Advertisement
E-Paper

রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে বেহালা বাজাতেন তিনি

ছবির মুদ্রণ নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা ও পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন, তাঁর গবেষণাপত্র চুরি করে পেটেন্ট হাতিয়ে নিয়েছে অন্য লোক। তাঁর লেখা গান গাওয়া হত ব্রাহ্মসমাজের প্রার্থনায়, খ্রিস্টানদের উৎসবে। ভ্রমণকাহিনি লিখেছেন, তেলরং আর জলরঙে এঁকেছেন ছবি। লোকে শুধু ‘টুনটুনির গল্প’ই পড়ে, এই উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীকে জানে ক’জন? আজ তাঁর জন্মদিন।তখন এ দেশে ছবি ছাপা হত কাঠের ওপর খোদাই করা ব্লক দিয়ে। উপেন্দ্রকিশোর এই ব্যবস্থা মেনে নিতে পারেননি।

শুভাশিস চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১২ মে ২০১৯ ০০:০১
শিল্পী: উপেন্দ্রকিশোর, সত্যজিৎ রায়ের স্কেচ। ছবি: সন্দীপ রায়ের সৌজন্যে।

শিল্পী: উপেন্দ্রকিশোর, সত্যজিৎ রায়ের স্কেচ। ছবি: সন্দীপ রায়ের সৌজন্যে।

একটা অন্ধকার ঘরে বসে ছবি ছাপা সংক্রান্ত বিশেষ এক পরীক্ষা করে যাচ্ছেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। শিবনারায়ণ দাস লেনের এই ভাড়াবাড়িতে উঠে এসেছেন এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুবিধার জন্যই। ১৩ নম্বর কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটে আগের বাড়িতেও তাঁর নিজস্ব ডার্করুম ছিল। হাফটোন ফোটোগ্রাফি ও প্রসেস শিল্প নিয়ে গবেষণা করতেন সেখানেও।

সেই প্রয়োজনেই ১৮৯৫ নাগাদ বিলেত থেকে প্রচুর বই, প্রসেস ক্যামেরা, নানান যন্ত্রপাতি এসে পৌঁছল তাঁর কাছে। গবেষণা, ব্যবসা একযোগে চালাতে গেলে দরকার আরও বেশি জায়গা। তাই বাসাবদল। মেয়ে পুণ্যলতা চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘মাঝারি রকমের বাড়ি, তার মধ্যে একটা ঘরে বাবা স্টুডিও তৈরী করলেন, আর একটা ঘরে ও বারান্দায় নানা রকম যন্ত্রপাতি রাখা হল। একটা স্নানের ঘরকে করা হল ডার্করুম।’

তখন এ দেশে ছবি ছাপা হত কাঠের ওপর খোদাই করা ব্লক দিয়ে। উপেন্দ্রকিশোর এই ব্যবস্থা মেনে নিতে পারেননি। তাঁর ‘ছেলেদের রামায়ণ’ বইটিতে ছিল তাঁরই আঁকা চমৎকার সব ছবি। কিন্তু বই বেরোনোর পর দেখা গেল কাঠের ব্লকে ছাপানোর ফলে সেগুলো সম্পূর্ণ বিকৃত হয়ে গেছে। তবে এই বিভ্রাটের অনেক আগেই তিনি এ বিষয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন। ছাত্রাবস্থায় জানতে পেরেছিলেন, তামা ও দস্তার পাতে খোদাই করে ছাপলে সুন্দর ও সূক্ষ্ম ছবি পাওয়া যায়। সেই থেকে গবেষণার নিয়ম মেনে পৌঁছে গেলেন হাফটোন প্রসেসের জগতে।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

ইওরোপেও এই সময় হাফটোন ফোটোগ্রাফি গবেষণার পর্যায়ে ছিল। কোনও নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ছিল না। চালু তত্ত্বগুলোর অধিকাংশই ছিল অনুমাননির্ভর, পরস্পরবিরোধীও। উপেন্দ্রকিশোর চাইছিলেন, হাফটোন ব্লক নির্মাণের সুনির্দিষ্ট নিয়ম থাকুক। পরিশ্রম কম হোক। পুরো ব্যবস্থাটায় একটা বৈজ্ঞানিক শৃঙ্খলা আসুক, কাজের নমুনা সর্বত্র এক হোক। সেই কারণেই দিনের পর দিন ডার্করুমে। সুকুমার রায় লিখেছেন, ‘লঘুভাবে কোন কার্যে প্রবৃত্ত হওয়া তাঁহার প্রকৃতিবিরুদ্ধ ছিল, যখন যাহাতে হস্তক্ষেপ করিতেন তাহারই সাধনায় একেবারে নিমগ্ন থাকিতেন।’

হাফটোন ব্লক তৈরি করার জন্য এক বিশেষ ধরনের ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়, যা ‘প্রসেস ক্যামেরা’ নামে পরিচিত। সাধারণ ক্যামেরার সঙ্গে প্রসেস ক্যামেরার মূল পার্থক্য একটি কাচের স্ক্রিনের। সূক্ষ্ম জাফরি-কাটা এই স্ক্রিনের দৌলতেই মূল ছবিটি নেগেটিভ বিন্দুর সমাহারে পরিণত হয়। আলোক-সংবেদী প্লেটের থেকে ঠিক কতটা দূরে এই স্ক্রিন স্থাপন করতে হবে, সেই হিসেবটা জরুরি। ইওরোপের ব্লক নির্মাতারাও এ বিষয়ে দিশাহারা ছিলেন। উপেন্দ্রকিশোরের পরিশ্রমী গবেষণা প্রসেস ক্যামেরা ব্যবহারের পদ্ধতির মধ্যে গাণিতিক নির্ভুলতা নিয়ে এল।

গবেষণালব্ধ প্রবন্ধগুলো প্রকাশিত হল ‘মুদ্রণজগতের বাইবেল’ বলে পরিচিত একটি পত্রিকা— ‘পেনরোজ় পিকটোরিয়াল অ্যানুয়াল’-এ। মুদ্রণ ও প্রসেস-বিদ্যা বিষয়ক এই বার্ষিকীর প্রথম প্রকাশ ১৮৯৫ সালে, লন্ডনে। প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক উইলিয়ম গ্যামবেল। তৃতীয় বার্ষিক সংখ্যায় ছাপা হল উপেন্দ্রকিশোরের প্রবন্ধ ‘ফোকাসিং দ্য স্ক্রিন’। পরের দু’বছর বেরোল ‘দ্য থিয়োরি অব দ্য হাফটোন ডট’ এবং ‘দ্য হাফটোন থিয়োরি গ্রাফিক্যালি এক্সপ্লেনড’। গবেষণাগুলি এত দিন প্রচলিত ‘হাতড়ে বেড়ানো পদ্ধতি’র অবসান ঘটাতে পেরেছে, তা স্বীকার করতে শুরু করল তামাম মুদ্রণবিশ্ব।

স্ক্রিন অ্যাডজাস্টমেন্ট ইন্ডিকেটর যুক্ত প্রসেস ক্যামেরা

১৮৯৯ নাগাদ উপেন্দ্রকিশোর পেনরোজ় কোম্পানির মাধ্যমে স্ক্রিন-প্রস্তুতকারী সংস্থার কর্ণধার মি. লেভিকে অনুরোধ করলেন ‘থ্রি লাইন স্ক্রিন’ তৈরি করে দিতে। সাধারণ স্ক্রিনে দুই গুচ্ছ সমান্তরাল রেখা থাকে; প্রতিটি গুচ্ছের সমদূরবর্তী রেখাগুলি অন্য গুচ্ছের সমান্তরাল রেখাগুলিকে নব্বই ডিগ্রিতে ছেদ করে। উপেন্দ্রকিশোরের নতুন স্ক্রিনে গুচ্ছ দুটি ষাট ডিগ্রিতে পরস্পরকে ছেদ করবে। লেভি উপেন্দ্রকিশোরের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলেন। অন্য নির্মাতারাও ব্যর্থ হলেন এটি তৈরি করতে। উপেন্দ্রকিশোর লিখছেন, ‘আমার আর বিকল্প রইল না।…এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই খবর পেলাম মিস্টার শুলৎজে এটির (ষাট ডিগ্রি স্ক্রিন) পেটেন্ট নিয়েছেন।’

এই শুলৎজে আর এক জন স্ক্রিন নির্মাতা। লেভির প্রত্যাখ্যানের পর উপেন্দ্রকিশোর তাঁকে গবেষণাপত্রটি পাঠিয়ে স্ক্রিন তৈরি করে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। শুলৎজে গবেষণাটি নিজের নামে চালিয়ে পেটেন্ট নিয়ে নিলেন। এই ‘চুরি’র সংবাদে উপেন্দ্রকিশোরের প্রতিক্রিয়া, ‘পেটেন্ট তালিকার কোটি কোটি নামের মধ্যেই শুধু বেঁচে থাকবে শুলৎজে। ৬০ ডিগ্রি স্ক্রিনের পেটেন্টকার হিসেবে অর্থ ছাড়া সে কিছুই পায়নি, স্ক্রিনের ব্যবহারবিধি সম্বন্ধে কিছুই সে জানত না।’

‘স্ক্রিন অ্যাডজাস্টমেন্ট ইন্ডিকেটর’ উপেন্দ্র-আবিষ্কৃত আরও একটি যন্ত্র। যান্ত্রিক উপায়ে স্ক্রিন-দূরত্ব নির্ধারণে সক্ষম এটি। আবিষ্কারকের নামে পরে এর নামকরণ হয় ‘রে-স্ক্রিন অ্যাডজাস্টার’। উপেন্দ্রকিশোরের হয়ে পেনরোজ় কোম্পানি এর পেটেন্ট নেয়। নিজেদের প্রসেস ক্যামেরার অতিরিক্ত যন্ত্রাংশ হিসেবে তারা এটি বিক্রি করত। এই আবিষ্কারে সাধারণ ও হাফটোন ফোটোগ্রাফির মধ্যে ব্যবধান কমে এল।

১৮৯৭ থেকে ১৯১২, পনেরো বছরে ‘পেনরোজ়’ পত্রিকা উপেন্দ্রকিশোরের ন’টি মৌলিক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিল। ‘হাউ মেনি ডটস্’, ‘মোর অ্যাবাউট দ্য হাফটোন থিয়োরি’, ‘মাল্টিপল স্টপস’ প্রভৃতি মৌলিক চিন্তাভাবনা ইওরোপের বিশেষজ্ঞদের কাছে আগ্রহ ও বিস্ময়ের বস্তু হয়ে উঠল। আর একটি বিদেশি পত্রিকা ‘প্রসেস ওয়ার্ক অ্যান্ড ইলেকট্রোটাইপিং’ তাদের এক সংখ্যায় উপেন্দ্রকিশোরের বৈজ্ঞানিক অবদানকে স্বীকৃতি জানাল।

হাফটোন মুদ্রণ বিষয়ে উপেন্দ্রকিশোরের বাংলা প্রবন্ধ প্রথম প্রকাশিত হয় ‘প্রদীপ’ পত্রিকার ১৩০৫ আশ্বিন-কার্তিক সংখ্যায়। রবীন্দ্রনাথ প্রবন্ধটি পড়ে ‘ভারতী’ পত্রিকায় লিখলেন, ‘অনেকেই হয়ত জানেন না হাফ-টোন লিপি সম্বন্ধে উপেন্দ্রবাবুর নিজের আবিষ্কৃত সংস্কৃত পদ্ধতি বিলাতের শিল্পী-সমাজে খ্যাতি লাভ করিয়াছে; উপেন্দ্রবাবু স্বাভাবিক বিনয় বশত তাঁহার প্রবন্ধের কোথাও এ ঘটনার আভাসমাত্র দেন নাই।’ এর পাঁচ বছর পরে ‘প্রবাসী’ পত্রিকার ১৩১০ আষাঢ় সংখ্যায় চিত্রকর রবিবর্মার সুবিখ্যাত তৈলচিত্র ‘অজবিলাপ’ ত্রিবর্ণ হাফটোন ব্লকে ছাপা হয়। এই প্রথম কোনও ভারতীয় কাগজে তিন-রঙা হাফটোন মুদ্রিত হল। ‘প্রবাসী’ লিখেছিল, ‘আমরা জানি ভারতীয় কোন কাগজে তদ্রূপ ছবি প্রকাশিত হয় নাই।’

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের জেরে নানা জায়গায় স্বদেশি মেলার আয়োজন হচ্ছিল। কংগ্রেস অধিবেশন উপলক্ষে পিজি হাসপাতালের উল্টো দিকের মাঠে ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কালচারাল এগজ়িবিশন’ নামের একটি মেলা শুরু হয় ১৯০৬-এর ২১ ডিসেম্বর। চলেছিল একুশ দিন। ১০০০ প্রদর্শক এতে অংশ নিলেন। উপেন্দ্রকিশোর সেখানে তাঁর হাফটোন ছবি এবং আবিষ্কৃত স্ক্রিন অ্যাডজাস্টমেন্ট ইন্ডিকেটর যন্ত্রটির জন্য মোট তিনটি স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন।

রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে উপেন্দ্রকিশোর বরাবর দূরে থাকলেও ব্যতিক্রম ঘটেছে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়। স্বদেশি আন্দোলনের প্রবল জোয়ারে ভেসে গিয়েছিলেন তিনিও। ১৯০৫ সাল, দূর থেকে শোনা যাচ্ছে গান। মস্ত বড় শোভাযাত্রা, নেতৃত্বে রবীন্দ্রনাথ। সবাই গাইছেন ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল’। খোল বাজাচ্ছেন দীনু ঠাকুর। বেহালা নিয়ে উপেন্দ্রকিশোর যোগ দিলেন সেই শোভাযাত্রায়। টাউন হলের ঐতিহাসিক অধিবেশনেও রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের সঙ্গে বেহালা বাজিয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। পুণ্যলতা লিখেছেন, ‘বাবার বেহালা বাজনার প্রতি তিনি (রবীন্দ্রনাথ) অনুরাগী ছিলেন। প্রতি বৎসর জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে উৎসবের সময় বাবাকে রবীন্দ্রনাথের নতুন গানের সঙ্গে বেহালা বাজাতে হত।’

দ্বারকানাথ ঘোষের ‘ডোয়ার্কিন’ থেকে উপেন্দ্রকিশোরের সঙ্গীতশিক্ষা বিষয়ক দুটি বই প্রকাশিত হয়েছিল— ‘শিক্ষক ব্যতিরেকে হারমোনিয়াম শিক্ষা’ এবং ‘বেহালা শিক্ষা’। প্রথম বইটি যে তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল তার প্রমাণ বইটির আরও দুটি সংস্করণ। অথচ উপেন্দ্রকিশোর এর প্রকাশ বন্ধ করে দেন, কারণ তাঁর ধারণা হয়েছিল হারমোনিয়াম সহযোগে গান ভারতীয় সঙ্গীতের পক্ষে ক্ষতিকর। ১৯১৪ সালে প্রকাশিত হয় এ এইচ ফক্স স্ট্র্যাংওয়েসের ‘মিউজ়িক অব হিন্দুস্তান’ বইটি। এই বইয়ের জন্য উপেন্দ্রকিশোর প্রচলিত ও জনপ্রিয় কয়েকটি রাগের ইংরেজি পরিচিতি লেখেন এবং রবীন্দ্রনাথের তিনটি গানের অনুবাদ করেন। এ ছাড়াও তিনি নানা প্রয়োজনে প্রিয় বন্ধু রবীন্দ্রনাথের বারোটি গানের স্বরলিপিও তৈরি করেছিলেন।

গানবাজনার বিষয়ে তাঁর কোনও ক্লান্তি ছিল না। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন। বেহালা, হারমোনিয়াম ছাড়াও বাজাতেন সেতার, পাখোয়াজ, বাঁশি। ছয়টি ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করেছিলেন। তাঁর লেখা ‘জাগো পুরবাসী’ গানটি ব্রাহ্মসমাজের প্রার্থনায়, খ্রিস্টানদের ধর্মোৎসবেও গাওয়া হত। বড় বড় সভা-সমিতি ও সঙ্গীত সম্মেলনে তাঁর গুরুত্ব ছিল, ছোটখাটো নানা অনুষ্ঠানেও তাঁকে অনুরোধ করে কেউ কোনও দিন নিরাশ হননি। পুণ্যলতা জানিয়েছেন, ‘আমাদের রোজ নিয়ম মতো বাবা গান বাজনা শেখাতেন, তাছাড়া কত যে তাঁর ছাত্রছাত্রী এসে জুটতো! তার উপরে ছিল মন্দিরে উৎসবের গান, স্কুলের প্রাইজের গান, কত বিয়ে ও সভা-সমিতির গান।’

গান শিখতে বা সঙ্গীত নিয়ে আলোচনা করতে বিচিত্র লোকসমাগম হত রায়চৌধুরী বাড়িতে। এক মার্কিন যুবক, উপেন্দ্রকিশোরের ছাত্র, মেঘমন্দ্র গম্ভীর স্বরে গাইছেন ‘প্রোভাটে বিমলো আননডে’ (প্রভাতে বিমল আনন্দে), বা সিকিমের এক মধ্যবয়সি ভদ্রলোক, মিহি মোলায়েম গলা, সুরটাও ধরেছেন ঠিকঠাক; কিন্তু ‘তা–তা–থৈ–থৈ’ কিছুতেই মুখে আসছে না। ‘তা–তা–তৈ–তৈ’ বা ‘দা–দা–দৈ–দৈ’ হয়ে যাচ্ছে। শীতকালে গড়পারের বাড়ির লাইব্রেরি ঘরে অনেক লোক জড়ো হয়েছেন। সন্ধ্যাবেলা, কাঁপুনি দেওয়া ঠান্ডা। তারই মধ্যে কংগ্রেসের গানের রিহার্সাল শুরু হল—‘চল রে চল সবে ভারতসন্তান’। সঙ্গে অর্গান, বেহালা বাজছে, সারা বাড়িটা যেন গমগম করছে। ‘বিছানায় শুয়ে ‘এক মন্ত্রে কর জপ, এক তন্ত্রে তপ’ শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, কত রাত অবধি গান চলেছে, কিছুই জানি না।’ ছেলেবেলার স্মৃতিচারণে মণিমুক্তো তুলে এনেছেন পুণ্যলতা।

স্বজন-পরিজনদের নিয়ে বছরে অন্তত এক বার ঘুরতে যেতেন। ময়মনসিংহের মসুয়ায় দেশের বাড়ি ছাড়াও গন্তব্য হত পুরী, দার্জিলিং, চুনার বা মধুপুর। এই নিয়ে তাঁর লেখা ভ্রমণকাহিনি ‘পুরী’, ‘আবার পুরী’ ছাপা হয়েছিল শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘মুকুল’ পত্রিকায়। বেড়াতে গিয়ে জলরঙে বা তেলরঙে ছবি এঁকেছেন। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ আর ‘চুণার দুর্গ’ ভ্রমণ-পর্বের দুটি বিখ্যাত ছবি। শেষের ছবিটি উপহার দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। ১৩০৭ বঙ্গাব্দে শিলাইদহে বেড়াতে গিয়ে যতীন্দ্রনাথ বসু রবীন্দ্রনাথের পড়ার ঘরে চুনার দুর্গের ছবিটি দেওয়ালে টাঙানো দেখেছিলেন। ছোটদের জন্য রবীন্দ্রনাথ যুক্তাক্ষর বর্জিত কবিতা ‘নদী’ প্রকাশ করলে উপেন্দ্রকিশোর সাদা-কালোয় এই বইটির জন্য সাতটি ছবি এঁকেছিলেন।

‘ছবি আঁকিয়ে’ উপেন্দ্রকিশোরকে স্মৃতিকথায় তুলে এনেছেন পুত্র সুবিমল রায়: “ছেলেবেলায় আমরা তাঁর সঙ্গে দার্জিলিং গিয়েছিলাম। দেখেছিলাম যে বাবা ছবি আঁকতে আঁকতে মধ্যে মধ্যে পিছিয়ে এসে শান্তভাবে ছবিটার দোষ-গুণ দেখছেন, আবার এগিয়ে ছবির কাছে গিয়ে দরকার বুঝে কয়েকটা দাগ বা টান বা একটু তুলির কারুকার্য জুড়ে দিয়ে ছবিটাকে আরো সুন্দর করে তুলছেন। ছবির চেয়ে বাবার সেই চেহারাটাই বেশী মনে পড়ে— কী শান্ত, সজীব আনন্দময় সে চেহারা। গিরিডিতে শালবনের দিকে তাকিয়ে তিনি যখন ছবি আঁকতেন তখন তাঁকে দেখে মনে হত যেন তপোবনের একজন মুনি।”

উপেন্দ্রকিশোরের ছবিকে আক্রমণ করেছেন এক দল সমালোচক। তাঁদের কথায় এই সব ছবি ‘মেকী এবং বিদেশীর অনুকরণে অঙ্কিত’। উপেন্দ্রকিশোর কোনও প্রতিবাদ করেননি। মৃদু হাসির সঙ্গে তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল: “শিল্পের জগৎ খুব বড় ও মহৎ।”

শেষ করা যাক এক নিমন্ত্রণবাড়ির ঘটনা দিয়ে। ঠাকুর খাবার পরিবেশন করছে, কর্তা দাঁড়িয়ে তদারকি করছেন। গণ্যমান্যদের খুব খাতির, গরিব লোকেদের কেউ যত্ন-আদর করছে না। ঠাকুরকে সদ্য-ভাজা লুচি ঝুড়িতে নিয়ে ‘গরম লুচি! গরম লুচি!’ বলতে বলতে এগিয়ে আসতে দেখে এক গরিব মানুষ বললেন, “ঠাকুর, আমাকে দু’খানা গরম লুচি দাও।” কর্তা গম্ভীর ভাবে বললেন, “পাতের ঠান্ডা লুচিগুলো ফেলে দেবেন না যেন!” বলেই উপেন্দ্রকিশোরের কাছে এসে খুব খাতির করে বললেন, “আপনাকে দু’খানা গরম লুচি দিক?” উপেন্দ্রকিশোর বিনয়ী উত্তর, “কিন্তু আমার পাতের ঠান্ডা লুচি যে এখনও ফুরোয়নি।” শুনে লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিল গৃহকর্তার মুখ।

Upendrakishore Ray Chowdhury Literature
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy