Advertisement
E-Paper

আমেরিকার মেয়েরা

ছেলেদের সমান। স্বাধীন, দাপুটে জীবন তাঁদের। এই তো ধারণা? ভুল। আমাদের পোড়া দেশের মেয়েদের মতোই, তাঁরা মার খাচ্ছেন, সব অর্থে। লিখছেন পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়।ছেলেদের সমান। স্বাধীন, দাপুটে জীবন তাঁদের। এই তো ধারণা? ভুল। আমাদের পোড়া দেশের মেয়েদের মতোই, তাঁরা মার খাচ্ছেন, সব অর্থে। লিখছেন পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়।

শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০১৪ ১৬:৫০

সুপার বোল’-এর সকালে আমেরিকায় নামলাম। দেশটা উত্তেজনায় থরথর করছে। জাতীয় ফুটবল লিগের ফাইনাল ম্যাচ। সন্ধ্যায় ওয়াশিংটনে হোটেলের লবিতে এলইডি-র সামনে ওয়াইনের গ্লাস হাতে উচ্ছ্বসিত নরনারী। টিভি-র পর্দায় খানিক ক্ষণ চোখ রেখে চমকে উঠলাম! মাঠের জায়ান্ট স্ক্রিনে বার বার

ভেসে উঠছে লাইনটা, আর তত বারই মাঠ কাঁপিয়ে উল্লাসের ঢেউ উঠছে ‘ইটস আ ম্যান’স গেম!’

খুল্লমখুল্লা পৌরুষের আস্ফালন! মেয়েরা হজম করছে, আবার ওই মাঠে বসে খেলাও দেখছে! পরের পঁচিশ দিন মার্কিন মুলুকে কাটিয়ে বুঝলাম, সে দিন সন্ধের ধাক্কাটা স্রেফ ট্রেলর ছিল। আগে ভাবতাম, মার্কিন মেয়েরা কত স্বাধীন! ওদের ডানা দুটো যদি পেতাম! বুঝিনি সেই ওড়াটা আসলে বিভ্রম, ইলিউশন।

মেয়েদের নিজের দেহের উপর, নিজের ভ্রূণের উপর অধিকারের দাবিতে ঘোরতর আপত্তি মার্কিন সমাজের স্বঘোষিত কট্টরপন্থী ঠাকুরদাদের। তাই ‘অ্যাবরশন পলিটিক্স’-এর চাপে নাভিশ্বাস উঠছে সে দেশের মেয়েদের। আইনানুযায়ী আমেরিকায় গর্ভপাত বৈধ। কিন্তু দেশের অধিকাংশ ‘ক্রাইসিস প্রেগন্যান্সি সেন্টার’ আর অ্যাবরশন ক্লিনিকই দক্ষিণপন্থী বা কট্টরপন্থী ধর্মীয় সংগঠনের কবজায়। তারা এমন কিছু ছুটকো নিয়ম করে রেখেছে যা মানতে গেলে গর্ভপাত মুশকিল। চিকিৎসকেরাও যাতে গর্ভপাত করতে না চান, তার জন্য এরা তাঁদের ওপর পরোক্ষে চাপ দেয়। আবার প্রচার করে, গর্ভপাত করলে ব্রেস্ট ক্যানসারের সম্ভাবনা বাড়বে। যার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তিই নেই। অনেক সময় ক্লিনিকগুলিতে আসা মেয়েদের ইচ্ছাকৃত ভুল রিপোর্ট দিয়ে বলা হয়, তিনি আসলে গর্ভবতী নন। মেয়েরা নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরে যান। এবং কয়েক মাস পরে নিজেরাই গর্ভের অস্তিত্ব টের পান। কিন্তু তখন আর গর্ভপাত করার সুযোগ থাকে না। অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান নিয়ে মেয়েরা যত বিপদে পড়েন, বোধহয় কট্টরবাদীদের তত মজা!

ভোটের জন্য সরকারও প্রভাবশালী এই বর্গকে ঘাঁটাতে চায় না। হাসপাতালগুলির সিংহভাগও এই ধর্মীয় সংগঠনগুলি চালায়। তারা গর্ভপাতের কেস ভর্তি করতেই চায় না। দেশের দক্ষিণের অধিকাংশ রাজ্যে প্রায় সব বৈধ গর্ভপাত ক্লিনিক বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এ দিকে পরিসংখ্যান বলছে, গর্ভবতী অবস্থায় সে দেশে মেয়েদের উপর স্বামী, পুরুষসঙ্গী, এমনকী কর্মস্থলে মালিকের অত্যাচারও অনেক ক্ষেত্রে দ্বিগুণ হয়। ২০১৩ সালেই আমেরিকার ‘ইকুয়াল অপরচুনিটি কমিশন’-এ, গর্ভাবস্থায় কর্মস্থলে বঞ্চনা-নির্যাতন জনিত ৩৭০০টি অভিযোগ দায়ের হয়েছে!

২০১৪ সালে দাঁড়িয়ে মাতৃত্বকালীন সবেতন ছুটি পান আমেরিকার কর্মরতা মহিলাদের মাত্র ১৬%। যে সব কাজে ন্যূনতম মজুরি সবচেয়ে কম (নিয়মানুযায়ী ঘণ্টায় ৯ ডলার, তবে ৭ ডলারও দেওয়া হয় অনেক জায়গায়) তার প্রায় সবটাই করেন মেয়েরা। এঁদের ৪০%-এর কোনও স্বাস্থ্য বিমা বা সবেতন অসুস্থতার ছুটি থাকে না। শিকাগোয় এক নামী ফাস্ট ফুড চেনের দুটি দোকানে আলাদা আলাদা শিফ্ট-এ কাজ করেন ৪৩ বছরের সনিয়া আকুনা। বলছিলেন, ‘অনেক সময় ম্যানেজার বাথরুম যাওয়ার ব্রেকটাও দেন না। আমার ৫ বছরের মেয়ের সঙ্গে দিনে সাকুল্যে ২ ঘণ্টা দেখা হয়।’ দারিদ্রের সঙ্গে ঘরোয়া হিংসার একটা পরোক্ষ যোগ থাকে। ফলে এই মেয়েরা ঘরে-বাইরে নির্যাতিতা হন।

আমেরিকায় এখনও পর্যন্ত কোনও মহিলা প্রেসিডেন্ট নেই। গত বারো বছরে বিভিন্ন রাজ্যে প্রশাসনিক প্রধানের পদে মেয়েদের প্রতিনিধিত্ব ক্রমশ কমেছে। মেয়েদের স্বার্থ ভাববেন কারা? পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঘরোয়া হিংসা, স্ত্রীকে গুলি করে খুন, ধর্ষণ। প্রখ্যাত অনলাইন শপিং সংস্থা ছেলেদের জন্য টি-শার্ট বিক্রি করছে, বুকে বড় করে লেখা: ‘কিপ কাম অ্যান্ড রেপ আ লট’, ‘কিপ কাম অ্যান্ড হিট হার’! কুড়ি ডলারের এই টি-শার্ট বাজারে আনামাত্র রেকর্ড বিক্রি!

অদ্ভুত দ্বিচারিতা দেশটার। বাজি-পটকা নিষিদ্ধ। অথচ প্রাপ্তবয়স্ক যে কেউ আত্মরক্ষার কারণ দেখিয়ে য’টা খুশি আগ্নেয়াস্ত্র কাছে রাখতে পারেন। স্বামী-স্ত্রী’র মধ্যে ঝগড়া লাগলেই তাই রাগের মাথায় বন্দুক চালিয়ে বউ-বাচ্চাকে খুন করা জলভাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমালোচকেরা যতই গলা ফাটান, বন্দুক-আইন শুধরোচ্ছে না। ২০১৩ সালে শুধু মিনেসোটা প্রদেশেই বর বা বয়ফ্রেন্ডের বন্দুকের শিকার হয়েছেন ২৫ জন মহিলা।

গত বছরেই, ৬ জানুয়ারি সেন্ট পল-এ স্ত্রী মানিয়া জনসনকে গুলি করে খুন করে রজার জনসন। তার পর ১৮ মাসের সন্তানের সামনেই মৃতদেহ করাত দিয়ে কুচি-কুচি করে প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে গ্যারেজে রেখে দেয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি মেপ্লউড-এর বাসিন্দা ১৬ বছরের অ্যানা হার্ডকে গুলি করে মারে প্রেমিক অ্যান্টনি। ৭ মার্চ, অ্যাপ্ল ভ্যালির বাসিন্দা ৩৭ বছরের মারগোরি হল্যান্ডকে গলা টিপে, ঘাড় ভেঙে মেরে ফেলে স্বামী রজার হল্যান্ড। ১১ এপ্রিল ব্রুকলিন পার্কের ক্ল্যারেসা কুককে গুলি করে মারে প্রেমিক আলবের্তো পামার। ২৪ জুলাই জিয়ার রিভার এলাকায় সনিয়া অ্যান স্মিট-কে পিটিয়ে মেরে ফেলে প্রেমিক ইউজিন ন্যাসন। ইডেন প্রেইরি এলাকার ২১ সেপ্টেম্বর অনিত্রা র্যাচেল উইলিয়ামস-কে গুলি করে মারে স্বামী ডেরিক অ্যান্টনি উইলিয়ামস। পড়ে মাথা ঝিমঝিম করছে না? তালিকা আরও-আরও-আরও দীর্ঘ।

দেশটার সর্বত্র ‘হিজ’ আর ‘হার’-এর বিভেদ। মাঝেমধ্যেই অনেক কো-এডুকেশন স্কুলে কোনও একটি সাবজেক্টে ছেলে ও মেয়েদের আলাদা করে ক্লাস নেওয়া হয়। কারণ হিসাবে কর্তৃপক্ষের যুক্তি: ‘মেয়েদের বিজ্ঞান আর অংক বুঝতে সময় লাগে। তাই আলাদা বসানো হয়।’ আবার অনেক স্কুলে ছেলেমেয়েদের একসঙ্গে ক্লাস চলাকালীন বিজ্ঞানের উত্তর দিতে কোনও মেয়ে আগে হাত তুললে শিক্ষকেরা ঠিক মানতে পারেন না। তাঁরা কোনও ছেলের থেকে উত্তর চান। মেয়েদের বিষয় হল আর্টস, ছেলেদের সায়েন্স।

বায়োলজিতে ডক্টরেট, বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপিকা গল্প করছিলেন, পিএইচডি করার সময় এক জায়গায় পেপার প্রেজেন্ট করতে গিয়েছেন। খুব হাততালি পেয়েছেন। কিছু ক্ষণ পর এক প্রবীণ অধ্যাপক এসে বললেন, ‘সো গার্ল, হোয়েন আর ইউ গোয়িং টু বি আ মাদার?’ উদ্দেশ্য স্পষ্ট, মেয়েটিকে বুঝিয়ে দেওয়া, যতই পড়াশোনায় প্রশংসা পাও, তোমার অস্তিত্ব জরায়ু এবং বাচ্চা পালনেই আটকে। অধ্যাপিকা বলেন, ‘সেমিনারে কোনও মেয়ে কেমন বলছে, তার চেয়ে অনেক বড় আলোচনার বিষয়: সে কেমন দেখতে, কেমন পোশাক পরেছে।’

ডেনভারের ম্যাগনোলিয়া হোটেলের কফি বার-এ এক ঝাঁক মহিলার সঙ্গে আড্ডায় তাঁদের নানান অভিজ্ঞতা শুনছিলাম। আর ভাবছিলাম, কী মিল কী মিল! সে-ই রাস্তাঘাটে মেয়ে দেখে টিটকিরি, সে-ই কোনও মেয়ে ২৭-২৮ পেরিয়েও বিয়ে না করলে আত্মীয়-প্রতিবেশীদের কথা, ‘ওর কিছু একটা গোলমাল আছে।’ আর কোনও ছেলে বিয়ে করতে দেরি করলে বলা, ‘ও একটু চুজি। যোগ্য মেয়ে পাচ্ছে না।’ মার্কিন সমাজেও, যতই বেশি মাইনের চাকরি করো, বাড়ি ফিরে ঘরের ৯০ ভাগ কাজ করতে হবে মেয়েটিকেই। বাচ্চার সিংহভাগ দায়িত্বও তার ঘাড়ে পড়বে। চার-চারটি মার্কিন পরিবারে ডিনারের আমন্ত্রণে গিয়েই দেখলাম, সর্বত্র পুরুষেরা সোফায় হেলান দিয়ে লম্বাচওড়া বুকনি দিয়ে গেলেন, অতিথি আপ্যায়নে, রান্নায় খেটে মরলেন মেয়েরা। বোধ হয় এই সবের জন্যই ওই দেশের মেয়েদের বিয়ের হার হুড়হুড় করে কমছে। ৫০% মেয়ে বিয়ে করতে চাইছেন না।

অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল খেলনার দোকানেও। যেই হাতে একটা গাড়ি নিয়েছি, অমনি মাঝবয়সি দোকানি হেসে বললেন, ‘সো ইউ হ্যাভ আ বয়।’ তিনি নিশ্চিত, একমাত্র ছেলে বাচ্চাই গাড়ি নিয়ে খেলে। মেয়ে মানেই পুতুল, খেলনাবাটি, সাজার জিনিস। অন্য এক দোকানি কিছুতেই ছেলের জন্য ডলফিন আঁকা গোলাপি রঙের শার্ট নিতে দেবেন না। এটা নাকি মেয়েদের। ছেলেদের জন্য কালো বা বেগুনি রঙের ভয়ংকর হাঙর-আঁকা টি-শার্ট নিতে হবে। তাতেই তার শিশু-পৌরুষ রক্ষিত হবে। শেষে ব্যঙ্গের সুরে আমাকে বললেনও, ‘ইউ ওয়ান্ট ইয়োর বয় টু বি আ গার্ল?!’ ‘সিনডারেলা ব্যালে শো’তেও ভরপুর শিশুকন্যাদের ভিড়। তারা দেখতে এসেছে রাজার ছেলেকে বর হিসাবে পাওয়াই কী ভাবে মেয়েদের জীবনের মোক্ষ হয়। মার্কিন মা ছুটির সকালে মেয়েকে কেক-বেকিং শেখান আর ছেলের সঙ্গে ফুটবল-রাগবিতে মাতেন বাবা। ম্যান’স গেম! মার্কিন মুলুকে মেয়েদের মুক্তির উড়ান দেখার ইচ্ছেটা শীতের আমেরিকার রাস্তার ধারে জমে থাকা বরফের মতোই ঠান্ডা হয়ে গেল।

parijat bannerjee probondhya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy