ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
গত ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচন। যথারীতি ভোটের আগের দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আমরা পাঁচ জন ভোটকর্মী বিকেল-বিকেল পৌঁছে গেলাম বুথে। এটি পূর্ব মেদিনীপুরের খেজুরি ১ নং পঞ্চায়েত সমিতির অন্তর্গত একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়। আমরা সমস্ত কাজকম্ম দ্রুত হাতে সারছি, হঠাৎ বারান্দায় ধপ করে কিছু রাখার শব্দ কানে এল। চতুর্থ পোলিং অফিসার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এলেন। দেখে আমাদের দিকে ফিরে অনুচ্চ কণ্ঠে বললেন, স্যর, ডাব। অর্থাৎ এক কাঁদি ডাব স্কুলের দাওয়ায় এসে পড়েছে। এ বার জনা চারেক গ্রামবাসী ঘরে ঢুকে পড়লেন। পাঞ্জাবি চোস্তায় লম্বা মতন এক জন এগিয়ে এসে নমস্কার করে বললেন, আমি স্যর বুথ সভাপতি, প্রিসাইডিং স্যর কে? প্রতিনমস্কার করে নিজের পরিচয় দিলাম। নেতা মুচকি হেসে এক জনকে বললেন, স্যরদের ডাব দাও। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বললাম, আরে এ সবের দরকার নেই, আপনারা বরং এজেন্টদের সকাল ছ’টার মধ্যেই পাঠিয়ে দেবেন।
উনি নেতাসুলভ ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, আরে খান খান, ভীষণ গরম পড়েছে, বাইরে থেকে আমাদের এলাকায় এসেছেন, একটু আতিথেয়তা করতে দিন। আর ভোট নিয়ে কোনও চিন্তা করবেন না। দশ বছর ধরে ভোট করাচ্ছি, এ এলাকা ভীষণ শান্ত। কোনও গন্ডগোল নেই, দুপুরের মধ্যেই ভোট শেষ হয়ে যাবে। আমাকে বলতেই হল, দশ বছর ধরে আপনি কী করছেন বলতে পারব না, কিন্তু এ বার ভোটটা করাতে আমরা এসেছি। নির্বাচন কমিশনের কঠোর নির্দেশ আছে, পাঁচটা অবধি ভোট দেওয়ার বন্দোবস্ত রাখতেই হবে। নেতার হাসিটি বড়ই প্রাণবন্ত, বললেন, ও-সব ছাড়ুন, তার থেকে বরং আপনি কী খান না বলুন তো? তেমন কিছু বারণ নেই শুনে পাশের সহযোগীকে প্রায় আদেশের সুরেই বললেন, বাবুদের জন্য আজ রাতে খাসি লাগি দে, কাল সকালে বরং পোনা মাছের জিরা-ঝোল আর আম-শোল। আমরা প্রায় সকলেই বলে উঠলাম, না না দাদা, এ পারব না। সেল্ফ হেল্প গ্রুপের মেয়েরা এলে আমরা বলে দেব আমরা কী খাব। এ বার এক জন এগিয়ে এসে বললেন, ওদের তো খেয়েদেয়ে কাজ নেই, দেখা করতে আসবে! ওরা রান্না করছে। আমরা তো আছি, আপনাদের যখন যা দরকার হবে আমাদের বলবেন, মুহূর্তেই সমাধান, হাঃ হাঃ হাঃ। তাঁরা নিজেরাই বলছেন, নিজেরাই হাসছেন। আমাদের কাজ প্রায় লাটে উঠছে, সময় চলে যাচ্ছে হু হু করে, এক সময় নেতা আর শাগরেদদের নমস্কার জানাতেই হল। ওঁরা চলে গেলেও এক জন কিন্তু থেকে গেলেন। আমাদের এক সহকর্মীর সঙ্গে একটু ভাবসাবও করে নিয়েছেন। আমাদের বারে বারে প্রশ্ন করেন, এটা কী, ওটা কী? ভোটের কালি কোথায় ছাপা হয়? এক সময় কঠোর হয়ে বলতেই হল, এখন আসুন, কাজ গোছাতে দিন। তিনি উঠে পড়তেই আমাদের ওই পোলিং অফিসারও উঠে পড়লেন। বললেন, স্যর, বসে বসে মাথা ধরে যাচ্ছে, একটু ঘুরে আসছি।
রাত তখন সাড়ে আটটা হবে। আমরা কাজ গুছিয়ে স্নানের জন্য বেরোচ্ছি, সহকর্মীটি এলেন একেবারে ফুরফুরে মেজাজে। বললেন, স্যর, সব খোঁজখবর করে এলাম। একদম পিসফুল এলাকা, দারুণ সব লোকজন! গলার আওয়াজ আর মেজাজে বোঝা যাচ্ছিল একটু অন্য রকম আতিথেয়তা হয়েছে, এ বিষয়ে ইঙ্গিত করতে তিনি বলে উঠলেন, এক নম্বর বিদেশি মাল স্যর, ফোকটে পেলে ছাড়া যায় কি? বলুন স্যর।
সকালে সময়মত নির্বিঘ্নেই ভোট শুরু হল। যুযুধান সব দলেরই পোলিং এজেন্ট পাশাপাশি বসে কাজ করছিলেন। স্বাভাবিক নিয়মে ভোট হচ্ছে। সকাল দশটার মধ্যে প্রায় শ’তিনেক ভোট পড়ল। এবং লক্ষণীয় ভাবে আড়াইশোই মহিলা। অর্থাৎ, গ্রামের মেয়ে-বউরাই সকাল সকাল ভোট দিলেন। একটু কৌতূহল প্রকাশ করতেই এজেন্টরা বললেন, এটাই রেওয়াজ স্যর। লেডিজ ফার্স্ট। আমি কিছুটা বিস্মিত এবং অভিভূতও বটে। খেজুরির এই প্রান্তিক গ্রামের মানুষের ভাবনা কতটাই না আধুনিক!
এমন সময় বিরোধী এজেন্ট বলে উঠলেন, এর পর তো আসল নাটক শুরু হবে। আমি একটু অবাক হলাম। মানে? আমার কথার উত্তর না দিয়ে শাসক দলের এজেন্ট বিরোধী এজেন্টকে চোখ রাঙিয়ে মন্তব্য করল— তুই স্যরকে বিভ্রান্ত করছিস। দাঁড়া, ডাকছি মেজদাকে। বলেই তিনি সটান পকেট থেকে ফোন বের করে ডায়াল করতে শুরু করলেন। আমি বাধা দিয়ে বললাম, ফোন জমা দিন, বুথের মধ্যে ফোন ব্যবহার করা বারণ, জানেন না? উনি তত ক্ষণে লাইন পেয়ে গেছেন, হ্যালো মেজদা, সাড়ে দশটা বাজতে যায়, আর দেরি কেন? এ দিকে ওরা উসকানিমূলক কথাবার্তা বলছে, ভোটারকে প্রভাবিত করছে। আমি কঠোর ভাবে ওই এজেন্টকে বললাম— আপনাকে আমি আর বসতে দিতে পারি না, আপনি ফোন ব্যবহার করে ফেলেছেন। আপনি পরিবর্ত কাউকে দায়িত্ব বুঝিয়ে চলে যান। সঙ্গে সঙ্গেই ভদ্রলোক আমার সঙ্গে তর্ক জুড়ে দিলেন, আমি চলে যাব, বলেন কী! এ আমি কী শুনছি, হাঃ হাঃ হাঃ। হাসিটা কৃষ্ণ-মাতুল কংসের মতো গলা ফাটিয়ে।
ভোটার, ভোটকর্মী সবাই যেন সত্যিই নাটক দেখছেন। হন্তদন্ত হয়ে সপার্ষদ গতকালের সেই নেতার প্রবেশ ঘটল। এসেই বিরোধী এজেন্টকে বললেন, ও ভাই, সকাল থেকে অনেক খেটেছিস, খাওয়া-দাওয়া হয়নি, যা, বাইরে গিয়ে ভাল করে খাওয়া-দাওয়া কর। সঙ্গীদের তিনি আদেশ দিলেন, অ্যাই কে আছিস, একে একটু খাইয়ে আন না রে। ভদ্রলোককে বেরিয়ে যেতেই হল। আমি দুই পুলিশকর্মীকে খুঁজলাম। তারা দুজনেই লাইনের শেষে, ভোটার সামলাচ্ছে। এ বার সেই মেজদা আমার পোলিং অফিসারদের দিকে ফিরে বললেন, আপনাদের তো ‘আসি যাই মাইনে পাই’ চাকরি, হাতের কাজ একদম বসে গেছে। লাইনে শ’তিনেক ভোটার দাঁড়িয়ে, কবে ভোট দেবে ওরা? আমরা সাহায্য করছি, আপনারা বিশ্রাম করুন।
বোঝাই গেল, শ্রীমান মেজদা অ্যান্ড টিম কারও অনুমতির ধার ধারেন না। ফার্স্ট পোলিং অফিসার— যাঁর কাজ পরিচয়পত্র দেখে ভোটারদের শনাক্ত করা, তাঁর পাশেই মেজদা বসে পড়লেন। খপ খপ করে কয়েক জন ঢুকে বসে পড়লেন, বাকি ভোটকর্মী অফিসারদের পাশে। বুথের মধ্যে যেন ভানুমতীর খেল শুরু হয়ে গেল। নেতা তো সব গ্রামবাসীকে হাতের তালুর মতো চেনেন। তিনি ডেকে-হেঁকে নিচ্ছেন সবাইকে। আরে হরিদা, সেই কখন থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে আছো, এসো এসো, তাড়াতাড়ি এসো, যাও ভোট দাও। আরে মণিদা..., হরদা যে, আরে মেজোবউদি, এখনও হয়নি! তুমি আগে যাও। এর মধ্যে এদেরই এক জন ভোটিং কম্পার্টমেন্টের পিচবোর্ডের আড়াল সরিয়ে টেবিলটাকে কাছে টানে নিয়েছে। ঝড়ের গতিতে ভোট চলছে, সবাই নিজের ভোট নিজেই দিচ্ছেন বটে!
আমি বাথরুম থেকে সেক্টর অফিসারকে ফোন করে বিষয়টি জানালাম। উনি প্রতিপ্রশ্ন করলেন: কোনও মারামারি হচ্ছে কি, ঠেলাঠেলি, রক্তপাত? আমাকে বলতেই হল, ও-সব কিছু নয়। ‘দেখছি’ বলে তিনি ফোন রাখলেন। মোটামুটি দেড়টা-দুটোর মধ্যে স্কুল-চত্বর ফাঁকা হয়ে গেল। তত ক্ষণে অবশ্য আমাদের পালা করে কই মাছের পাতলা ঝোল আর আমশোল দিয়ে মধ্যাহ্নভোজন সারিয়ে নেওয়া হয়েছে। কোল্ড ড্রিংকেরও ব্যবস্থা ছিল। বেলা তিনটে বাজতে পাঁচ, নেতা ঘোষণা করলেন আর কেউ আসবে না, এ বার আপনারা ধীরে ধীরে কাজ করুন। কত ভোট পড়েছে, কত বাকি দেখুন। হিসেব করে দেখলাম ৫২ জন তখনও বাকি। দাদারা সঙ্গে সঙ্গে বায়না ধরলেন, আমরা পাঁচ জন দশটা করে দেব। আমি বললাম, অসম্ভব, এটা মানা যায় না। নেতা ভীষণ ঠান্ডা গলায় হাসি মিশিয়ে দিলেন একটা সলিড ডোজ। বললেন, স্কুলমাস্টার, এক দিনের অফিসার। বলি, বউ-বাচ্চা নিয়ে সংসার করতে হয় তো, নাকি? তবু মরিয়া চেষ্টায় বললাম, হান্ড্রেড পার্সেন্ট ভোট পড়লে সব ক্যানসেল হয়ে যাবে, রি-পোলিং হবে। নেতা বললেন, আমাদের হিসেব আছে স্যর, দুটো বাকি থেকে যাবে। তবু আপনি বলছেন, আপনার কথার মান রাখা দরকার। পাঁচটা করে দে সবাই। আমার অফিসাররা পাঁচটা করে ব্যালট ছিঁড়ে দিতে বাধ্য হলেন, ওঁরা ধপাধপ ভোট দিতে থাকলেন। গণতন্ত্রের সেরা উৎসব যখন এ ভাবে সাঙ্গ হল, প্রায় এক গাড়ি পুলিশ নিয়ে এলেন সেক্টর অফিসার। এর পরের গল্প আর বলবার ইচ্ছে নেই।
শুধু বলি, নির্বাচন প্রক্রিয়ার পয়লা নম্বর কাগজ অনুবন্ধ ১৪-র, একুশের ‘ঙ’ ও ‘চ’ দাগ পূরণ করতে আমার হাত অসাড় হয়ে আসছিল। ঙ-র দাগে ছিল— ভোটদাতা বা অন্যান্য কাউকে ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে কি না, আর চ-র দাগে ছিল, বুথ দখল হয়েছে কি না। দুটো ক্ষেত্রে আমি লিখেছিলাম ‘না’, আর আত্মগ্লানিতে মরমে মরমে মরে যাচ্ছিলাম। সেই বিদ্রুপটা আজও ভুলতে পারিনি: ‘স্কুলমাস্টার, এক দিনের অফিসার, প্রিসাইডিং অফিসার’। অর্থাৎ, ভোট তো মিটবে, তার পর...!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy