ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।
টুকুস’ করে মাথায় কিছু একটা এসে পড়ল ওপর থেকে, অমনি থমকে দাঁড়াল ঋক। কটমটিয়ে তাকাল ভদ্রমহিলার দিকে, এই মাত্র যিনি দোতলা থেকে হাতের নোংরাটি ফেলে কেবলার মতন তাকিয়ে আছে ওর রাগে লাল হওয়া চোখের দিকে। ‘স্যরি-টরি’ কিছু একটা বললেনও বোধ হয়। কিন্তু সে দিকে দৃকপাত না করে হনহনিয়ে বেরিয়ে এল ঋক।
অমন চলে আসার কারণও আছে একটা অবশ্য, সে একমাত্র ঋকই জানে। আসলে ওই মুহূর্তে ওর মায়ের মুখটাই ভেসে উঠছিল বারবার। তাই তো মনে মনে ঠিক করল, না, অভিযান যদি করতেই হয়, তবে তা নিজের বাড়ি থেকেই শুরু হওয়া প্রয়োজন।
কলকাতার বাসিন্দা ঋকেরা। শিক্ষিত পরিবার। বাবা স্কুলমাস্টার। মা-ও থাকেন লেখাপড়া নিয়ে। তবু মায়ের ওই এক দোষ, ফুরসত পেলেই হাতের নোংরাটি গিয়ে ‘থপাস’ করে ফেলে আসবেন বারান্দার ওপর থেকে। আশ্চর্য! রাস্তার ধারে বাড়ি, কারও তো মাথায়ও পড়তে পারে! ঠিক আজ যেমনটি ঘটে গেল ওর ক্ষেত্রেই! তা ছাড়া এ সব নোংরা আবর্জনা, প্লাস্টিকগুলো সব তো ড্রেনে গিয়ে ঢুকবে, আর বিনা বর্ষাতেই জল থইথই হয়ে উঠবে কলকাতা।
রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিলেন মা। ছেলে কী সব কটর-কটর করে যাচ্ছিল কানের ধারে, কান দিতে চাইলেন না তেমন। শেষে আর চুপ থাকতে না পেরে মুখ খুললেন। আরে বাবা, শুনলাম তো সব কথা। চিন্তা করছিস কেন? আর ফেলব না, বললাম তো। তা ছাড়া, আমি ফেললেও দেখে শুনে ফেলি, কারও গায়ে পড়ার সম্ভাবনাই থাকে না।
এটা তুমি ঠিক বলছ না, মা। সাবধানের মার নেই। পড়েনি বলে পড়বে না কোনও দিন, তাই বা কেমন কথা! পড়তেও তো পারে? আজ যেমন আমারই...
বেশ হয়েছে। কেন, একটু চারিদিকে নজর রেখে হাঁটা-চলা করা যায় না?
ওমা, তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? কী সব উল্টোপাল্টা বকছ! তাকিয়েই তো হাঁটছিলাম। তা বলে উপরের দিকে তাকিয়ে কেউ পথ চলে নাকি? সে তো শুনেছি একমাত্র চাতক পাখিরাই...
কথা কেড়ে নিলেন মা রেনুকা। চুপ কর! বেশি বেশি কথা শিখে গেছিস! যা, গিয়ে পড়তে বস।
পর দিন পড়তে বসলেও বেশ তক্কে-তক্কে ছিল ঋক। মনে মনে ভেবেই রেখেছিল, আজ মাকে হাতে-নাতে পাকড়াও করবে, তার পর বাকি কথা। কিন্তু ঘণ্টা দুই গোয়েন্দাগিরি করেও কাজ হল না। এক রকম ক্লান্তই হয়ে গেল নিজে। ও দিকে মন দিয়ে পড়াশোনারও দফারফা।
পড়তে বসে ঋকের এমন ছোঁক ছোঁক করা দেখেই রেনুকাদেবীর কেমন সন্দেহ হল। গরম দুধের গ্লাসটা হাতে নিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, কী রে, কিছু পাহারা দিচ্ছিস মনে হচ্ছে?
অমনি ঋকের পটাং করে উত্তর। দিচ্ছিই তো।
আমাকে?
মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল ঋক।
রেনুকাদেবী ওর পাশে বসে পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, তোকে কালকেই বললাম তো, আর কোনও দিন ফেলব না। আসলে কী জানিস তো, সব সময় মনে থাকে না, এই যা। তবু কাজটা তো ভীষণই খারাপ।
দুধের গ্লাসটি টেবিলে রেখে ঋক বলল, ব্যস, এটাই তো চেয়েছিলাম। সাকসেস। নিজের মাকে বোঝাতে না পারলে অন্যের মায়েদেরই বা বোঝাব কেমন করে?
আশ্চর্য! গলিটায় পা বাড়িয়েই আজও চমকে উঠল ঋক। ভদ্রমহিলা আজও দাঁড়িয়ে রয়েছেন দোতলার বারান্দায়। নিশ্চয়ই তবে হাতে রয়েছে কালকের মতোই নোংরা আবর্জনা কিছু একটা। দিব্যি তাক করে আছেন কালকের মতোই! কিছু একটা বলতেই হয় তবে। বেশ নিন্দে-মন্দ করেই!
কিন্তু তাকিয়েই চমকে উঠল ঋক। ভদ্রমহিলা হাসছেন যে! বোধ হয় কিছু একটা বলছেনও।
এ বারে ভাল মতো তাকাল ও। কান পেতে শুনতে চাইল, কী বলছেন উনি।
খোকা, কাল কিছু মনে করোনি তো? আমার খুব অন্যায় হয়ে গিয়েছে। আর কক্ষনও হবে না, দেখো।
এমন কথা শোনার পর, আর কারও রাগ থাকে? ভেতরে ভেতরে বেশ উত্ফুল্ল ঋক। মনে মনে বলল, তথাস্তু কাকিমা। আপনার সুমতির জন্য ধন্যবাদ।
রাতে ঘুমোতে গিয়ে ঋক ভাবল, শুধু মা আর ওই ভদ্রমহিলাই তো নন, ঘরে ঘরে এমন সংখ্যা যে প্রচুর! তবে তাদের শোধরানো যাবে কেমন করে? কোন অভিযানে তা সম্ভব?
তাই তো রথীনস্যরের পরামর্শে গলির মোড়ে মোড়ে দারুণ এক পোস্টারিং করল ওরা। পোস্টারে লেখা থাকল, ‘বাঃ! টুপ করে ময়লা ফেলছেন না তো আর নীচে? দারুণ ব্যাপার! নিশ্চয়ই থুথুও ফেলছেন না রাস্তায়? সাবাস, এটাই তো চাই! একটা সুন্দর সমাজ গড়তে গেলে আপনার এমন সহযোগিতাটুকুই যে প্রয়োজন!’
স্যরের বুদ্ধিটা সত্যিই কাজে এল বেশ। গোটা পাড়াটাই যে আমূল বদলে গেল রাতারাতি, তা নয়। তবে বেশ সাড়া ফেলেছে বিষয়টা। অনেকেই কৌতূহল প্রকাশ করছে পোস্টারগুলো নিয়ে। এক বার অন্তত দাঁড়াচ্ছে তার সামনে এসে। পড়ছে, মুচকি হাসছে... দেখে ভারী আনন্দ হয় ঋকের।
ওর ইচ্ছে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার নয়, বড় হয়ে ও এক জন সমাজ-সংস্কারক হবে। রামমোহন, ডিরোজিও, বিদ্যাসাগরের মতন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy