Advertisement
E-Paper

মার্জিনে রবীন্দ্রনাথ

বই পড়তে পড়তে তার প্রান্তরেখা পেরিয়েও মন্তব্য লিখে রাখতেন তিনি। কখনও দাগিয়ে রাখতেন পেনসিলে, বা এঁকে ফেলতেন ছবি। নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়বই পড়তে পড়তে তার প্রান্তরেখা পেরিয়েও মন্তব্য লিখে রাখতেন তিনি। কখনও দাগিয়ে রাখতেন পেনসিলে, বা এঁকে ফেলতেন ছবি। নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০১৭ ০০:০০
Share
Save

রবীন্দ্রনাথকে নিজের লেখা বই ‘বাগ্ধারা-সংগ্রহ’ উপহার দিয়ে, প্রথম পৃষ্ঠায় সুধীরচন্দ্র মজুমদার লিখে দিলেন, ‘অভিমত প্রার্থনীয়’। পাঠক রবীন্দ্রনাথ ওই বইয়ের মার্জিনে ‘গায়ে পড়া’ বাগধারাটির পাশে লিখলেন, ‘লোকটা গায়ে পড়া’। নীচে, ইংরেজিতে লিখলেন, ‘ফোর্সড ইন্টিমেসি’। ‘চক্ষু চড়কগাছ’ শব্দ দুটির নীচে দাগ টেনে লিখলেন, ‘জানা নেই’। রবীন্দ্রনাথের পড়া অসংখ্য বইয়ের খোঁজ পাওয়া যায় তাঁর চিঠিপত্রে এবং আত্মকথায়। তাঁর পড়া বইয়ের সংগ্রহ মূলত রয়েছে বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনে। কবির ব্যবহৃত বলে চিহ্নিত প্রায় ৩৫০টি বইয়ের মধ্যে ৪০টিতে আজও আছে তাঁর প্রান্তলিখন। সম্ভবত পড়ার সময় রবীন্দ্রনাথ হাতে রাখতেন একটা পেনসিল, কালেভদ্রে কলম। বইয়ের অধিকার বজায় রাখতে কখনও সই করেছেন, কখনও শুরুর পৃষ্ঠায় ব্যবহার করেছেন নিজের সিলমোহর।

চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য ও গিরিজাপ্রসন্ন মজুমদারের ‘প্রাথমিক বিজ্ঞান’ পড়ছেন রবীন্দ্রনাথ। ‘তড়িৎ সুপরিবাহী’ কেটে লিখলেন ‘সুসম্বাহী’, আর ‘কুপরিবাহী’ হল ‘তড়িৎ নসম্বাহী’। আকাশে ভাসমান ধূলিকণার পাশ দিয়ে আলো আসে বলেই আকাশ নীল— লেখকের এই অভিমত পড়ে মার্জিনে লিখলেন, ‘সে জন্যই নীল রং হতে হবে এযুক্তি ছেলেরা গ্রহণ না করতে পারে।’ কোথাও ঠেকে গেলে লিখলেন, ‘অত্যন্ত বিস্তৃত করায় দুরূহ হইয়াছে।’ আবার তড়িৎ-ঘণ্টার বিবরণ পড়ে লিখেছিলেন, ‘চোখে না দেখলে পড়ে বোঝা দুঃসাধ্য’।

দাগ দিয়ে, কখনও মনের কথা লিখে লিখে রবীন্দ্রনাথ এ ভাবেই পড়েছেন বাণভট্টের ‘কাদম্বরী’, কালিদাসের ‘মেঘদূত’ অথবা ম্যাথু আর্নল্ড-এর ‘কালচার এন্ড অ্যানার্কি’-র মতো বই। গ্রিয়ার্সনের বইয়ে বিদ্যাপতির পদ পড়তে পড়তে মেতে গেলেন অনুবাদে। পেনসিলে নিজের সেই সব রূপান্তর লিখে রাখলেন বইয়েই। কবির হস্তাক্ষরে সে বইয়ে দেখা যায়: ‘কামপ্রেম উভয়ে যদি একমত হইয়া থাকে তবে কখন কি না করায়।’ আবার কোথাও লিখেছেন, ‘বড়র অনুরোধ বড়তেই রাখে’। ‘দি বায়োকেমিক সিস্টেমস অফ মেডিসিন’ বইয়ে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য আর নজরটান দেখে মনে হয়, তিনি ছিলেন শ্বাসজনিত উপসর্গে উদ্বিগ্ন।

‘রোটা প্রিন্টার’ বলে এক যন্ত্রে রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখায় ১৯২৬-এ ছাপা হলো তাঁর বই ‘লেখন’। কবিতাগুলোর বেশির ভাগই চিন, জাপানে অটোগ্রাফ হিসেবে লিখে দেওয়া। বারো বছর পর, রবীন্দ্রনাথ নতুন করে পড়লেন নিজের সেই বই। পাতায় পাতায় করলেন সংশোধন। কেটে দিলেন ভুল করে নিজের নামে ছেপে দেওয়া প্রিয়ম্বদা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাঁচটি কবিতার তিনটি। দুই প্রিয় দেশ চীন-জাপানের যুদ্ধের ছায়াতেই যেন আঁকলেন কালি-মাখা এক আত্ম-প্রতিকৃতি।

কবি উইলিয়ম বাটলার ইয়েটস এক বার নীৎশের ‘দি জিনিয়োলজি অব মরালস’ পড়তে গিয়ে বইটির মার্জিনে লিখেছিলেন, কেনই বা নীৎশে মনে করেন রাতের আকাশে তারা নেই, আছে শুধু বাদুড়, প্যাঁচা আর পাগল চাঁদ! ইয়েটস-এর মতোই, লেখকদের মধ্যে ‘মার্জিনালিয়া’-র জন্য পরিচিত ছিলেন স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ, এডগার অ্যালান পো, মার্ক টোয়েন, সিলভিয়া প্লাথ-ও। মার্কিন কবি বিলি কলিন্স ‘মার্জিনালিয়া’ শিরোনামে লিখেছিলেন একটি কবিতাও। কবিতাটিতে দেখা যায়, স্কুল-জীবনে লাইব্রেরির বইয়ে ‘মার্জিনালিয়া’-র আড়ালে কবি খুঁজে পেয়েছিলেন কোনও অচেনা অপরূপার মুখ। যার সঙ্গে জীবনেও দেখা হবে না, বইটির দাগ-ধরা এক পৃষ্ঠায় হালকা পেনসিলে এমন এক সুন্দরীই যেন লিখেছিল : ‘এগ স্যালাডের দাগটুকুকে মাফ করে দাও, প্রেমে পড়েছি আমি।’

নেপাল চন্দ্র রায়ের ‘ইংল্যান্ডের ইতিহাস’ বইয়ের প্রচ্ছদে আর অক্ষয়চন্দ্র সরকার সম্পাদিত ‘চণ্ডীদাসের পদাবলী’-র মার্জিনে রবীন্দ্রনাথ এঁকেছিলেন দুই পুরুষের মুখের ছবি। মুনীন্দ্র দেব রায়ের ‘গ্রন্থাগার’-এ বইটির সাফল্য কামনা করে লিখেছিলেন ‘...বাংলাদেশে গ্রামে নগরে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা সর্ব্বত্র ব্যাপ্তি লাভ করচে। এই প্রচেষ্টা যাতে কেবলমাত্র চিত্তবিনোদনের উপলক্ষ্ মাত্র না হয় এবং সংস্কৃতি সাধনাকে লোকসমাজে বিস্তারিত করতে পারে সেই দিকে সতর্ক দৃষ্টি দেবার সময় এসেছে।’ বররুচির প্রাকৃত ব্যাকরণে ‘মালাইল্লো’ শব্দের বাংলা করে লিখেছেন ‘মালাওয়ালা’। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ‘দি অরিজিন এন্ড দি ডেভলপমেন্ট অব দি বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ’ পড়তে গিয়ে ‘ধোবানী’, ‘বদ্যিনী’, ‘মেথরানী’ গোত্রের শব্দের পাশে লিখেছেন: ‘উকিলনী কেন হল না?’

৩ মার্চ ১৮৯৩। ও়়ড়িশা থেকে ইন্দিরা দেবীকে চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, মফস্‌সলে যখন যান, সঙ্গে নিয়ে যান অনেক বই। জানালেন, শেক্‌সপিয়রের সঙ্গেই এনেছেন ‘নেপালীজ বুদ্ধিস্টিক লিটারেচার’। কিছু নাটক আর কবিতার বৌদ্ধ উপাদান এই বই থেকেই পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৮৮২-তে প্রকাশিত রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সেই ‘The Sanskrit Buddhist Literature of Nepal’-এর প্রথম খণ্ডে রবীন্দ্রনাথ রেখেছেন সেই ঋণের স্বাক্ষর। সংশ্লিষ্ট কাহিনির পৃষ্ঠাসংখ্যা সহ লিখে রেখেছেন ‘মালিনী’, ‘পূজারিণী’, ‘মূল্যপ্রাপ্তি’, ‘শ্রেষ্ঠভিক্ষা’, ‘উপগুপ্ত’-এর মতো নাম।

এই সব ছোট ছোট হালকা ‘মার্জিনালিয়া’-ই এঁকে দেয় নিবিড় পাঠক রবীন্দ্রনাথের এক অন্তরঙ্গ ছবি।

বইয়ের ছবি: বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনের সৌজন্যে

Rabindranath Tagore

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে আপনার সাবস্ক্রিপশন আপনাআপনি রিনিউ হয়ে যাবে

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।