Advertisement
২২ মার্চ ২০২৩

বর্শায় সিংহ এফোঁড়-ওফোঁড়

মাংসের টোপে উত্তেজিত সিংহ লাফিয়ে উঠবে, আর শিকারির বর্শা বিঁধে যাবে তার শরীরে। হোটেলের ঘরে বসে এমনই চুক্তি হয়েছিল। ঝুঁকি নিয়ে তোলা হচ্ছে গন্ডার, কুমির, জলহস্তীর ছবি। ইউরোপে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরুর সময় কলকাতার বাঙালি পরিচালক হীরেন্দ্রনাথ বসুর আফ্রিকা অভিযান।মাংসের টোপে উত্তেজিত সিংহ লাফিয়ে উঠবে, আর শিকারির বর্শা বিঁধে যাবে তার শরীরে। হোটেলের ঘরে বসে এমনই চুক্তি হয়েছিল। ঝুঁকি নিয়ে তোলা হচ্ছে গন্ডার, কুমির, জলহস্তীর ছবি। ইউরোপে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরুর সময় কলকাতার বাঙালি পরিচালক হীরেন্দ্রনাথ বসুর আফ্রিকা অভিযান।

চিত্র-পরিচালক হীরেন্দ্রনাথ বসু

চিত্র-পরিচালক হীরেন্দ্রনাথ বসু

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে শুটিং হয়েছে। সূর্যের আলোয় ঝকমক করছে চাঁদের পাহাড়। কিন্তু বিকেলের ধূসর ছায়া বরফের উপর পড়তেই পালটে গেল রূপ। সে কি ছাড়া যায়! রাস্তার মধ্যিখানে ক্যামেরা পাতা হল আবার। দূর থেকে এগিয়ে আসছে একটা মোটরগাড়ি। কাছেই এসে পড়েছে, কিন্তু গতি কমানোর লক্ষণ নেই। এ দিকে পরিচালক, চিত্রগ্রাহক তাঁদের কাজ চালিয়েই যাচ্ছেন। স্থানীয় বাসিন্দা পটেলজি আচমকা দৌড়ে এসে ক্যামেরাটা কাঁধে তুলে পাশের খাদে লাফিয়ে পড়লেন!

Advertisement

১৯৩৯ সালের টাঙ্গানাইকা। মানে, এখনকার তানজানিয়া। মোসি শহর লাগোয়া জঙ্গলের রাস্তায় ক্যামেরা তাক করেছে মাউন্ট কিলিমাঞ্জারোর দিকে। তার মাঝে এ কী পাগলামো! খাদটা অগভীর, ক্যামেরাও অক্ষত। পটেলজি উঠে এসে বললেন, গোরা সাহেবের গাড়ি ক্যামেরা দেখে থামবে, এমন ভাবার কোনও কারণই নেই। ওরা অবলীলায় ক্যামেরা গুঁড়িয়ে দিয়ে চলে যেত আর সেই সঙ্গে গুলি চালিয়ে ক’জনকে জখমও করত। এ অঞ্চলে এটাই দস্তুর।

মোম্বাসা থেকে নাইরোবি আসার সময়েই বা কী হল? পাঁচশো মাইল রাস্তা। শুটিংয়ের লটবহর রয়েছে। ট্রেন পেলে সুবিধা হত। জানা গেল, ফার্স্ট ক্লাসে যদি এক জনও শ্বেতাঙ্গ থাকেন, তা হলে টিকিট মিলবে না। ওঁরা বাধ্য হয়ে মোটরগাড়িই নিলেন।

ওঁরা মানে হীরেন বসু আর তাঁর ইউনিট। বাঙালি আজই কেবল আফ্রিকা-অ্যামাজন দৌড়চ্ছে না। তিরিশের দশকের শেষেই এই বঙ্গতনয় নায়ক-নায়িকা-কমেডিয়ান-ভিলেন সমেত সদলবল আফ্রিকায় শুটিং করে এসেছিলেন! সাহেবরা পারলে আমরাই বা পারব না কেন, এ রকমই ছিল ওঁদের মনের ভাব। ‘ইন্ডিয়া ইন আফ্রিকা’ নামের সেই হিন্দি ছবি মুক্তি পায় ১৯৪০-এর ২৮ জুন। রোমাঞ্চকর শুটিংয়ের গল্প ‘বনে জঙ্গলে’ বইয়ে নিজেই লিখে গিয়েছেন পরিচালক। বইয়ের প্রচ্ছদে তিনি, হীরেন্দ্রনাথ বসু (১৯০৩-১৯৮৭)। কিন্তু চলচ্চিত্র ও সঙ্গীতজগতে তাঁর খ্যাতি হীরেন বসু নামেই। এই হীরেনই ‘জোর বরাত’ (১৯৩১) ছবিতে এ দেশে প্রথম প্লেব্যাক ব্যবহার করেন। ইনিই ‘আজি শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও’, ‘শুকনো শাখার পাতা ঝরে যায়’, ‘আমার আঁধার ঘরের প্রদীপ’-এর মতো বিখ্যাত গানের গীতিকার এবং সেই সঙ্গে প্রায় এগারোটি ছবির পরিচালকও। ‘ইন্ডিয়া ইন আফ্রিকা’ যার অন্যতম।

Advertisement

বিশ শতকের সেই সময়টায় লেখালিখির জগতে আর সেলুলয়েডে আফ্রিকা নিয়ে বেশ মাতামাতি চলছে। ১৯১৪ সালের মধ্যে আফ্রিকার প্রায় নব্বই শতাংশই পশ্চিমি দেশগুলোর দখলে চলে এসেছে। সেখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ লুটে নেওয়ার প্রতিযোগিতাও তখন জোরকদমে। সেই সঙ্গে তার ভূপ্রকৃতি, বন্যপ্রাণ এবং অরণ্যচারী জনজীবনকে নিয়ে তৈরি হচ্ছে রোমহর্ষক সব মিথ।

ঐতিহাসিক: ‘ইন্ডিয়া ইন আফ্রিকা’ ছবির পোস্টার।

১৯৩১ সালে আফ্রিকার মাটিতে শুট হচ্ছে প্রথম কাহিনিচিত্র ‘ট্রেডার হর্ন’, তার পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৩২ সালে সুবিখ্যাত ‘টারজান দি এপ ম্যান’। আফ্রিকা নিয়ে উদ্দীপনা তখন এ দেশে বা এ রাজ্যেও কিছু কম ছিল না। বাংলায় প্যারীমোহন সেনগুপ্তের বই ‘কাফ্রিদের দেশ আফ্রিকা’ বেরিয়ে গিয়েছে ১৯২২ সালেই। ১৯৩৩ সালে হেমেন্দ্রকুমার রায় লিখে ফেলেছেন ‘আবার যকের ধন’, ১৯৩৫ থেকে ‘মৌচাক’-এ ধারাবাহিক ভাবে বেরোতে শুরু করছে ‘চাঁদের পাহাড়’। আর ছায়াছবির জগতে তো টারজানের জাদু দিকে দিকে। ১৯৩৭-এ ওয়াদিয়া মুভিটোন বিপুল ব্যবসা করল ‘তুফানি টারজান’ ছবিতে। পরের বছরই আবার অরোরা বানিয়ে ফেলল ‘টারজান কি বেটি’।

হীরেন বসুর আফ্রিকা-চিত্র সে দিক থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কিন্তু এ দেশে তখনও আর কেউ যা করেনি, সেটাই তিনি করেছিলেন, অর্থাৎ খাস আফ্রিকার লোকেশনে গিয়ে শুটিং করে এসেছিলেন। ছবিটার পিছনে একটা জাতীয়তাবাদী তাগিদও ছিল। সেটার অনেকখানি কৃতিত্ব ছবিটির প্রযোজক, তখনকার নামকরা কংগ্রেসি নেতা শেঠ গোবিন্দদাসের। বস্তুত এমন একটি ছবির আইডিয়া গোবিন্দজির মাথাতেই প্রথম এসেছিল। ‘ট্রেডার হর্ন’ ছবিটি দেখে গোবিন্দজির মনে হয়, সাহেবরা ভুল ইতিহাস শেখাচ্ছে। আফ্রিকার জনজাতিদের সঙ্গে সাহেবদের বাণিজ্য শুরু হওয়ার অনেক আগে, প্রাচীন কাল থেকে ভারতের, বিশেষত কাথিয়াবাড়ের বণিকদের সঙ্গে যে আফ্রিকার নিয়মিত বাণিজ্য ছিল, সে কথাটা কেউ তুলছেই না। গোবিন্দজি এর পর থেকেই নিজের সমস্ত যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে আফ্রিকায় একটি বড় মাপের সাফারির বন্দোবস্ত করেন, ছবির টাকাও জোগাড় করেন। পাচ্ছিলেন না শুধু উদ্যমী, সাহসী পরিচালক। ১৯৩৮ সালের পুজোয় হীরেনের সঙ্গে দেখা হওয়ার পরে সেই অভাবটুকু আর রইল না।

১৯৩৯-এর ৩১ জানুয়ারি হীরেনরা মুম্বই থেকে মোম্বাসাগামী জাহাজে চড়ে বসলেন। সঙ্গে আছেন ক্যামেরাম্যান সুধীর বসু, সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার পরিতোষ বসু, সাউন্ড রেকর্ডিস্ট জগতাপ, সহপরিচালক অশ্বিনী মিত্র ও এস ব্যানার্জি, এবং ছবির নায়ক নান্দরেকর আর দুই নায়িকা ঊর্মিলা দেবী ও বিদ্যা দেবী। আর এক জন আছেন, আলিভাই, তিনি আফ্রিকা থেকে এসেছেন, ইউনিটের গাইড হিসেবে থাকবেন। মোম্বাসা থেকে সবাই যাবেন নাইরোবি হয়ে একশো মাইল দূরের থিকা শহরে। সেখানে কিছু শুটিং হবে। তার পর মেয়েরা সেখানেই থেকে যাবেন। বাকি ইউনিট টাঙ্গানাইকা রওনা হবে।

ক্যামেরা অবশ্য চালু হয়ে গেল সমুদ্রপথেই। উড়ুক্কু মাছ থেকে শুরু করে পথিমধ্যে সিসিলি-তে আদিবাসী নাচগান, উটপাখির সার— সবই তোলা হল। মোম্বাসা থেকে নাইরোবির পথেও হুডখোলা গাড়িতে ক্যামেরা প্রস্তুত রাখা হল, সঙ্গে চালু রইল দু’টো আইমো হাত-ক্যামেরাও। কিন্তু আফ্রিকার জঙ্গলে ছবি তোলার আসল পাঠ নেওয়া তখনও বাকি। নাইরোবিতে পৌঁছে প্রথম গন্তব্য জোন্স অ্যান্ড জোন্স-এর স্টুডিয়ো। পূর্ব আফ্রিকায় শুটিং করতে এলে তখন বেশির ভাগ দলই এখান থেকে ক্যামেরার সরঞ্জাম ভাড়া নিত। এখানেই শিখিয়ে দেওয়া হত, কোন জন্তুর কেমন মেজাজ। সিংহের ছবি তুলতে গেলে কী করতে হবে, হাতির কাছাকাছি যাওয়ার নিয়ম কী, গন্ডারের ছবি গাছ থেকে নেওয়াই ভাল, জলহস্তী কী করলে জল থেকে উঠবে, ঘুমপাড়ানি মাছি থেকে সাবধান, এই সব।

থিকায় পৌঁছে চেনিয়া আর থিকা নদীর প্রপাত দেখেই হীরেন চিনলেন, এই তো টারজানের লোকেশন! এ তো পরদায় দেখা! বাজারে একটি ক্যামেরার দোকানে গিয়ে আলাপ হয়ে গেল মেট্রো গোল্ডউইন মেয়ার-এর এক ক্যামেরাম্যানের সঙ্গে। ওঁদের ইউনিটও এসেছে শুটিং করতে। সঙ্গে এনেছে মুভিং ল্যাব, মুভিং জেনারেটর আর লাইট, ছোট প্রজেক্টর, আরও কত কী! চিত্রগ্রাহক সুধীর বেশ একটু দমেই গেলেন! হীরেন উৎসাহ দিয়ে বললেন, নিধিরাম সর্দার হয়েই আমরা লড়ে যাব ঠিক! পরের দিন মহরত শট! হলিউডি ক্যামেরাম্যানও দেখতে এসেছেন! অশ্বিনী মিত্র কমেডিয়ানের ভূমিকায়। গাছের ডাল ধরে ঝুলতে ঝুলতে নদীতে ঝাঁপ দিলেন! স্রোতের টানে গড়িয়ে গেলেন খাদের দিকে! কাট! অশ্বিনী জল থেকে উঠে এসে বললেন, ঠিক হয়েছে তো?

পরের দিন আর একটা প্রপাতে নায়িকার স্নানদৃশ্য তোলা হচ্ছে। সঙ্গে গানও আছে। টেলিফোটো লেন্স পড়ে গেল জলে। দলের একটি রাঁধুনি যুবক সাঁতার জানতেন। তিনিই উদ্ধার করলেন। তাঁর সাহস দেখে তাঁকেই নায়কের পোশাক পরিয়ে একটা স্টান্ট করানো হল। সকলের উৎসাহে তিনি করেও ফেললেন, কিন্তু উপরে উঠে এসেই অজ্ঞান। সেবাশুশ্রূষা করে তাঁকে সুস্থ করা হল।

হীরেনের বিবরণ পড়লে বেশ বোঝা যায়, সিনেমার শুটিং সে সময়ে আফ্রিকার অরণ্য-জীবনে দৈনন্দিনতার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। টাঙ্গানাইকার আরুশা শহরে হোটেল ম্যানেজারই বলে দিলেন, টাকা দিলে মাসাই যুবকরা এসে তাঁদের সিংহ শিকার করার বিশেষ নাচ দেখিয়ে যাবেন। চাই কি, সিংহ মেরেও দেখিয়ে দেবেন। শুটিংয়ের সময়ে দেখা গেল, নাচিয়েরা ক্যামেরা কী চায় বুঝে গিয়েছেন। লেন্সের সামনে লাফিয়ে পড়ে মুখব্যাদান করছেন, বর্শা নিয়ে এমন সব কসরত করছেন যেন সিংহ পাশেই দাঁড়িয়ে আছে!

এমনিতে সিংহের সঙ্গে মোলাকাত এর মধ্যে দু’-এক বার হয়েছে ঠিকই। কিন্তু আসল শুটিং বাকি। তার জন্য যাওয়া হবে বানাগি হিলস। সেখানকার বন বিভাগের অফিসার বলে দিলেন, সিংহকে জেব্রা বা হরিণ মেরে খেতে দিলে তারা খুশি হয়ে ছবি তুলতে দেবে। কোটপ্যান্ট পরা লোক নাগাড়ে দেখতে দেখতে সিংহেরা বুঝেই গিয়েছে, এরা এলে খেতে দেয়। অতএব একটা লরিতে বড় ক্যামেরা রাখা হল, সঙ্গে দু’টি গাড়িতে দু’টি আইমো ক্যামেরা, হাতে হাতে আরও দু’টি। এ বার একটি জেব্রা মেরে প্রথমে তার একটা পা কেটে বাঁধা হল একটা গাড়ির সঙ্গে। পিছনের পা দু’টিতে এমন ভাবে দড়ি বাঁধা হল যাতে তা গাছে ঝোলানো যায় এবং দরকার মতো উঁচু-নিচু করা যায়। সেই দড়ি বাঁধা থাকল লরির চাকায়। এ বার জেব্রার একটা পা নিয়ে ছুটল গাড়ি আসল টোপ-বাঁধা গাছটার দিকে আর সিংহের দল ছুটল তার পিছন পিছন। পাঁচখানা ক্যামেরা আশ মিটিয়ে তাদের ছবি তুলতে লাগল। এক দল সিংহের পরে আর এক দল, আবার টোপ সাজানো হয়। এ বার টোপের গায়ে জড়িয়ে দেওয়া হয় চাদর, যেন সিংহ মানুষই টেনে নিয়ে গেল! আবার একটি সিংহকে টোপ দেখিয়ে উত্তেজিত করে, শেষ মুহূর্তে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। সে লাফ দিয়ে উঠতেই মাসাই শিকারির বর্শা তাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয়। ঠিক যেমনটি তাদের সঙ্গে বায়না হয়েছিল হোটেলে বসেই!

শুধু কি সিংহ? সে বার সব মিলিয়ে প্রায় ছ’হাজার মাইল সাফারি করেছিলেন হীরেনরা। আবিসিনিয়ার গ্রামে আদিবাসী মেলা, কেনিয়ার গন্ডার, উগান্ডার কুমির, কঙ্গোর জলহস্তী আর হাতি— প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে, পাগলের মতো পরিশ্রম করে তুলে এনেছিলেন সব চলচ্ছবি। কখনও চোরাবালিতে পড়েছেন, কখনও বিষাক্ত মাছির পাল থেকে বাঁচতে গলাজলে নেমে দাঁড়িয়েছেন। এক বার তো মরীচিকা রাস্তা ভুলিয়ে দিয়েছিল বিলকুল। দলছুট গাড়ি মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকল সারা রাত। দশ ফুট দূরে সিংহের চোখ জ্বলছে, দমবন্ধ করে গাড়ির ভিতরে হীরেন জলাভাবে রবার চিবোচ্ছেন।

গায়ে কাঁটা দেওয়া আশ্চর্য সব বর্ণনা হীরেনের লেখার ছত্রে ছত্রে। নিজে পরাধীন দেশের নাগরিক। আফ্রিকার সম্পদ লুণ্ঠনের দিকটি তাঁর মনে বড় বাজে। ‘মনে মনে ভাবি, প্রকৃতি যাদের এ অজস্র দান আপন হাতে দিয়েছেন... তাদের ধন এরা কেড়ে নিয়ে আবার তাদেরই উপর পাহারা বসিয়েছে! কার ধন কে নেয়, কে খায়?’ কিন্তু এই চোখই যখন তথাকথিত ‘সভ্য’জগৎ থেকে দূরে থাকা জনজাতির দিকে তাকায়, তার চশমাটা হয়ে যায় পশ্চিমের মতোই। তখন ভূমিপুত্রদের জন্য ‘জংলী’ ছাড়া অন্য বিশেষণ মেলেই না। তবু সেই ‘জংলী’দের যে ক’জন বিদেশিদের কাছে কাজ করছেন, শুটিং দলের সঙ্গে সহযোগিতা করছেন, তাঁদের কিছুটা দাম আছে। বহিরাগত চোখে বাকিরা শুধুই কিম্ভূত, বিপজ্জনক, নরখাদক রাক্ষস।

বস্তুত আফ্রিকার বুকে চলচ্চিত্রনির্মাণও যে সে আমলে কী আগ্রাসক চেহারা নিয়েছিল, তার এক দলিল হীরেনের লেখা। অবাধ বন্যপ্রাণ হত্যা তো আছেই, কৃষ্ণাঙ্গদেরই একটি গোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে পিগমিদের খেদানো হচ্ছে এবং তার পর তাদের বস্তি জ্বালিয়ে দিয়ে সেই ছবি তুলছে হলিউড, এমন রেওয়াজের কথাও স্বকর্ণে শুনে এসেছিলেন হীরেন। তাঁর নিজের ইউনিট একেবারে শেষ পর্বে পিগমিদের একটি দলের আক্রমণের মুখে পড়েছিল। ইউনিটেরই এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবককে তারা তুলে নিয়ে যায়। তার আর খোঁজ মেলেনি।

মিকোয়া নামে ওই যুবক, তাড়া খাওয়া পিগমিদের দল, শুটিং দলের গাড়ির তলায় চাপা পড়া পশুরা, সিংহের টোপ হয়ে যাওয়া জেব্রা আর হরিণেরা—এরা সবাই এক অর্থে শহিদ। আফ্রিকার শহিদ, চলচ্চিত্রের শহিদ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.