স্মারক: ভবানীপুরে ইন্দ্রলাল রায়ের নামাঙ্কিত রাস্তার ফলক।
কাজে যোগ দেওয়ার পরে সহোদরা লীলাকে একটি চিঠিতে ইন্দ্র লিখেছিলেন, তাঁদের এরোড্রাম মূল শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরে। তাই ঘন ঘন তিনি শহরে যেতে পারেন না। চিঠিতে তিনি লীলার স্বামী, অর্থাৎ তাঁর বড় জামাইবাবু সত্য মুখোপাধ্যায়ের কথাও জানতে চান। বড় জামাইবাবুকে তিনি ভালবেসে ‘সক’ নামে ডাকতেন। সক কেন তাঁকে চিঠি লেখেন না, সেই অনুযোগও করেন দিদিকে। পরক্ষণেই অবশ্য স্বীকার করে নেন যে সক তাঁর চেয়ে অনেক তাড়াতাড়ি চিঠি লেখেন। দিদিকে লিখতে ভোলেন না, ল্যাডি খুব তাড়াতাড়ি সক-কে চিঠি লিখবেন। এও জানান, ক’দিন পরেই তাঁর পাইলট হিসেবে ট্রেনিং শুরু হবে। চিঠির শেষে লেখা, ‘তোমার স্নেহের ভাই, ল্যাডি’। এই চিঠিই বুঝিয়ে দেয়, দিদি-জামাইবাবুর সঙ্গে কতটা স্নেহের সম্পর্ক ছিল ল্যাডির। লীলাকে লেখা ইন্দ্রলালের এই চিঠিটি লন্ডনের রয়্যাল এয়ার ফোর্স মিউজিয়মে আজও সযত্নে রাখা আছে।
ইন্দ্র তথা ল্যাডির সাহসও ছিল আকাশছোঁয়া। আত্মবিশ্বাসে ভর করে তখন সগর্বে উড়ছেন আকাশে। মাত্র আঠারো বছর বয়সেই কার্জিস, বি ই টু, সপউইথ ক্যামেল, আভরো এবং এস ই ফাইভ-এর মতো যুদ্ধবিমানে হাত পাকান তিনি।
আকাশে উড়তে না উড়তেই মুখোমুখি হন শত্রুপক্ষ জার্মান বিমানেরও। ১৯১৭ সালে ৬ ডিসেম্বর, ঘটে গেল এক অঘটন। সে দিন এস ই ফাইভ বিমানে আকাশে উড়ছিলেন ইন্দ্র। আচমকা তাঁর বিমানকে লক্ষ্য করে এক জার্মান যুদ্ধবিমান গুলি চালায়। নো ম্যান’স ল্যান্ডে ভেঙে পড়ে তাঁর বিমান। স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে মৃত বলে ঘোষণা করা হয় ইন্দ্রলালকে। দেহ রাখা হয় মর্গে। হঠাৎ মর্গের দরজায় ভিতর থেকে ধাক্কা। ভূতের ভয়ে হাসপাতালের কর্মীদের তো একেবারে দাঁতকপাটি লেগে যাওয়ার জোগাড়। কিন্তু মর্গের ভিতর ভূত নয়, আসলে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিলেন ল্যাডি! দুর্ঘটনায় সে দিন মারা যাননি তিনি। মর্গে জ্ঞান ফিরে আসায় দরজায় ধাক্কা দিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করছিলেন। হাসপাতালের কর্মীদের ভূতের ভয় তাড়িয়ে ইন্দ্র শেষমেশ বোঝাতে সমর্থ হন যে তিনি বেঁচে আছেন। নিজের শিবিরেও ফিরে আসেন তিনি। চিকিৎসার পর ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠেন। ইন্দ্রলাল ছবিও আঁকতেন চমৎকার। অসুস্থতার সময় অনেকগুলো স্কেচ করেছিলেন তিনি। সবগুলোই যুদ্ধবিমানের ছবি।
সুস্থ হয়ে উঠলেও আর বিমান চালানোর ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি তাঁকে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত তাঁর পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তাঁর বারংবার অনুরোধ ও অদম্য ইচ্ছের কাছে হার মানতে হয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে। আকাশে ওড়ার জন্য আবার শারীরিক প্রস্তুতি নেন তিনি। হাসপাতালে থাকার সময় মানসিক দিক থেকেও আরও পরিণত হয়েছিলেন। শুধু আবেগে ভেসে নয়, এ বার আরও বেশি সচেতন হয়ে, মন দিয়ে ট্রেনিং নিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন জর্জ ম্যাকরয়-এর তত্ত্বাবধানে। বৈমানিকের দক্ষতায় আরও শান দিয়ে তিনি তিনি ফিরে আসেন ফ্রান্স থেকে। ১৯১৮ সালের ২২ জুন যোগ দেন ৪০ নম্বর স্কোয়াড্রনে।
৬ জুলাই ১৯১৮। আবার বিমান নিয়ে ইন্দ্রলাল উড়ে যান যুদ্ধক্ষেত্রে। প্রথম দিনেই তাঁর আক্রমণে পরাজিত হয় এক জার্মান বিমান। এই জয়ের ছবি তিনি এঁকে রেখেছিলেন তাঁর আঁকার খাতায়। ছবিটির তলায় লিখে রাখেন ‘‘৬ জুলাই, ১৯১৮। ৫.৪৫ এএম এন ই অফ আরাস, হ্যানওভার রানার, ২ সিটার, শট ডাউন বাই আই এল রায়।’’ তাঁর কৃতিত্বের উল্লাসে মেতে ওঠে বন্ধুরাও। পিঠ চাপড়ে শুভেচ্ছা জানায় সহকর্মীরা। এই উৎসাহ তাঁকে যেন আরও শক্তি জোগায়। ৯ জুলাই থেকে ১৯ জুলাই, টানা দশ দিনে ন’টি জার্মান বিমানকে তিনি আক্রমণ করে মাটিতে নামিয়ে আনেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় বিমান চালক, যিনি ১৭০ ঘণ্টা বিমান চালানোর রেকর্ড করেছিলেন।
২২ জুলাই। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ শেষ হওয়ার চার মাস আগের ঘটনা। ফ্রান্সের আকাশে ইন্দ্র উড়ছেন, তাঁর মন হিসাব কষছে শত্রুপক্ষের বিমানকে ধূলিসাৎ করার। আর ঠিক তখনই চার-চারটে জার্মান ফকার যুদ্ধবিমান তাঁকে চার দিক থেকে ঘিরে ধরে। ধুন্ধুমার যুদ্ধ শুরু হয় আকাশে। চার বনাম একের যুদ্ধে অভিমন্যুর মতো সর্বশক্তি দিয়ে লড়েন ইন্দ্র। পরাস্ত করেন দুটো জার্মান বিমানকে। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। একটি জার্মান বিমানের সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কা খায় তাঁর বিমান। শেষ হয়ে যায় ল্যাডির আকাশে ওড়ার স্বপ্ন। লন্ডনে বসে ললিতা জানতে পারেন, তাঁর মেজ ছেলে ‘মিসিং ইন অ্যাকশন’।
ল্যাডির কমান্ডিং অফিসার ইন্দ্রলালের যুদ্ধের বর্ণনা দিয়ে তাঁর মা’কে একটি চিঠি লিখে জানান, ‘‘ন’টা জার্মান বিমানকে ইন্দ্রলাল রায় একা পরাস্ত করেছেন। প্রত্যেক অফিসার তাঁর প্রশংসা করেছেন। সকলের কাছে তিনি খুব জনপ্রিয়ও ছিলেন। আমি নিশ্চিত, তিনি তাঁর এই সাহসিকতার জন্য পুরস্কৃত হবেন।’’
১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইন্দ্রলাল রায় যে বিমান দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন, তা পরে নিশ্চিত করে রয়্যাল এয়ার ফোর্স। ওই বছরই রয়্যাল ফ্লায়িং কর্পস-এর নাম বদলে হয় দ্য রয়্যাল এয়ার ফোর্স। এর তিন দিন পর তাঁকে মরণোত্তর ‘দ্য ডিসটিংগুইশ্ড ফ্লায়িং ক্রস’ সম্মানে ভূষিত করা হয়। তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি এই সম্মান পেয়েছিলেন। তাঁর মানপত্রে লেখা হয়েছিল, ‘‘(ইন্দ্রলাল রায়) ভীষণ সাহসী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এক অফিসার, যিনি ১৩ দিনে ৯টি জার্মান বিমানকে পরাস্ত করেছেন। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে তিনি অসাধারণ প্রতিভা দেখিয়েছেন।’’
উত্তর লন্ডনে বেন্টলি প্রায়রি মিউজিয়ামে কিছু দিন আগে অনুষ্ঠিত হল দ্য রয়্যাল এয়ার ফোর্সের শতবর্ষ। এই বিশেষ অনুষ্ঠানে ইন্দ্রলাল রায়কে তাঁর বীরত্বের জন্য শ্রদ্ধার্ঘ্য জানানো হয়েছে। এই বীর সন্তানের মা ললিতা রায়কে স্মরণ করা হয়েছিল পার্লামেন্ট স্কোয়ারে, ব্রিটেনে মেয়েদের ভোটাধিকার আন্দোলনের ১০০ বছর পূর্তিতে। ল্যাডির দিদি লীলার ছেলে সুব্রত মুখোপাধ্যায় পরে স্বাধীন ভারতের এয়ার ফোর্স-এর প্রথম ‘চিফ অব দি এয়ার স্টাফ’ হয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েই তাঁর বিমানচালনার কাজে হাতেখড়ি হয়। বেঁচে থাকলে ভাগ্নের জন্য মামা নিশ্চয়ই গর্বিত হতেন।
কলকাতার ভবানীপুরে ইন্দিরা সিনেমাহলের কাছে রাস্তাটির নাম ‘ইন্দ্র রায় রোড’। কিন্তু আমাদের মধ্যে ক’জনই বা চিনি এই বীর বাঙালিকে! কত জনই বা জানি তাঁর সাহসিকতার কাহিনি! বাঙালির ভিতু, ঘরকুনো তকমাকে যে মানুষটা মুছতে চেয়েছিলেন, মৃত্যুর শতবর্ষে আজ সেই ইন্দ্রলাল রায় বিস্মৃত।