Advertisement
E-Paper

ঠিক যেন মোগলি

প্রায় দেড়শো বছর আগে উত্তরপ্রদেশের জঙ্গলে শিকারীরা দেখেছিল, এক পাল নেকড়ের সঙ্গে দৌড়চ্ছে এক মানবসন্তান। তাকে ধরে এনে রাখা হয়েছিল অনাথ আশ্রমে। ছোট্ট সেই ছেলেই কি কিপলিং-এর ‘দ্য জাঙ্গল বুক’-এর প্রেরণা? প্রায় দেড়শো বছর আগে উত্তরপ্রদেশের জঙ্গলে শিকারীরা দেখেছিল, এক পাল নেকড়ের সঙ্গে দৌড়চ্ছে এক মানবসন্তান। তাকে ধরে এনে রাখা হয়েছিল অনাথ আশ্রমে। ছোট্ট সেই ছেলেই কি কিপলিং-এর ‘দ্য জাঙ্গল বুক’-এর প্রেরণা? চিরশ্রী মজুমদার

চিরশ্রী মজুমদার

শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০১৯ ০০:০০
নেকড়ে-মানুষ: ‘মোগলি: লেজেন্ড অব দ্য জাঙ্গল’ (২০১৮) ছবির দৃশ্য

নেকড়ে-মানুষ: ‘মোগলি: লেজেন্ড অব দ্য জাঙ্গল’ (২০১৮) ছবির দৃশ্য

গল্পে-কাহিনিতে যারা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে তথাকথিত সভ্য মানুষের সংসর্গে এসেছিল, প্রত্যেকেরই জীবন মোটের ওপর মিষ্টি। টার‌জ়ান, জর্জ অব দ্য জাঙ্গল বা মোগলি, সবাই বনেবাদাড়ে বড় হলে কী হবে, চেহারায় রাজপুত্তুর। বুনো জীবন ওদের লাবণ্যে এতটুকু আঁচড় কাটতে পারেনি। বরং অরণ্যের যা কিছু ভাল, তাই ওদের ওপর ঝরে পড়েছিল আশীর্বাদ হয়ে। দু’পায়ে চিতার মতো দৌড়ত, গাছের ডাল ধরে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে জিমন্যাস্টিক্স দেখিয়ে প্রায় হেলিকপ্টারের সঙ্গে পাল্লা দিত। বাঘ-সিংহদের সঙ্গে দারুণ দোস্তি। এই এক লাফে বেয়াড়া হাতির পিঠে উঠে তাকে শান্ত করছে তো পরক্ষণেই এক ঘুসিতে কুমিরের নাক ফাটিয়ে দিচ্ছে। জঙ্গলে থেকেও ওদের নখ বাড়েনি, গায়ে ময়লা চেপে বসেনি। শুধু কাঁধ ছাপানো উসকোখুসকো চুল, রকস্টারদের মতো। তা ওদের রাফ অ্যান্ড টাফ রূপকে আরও খোলতাই করেছে।

তবে জনপ্রিয়তার নিরিখে আর প্রথম আত্মপ্রকাশের হিসেবে এদের মধ্যে হয়তো সবার আগে আসবে রাডইয়ার্ড কিপলিং-এর মোগলি। আমরা চোখ গোল গোল করে দেখেছি নেকড়ের পালের সঙ্গে বড় হয়ে ওঠা আট-দশ বছরের ছেলের এলেম। তার চোখা বুদ্ধির জন্য নেকড়ে বাবা রামা আর মা রক্ষা তাকে বুঝি নিজের ছেলেপিলের থেকেও একটু বেশিই ভালবাসে। বালু ভাল্লুক হেলেদুলে বলে, তার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সেরা এই মানুষছানা। যে বাঘিরাকে সারা বন সমঝে চলে, মোগলির প্রতি সেও দুর্বল। মোগলি যেন জেতার জন্যই জন্মেছে। সে পাশের গ্রাম থেকে লাল ফুল, মানে আগুন নিয়ে এসে ভিলেন শের খানকে জব্দ করে। অজগর কা চোখের জাদুতে সব জন্তুদের বশ করে, তার পর পেঁচিয়ে মুটুস-মুটুস করে হাড় ভাঙে। তার সম্মোহনের জাল কেটে বন্ধুদের বাঁচায় মোগলিই। কুমিরের পিঠে টপাটপ পা দিয়ে এক দিন পৌঁছে যায় মানুষের গ্রামে। ‘দ্য জাঙ্গল বুক’-এর এক্কেবারে শেষে, কিপলিং লিখেছেন, মোগলি বড় হয়, তার বিয়েও হয়। কিন্তু সে কাহিনি অন্য। নিত্যনতুন সিক্যুয়েলওলা সিনেমা আর ছবি-আঁকা বইয়ের দাক্ষিণ্যে আমরা সে গল্পও বিলক্ষণ জানি। মোগলি মানুষের পৃথিবীতে এসেও শুধুই জেতে— গ্রামবাসীদের স্নেহ, সুন্দরীর মন আর বক্স অফিস।

ছেলে-ভুলানো গল্পে অমনই হয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই সব অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি, শিশুপাঠ্য রূপকথা লেখকেরা ফাঁদলেন কী ভাবে? তাঁদের কল্পনা দিগ্বিজয়ী ঠিকই, কিন্তু বাস্তবের কাঠামো থাকলে তবেই না গপ্পো এমনধারা জমে! মোগলি নাকি সত্যিকারের এক চরিত্রের আদলে লেখা। সভ্যতা থেকে ছিটকে গিয়ে, বনমানুষ বা পাখি বা নেকড়ের পালের মধ্যে বড় হওয়া মানবসন্তানের খবর এখনও কাগজে আসে মাঝেসাঝে। সে কালে জঙ্গল ছিল বেশি, এমন ঘটনাও কি তাই বেশিই ঘটত! ১৮৭২ সালে নাকি এক দল শিকারী উত্তরপ্রদেশের গভীর বনের মধ্যে দেখেন, এক পাল নেকড়ের সঙ্গে চার পায়ে দৌড়চ্ছে একটা মানুষের ছেলে! তাঁদের দেখেই পশুর পাল পাহাড়ের খাঁজে লুকোল। তখন গুহার বাইরে গনগনে আগুন জ্বালালেন শিকারীরা। ধোঁয়ার চোটে পশুগুলো বাইরে আসতেই, সব ক’টাকে গুলি করে মারলেন। আর ধরে আনলেন নেকড়ে-বালককে। ভীষণ আঁচড়ে-কামড়ে দিচ্ছিল সে, দু্র্বোধ্য শব্দ বের করছিল মুখ দিয়ে। তাকে ধরতে খুব কসরত করতে হল শিকারীদের। বছর ছয়েকের শিশুর ঠাঁই হল মিশনারিদের এতিমখানায়। তার নাম দেওয়া হল ‘দিনা শনিচর’। বোধহয় শনিবার তাকে ধরা হয়েছিল বা ওই অনাথ আশ্রমে আনা হয়েছিল। যে ফাদার সেই মিশন চালাতেন, তিনি তাকে দুচক্ষে দেখতে পারতেন না। বলতেন, ব্যাটা ধুম পাগল। দু’পায়ে চলতে শেখানো হলেও কেমন নুয়ে নুয়ে হাঁটে। আবোলতাবোল দিকে চোখের মণি ঘোরায়। আসলে হাড়-বজ্জাত একটা।

দুচ্ছাইয়ের কিসসা এখানেই শেষ হয় না। শিশু মনস্তত্ত্ববিদ ওয়েন ডেনিস সে সময়ে অরণ্যে প্রতিপালিত শিশুদের নিয়ে যে গবেষণা করেছিলেন, তাতে শনিচরের কথা অনেকখানি পাওয়া যায়। সে মাংস খায় শুঁকে শুঁকে, জামাকাপড় পরাতে গেলে তেড়ে আসে আর রাস্তার পাথরে উপুড় হয়ে পড়ে দাঁত ঘষে ধারালো করে। মানুষের ভাষা কিছুতেই সে শিখল না, মুখ দিয়ে কেবল ফ্যাঁসফেঁসে ঘড়ঘড়ে জান্তব আওয়াজ বার করে। পরে ভাষাতাত্ত্বিকরা ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, কথা বলতে শেখার কয়েকটা ধাপ আছে। তার একটা ধাপে ফাঁকি থেকে গেলেই, গেল। ভাষাটা পুরোপুরি আর শেখা হয় না। শনিচর নেকড়েদের যোগাযোগ-রীতি আয়ত্ত করছিল, হঠাৎ করে মানুষের কথা শেখানোর চেষ্টায় তার মস্তিষ্কে জট পড়ে গেল। খ্যাঁকখ্যাঁক করা, গোঁগোঁ, দাঁত কিড়মিড়— এ সবই ভাল পারত। আর রাতবিরেতে বুকের রক্ত জল করা নেকড়ের ডাকও ডাকত। সবাই তখন তাকে লাঠি নিয়ে তাড়া করত!

তার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতানোই ছিল এক বিষম ব্যাপার। বন থেকে ধরে আনা আর একটি বাচ্চার সঙ্গে তার খানিক ভাব জন্মেছিল। কারণ, সে তাকে কাপে করে খেতে শিখিয়েছিল। মানুষের সংস্পর্শে একটাই স্বভাব দারুণ রপ্ত করেছিল সে। সেটা হল অনর্গল ধূমপান। ১৮৯৫ সালে, বয়স ৩০ হওয়ার আগেই তার তালগোল পাকানো জীবনটা শেষ হয়ে গেল। যক্ষ্মা হয়ে মারা গিয়েছিল সে।

অনাথ আশ্রমে শনিচরের উদ্ভট কাজকারবার যখন লোকের মুখে ঘুরছে, তখন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতের বম্বে প্রেসিডেন্সিতে মস্ত বাড়িতে বড় হচ্ছেন কিপলিং। রাতে ঘুমোবার সময় আয়ারা তাঁকে ভারতের গ্রাম-জঙ্গলের এই সব গা-ছমছমে গল্প শোনাতেন। কে জানে, নরম বিছানায় ঘুমের মধ্যে তলিয়ে যেতে যেতে খ্যাপা শনিচরই হয়তো তাঁর মানসচক্ষে ভেসে উঠেছিল মোগলি হয়ে!

যখন কিপলিং তুমুল জনপ্রিয় লেখক হয়ে উঠছেন, প্রকাশিত হয়েছে মোগলির গল্প বা ভারতের রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো আইরিশ খোকা কিমের উপন্যাস, তখনই অভিযোগের তির উঠেছিল, তাঁর কাহিনিতে ভারতকে স্টিরিয়োটাইপ করা হচ্ছে। কিপলিং এক বার বলেছিলেন, জল-জঙ্গল, গ্রামের কুঁড়ে, সুন্দরবনের বাঘ, মন্দিরের বিগ্রহ, ধুলো-ওড়া রাস্তায় ছুটে বেড়ানো ডানপিটে ছোকরারা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। শব্দ দিয়ে কেবল তাদের ছবি এঁকে তৃপ্তি পেয়েছেন। তাঁর লেখায় সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার আভাস ছিল কি না, সে তর্ক দূরে সরিয়ে বলা যায়, তাঁর ‘এগজ়োটিক ইস্ট’ সত্যিই বড় আকর্ষক, মজার। তাই তো আজও যত বার ‘জাঙ্গল বুক’ দেখানো হয়, মোগলিকে পাত-চাটা তবাকিকে শায়েস্তা করতে দেখলে বা বাঁদরের দলকে ভ্যাবলা বানাতে দেখলে কচিকাঁচারা আনন্দে, হাসিতে লুটোপুটি খায়।

কিন্তু গোলমালটা যে থেকেই যায়! আজও গভীর বন থেকে যত বাচ্চা ধরা পড়ে, তাদের সকলের নাকি সেটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। দিনা শনিচরের এই খুঁতটা নিয়েই তো আশ্রমের ইনচার্জ-এর যত রাগ, অভিযোগ ছিল। এত কিছুর পরও, ব্যাটা এক বারের জন্যও হাসল না!

Rudyard Kipling The Jungle Book Mowgli
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy