Advertisement
E-Paper

আমার প্রথম বই

এমাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল একটা বাড়ির নাম ‘রাইটার্স বিল্ডিং’। সাহেবদের দেওয়া নাম। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কত সাদা, কালো, বাদামি ‘রাইটার’ একটি পরাধীন জাতির ভাগ্য লিখেছেন, ফাইলে, দলিলে, দস্তাবেজে। সব রাইটার লেখক বা সাহিত্যিক নন। সাহিত্যিক মনে হয় কসরত করে হওয়া যায় না। কুস্তিগির হওয়া যেতে পারে। তা হলে ব্যাপারটা কী? শিবরাম চক্রবর্তীর আত্মজীবনীতে এর উত্তর আছে।

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০৫

এমাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল একটা বাড়ির নাম ‘রাইটার্স বিল্ডিং’। সাহেবদের দেওয়া নাম। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কত সাদা, কালো, বাদামি ‘রাইটার’ একটি পরাধীন জাতির ভাগ্য লিখেছেন, ফাইলে, দলিলে, দস্তাবেজে। সব রাইটার লেখক বা সাহিত্যিক নন। সাহিত্যিক মনে হয় কসরত করে হওয়া যায় না। কুস্তিগির হওয়া যেতে পারে। তা হলে ব্যাপারটা কী? শিবরাম চক্রবর্তীর আত্মজীবনীতে এর উত্তর আছে। ‘প্রবাসী’ পত্রিকার সম্পাদক শিবরামবাবুর লেখা না ছেপে ফেরত পাঠালেন। সঙ্গে মন্তব্য, ‘তোমার কবিতাটি মন্দ হয়নি, কিন্তু এটি প্রবাসীতে ছাপিয়ে তোমাকে উৎসাহ দিতে চাই না। এখন তোমার লেখাপড়া করার বয়েস। বড় হয়ে যথাসময়ে এ সবের চর্চা কোরো না হয়। সঙ্গীত, কবিত্ব আর ল্যাজ কারও ভেতরে থাকলে তা আটকে রাখা যায় না। তোমার মধ্যে যদি তা থাকে, প্রকাশ পাবেই। যথাকালে দেখা দেবে। অযথা জোর করে অসময়ে তাকে টানাটানি করে বার করার কোনও দরকার নেই।’ শিবরামবাবু লিখছেন, ‘সদুপদেশ নিঃসন্দেহেই: কিন্তু মর্মান্তিক।’

আমার ছাত্রজীবনের সময়টাকে বলা যেতে পারে ‘স্বর্ণযুগ’। স্বপ্ন দেখার কাল। সদ্য স্বাধীন এবং তার পরের অবস্থা। দেশ বিভাগের ধাক্কা মেনে নিতে হলেও তরুণ ভারত সহিষ্ণু। হবে, হবে, অনেক কিছু হবে। সাহিত্যে, শিল্পে, সংগীতে রেনেসাঁস। মধ্যবিত্ত পরিবারে প্রচুর সমস্যা থাকলেও, মচকেছে, ভাঙেনি। ধর্ম, আদর্শ, নৈতিকতা— জীবন-তানপুরার তিনটি তারে ধ্রুপদী জীবনের ঝংকার। বিষয়ী মানুষের চেয়ে জ্ঞানী মানুষের সংখ্যা বেশি। পাড়ায় পাড়ায় লাইব্রেরি। বই পড়া একটা নেশার মতো। বড় বড় সাহিত্যিক, সংগীতশিল্পী, চিত্রকর, ভাস্কর, অভিনেতা, অভিনেত্রী, পরিচালক। তারাভরা আকাশ।

কিন্তু শাসন! ছাত্রজীবনে স্বাধীনতা খড়ি দিয়ে ঘেরা। লেখাপড়া করে আগে মানুষ হও, প্রতিষ্ঠিত হও, তার পর খোঁজ নাও ভেতরে অন্য প্রতিভা কী আছে। কিন্তু স্বপ্ন দেখা তো অনেক আগেই শুরু হয়। তরুণ বয়সের উপসর্গ। তখন দুঃখে দুঃখ থাকে না, বিপদে বিপদ থাকে না, জীবনে মৃত্যু থাকে না। সময়ের সবটাই বর্তমান। অতীত নেই, ভবিষ্যৎ নেই। কিন্তু প্রেম, দেশপ্রেম নয়, অন্য রকমের একটা প্রেম। যার নাম ভালবাসা। এক জন ‘সে’। যেন অন্তঃসত্ত্বা হয়েছি। ভীষণ আনন্দদায়ক একটা বেদনা। নিত্যকার বেঁচে থাকার আড়ালে কী যেন একটা রয়েছে! অনুভূতি! পাশের বাড়ির মেয়েটি হঠাৎ এমন অসাধারণ হয়ে উঠল কী করে? তার অসাধারণত্ব তার বাড়ির কেউ দেখতে পাচ্ছে না কেন? আমার চোখে যে নায়িকা, অন্যের চোখে সে নিতান্তই সাধারণ একটি মেয়ে। কর্কশ গলায় তার মা একতলা থেকে চেঁচাচ্ছেন, ‘অ্যায় উমা! এখন কি ছাতে উঠে আকাশ দেখার সময়! সব বেরোবে, সৃষ্টি কাজ পড়ে আছে।’

আমরা কলেজেপড়া চার-পাঁচ জন গঙ্গার ধারের জেটিতে প্রতি শনিবার বিকেলে মিলিত হই। আমাদের ছোট্ট দলটির মাথায় ঢুকেছিল সাহিত্যচর্চা। কিছু লিখব আমরা। সপ্তাহে এক দিন কোথাও বসে পড়া হবে। আলোচনা, সমালোচনা হবে। যার যেমন লিখতে ইচ্ছা করবে। বাধ্যবাধকতা নেই। এক বন্ধুর কৃপায় বড় রাস্তার ওপরে সম্পূর্ণ একানে একটি ঘর ও তক্তপোশ পাওয়া গেল। উলটো দিকে চায়ের দোকান, তেলেভাজার দোকান। বিহারি ভুজাঅলা মুড়ি, ছোলা, বাদাম ভাজছে। সাহিত্যের বিকাশের জন্যে এই সব উপাদানের খুব প্রয়োজন। আর, একটু দূরেই গঙ্গা। গঙ্গাই আমার মা, কারণ ঠিকমত জ্ঞান হওয়ার আগেই মা’কে হারিয়েছি। শুধু মা কেন, যখন স্কুলে পড়ি তখন সংসারে বাবা ছাড়া কেউ নেই। নিঃসঙ্গ বালক। আকাশ, গাছ, মাঠ, পাখি, নির্জন মন্দিরে দীর্ঘ শিবলিঙ্গ, খোলা জানলায় সুন্দর মুখ, সামনে ঝুঁকে পড়া প্রৌঢ়া, নৌকার মাঝি, ঘাটের সিঁড়ির আরোহণ, অবরোহণ— এই সবই আমার জীবনপথের সঙ্গী। একটা চাপা অভিমান— কেউ আমাকে ভালবাসে না কেন!

ভোরবেলা এক বনেদি প্রৌঢ়, তাঁর সুন্দরী পুত্রবধূকে নিয়ে গঙ্গার ধারে বেড়াতে আসতেন। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি, ধুতি। হাতে ছড়ি, সোনার ফ্রেমের চশমা, টকটকে ফরসা। আভিজাত্য ঝরে পড়ছে। দুজনের কী মধুর সম্পর্ক! মাঝে মাঝে ছড়ি তুলে এটা-ওটা দেখাচ্ছেন। কত সুখ, কত সুখী! তখনই আবিষ্কার করলুম, কেউ সুখে থাকলে ভীষণ ভাল লাগছে। আমার ভেতরেও একটা সুখ-সুখ ভাব আসছে। গঙ্গা যখন কানায় কানায় ভরে যেত, আমার কাছে ঠিক খবর আসত। আমি তখন কোনও একটা উঁচু জায়গা থেকে ঝপাং করে লাফিয়ে পড়তুম জলে। ঘাট থেকে ঘাটে সাঁতার দিয়ে চলেছি। তখন আমি কিশোর। মার খেয়েছি। বাড়ির কারও হাতে নয়, কেউ তো নেই। গঙ্গার ধারে রাধাগোবিন্দের মন্দির, লতাবিতান। থাকেন এক বৈষ্ণবী। তাঁরই এক সঙ্গী গঙ্গাদি। ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকত একটা ছড়ি নিয়ে, ‘তুই আয়, তার পর দেখাচ্ছি। কখন জলে পড়েছে, ওঠার নাম নেই। তোর মা কিছু বলে না কেন রে!’ যে দিন শুনল আমার মা নেই, কেমন পাথরের মতো হয়ে গেল। রূপকথার সেই গল্প, ‘নাকের বদলে নরুন পেলুম, টাক ডুমাডুম ডুম!’ মা গঙ্গার উপহার বৈষ্ণবী গঙ্গাদি। আজও দেখতে পাই, টিকোলো নাক, ফরসা ত্বক, শরীরে তুলসী-চন্দনের গন্ধ। কান ধরে জল থেকে টেনে তুলতে তুলতে বলছে, ‘বর্ষার এই ভরা গঙ্গা, এক দিন তুই ডুবে মরবি। চল তোকে বোর্ডিংয়ে দিয়ে আসি।’

সে এক আশ্চর্য চিন্তা। গভীর রাত, দোতলার ঘর। এক ফালি চাঁদের আলো। শুয়ে শুয়ে ভাবছি, গঙ্গাদি কি আমার মা হতে পারে না? বিছানার এই এতটা জায়গা ফাঁকা পড়ে আছে— দুধসাদা। দূর বোকা! বাবা না থাকলে মা আসবে কোথা থেকে! বাবা দ্বিতীয় বার বিবাহ করবেন না। ‘আমি ফাদার অ্যান্ড মাদার কম্বাইন্ড।’ অমন মানুষ আর দেখতে পাব না। ‘সেন্ট’। বছর দশেকের জন্যে সংসার করেছিলেন। রসায়ন, গণিত, সংগীত, সাহিত্য— এই ছিল তাঁর বিষয়। আর মন্ত্র— ‘সেল্ফ হেল্প ইজ দ্য বেস্ট হেল্প।’ ঘুমোবার অনেক সময় পাবে। এখন জেগে থাকো। যদ্দিন বাঁচো, তদ্দিন বাঁচো। তিনি ভাবতেন, আমি হলুম মায়ের রেখে যাওয়া এক ডেলিকেট উপহার। সন্তানকে ভালবাসা নতুন কথা নয়, কিন্তু তাকে শ্রদ্ধা করা? সন্তান পিতার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তুই আমার চেয়েও জ্ঞানী। ফল এই হল, আত্মবিশ্বাস ভীষণ বেড়ে গেল। পরে, জীবনের মাঝনদীতে এসে যখন স্বামীজিকে পেলুম, তখন দেখি তিনি বলছেন, ‘যে নিজেকে শ্রদ্ধা করে না, সে-ই সবচেয়ে বড় পাপী।’

আমাদের সেই সাহিত্যচক্রে যারা ছিল, তারা সব জীবনপথে অদৃশ্য হল। পড়ে থাকলুম আমি আর আমার গঙ্গা আর ইতিহাসের পদচিহ্ন। সবই তো হল, লেখার কী হল? হতেই হবে, এমন তো কোনও কথা নেই। লিখবে তো মন। সেই মন আরও খানিক জর্জরিত হোক। ব্লটিং পেপারের মতো আরও আরও দুঃখ-সুখ শুষে নিক জীবনপাত্র থেকে। ছাত্রজীবন শেষ হল। এই সময় ভীষণ বৈরাগ্য এল। ইতিমধ্যে গুরু লাভ করেছি। রামকৃষ্ণ মিশনের জ্ঞানী সন্ন্যাসী, উদ্বোধন পত্রিকার সম্পাদক শ্রদ্ধেয় স্বামী শ্রদ্ধানন্দ। অসাধারণ এক প্রভাব। ঠাকুর, মা, স্বামীজির জগতে প্রবেশ করিয়ে দিলেন।

শিক্ষকতা করতে গেলুম দেওঘর রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠে। উদ্দেশ্য, ঠিক এক বছরের মাথায় সন্ন্যাসী হব। হল না। বাবা একেবারে একা। হঠাৎ অসুস্থ হলেন। ফিরতে হল। আর ফেরা হল না। এই বার কলকাতার এক বিখ্যাত রাসায়নিক সংস্থায় চাকরি। সারা দিন ল্যাবরেটরিতে অ্যানালিসিস। হাতটা খুব ভাল ছিল। এমন সময় আমার পাড়ার এক শ্রদ্ধেয় দাদা একটি সিনেমা সাপ্তাহিক করলেন। বললেন, তোমাকে মদত দিতে হবে। এতেই প্রকাশিত হল আমার প্রথম গল্প।

কর্মক্ষেত্রে আমি যে কেমিস্টের অধীনে কাজ করতুম, তিনি গল্পটি পড়লেন। সকাল ন’টা। কাজের লম্বা টেবিলে বুনসেন বার্নার জ্বলছে। একটি তরল ডিস্টিল করছি। ফোঁটা পড়ছে টুপ টুপ শব্দে। তিনি এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে কানে কানে বললেন, ‘তোমার হবে। লেখা ছেড়ো না।’ পিঠে একটা হাত রাখলেন, আশীর্বাদের মতো। ছ’ফুট লম্বা, সাদা শার্ট, প্যান্ট, যেন ক্রিকেটার, সৌম্যসুন্দর। অপরিসীম ভদ্র। তাঁর নাম রবি বসু। আমাকে পতাকা নেড়ে তিনিই শুরু করিয়েছিলেন দুস্তর পথে যাত্রা। আমি আপনাকে ভুলিনি।

এর পরেই শুরু হল আমার সরকারি চাকরি জীবন। বিরাট পরিসরে খেলা। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশ। জনসংযোগ, গণসংযোগ, সংবাদমাধ্যম, প্রচার, প্রসার, সেমিনার, নিউজ লেটার, পুস্তিকা, টিভি, বেতার। শহর থেকে শহরে ছোটাছুটি। দেখাও তোমার ‘ক্যারিশমা’। বেশ জমে গেল। নকশাল আন্দোলন। চোখের সামনে খুনের পর খুন। আর এক শিবতুল্য মানুষ শ্রদ্ধেয় ভবানী মুখোপাধ্যায় আমার একটা গল্প প্রকাশ করলেন সাপ্তাহিক ‘অমৃত’ পত্রিকায়। দ্বিতীয় গল্পটি পড়ে বললেন, এটা তুমি ‘দেশ’ পত্রিকায় নিয়ে যাও। আমি বিমলকে বলে দিচ্ছি।

শ্রদ্ধেয় বিমল কর। বাংলা সাহিত্যের দিকপাল। ‘দেশ’-এর গল্প বিভাগের সর্বময়। গম্ভীর। দুগ্ধশুভ্র ধুতি-পাঞ্জাবি, ভয়ে কম্পমান আমি। চোখ একটি লেখায়। আমার দিকে না তাকিয়েই লেখাটি নিলেন। এই বার তাকালেন, ‘কী করেন?’ ‘এই করি সেই করি, জেলায় জেলায় শিল্প, জীবিকার সংস্থান।’ ‘বসুন।’ সিগারেট ধোঁয়া ছাড়ল। ‘একটা ধারাবাহিক লিখতে পারবেন, ‘জীবিকার সন্ধানে পশ্চিমবঙ্গ’? এক বছর। বাহান্ন সপ্তাহ।’’ জ্ঞান হারাতে পারতুম। হারাইনি। এই সব আত্মপ্রচার অসভ্যতা। ভাল লাগছে না। সেই ধারাবাহিক একটা হইচই। আপনি থেকে তুই। বিমলদা আমাকে বলতেন, ‘son’, আমি বলতুম ‘father’। সত্যই আমার দ্বিতীয় পিতা।

কিন্তু গল্প! প্রকাশিত হল ‘শ্বেতপাথরের টেবিল’। আবু সয়ীদ আইয়ুব শ্রদ্ধেয়, শ্রদ্ধেয়া গৌরী আইয়ুব একটি চিঠি লিখলেন, ‘... এই লেখক আর যদি কিছু না লেখেন তা হলেও বাংলা সাহিত্য তাঁর নাম থাকবে।’ তার পর? আমি হাসতে হাসতে কাঁদছি, কাঁদতে কাঁদতে হাসছি ‘সব হারানোর তীরে’, ‘লোটাকম্বল’ তুলে নেওয়ার সময় হল। কোথায় আমার সাগরদা! সেই মধুর, স্নেহঝরা ডাক— ‘সঞ্জীব, অনুমতি করো, বাড়ি যাই।’

sanjib chattopadhyay anandabazar rabibasariya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy