Advertisement
E-Paper

অস্কারের হুজুগ

অস্কার হল আমেরিকার ফিল্মের ‘ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড’। তা হলে তাকে নিয়ে আমাদের এত হইচই আর নাচন কীসের?নিশ্চয়ই কাল রাতে ফোনে অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিলেন! ছুটির দিন যেখানে বেলা অবধি নাক ডাকানোর কথা, আপনি সেখানে তড়াক উঠে টিভির সামনে। অস্কার আছে না! রেড কার্পেট থেকে শুরু করে এন্ড টাইট্ল অবধি সব গিলতে হবে, মাঝের ব্রেকগুলোতে বাথরুমটুম সারবেন। বিশ্বের সেরা ফিলিম-পুরস্কার অনুষ্ঠান বলে কথা! না দেখলে জাত যাবে।

অঞ্জন মণ্ডল

শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০৩

নিশ্চয়ই কাল রাতে ফোনে অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিলেন! ছুটির দিন যেখানে বেলা অবধি নাক ডাকানোর কথা, আপনি সেখানে তড়াক উঠে টিভির সামনে। অস্কার আছে না! রেড কার্পেট থেকে শুরু করে এন্ড টাইট্ল অবধি সব গিলতে হবে, মাঝের ব্রেকগুলোতে বাথরুমটুম সারবেন। বিশ্বের সেরা ফিলিম-পুরস্কার অনুষ্ঠান বলে কথা! না দেখলে জাত যাবে।

কান-ভেনিস-বার্লিন আদি বিশ্বের তাবড় চলচ্চিত্র-উৎসবগুলো কবে হয়, তার পুরস্কার-অনুষ্ঠানটাই বা কেমন, সে খবর আমরা রাখি না, কিন্তু অস্কারের যাবতীয় কী-কবে-কেন ঠোঁটস্থ। অথচ, অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডস বা অস্কার কিন্তু ‘আমেরিকার ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড’-এর বেশি কিচ্ছু না। ওই দেশে সে-বছর যতগুলো ছবি রিলিজ হয়েছে, তাদের মধ্যে নানান বিভাগে কে ফার্স্ট বয় হল, তার প্রাইজগিভিং সেরিমনি ছাড়া কিচ্ছু না। শুধু এর সঙ্গে একটা ‘বেস্ট ফরেন ফিল্ম’-এর একটা পুরস্কার থাকে, এই যা। আপাতদৃষ্টিতে সিনেমার সার্বিক উৎকর্ষ উদ্যাপন করলেও, অস্কার হরেদরে অব দি আমেরিকান্স, বাই দি আমেরিকান্স, ফর দি আমেরিকান্স। তা হলে তাকে নিয়ে আমাদের এত হইচই কীসের? আমেরিকার জাতীয় পুরস্কার এই গ্রহের জাতীয় পুরস্কার হল কেমনে?

যাকে নিয়ে আবিশ্ব নাচনকোঁদন, তার অন্দরে বেনো জল আর ছেঁদো জিনিসপত্র কম নয়। অ্যাট লিস্ট বিতর্কের অবকাশ বিস্তর। একটা ফিল্ম অস্কার নমিনেশন পেতে গেলে তাকে যে শর্তগুলো পূরণ করতে হয়, তার অন্যতম হল: ছবিটাকে অন্ততপক্ষে সাত দিন সফল ভাবে সিনেমা হল-এ চলতে হবে। হবেই। ছবি গুণে-মানে দুর্দান্ত, কিন্তু হল-এ চলেছে মোটে দু’দিন— মানে ডিসকোয়ালিফাইড ফর অস্কার? ‘ভাল ছবি’র মানদণ্ড তার হল-এ চলার দিন-কাউন্ট? মানে, ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’ হপ্তার পর হপ্তা দৌড়চ্ছে বলে চাইলে অস্কার-কিউয়ে দেঁতো হেসে এক নম্বর হতে পারে, আর ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’ কেউ প্রায় দেখেইনি বলে জাস্ট বাদ? গোদা ‘হিট’ আর ‘ফ্লপ’-এর মাপকাঠিতে সিনেমা শিল্পটাকে বিচার করা হয় যে উৎসবে, তার কোয়ালিটি সম্বন্ধে ধন্দ জাগাটা স্বাভাবিক। অস্কার যে শুধু একটা ধনতান্ত্রিক দেশের সিনেমা উৎসব, সেই বিশ্বাসটাও এতে আরও দৃঢ় হয়।

তা-ও মানা যেত, যদি সেখানে অবিচারের রাজনীতি কিছু কম হত। স্ট্যানলি কুব্রিক, অ্যালফ্রেড হিচকক— ইংরেজি ভাষায় বাণিজ্যিক ভাবে সফল এবং অদ্ভুত অসাধারণ পরিচালক। কিন্তু এঁরা কখনও সেরা পরিচালকের অস্কার পাননি। ইংরেজি ভাষার বাইরে তো অস্কার না পাওয়া অসামান্য পরিচালক ও সিনেমা অগুনতি। গোদার পাননি, ফেলিনি পাননি, বার্গম্যান-এর তিনটি ছবি বিদেশি ভাষার ক্যাটিগরিতে পুরস্কার পেলেও তিনি কখনও সেরা পরিচালকের পুরস্কার পাননি। সবচেয়ে আশ্চর্য, চার্লি চ্যাপলিন-এর ভাগ্যে কখনও জোটেনি সেরা পরিচালক বা সেরা অভিনেতার অস্কার! এতে কে অসম্মানিত হলেন, চ্যাপলিন, না অস্কার? যদিও চার্লিকে সাম্মানিক অস্কার দেওয়া হয়েছে দু’বার, এক বার এক্কেবারে প্রথম অস্কার অনুষ্ঠানে, আর এক বার ১৯৭২-এ, তখন অনেক কিন্তু-কিন্তু করেও শেষ অবধি তিনি পুরস্কার নিতে এসেছিলেন। আসলে, আমেরিকায় ভাবা হত, রাজনৈতিক মতাদর্শে চ্যাপলিন কমিউনিস্ট। তাই ১৯৩১-এ ‘সিটি লাইটস’ নমিনেশনই পায়নি, সে বার অস্কার পেয়েছিল ‘সিমারন’। কী বললেন? ‘সিমারন’ আবার কী? এগজ্যাক্টলি। লোকে ওই তাৎপর্যহীন ছবিটি সংগত ভাবেই ভুলে গেছে, কিন্তু কোনও দিনই ভুলবে না ‘সিটি লাইটস’। অস্কারের ফাঁপাত্ব বোঝার এটা একটা ভাল উপায়।

যেখানেই মৌলিক ভাবনার চাষ কম সেখানেই একটা চেনা গৎ বেরিয়ে আসবেই। অস্কার পুরস্কার পাওয়ার তাই সরল একটা সমীকরণও বানিয়ে ফেলা যায়, এটি হস্তগত করতে আপনাকে হতে হবে ‘ঠিক-ঠিক’ মধ্যমানের। আর, একটু প্রান্তিক লোককে নিয়ে গদগদ হতে হবে। সমকামী, কৃষ্ণাঙ্গ, ধর্ষিতা, মুমূর্ষু লেখিকা বা বক্সার— এমন প্রান্তিক, অন্তেবাসী, সংখ্যালঘু চড়া দাগের চরিত্র নিন। ব্যস, ‘সেরা ছবি’ বা ‘শ্রেষ্ঠ অভিনেতা/ অভিনেত্রী’র পুরস্কার বাঁধা বললেই চলে। আর চরিত্রটির সাংঘাতিক অসুখ বা প্রতিবন্ধকতা থাকলে তো কথাই নেই। যেই না আপনি জানলেন, ‘চিলড্রেন অব আ লেসার গড’-এ মার্লি ম্যাটলিন বোবা-কালা, ‘রেন ম্যান’-এ ডাস্টিন হফম্যান অটিস্টিক, ‘মাই লেফ্ট ফুট’-এ ড্যানিয়েল ডে লিউইস প্যারাপ্লেজিক, ‘সেন্ট অব আ উওম্যান’-এ আল পাচিনো অন্ধ, ‘ফিলাডেলফিয়া’-য় টম হ্যাংকস সমকামী ও এড্স-রোগী, ‘ফরেস্ট গাম্প’-এ টম হ্যাংকস মানসিক প্রতিবন্ধী, তখনই বাজি রেখে দিতে পারেন, অস্কারটা এঁদের হাতে জ্বলজ্বল করবে। বলা হয়, ‘ডিসএবিলিটি ফিল্ম’ করো, অস্কার নাও। এ বার অস্কার পেতেই পারেন জুলিয়ান মুর (চরিত্রের আলঝাইমার’স হয়েছে) আর এডি রেডমেন (স্টিভন হকিং-এর চরিত্র, ‘লু গেরিগ’স ডিজিজ’ আক্রান্ত)। অবশ্য বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচ-ও পেতে পারেন, তিনি তো অভিনয় করেছেন অ্যালান টুরিং-এর চরিত্রে, যে জিনিয়াস বৈজ্ঞানিককে সমকামী বলে মার্কিন সমাজ অচ্ছুত করেছিল, কাহিনিকে জবজবে করতে সিনেমায় আবার তাঁর একটা অসুখও জুড়ে দেওয়া হয়েছে, ‘অ্যাসপারজার্স সিনড্রোম’, যা টুরিং-এর সত্যি সত্যি ছিল বলে তো তাঁর চেনাজানা কেউ মনে করতেই পারছেন না!

একই কথা বলা যায় কৃষ্ণাঙ্গ থিম নিয়েও। যুগ যুগ ধরে কালো-চামড়ারা চূড়ান্ত অপমানের শিকার, আর অস্কারই সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত— এটা এখন একটা ওপ্ন সিক্রেট। গত বছরই জোক চালু হয়ে গিয়েছিল অস্কার সেরিমনির আগে, ‘টুয়েল্ভ ইয়ার্স আ স্লেভ’ ক’টা অস্কার পাবে তা নিয়ে। বোদ্ধারা জনান্তিকে গুনগুনান, অন্য থিমের ছবি ‘বেস্ট ফিল্ম’ বা ‘বেস্ট আক্টর’ ছিনিয়ে নিয়ে গেলে ‘বেস্ট সাপোর্টিং অ্যাকট্রেস’টা কোনও এক কৃষ্ণার জন্য কুটোবাঁধা থাকবেই। হালফিলের ‘দ্য হেল্প’, ‘প্রেশাস’ জ্বলজ্বলে দৃষ্টান্ত। ২০০২-এ একেবারে ত্র্যহস্পর্শ— বেস্ট অ্যাক্টর ডেনজেল ওয়াশিংটন, বেস্ট অ্যাকট্রেস হ্যালে বেরি, আর সাম্মানিক অস্কার পেয়েছিলেন সিডনি পয়েটিয়ের। এগুলো সব যোগ্য ব্যক্তির পুরস্কার হতেই পারে, ঠিকই, কিন্তু সমাপতন থেকে সমীকরণ বানানোর জমিও থেকে যায়।

কিংবা আপনাকে করতে হবে আমেরিকান অস্ত্র বা মগজের সুপিরিয়রিটির গুণগান। গত বছরই অস্কার-অনুষ্ঠানে সবার চোখ ছানাবড়া করে বেস্ট ফিল্ম হিসেবে ‘আরগো’কে অস্কার তুলে দিলেন কে? হোয়াইট হাউস থেকে লাইভ ভিডিয়ো কনফারেন্সে খোদ মিশেল ওবামা! ‘আরগো’র গল্প হল, ইরানের রাজধানীতে আমেরিকান এমব্যাসি আক্রমণ করেছে মুসলিম কট্টরপন্থীরা, পঞ্চাশ জন বন্দি। শুধু পাঁচ মার্কিন কর্মী লুকিয়ে আছেন অজানা এক জায়গায়, প্রাণভয়ে। তাঁদেরই দায়িত্ব, বন্দিদের মৃত্যুমুখ থেকে বাঁচিয়ে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। ইরান-আমেরিকার সাম্প্রতিক টলোমলো কূটনৈতিক সম্পর্কের আবহে, আর আমেরিকার তীব্র ইসলাম-বিরোধিতার পরিবেশে, এই কাহিনির সেরা ছবির অস্কারটা ফার্স্ট লেডির হাত দিয়ে দিইয়ে, আদতে কোন অলিখিত বার্তা দেওয়া হল?

9.anjan@gmail.com

oscar academy awards anjan mondal anandabazar rabibasariya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy