Advertisement
২০ মে ২০২৪
রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ১

আমি ছাড়ছি না

প্লেনের টিকিট। রামদেব। ভোটের টিকিট। গানের শো। রোড শো। প্রথম রাজনৈতিক বক্তৃতা। প্রথম প্রচার। আসানসোল থেকে দিল্লি। মুসাফির হুঁ ইয়ারো। আজ প্রথম পর্ব। ঘটনাটা ঘটল আজ সকালেই। ফুটবল খেলতে গিয়ে হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পেয়েছি। দিল্লিতে বোর্ডিং পাস নেওয়ার সময় বলেছিলাম, সামনের আসন চাই, আইল সিট। পা ছড়িয়ে সবে বসেছি, দেখি সাক্ষাত্‌ এক বাবাজি! যোগগুরু রামদেব। যোগের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই, এক সময় অনুলোম-বিলোম শিখেছিলাম। বললাম, স্যর, জানলার পাশেরটা আপনার, ঢুকে যান।

বাবুল সুপ্রিয়
শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

২৮ ফেব্রুয়ারি

ঘটনাটা ঘটল আজ সকালেই। ফুটবল খেলতে গিয়ে হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পেয়েছি। দিল্লিতে বোর্ডিং পাস নেওয়ার সময় বলেছিলাম, সামনের আসন চাই, আইল সিট। পা ছড়িয়ে সবে বসেছি, দেখি সাক্ষাত্‌ এক বাবাজি! যোগগুরু রামদেব। যোগের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই, এক সময় অনুলোম-বিলোম শিখেছিলাম। বললাম, স্যর, জানলার পাশেরটা আপনার, ঢুকে যান। যেন শুনেও শুনলেন না, ফোনে কথা বলতে বলতেই বসে পড়লেন। খিনখিনে গলায় বলছিলেন, ‘তুমহারা টিকিট হো গয়া বেটা, অব জি জাঁসে লড়ো।’ সেটা রেখে আরও একটি নম্বর মেলালেন। ‘হাঁ জি! আপকো আলবার সে হি লড়না হ্যায়। চিন্তা মত করো, রাজস্থান মে ভাজপা-কা উমিদ ইসবার জাদা হ্যায়! অউর ম্যায় হুঁ না!’

বেশ মজার লাগল। ফোন রাখতেই বললাম, স্যর, আমারও একটা টিকিট চাই। খড়ম জোড়া খুলে সবে শরীরটা এলিয়েছেন, শুনেই তড়াক করে উঠে বসলেন স্বামীজি! বাঁ চোখটা ওঁর সারাক্ষণ লাফায়। সেটা আরও বেড়ে গেল! ‘কী বললে?’ বললাম, টিকিট চাই স্যর, আমিও ভোটে লড়তে চাই। মাঝের সিটে বসেছিলেন ওঁর সচিব। ওঁকে আঙুলের খোঁচা দিয়ে স্বামীজি বললেন, ‘সিদ্ধার্থ, এ লড়কা কৌন হ্যায়।’ আমি বললাম, গুগ্ল করে দেখতে পারেন স্যর। প্রেম ভালবাসার গান গাই বলিউডে। কিন্তু টিকিট আমার চাই, নইলে প্লেন থেকে নেমেই মিডিয়াকে বলে দেব। ‘কী বলবে?’ এক গাল হাসলাম, বলব, শুধু আসনের সঙ্গে আপনার যোগ নেই, লোকসভার আসনও আপনার মুঠোয়! কাকে কোথায় টিকিট দিচ্ছেন সব বলে দেব। স্বামীজিও এ বার হেসে কুটোপাটি! সিদ্ধার্থকে বললেন, ‘কোথায় এনে ফেলেছিস রে বেটা!’ আর আমি বললাম, এসে যখন পড়েছেন স্বামীজি, দিয়েই যেতে হবে। আমি ছাড়ছি না। বলে সিদ্ধার্থকে সরিয়ে মাঝের সিটে এসে বসলাম। গোটা রাস্তা খুনসুটি করে গেলাম ওঁর সঙ্গে। যত বারই কথা ঘোরাতে চান, তত বারই টিকিটের প্রসঙ্গ টেনে আনি। শেষমেশ নিজের কোর্টে বল টানলেন, ‘পবনমুক্তাসন জানো? কপালভাতি?’ বললাম, একটা টিকিট দিন, সব শিখে নেব। আপনি কপালভাতি শেখাবেন, আমি আপনাকে চড়ুইভাতি শেখাব। চড়ুইভাতি! স্বামীজি অবাক। মানেটা শুনে ফের অট্টহাসি। বললেন, ‘এ ব্যাটা পিছন ছাড়বে না রে! সিদ্ধার্থ, ওঁর নম্বরটা নিয়ে নে।’ নেমে যেন পালিয়ে বাঁচলেন বাবাজি!

১ মার্চ

স্টুডিয়ো থেকে ফিরে একটু জিরিয়ে নিচ্ছি, অচেনা নম্বর থেকে ফোন। ‘হ্যালো সুপ্রিয়জি?’ হ্যঁা বলুন। ‘আমি রাকেশ, সঙ্ঘের প্রচারক। রামদেবজি আপনার কথা বলেছেন। আপনি নাকি ভোটে লড়তে চাইছেন!’ একটু ভেবে বললাম, হ্যঁা চাইছি, কী করতে হবে বলুন। ‘সে পরে সব বুঝিয়ে বলব। আগে বলুন ধনরাশি কত খরচ করতে পারবেন। এমনিতে ৭০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত প্রচারে খরচ করা যায়। কেউ কেউ এর ঢের বেশি করেন।’ ধনরাশি? কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইলাম। তার পর বললাম, ধনরাশি খরচ করতে পারব না। মোদীজিকে ভাল লাগে। ওঁর জন্য লড়তে পারি। প্রচারে সময় দিতে পারি। আমার একটা গুডউইলও রয়েছে। কিন্তু টাকাপয়সা ঢালা সম্ভব নয়। এই জবাবের জন্য হয়তো উনিও ঠিক ছিলেন না। ‘ঠিক আছে, বাবাজির সঙ্গে কথা বলি’ বলে ফোন কেটে দিলেন। বুঝলাম, ধনরাশি ছাড়া ভোটে লড়া যাবে না। তা হলে থাক!

৪ মার্চ

সাতসকালে ফোন। অচেনা নম্বর। তখনও বিছানা ছাড়িনি। ‘বাবুল, চিনতে পারছ?’ জড়ানো গলায় বললাম, কে বলুন তো! ‘তোমার টিকিটটা হয়ে গেছে। বাংলা থেকেই তোমায় লড়তে হবে।’ এত ক্ষণে ঠাহর হল, বললাম, আরে নমস্তে বাবাজি। কিন্তু ধনরাশি আমি খরচ করতে পারব না। বললেন, ‘ওটা বিজেপি ভাববে। তবে হ্যঁা, ভোটের পর পবনমুক্তাসন শিখতে হবে কিন্তু!’ বলেই খিলখিল করে হাসলেন অনেক ক্ষণ। ওঁর হাসিটা বেশ লাগে।

৬ মার্চ

রামদেবের সঙ্গে সাক্ষাতের ঘটনা বাবাকে আগেই বলেছিলাম। দুষ্টুমির কথাগুলো অবশ্য ভাঙিনি, এই বয়সেও বকুনি খেতে হত। আজ বললাম। সব শুনে বাবা থ! বললেন, ‘তুই পারবি তো বাবুল? রাজনীতি সহজ ব্যাপার নয় রে। নতুন করে ঝামেলা ঝঞ্ঝাটে কেন যাবি?’ বাবাকে রাজি না করিয়ে এগোনোর উপায় নেই। বললাম, দেখি না কোথাকার জল কোথায় গড়ায়! বম্বের লড়াইটাও কি সহজ ছিল বাবা?

কাছের দু’এক জন বন্ধুকেও বললাম সব। অত্রিম আহ্লাদে আটখানা। বলল, ‘নেমে পড় বাবুল। তোর ভাল সময় আসছে। হাতের পান্নাটা আছে তো! নাকি এ বারও ফুটবল খেলতে গিয়ে হারিয়ে ফেললি!’

৭ মার্চ

সব কিছু এত দ্রুত ঘটছে, যেন অবাক হওয়ার সময়টুকুও পাচ্ছি না। আজ সন্ধ্যায় রাহুল সিংহ ফোন করলেন। পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির সভাপতি। আগে কখনও পরিচয় হয়নি। আলাপ সেরেই বললেন, ‘ভাই, আসানসোল থেকে আপনাকে প্রার্থী করলে অসুবিধা নেই তো!’ একটু ভেবে বললাম, না, তা নেই। কিন্তু আসানসোল কেন? বললেন, ‘গোড়ায় শ্রীরামপুর ভেবেছিলাম। এখন দেখছি আসানসোলটা ভাল হবে। আপনি ভাল হিন্দি বলতে পারেন। ওখানে হিন্দিভাষী অনেক। একটু খাটলে সিটটা বেরিয়ে যেতে পারে।’ উত্তরপাড়া-শ্রীরামপুর আমার ঘরের মাঠ। কিন্তু ওঁর যুক্তিটাও ফেলা গেল না। তা ছাড়া অ্যাওয়ে ম্যাচের মজাটাই আলাদা! ‘হ্যঁা’ করে দিলাম।

৮ মার্চ

সকাল থেকেই মনটা উড়ুউড়ু। লোকসঙ্গীতের আ্যালবামটা করে খুব তৃপ্তি হয়েছিল। ‘হোয়াট দ্য ফোক’-এর জন্যই আজ জি গৌরব সম্মান দেওয়া হল আমায়। সবে মঞ্চ থেকে নেমেছি, শুনলাম বাইরে মিডিয়ার ভিড়। আমাকে খুঁজছে। কেন? বলল, দিল্লি থেকে আমার নাম আসানসোলের প্রার্থী হিসাবে ঘোষণা করেছে বিজেপি। ছোট বেলার এক বন্ধু টেক্সট করল, ‘তুই পাগল হয়ে গেলি?’ স্মাইলি পাঠালাম। তবে এই প্রথম মনের মধ্যে একটা খোঁচা লাগল। ঠিক করছি তো!

১০ মার্চ

আসানসোলে শো করতে অনেক বার গেছি। বাবুল সুপ্রিয় নাইট। শহরটা তবু অচেনা। শো করতে গেলে তো আর ঘোরা হয় না! আজ সকালে গুগ্ল করতে বসলাম। কয়লাখনির সাড়ে তিনশো বছরের ইতিহাস, কর্পোরেশন, মানুষ, অর্থনীতি, ইসকো, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, যতটা পারি নোট করলাম ডায়েরিতে। রানিগঞ্জ কুলটি জামুরিয়া বারাবনি সহ সাতটা বিধানসভা। প্রচুর ঘুরতে হবে। পরীক্ষার দু’মাস আগে সিলেবাস হাতে পেলে যেমন হয়, যেন তেমনই অনুভূতি! আগের সব ভোটের ফলাফলও মোটামুটি নোট করে নিলাম। গত ভোটে বিজেপি পেয়েছিল মাত্র ৪৯ হাজার ভোট। পরক্ষণেই নিজেকে সাহস দিলাম, আগের বার তো মোদীজি ছিলেন না, বাবুলও না। হিয়ার আই কাম আসানসোল!

১৪ মার্চ

আজ ফোন করলেন আসানসোলের স্থানীয় নেতা নির্মল কর্মকার, ‘দেওয়াল লেখা শুরু করে দিয়েছি। সুপ্রিয় বড়াল, ব্র্যাকেটে বাবুল সুপ্রিয়।’ খুব ভাল! ‘কিন্তু আসবেন কবে? ছেলেরা অধৈর্য হয়ে পড়ছে। মানুষও এক্সাইটেড।’ বললাম, খুব শিগগির আসছি। রাহুলদার সঙ্গে কথা বলে নিচ্ছি। আপনিও ওঁর সঙ্গে কথা বলুন।

রাহুলদাকে ফোন করলাম। ‘হ্যঁা, বাবুল বলো।’ দাদা, কবে যাব? বললেন, ‘তুমি বলো। এখন যত তাড়াতাড়ি নেমে পড়বে ততই ভাল।’ বংশদা (বংশগোপাল চৌধুরী), দোলা সেনরা এর মধ্যেই নেমে পড়েছেন।’ বললাম, এ-দিকের কাজগুলো একটু গুছিয়ে নিয়েই চলে আসছি। মাঝে দুটো শো আছে। একটু পর ফের ফোন করলাম, ১৮ তারিখ কলকাতায় আসি? ‘এসো, তার পর একসঙ্গে যাব দুজনে। নির্মলদাকে বলে দিচ্ছি ও-দিকের ব্যবস্থা যেন করে রাখেন।’

১৭ মার্চ

কাল আসানসোল যাচ্ছি। শর্ট ট্রিপ। দু’দিনের। ওখান থেকেই সোজা বাংলাদেশ, তার পর ফিলাডেলফিয়া। দুটো শো। জামাকাপড় গুছিয়ে নিতে হল। নোটবুকটাও নিলাম। ইন্টারনেট থেকে আসানসোলের একটা ম্যাপ ডাউনলোড করে রেখেছিল মেয়ে, এক্ষুনি দিয়ে গেল। বুঝলাম, ভেতরে ভেতরে ওরও একটা উত্তেজনা হচ্ছে। কাগজটার ওপর আবার হাতে লিখে দিয়েছে ‘মিশন আসানসোল’। এক মুহূর্তের জন্য চোখে জল এসে গেল। ব্যাগ গুছনোর সময় দেখি একটা সানস্ক্রিন লোশনও কিনে এনেছে মেয়ে। বলল, ‘বাবা, ইন্টারনেটে দেখেছি ওখানে এখন খুব রোদ। সাবধানে থেকো!’ অত্রিমও ফোন করল!

১৮ মার্চ

মুম্বই থেকে মর্নিং ফ্লাইটে কলকাতা। রাহুলদাকে তুলে এখানে পৌঁছতে প্রায় বিকেল। হ্যালো আসানসোল! ভগ্ন শিল্পশহর যতটা চোখে পড়ল শুষে নিলাম। গাড়ি থেকে নেমে সবে আড়মোড়া ভাঙছি, নির্মলদা এলেন, ‘দেখেছ কাণ্ডটা, হোটেল বুকিংটাই ক্যানসেল করে দিয়েছে!’ কে করেছে? আসানসোল রেসিডেন্সি হোটেলে আগাম বুকিং ছিল, পুলিশ নাকি সকালে এসে ক্যানসেল করে গেছে। বলেছে, ওখানে থাকা আমার পক্ষে নিরাপদ নয়। সরকারবাহাদুরের এমন আতিথেয়তা! রাহুলদাও শুনে ভীষণ রেগে গেলেন! পুলিশের সঙ্গে তর্ক করে ওখানেই উঠলাম। বুঝলাম, লড়াইটা শুরু হয়ে গেছে!

সন্ধ্যায় রানিগঞ্জে কর্মিসভা। জীবনে প্রথম রাজনৈতিক বক্তৃতা দিলাম, ‘গানের জন্য আমাকে ভালবেসেছেন। আমি আপনাদের কাছে ঋণী। এক জন ভাল ক্যাপ্টেন পেয়েছি। আশা করি আমার কাজ দিয়ে ভালবাসার প্রতিদান দিতে পারব।’ গানের আবদার থাকবেই, জানতাম। গাইলাম: বম্বে কাঁপিয়ে, ভারত নাচিয়ে এসেছি বাংলায়। ‘সঙ্গী’ ছবির হিট গান। আমারই গাওয়া।

১৯ মার্চ

খালি পায়ে গাড়ি থেকে নামতেই, ছ্যঁাকা লেগে গেল! ঘাঘরবুড়ি মন্দিরের চাতালটা তেতেপুড়ে রয়েছে। তাতেও থইথই ভিড়। এ-দিক ও-দিক হাত মিলিয়ে এক ছুটে মন্দিরের দাওয়ায়। মায়ের সামনে গিয়ে বসতেই পুরুতমশাই কপালে তিলক কেটে দিলেন, প্রসাদি ফুল দিলেন হাতে। বাইরে তখন তুমুল স্লোগান উঠছে আমার নামে। শঙ্খ, কাঁসরঘণ্টা, উলু, সব মিলেমিশে যেন স্টিরিয়ো সাউন্ড খেলে যাচ্ছে! এই প্রথম অনুভব করলাম, চার পাশের উত্‌সাহ, আবেগ, আবাহনের মধ্যে আমার দুটো সত্তা যেন মিশে যাচ্ছে। গায়ক বাবুল আর রাজনীতিক বাবুল। গায়ককে ওঁরা চেনেন, তাকে দেখতে এসেছেন। ওঁদের হাতেই আবার আজ বিজেপির পতাকা, মুখে স্লোগান।

গতকাল রাতে রাহুলদা, নির্মলদার থেকে ব্রিফ নিয়েছি। বুঝতে পারছি, কঠিন লড়াই। মন্দির চত্বরের ওই মুডটাই শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে হবে। আজ রাতেই পৌঁছে গেলাম কলকাতা। কাল ঢাকা উত্তরা ক্লাবে শো। ২২ মার্চ ফিলাডেলফিয়া। ভোটের আগে এই দুটো শো করতেই হবে। অনেক দিন ধরে কথা দিয়ে রেখেছিলাম।

২২ মার্চ

মঞ্চে টুকটাক হোঁচট খেয়ে হাতের মাইকটা কখনও-সখনও দাঁতে লাগে। কিন্তু আজ যেটা হল, মারাত্মক। ফিলাডেলফিয়া কনভেনশন সেন্টারে এশিয়ান আমেরিকান হোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের শো ছিল। করিনা কপূর, আমি আর মল্লিকা শেরাওয়াত। করিনার প্রথম দুটো পারফরমেন্সের পর আমার স্টেজ। বাচ্চাদের স্টেজে তুলে ‘চন্দা চমকে’ গানটা শুরু করতেই বিপত্তি। জুতোয় একটা স্টিলের স্টাড ছিল। পা হড়কে পড়ে গেলাম। মাইকটা সপাটে লাগল দাঁতে। রক্ত বেরোতে লাগল ওপরের পাটির সামনের দাঁতটা থেকে। কয়েক সেকেন্ড মাথাটাও ঘুরছিল বোঁ বোঁ করে। মিউজিক বন্ধ। কী হল কী হল করে দর্শকরা উঠে দাঁড়ালেন। আয়োজকদেরই এক জন ব্যাকস্টেজ থেকে ছুটে এলেন। ‘না না কিছু হয়নি’ বলে জল খেয়ে গান শুরু করলাম, কিন্তু এখন খুব যন্ত্রণা করছে। মুম্বইতে ডাক্তারকে ফোন করলাম। বললেন, ‘গোড়া থেকে দাঁতটা হয়তো নড়ে গেছে। পারলে একটা পেনকিলার খেয়ে নিন।’ ওষুধের একটা বাক্স সব সময়ই সঙ্গে থাকে। একটা কম্বিফ্ল্যাম খেতেই হল।

২৭ মার্চ

মুম্বইতে আপাতত কাজ আর রাখিনি। দেশে ফিরে ডাক্তারকে দুটো সিটিং দিতেই হল। আজ ফের আসানসোল পৌঁছলাম। সুশান্তদারা হোটেলেই এলেন, ‘এ বার কিন্তু আদাজল খেয়ে নামতে হবে বাবুল! কাল সকালে আসানসোল টাউনে ঘুরব, দুপুরে একটু রেস্ট, বিকেলে কুলটির কেন্দুয়া বাজার।’ বললাম, ও কে স্যর!

তৃণমূলের উত্‌পাত নাকি বেড়েছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে শাসাচ্ছে। বিরোধীদের ঘরছাড়া করছে। কে যেন বলল, ‘চলুন কমিশনে এক বার।’ বললাম, আগে ক্যাম্পেন শুরু করি।

২৮ মার্চ

হোটেল থেকে বেরিয়েই দেখি, গাঁদা ফুলে সাজানো একটা টেম্পো দাঁড়িয়ে। সামনে পিছনে আরও দুটো গাড়ি। তপসিবাবার মন্দিরে পুজো দিয়ে ধাদকা রোড ধরে সবে এগিয়েছি, লোক-বোঝাই বাসটা ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল আমার টেম্পোর সামনে। গিয়ার-স্টিয়ারিং ছেড়ে আধখানা শরীর হাওয়ায় ভাসিয়ে জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন বাসচালক। আমি তখন টেম্পোর ছাদে। ওঁকে হাত ধরে টেনে নামাতেই, হুড়মুড় করে নেমে পড়লেন যাত্রীরাও। ‘দাদা একটা গান হোক।’ ধাদকা পলিটেকনিক মোড়ে তত ক্ষণে বেশ ভিড় জমেছে। বললাম, ‘আমি আপনাদের কথা শুনতে এসেছি। সুযোগ দিলে আপনাদের কথা পৌঁছে দেব দিল্লিতে।’ সকালে ঘন্টা তিনেক ঘুরলাম। বিকেলে কুলটি বাজারে বেরোলাম পায়ে হেঁটে। দোকানদাররা ছেঁকে ধরলেন। রেলের ফ্রেট করিডরের জন্য বাজারটা নাকি ভাঙা পড়বে! বললাম, আসানসোলে কোনও কিছুই আসান নয় জানি। কিন্তু সোল দিয়ে আপনাদের মুশকিল আসান করব।

৩০ মার্চ

আজ জামুরিয়া। পুনিহাটি ওয়ার্কশপ পিছনে ফেলে গাড়িটা এগোচ্ছিল। সামনে ব্যান্ডে বাজনা বাজছে। কিন্তু পথচলতি কিছু মানুষ, আর দলের ক’জন সমর্থক। লোক কই! বুঝলাম এ ভাবে হবে না। জামুরিয়া বাজারের কাছে এসে গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। নির্মলদাকে বললাম, চলুন কচুরি খাই। আধখানা কচুরি সবে মুখে পুরেছি, পাশ থেকে আওয়াজ এল, ‘বাবুল সুপ্রিয় না!’ আধ ঘন্টায় হইচই পড়ে গেল। থিকথিক করছে মানুষ। দোতলার বারান্দা, বাড়ির ছাদ থেকে ঝুঁকে পড়েছেন কাকিমা, বউদিরা। মাইকটা নিলাম, ‘এটা লোকসভার ভোট। মোদীজি গুজরাতে উন্নয়ন ঘটিয়েছেন, উনি প্রধানমন্ত্রী হলে আসানসোলেও উন্নয়ন হবে। আমাকে ভরসা করে দেখুন।’ এও বললাম, ‘আর কত ছোটখাটো দলকে ভোট দেবেন? জোটনির্ভর সরকার অনেক হয়েছে। এ বার স্থায়িত্বের জন্য ভোট দিন।’

জানতাম, ভোট মানেই মিটিং। অথচ রাহুলদা বলেছিলেন, ‘জনসভা তোমাকে করতে হবে না। তুমি শুধু রোড শো করো। যত পারো ঘোরো, মানুষের সঙ্গে কথা বলো।’ আজ বুঝলাম, মিটিংয়েরও রকমফের হয়!

২ এপ্রিল

সন্ধে থেকেই কিশোরকুমারের গানটা গুনগুন করছি। সবাই চলে যেতে ঘরের দরজা বন্ধ করে গেয়েই ফেললাম। মুসাফির হুঁ ইয়ারো! যেন সেই ছোটবেলার বাবুল! তখন জগন্নাথের রথ সাজাতাম। আজ নিজের রথের নকশা করলাম।

বিশেষ রেস্ত নেই। পাতি একটা টেম্পোয় চড়ে আসানসোল-রানিগঞ্জে ঘুরছিলাম ক’দিন ধরে। দুপুরে ঘুরতে ঘুরতেই বুদ্ধিটা এল মাথায়। দীপককে বললাম, চল তো আমার সাথে। প্রথম দিনই নজর করেছিলাম, রাস্তার পাশে লরির ওয়ার্কশপ। নিয়ে গেলাম টেম্পোটা। ছবি এঁকে বুঝিয়ে দিলাম লোহার গ্রিল দিয়ে ছাদটা কী ভাবে ঘিরতে হবে। মাঝে গদি পেতে চার দিকে প্লাই বোর্ড মেরে দিতে বললাম। দিব্যি দাঁড়িয়েছে। শুধু কিছু ফ্ল্যাগ দিয়ে একটা শামিয়ানার মতো করে নেব কাল। ছেলেটা বলল, ‘দাদা একটা বাড়তি শকারও লাগিয়ে দিয়েছি। ঢকঢক করবে না।’

৩ এপ্রিল

সারা দিন ঝলসে সবে হোটেলে ফিরেছি। নির্মলদা খবরটা দিলেন। থানা থেকে ফোন এসেছিল। জনৈক সঞ্জয় সিংহ আসানসোল সিটিজেন ফোরামের তরফে অভিযোগ করেছেন, বাবুল সুপ্রিয় মদ খেয়ে মন্দিরে ঢুকেছে, ধর্মীয় আবেগে আঘাত লেগেছে! চট করে মেজাজ হারানো আমার ধাতে নেই। কিন্তু শুনেই মাথাটা ঝনঝন করে উঠল। বললাম, ঠিক আছে, পুলিশকে আসতে দিন। আসানসোলে পাড়ায় পাড়ায় হরিমন্দির। কখন কোন মন্দিরে ঢুকেছি বলতে পারব না। কিন্তু মদ খেয়ে? তা হলে এ বাড়ির কাকিমার কাছে লুচি আলুর দম, ও বাড়ির রোয়াকে বসে নারকেল নাড়ু জল খেল কোন বাবুল! বুঝলাম, নোংরা খেলা শুরু হয়েছে। মনে মনে ঠিক করলাম, ওদের ঘোল খাওয়াতেই হবে।

অনুলিখন: শঙ্খদীপ দাস।

আগামী সংখ্যায় সমাপ্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

rabibasariya probondho babul supriyo
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE