারও কিছুটা পালটে গেল তার পর থেকে। মারধোর গলাধাক্কা তো দূরস্থান, সর্বক্ষণের জন্য বাঁধনও খুলে দেওয়া হল। তবে ওই ঘরেই রান্না করতাম। বাইরে যাওয়ার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠল না।’’ না উঠলেও, সোমেন বুঝতে পারলেন, মুক্তির একটাই রাস্তা তাঁর সামনে তৈরি হচ্ছে। তাই প্রতি দিন রান্না করে খাওয়ানোর পাশাপাশি, তত দিনে প্রায় ‘দোস্ত’ হয়ে যাওয়া দোভাষীর আস্থাভাজন হয়ে ওঠার চেষ্টাও চালাতে লাগলেন সোমেন। ‘‘বলতাম আমার অ্যাডভেঞ্চারের কথা। ছবি দেখাতাম বিভিন্ন দেশভ্রমণের। কারও সাতেপাঁচে থাকা যে আমার উদ্দেশ্য নয়, কোনও দেশের হয়ে কাজও যে করছি না, সেটা ধীরে ধীরে বোঝাতে পেরেছিলাম। জানতাম যে, তার দলের বাকিদের কাছে সে আমার কথা পৌঁছে দেবে।’’

হয়েওছিল তাই। দু’সপ্তাহের মধ্যে তাদের মনে ধারণা তৈরি হল, সোমেন দেবনাথ তাদের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ। শুধু তাই নয়, এক জন রন্ধনশিল্পীও বটে। ‘‘অটোমেটিক মেশিনগান, চপার, তরোয়াল, বোমার বাইরে যে তাদের রান্না নিয়ে এত উৎসাহ, তা কে জানত! চব্বিশ দিন পর যখন আমায় ছাড়ল, বাইরে বেরিয়ে সূর্যের আলোয় চোখ ঝলসে গিয়েছিল। বেশ কিছু ক্ষণ কিছুই দেখতে পাইনি। তবে না, কেউ আমার পিছু নেয়নি। হাসিমুখেই বিদায় দিয়েছিল ওরা।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE