ছবি: সুমন চৌধুরী
৬ এপ্রিল
দ্বিতীয় বার আসানসোল এসে শ্রদ্ধাঞ্জলি হোটেলে উঠেছিলাম। হোটেল মালিক মিঠু সজ্জন মানুষ। তবে আজ হোটেল ছেড়ে এলাম নতুন বাড়িতে। মহীশিলায়। তিন কামরার একটা ফ্ল্যাট খালি পড়ে ছিল। ভাড়া নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন নির্মলদা। খুব ছড়ানো-ছিটনো না হলেও বেশ ভাল। একটা ঘর অফিস করে দিলাম। একটায় আমি থাকব। বাবা মা এলে থাকবে অন্য ঘরটায়।
দিনটাও ভাল কাটল। আজ অতিরিক্ত জেলাশাসকের সঙ্গে কথা হয়েছে। বললেন, মদ খাওয়ার ব্যাপারে মিথ্যা অভিযোগ জানানোর জন্য ওঁদের সতর্ক করে দিয়েছেন। সে ভাল, তবে ঠিক করলাম, ভোটটা কেটে গেল ওঁদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করব।
৯ এপ্রিল
অন্ডাল স্টেশন ছাড়িয়ে দীর্ঘনালা গ্রামের দিকে যাব। সবে রথে চড়তে যাচ্ছি, পুলিশ এসে বলল, ‘ও দিকে যাবেন না স্যর, ঝামেলা হতে পারে।’ বললাম, ‘আপনারা আছেন কী করতে? ঝামেলা হলে ঠেকাবেন!’ ড্রাইভারকে গাড়ি চালাতে ইশারা করলাম। পুলিশকে বললাম, ‘আপনারা সামনে থাকুন, দেখি কে কী করে?’ গ্রামে ঢুকে এলোপাথাড়ি ঘুরলাম। যেখানে টেম্পো যাবে না, সেখানে পায়ে হেঁটে ঘুরলাম। যে যেমন অবস্থায় ছিলেন ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। কেউ জড়িয়ে ধরলেন। কেউ মোবাইলের ক্যামেরা উঁচিয়ে ফোটো তুললেন। অটোগ্রাফও দিতে হল অনেক। দীর্ঘনালা, মদনপুর, রামপ্রসাদপুর, শ্রীরামপুরে ভ্যানে চেপে ঘুরলাম।
আসার পর থেকেই শুনছি, তৃণমূল আমাকে বহিরাগত বলে প্রচার চালাচ্ছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখানে প্রচারে এসে বলেছেন, ‘বিজেপি প্রার্থী গত কুড়ি বছর ভোটই দেননি। উনি গণতন্ত্রের কী বোঝেন?’ আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম, ওঁদের মতো বিলো দ্য বেল্ট যাব না। বিকেলে কাজোড়ায় যখন রথ এসে দাঁড়াল তখন সন্ধে। অজস্র মানুষ। ‘বাবুল! বাবুল!’ বলে স্লোগান দিচ্ছেন। বললাম, ‘দেখুন আপনারা এত ভালবাসেন, আর ওঁরা বলছেন আমি বহিরাগত।’ একটু থেমে প্রশ্ন ছুড়লাম, ‘আমি বহিরাগত?’ সমস্বরে জবাব এল, ‘না।’ ফের প্রশ্ন করলাম, ‘আমি এ দেশেরই মানুষ, বাংলার ছেলে, সেটাই যথেষ্ট নয়?’ ওঁরা হাত উঁচিয়ে হাততালি দিলেন। বললাম, ‘দেখুন বিপক্ষ পার্টি কতটা হেভিওয়েট ভাবছি না। একমাত্র প্রতিপক্ষ এখানকার অনুন্নয়ন এবং না মেটা সব চাহিদা। চলুন একসঙ্গে লড়াই করি।’
১০ এপ্রিল
আমার ক্যাপ্টেন যদি এ-সব কাণ্ডকারখানা দেখতেন, কী বলতেন কে জানে! প্রশান্তদা, নির্মলদা তো দেখলেই বলেন, ‘না বাবুল, আজ নয় প্লিজ, দেরি হয়ে যাবে।’ কিন্তু বালিয়াপুরে ছেলেগুলোকে খেলতে দেখে আজও লোভ সামলাতে পারলাম না। নিজেদের মধ্যে টিম করে ক্রিকেট খেলছিল। কী যেন নাম বলল ছেলেটা! পল্টু মনে হয়। প্রথম দুটো বলের লাইন লেংথ খুব ভাল ছিল। পরের শর্ট বলটা স্কোয়ার লেগের ওপর দিয়ে টাঙিয়ে খুব মজা লাগল। এখনও ভুলতে পারছি না।
বারাবনি, লালগঞ্জ, আমনালা, পূঁচড়ায় ক’দিনের প্রচারে খেলাটাকেও ঢুকিয়ে নিলাম। ক্রিকেট, ফুটবল। এখন কোনও পাড়ায় ঢুকলেই ছেলেরা বলে, বাবুলদা এক দান ক্যারম খেলে যান। মুম্বইতে এ-রকম ম্যাচবোর্ড কোথায় আর মেলে! আসানসোলেই যেন উঠে এসেছে ছোটবেলার উত্তরপাড়া!
১২ এপ্রিল
ঘটনাটা ঘটল আজ দুপুরে। আর পাঁচটা দিনের মতোই আজ প্রচারে বেরিয়েছি। হাঁটতে হাঁটতে বাকিদের থেকে কিছুটা এগিয়েই গিয়েছিলাম। দীপক ছুটে এসে খবর দিল, ‘দাদা, তৃণমূলের ছেলেরা আমাদের ছেলেদের ওপর চড়াও হয়েছে। খুব মারধর করছে।’ ছুটে গেলাম। গামছা পরা কিছু ছেলে মিলে আমাদের ছেলেদের মারছে, অশ্লীল গালাগাল দিচ্ছে। পাড়ার বউ, মেয়েদের ঘরে ঢুকে যেতে বলছে। ওদের মাঝে দাঁড়িয়ে ঝামেলা থামানোর চেষ্টা করছিলাম। হঠাৎই দেখি, টাকমাথা একটা লোক খুব তড়পাচ্ছে! আমরা নাকি এলাকায় শান্তিভঙ্গ করেছি। আমিও ছেড়ে দিলাম না। বললাম, ‘আপনি কে মশাই!’ বললেন, ‘যে-ই হই, এখান থেকে চুপচাপ চলে যান।’ কেউ কেউ আমাকে ধাক্কাও দিল বেশ কয়েক বার। পুলিশ কিছু করল না।
প্ররোচনায় পা না দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলাম। শুনলাম তত ক্ষণে গোটা রানিগঞ্জে খবর হয়ে গেছে। বিজেপি সমর্থকরা রাস্তা অবরোধ করেছে। আমাকেও ধরনায় বসতে হল কিছু ক্ষণ। মিনিট পাঁচেকের অবরোধেই রাস্তার দু’দিকে গাড়ির লম্বা লাইন। মানুষের দুর্ভোগের কথা ভেবে খারাপই লাগল। বুঝিয়েসুঝিয়ে অবরোধ তুলে নিতে রাজি করালাম ওদের। বললাম, থানায় চলো। তৃণমূলের ছেলেগুলোকে দুপুরে হাতে পেয়েও পুলিশ ছেড়ে দিয়েছিল। এখন তারাই বলল, ‘পুলিশের নামে কোনও অভিযোগ করবেন না প্লিজ। আমাদের চাকরি চলে যাবে।’
ওঁদের অনুরোধ শুনে এফআইআর-এ তিন জন পুলিশের নাম লিখেও কেটে দিয়েছিলাম। এখন মনে হচ্ছে ভুলই করেছি। তৃণমূলের টাকমাথার ওই লোকটা নাকি দুপুরেই থানায় এসেছিল। নাম সেনাপতি মণ্ডল। তার পর রাতে এসে আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে গিয়েছে। যেন জেমস বন্ডের থ্রিলার লিখেছে। বলেছে, আমাদের একটা ছেলে নাকি ওদের কাউকে পিস্তল নিয়ে তাড়া করেছিল। এবং পুলিশ নাকি সেটা শুনেই আমার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা করেছে। ওটাই ব্রেকিং নিউজ চলছে এখন।
রাতেই ফোন করে রাহুলদাকে সবটা জানালাম। বললেন, ‘ঠিক আছে, উকিলের ব্যবস্থা করছি। তুমি মিডিয়াকেও ব্যাপারটা বলো।’
১৮ এপ্রিল
গতকাল সমন পাওয়ার পর থেকেই বাবা একটু টেনশন করছিল। জামুরিয়ায় সার্কল ইন্সপেক্টরের অফিসে আমাকে জেরা করা হবে। আমার অবশ্য বিশেষ হেলদোল ছিল না। বুঝতে পারছিলাম আমাকে প্রচার থেকে সরিয়ে রাখতেই এ-সব ফন্দিফিকির চলছে। তাই মাঠ ছাড়লাম না। আজ প্রচারে গিয়ে বললাম, ‘ছোটবেলা থেকেই আমি আর্মস ব্যবহার করি। রাইট আর্ম আর লেফ্ট আর্ম। তার বেশি অস্ত্র আমার চাই না।’ দেখলাম মানুষ মজাটা নিলেন।
জামুরিয়ার অফিসে পৌঁছলাম রাত সাড়ে আটটায়। বাবাকে ওঁরা ভিতরে ঢুকতে দিলেন না। আমি আর আমার আইনজীবী ঢুকলাম। দেখি বামাপদ দাস এক বড় প্রশ্নপত্র নিয়ে বসেছেন। সেটা দেখেই একের পর এক অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। ভীষণ রাগ হচ্ছিল। সেনাপতিদের সঙ্গে ঝামেলাটা কী হয়েছিল তা নিয়ে কোথায় আমার বয়ান নেবেন, তা নয়, যত সব আলতুফালতু প্রশ্ন! বাধা দিয়ে বললাম, আমার বয়ানটা তো আগে নিন। আগেই প্রশ্ন করছেন কেন? বললেন, ‘কেন, প্রশ্ন করা কি বারণ আছে?’ বললাম, ‘সে করুন। কিন্তু এমন সব হাঁসজারু গল্প ফাঁদছেন, শুনেই মনে হচ্ছে আপনি পক্ষপাত করছেন।’ আমি পক্ষপাত করছি? বললাম, ‘হ্যাঁ করছেন তো। আমি ক্রিমিনাল নাকি! যা ইচ্ছে বলে যাবেন? যান, আপনার প্রশ্নের জবাব দেব না।’
বামাপদ এ বার নরম হলেন। বললেন, ‘রেগে যাচ্ছেন কেন? আমি আপনার প্রতিবেশী। আপনার উত্তরপাড়ায় বাড়ি, আমার চুঁচুড়ায়। বয়সেও আপনার বাবার মতো।’ বললাম, একেবারেই নয়। আমার বাবা আপনার মতো নয়। এখন চা আনতে বলুন।
আড়াই ঘন্টা জেরার পরেও পুলিশ মামলা তোলেনি। অস্ত্র আইনের পাশাপাশি রাস্তা অবরোধের জন্য ন্যাশনাল হাইওয়ে অ্যাক্ট-এও মামলা রুজু করেছে। যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিজেই একটানা কুড়ি দিন রাস্তা অবরোধ করে রেখেছেন, তাঁর সরকারই এখন মামলা করছে আমার বিরুদ্ধে। নির্লজ্জতার চূড়ান্ত। অথচ আমিই অবরোধটা তুলে দিতে সাহায্য করেছিলাম। পুলিশ ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলেছিল।
আজ সত্যিই আঁতে ঘা লাগল, আর ছেড়ে দেওয়া যাবে না। এ বার ওদের হারিয়েই ছাড়ব।
২২ এপ্রিল
আদালতে আত্মসমর্পণ না করলে পুলিশ গ্রেফতার করত। তাই আজ যেতেই হল এজলাসে। বিচারক যদিও আধ মিনিটও বোধহয় শুনলেন না। উনিও নিশ্চয়ই সব বুঝতে পারছেন। আদালত চত্বরে আজ বেশ মজা হল। পুলিশ, আইনজীবী, মানুষ, মিডিয়া, ফ্যান, দলের কর্মী-সমর্থক মিলেমিশে থিকথিকে ভিড়। কচুরি খেয়ে, আড্ডা মেরে দারুণ জমে গেল। বার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা বারবার ওঁদের চেম্বারে ডাকছিলেন। বললাম, ‘দেখুন দাদা, মদ না খেতেই মাতলামির তকমা দিয়েছে। এখন বারে গিয়ে বসলে কী জানি কী করবে!’ বারের সদস্যদের আবদারে একটা গান গাইতেই হল। ওই গানটা গাইলাম, বারে বারে কে যেন ডাকে আমারে।
শুধু ভাবছি, আমাকেই যদি পুলিশ এত হেনস্তা করে, সাধারণ মানুষের কী হাল!
২৩ এপ্রিল
পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহের কাছে খবরটা পেয়েই মনটা ভাল হয়ে গেল। আমার হয়ে প্রচারে ক্যাপ্টেন আসছেন! দশ দিন ধরে পুলিশ আদালত জেরা সালিশির পর যেন এক পশলা বৃষ্টি! সঙ্গে সঙ্গে টুইট করলাম, ‘থ্যাঙ্ক ইউ, নরেন্দ্র মোদীজি ইজ কামিং টু আসানসোল টু ক্যাম্পেন ফর মি অন ফোর্থ অব মে। অনার্ড বিয়ন্ড বাউন্ডস।’
৩ মে
নরেন্দ্র মোদীর সভা বলে কথা! ভেবেছিলাম, প্রস্তুতিটা রাতে আর এক বার দেখে আসি। ভাগ্যিস গিয়েছিলাম! ওটা মঞ্চ হয়েছিল! পইপই করে বলেছিলাম, ধানবাদে মোদীজির বিজয় সঙ্কল্প র্যালির মঞ্চটা যেমন হয়েছিল, ঠিক সে-রকমই বানাতে। সেই গোলমাল করল। আর ক’ঘণ্টাই বা আছে? শেষমেশ সবটা খোলালাম। তার পর নিজে নকশা এঁকে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এখন তবু মানিয়েছে!
রাত প্রায় তিনটে বাজে। আর কত ক্ষণই বা ঘুমোতে পারব! কাল সক্কাল সক্কাল বেরিয়ে পড়তে হবে।
৪ মে
কানের মধ্যে কথাগুলো এখনও বাজছে। ‘মুঝে পার্লামেন্ট মে বাবুল চাহিয়ে।’ ৪৫ ডিগ্রি ছুঁই ছুঁই তাপমাত্রা। ১২ ফুট ওপর থেকে যে দিকে তাকাচ্ছি শুধু কালো মাথা। মনটা ভরে গেল। মঞ্চে দাঁড়িয়েই মনে মনে বলছিলাম, ‘দিদি দেখে যান!’ মোদীজিও যেন আমার মনের কথাটা বুঝতে পারলেন। বক্তৃতাতেই বললেন, ‘দিদি এক বার হেলিকপ্টারে ঘুরে যান, সব বাঘ এখানেই জড়ো হয়েছে। রিয়েল টাইগার, রয়্যাল টাইগার।’ তার পর বললেন, ‘ভাবছিলাম দিদি কেন আমার ওপর রেগে থাকেন। আজ এই ভালবাসা দেখে কারণটা বুঝলাম।’
আসানসোলে প্রথম দিন পা রেখেই বুঝেছিলাম, তৃণমূল ভয় পাচ্ছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পাঁচ দিন এসেছেন প্রচারে। এক দিন তো মিঠুনদাকেও নিয়ে এলেন। স্যাকরার ঠুকঠাকের পর আজ এক ঘা দিলেন আমার ক্যাপ্টেন। তৃণমূলের সন্ত্রাসের কথা ওঁকে আগেই বলেছিলাম। আজ নির্বাচন কমিশনকেও হুঁশিয়ার করে দিলেন মোদীজি। বললেন, ‘কেন রিগিং হচ্ছে? কেন মারপিট হচ্ছে? কেনই বা মিথ্যা মামলা হচ্ছে আমাদের বাবুলের ওপর? নিরপেক্ষ ভোট করানোর জন্য আপনারা হিম্মত দেখান।’ দরকার ছিল।
বক্তৃতা শেষ করে কাছে ডেকে নিলেন মোদীজি। কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘বাবুল, মানুষ চিনতে বড় একটা ভুল হয় না আমার। আজ যা দেখলাম, তুমিই জিতবে।’ ভোটের আর তিন দিন বাকি। এই ভোকাল টনিকটাই যেন অ্যাড্রিনালিনের ক্ষরণ আরও বাড়িয়ে দিল।
সকালে ছোট একটা ঝামেলা হয়েছিল অবশ্য। কালার প্লাসের সবুজ জামাটা গুঁজে পরেছিলাম। কোমরে সাদা রঙের ডলচে-র বেল্টটা পরা। দলের কিছু নেতা কর্মী বললেন, সবুজ পরেছেন কেন, ওটা তো তৃণমূলের রং। আমি বললাম,‘কে বলেছে? রঙের ওপর কারও নাম লেখা আছে নাকি! আমার যেটা খুশি সেটাই পরব।’ আসলে ভড়ংটা আমার ধাতে নেই। আমি আমার মতোই।
৬ মে
ভেবেছিলাম, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনও মন্তব্য করব না। কথা রাখতে পারলাম না। ক্যাপ্টেনের বিরুদ্ধে দিদি যে-রকম গালমন্দ করছেন, আজ মুখ খুলতেই হল। এবিপি আনন্দকে ডেকে বললাম, ‘উনি তো কথায় কথায় রবীন্দ্র-নজরুল উদ্ধৃত করেন। অথচ শিষ্টাচারের ন্যূনতম পাঠ নিয়েছেন বলে মনে হয় না।’ মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, মোদীজির কোমরে দড়ি পরাবেন। আমি বললাম, ‘লম্বা দেখে একটা দড়ি কিনে নবান্নেই রাখুন। শিগগিরই কাজে লাগবে। সারদায় সি বি আই তদন্ত শুরু হয়েছে। কদিন বাদে যাঁরা ধরা পড়বেন, তাঁরা ওঁর চারপাশেই ঘুরঘুর করেন!’ বললাম, ‘আপনার ডানহাত অনুব্রতকে আগে জেলে পুরে দেখান। সে-ও তো করবেন না! তা হলে আপনার হয়ে রিগিং করবে কে? কে-ই বা মানুষকে ভয় দেখাবে!’ কাল ভোট। তার আগে আজ সারা রাত টিভিতে আমার এই ‘বাইট’টা দেখানো হল।
৭ মে
নির্মলদা আগেই বলেছিলেন, আসানসোল, রানিগঞ্জ, কুলটি নিয়ে চিন্তা নেই। ওখানে সব বুথে আমাদের এজেন্ট রয়েছেন। আঠারোশো বুথের মধ্যে চোদ্দোশো বুথে এজেন্ট দিতে পেরেছি আমরা। রিগিং হতে পারে জামুরিয়া, পাণ্ডবেশ্বরে। ঠিক তাই! জামুরিয়ার শুখা খনি এলাকার কেন্দার একটা বুথের কাছাকাছি পৌঁছতেই ওরা চোটপাট শুরু করে দিল। কী অপরাধ? সকাল সকাল দুটো চ্যানেলে বাইট দিয়ে নাকি আচরণবিধি ভেঙেছি। তাই বুথ চত্বরে যেতে দেবে না। বুঝলাম ওরা ছুতো খুঁজছে। সোজা জেলাশাসকের দফতরে গিয়ে বাড়তি সিকিয়োরিটি চাইলাম। একটা ধ্যাড়ধেড়ে খটারা টাটা সুমোয় চেপে কিছু পুলিশ আমার পিছু নিল। জামুরিয়ার সাতগ্রাম, চাকদলা, হরিপুর, রামনগর ঘুরে দুপুরে গেলাম পাণ্ডবেশ্বরে। নামুপাড়ায় দলের সমর্থক আর উৎসাহী মানুষের সঙ্গে বৈদ্যনাথপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দিকে এগোচ্ছি, তৃণমূলীরা ঘিরে ধরল। কালো পতাকা দেখিয়ে স্লোগান তুলল, ‘বাবুল সুপ্রিয় গো ব্যাক।’ ওঁদেরই এক জনের কাঁধে হাত রেখে বললাম, ‘দাদা রেগে যাচ্ছেন কেন? যে যেখানে ইচ্ছা ভোট দিক না!’ তাতেও ওঁদের রাগ গেল না। নির্মলদা অবজার্ভারকে ফোন করলেন। আমি ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলে বেরিয়ে এলাম।
তৃণমূলের সবাই অবশ্য এক রকম নন। সকালে কেন্দা কোলিয়ারির সমবায় বুথের সামনে তৃণমূলের একটা ছেলে ছুটে এল। বলল, ‘ম্যায় টিএমসি হু।ঁ মগর আপ কা ফ্যান ভি হু।ঁ’ ওকে জড়িয়ে ধরলাম।
৯ মে
হেলিকপ্টারে একটা আসন খালি ছিল শুনেছিলাম। বাবাকে বললাম, ‘আজ তুমি চলো।’ বাবা এর আগে কখনও হেলো চড়েনি। তমলুকের কাকগেছিয়া মাঠে সভা শেষ করে হেলিকপ্টারে উঠতেই বাবা বললেন, ‘তুই তো ফাটিয়ে দিলি বাবুল। চল্লিশ দিনেই নেতা বনে গেছিস!’ আমার ভোট হয়ে গেছে। আসানসোলের বাইরে এই প্রথম একক জনসভা করলাম। অমলদাকে বললাম, ‘বাবার কথা ছেড়ে দিন, সত্যি বলুন তো, উতরে গেলাম কি না!’ অমলদা বললেন, ‘বক্তৃতার ফাঁকে ফাঁকে হাততালি শুনেও বুঝলে না? পাবলিক তোমায় নিচ্ছে! সত্যি নিচ্ছে!’ জানলা দিয়ে বাবা তখন ঠায় তাকিয়ে রয়েছে নীচে। বলল, ‘দেখ দেখ বাবুল। এটা বোধহয় শিলাবতী নদী! আমরা মনে হয় ঘাটালে চলে এসেছি।’ নেমে জনসভা। বললাম, ‘নট্ট কোম্পানি দুটো যাত্রা করেছিল। প্রথমটা মা মাটি মানুষ। পরেরটা কী বলুন তো?’ নানা উত্তর ভেসে এল।
বললাম, ‘পরেরটা হল অচল পয়সা।’ হাততালি যেন আর থামছেই না।
হেলিকপ্টারে বসে বাবা বলল, ‘বাবুল, একটা হেলিকপ্টার কিনলে কেমন হয়? টুক করে পুরী-দার্জিলিং ঘুরে আসা যাবে!’ চমকে গেলাম! বললাম, ‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে! হেলিকপ্টারের দাম জানো!’ জানলা দিয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে ছিল বাবা। আমার দিকে না তাকিয়েই বলল, ভাবতে আবার টাকা লাগে নাকি বোকা!
১৬ মে
এখনও যেন সবটাই স্বপ্নের মতো! পরীক্ষার খাতা বেরনোর সময়েও কখনও টেনশন করিনি। আজও সকাল থেকে মনে হচ্ছিল, ভোট যা হওয়ার হয়ে গেছে। লড়াই করেছি। বাকিটা জনগণের হাতে। একটা ব্রেড টোস্ট হাতে নিয়ে সকাল সাড়ে ছ’টাতেই ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম। আসানসোল ভিনসেন্ট স্কুলে গণনাকেন্দ্র। ছেলেদের বললাম, চা বিস্কুট যা লাগে আমি পাঠিয়ে দেব, কাউন্টিং ছেড়ে উঠো না বাবা। বেরিয়ে আসছি, দোলাদির সঙ্গে দেখা। বললেন, ‘বাবুল, আমার বিজয়োৎসবে তোমাকে দুটো গান গাইতে হবে কিন্তু।’ দু’হাত দিয়ে গাল টিপে দিলেন। আমি বললাম, ‘ঠিক আছে দিদি, আমি জিতলে আপনাকেও কিন্তু দুটো গান গাইতে হবে।’ হেসে বললেন, ‘সে সুযোগ তুমি পাবে না।’
গণনাকেন্দ্রে মোবাইল নিয়ে প্রবেশ বারণ। দেখলাম পুলিশের পাশে দাঁড়িয়েই দোলাদি ফোনে কথা বলছিলেন। আমি ফোনটা নিয়ে ওঁর কাছাকাছিই দাঁড়ালাম। সকাল ন’টা নাগাদ জায়ান্ট স্ক্রিনে ভেসে উঠল, সুপ্রিয় বড়াল ৩৬৭০ ভোটে এগিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে দলের কর্মী একটা লাল চেয়ার এনে দিলেন। বললেন, বাবুলদা বসুন। বললাম, সিপিএমের চেয়ার এনে দিলে! ওদের তো পিছনে ফেলে এসেছি।
দোলাদি বেলা একটা নাগাদই গণনাকেন্দ্র ছেড়ে বেরিয়ে গেছিলেন। বংশদাকে সকাল থেকেই দেখিনি। বেলা দুটো নাগাদ ব্যবধান সত্তর হাজার ছাড়াতেই মেয়েকে ফোন করলাম। বলল, ‘হ্যাঁ, টিভিতে দেখছি। লাভ ইউ, লাভ ইউ ড্যাড।’
পর্যবেক্ষকের কাছ থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে মোবাইলেই একটা ছবি তুললাম। ফেসবুকে পোস্ট করে দিলাম। নির্মলদাকে বললাম, আসানসোলে এ বার একটা পাকাপাকি বাড়ি দেখতে হবে কিন্তু। মিডিয়া জিজ্ঞাসা করতে বললাম, ‘ওই যে বলেছিলাম, সোল দিয়ে মুশকিল আসান করতে চাই আসানসোলের।’
পুনশ্চ: হ্যাঁ এটা সত্যিই, দুজন প্রিয় বন্ধুর কথায় রাজনীতিতে আসব, এটা মোটামুটি ঠিক করে ফেলেছিলাম, কিন্তু জীবনের যেই নতুন বাঁকটাতে যে সত্যি সত্যি ‘হাওয়া’তে এইভাবে স্ক্রিপ্টেড হয়ে যাবে, তা কিন্তু ভাবিনি! ‘হোয়েন ইউ রিয়েলি ওয়ান্ট সামথিং, দ্য ইউনিভার্স কনস্পায়ার্স ইন ইয়োর ফেভার’ কথাটার ওপর অগাধ বিশ্বাস রাখার পুরস্কার পেলাম বোধ হয়, না হলে হট করে বাবা রামদেব আমার পাশে এসে বসবেনই বা কেন, আর আমি মজা করে ‘দুষ্টুমির মোড়কে’ মুড়ে আসলে যে মনের খুব ‘সিরিয়াস’ একটা কথা ওঁকে বলছি, এটাই বা উনি বুঝবেন কী করে? স্যর উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, ‘আ জোক ইজ এ ভেরি সিরিয়াস থিং’! মনে হয় স্বামীজি কোথাও সেটা বুঝতে পেরেছিলেন, আর তাই বোধ হয় এত স্নেহের সাথে, আমার ওপর ভরসা রেখে এই নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন!! আমাকে!!! যোগ-এর কিছুই আমি জানি না, কিন্তু রাজনৈতিক যোগবিয়োগের এই ময়দানে আমার ‘অনুপ্রবেশ’ যে বাবা রামদেবের হাত ধরে, তা বলতে আমার কোনওরকম দ্বিধা নেই। আর, শুরুটা যখন ভাল হচ্ছে, বাকিটাও আমাকে ভাল করতেই হবে...‘অ্যান্ড মাই টাইম স্টার্টস নাও’!!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy