Advertisement
০৪ মে ২০২৪
মারিয়ো কেম্পেস

ইনি on উনি

বিশ্বকাপ এলেই আমার মনে পড়ে যায় ১৯৭৮-এর আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপের অবিসংবাদিত নায়ক মারিয়ো কেম্পেস-এর কথা। হ্যাঁ, ’৭৮-এ নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে ফাইনালে জোড়া গোল করা কেম্পেস, সে বারের টুর্নামেন্টে ‘গোল্ডেন বুট’-এর মালিক কেম্পেস, স্প্যানিশ লিগে ভ্যালেন্সিয়া ক্লাবের কিংবদন্তি কেম্পেস। ঝাঁকড়া, লম্বা চুলে, নীল-সাদা দশ নম্বর জার্সির গোল-মুখে দৌড় চোখের সামনে ভাসে এখনও।

কার্তিক শেঠ
শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০১৪ ০০:০৯
Share: Save:

বিশ্বকাপ এলেই আমার মনে পড়ে যায় ১৯৭৮-এর আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপের অবিসংবাদিত নায়ক মারিয়ো কেম্পেস-এর কথা। হ্যাঁ, ’৭৮-এ নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে ফাইনালে জোড়া গোল করা কেম্পেস, সে বারের টুর্নামেন্টে ‘গোল্ডেন বুট’-এর মালিক কেম্পেস, স্প্যানিশ লিগে ভ্যালেন্সিয়া ক্লাবের কিংবদন্তি কেম্পেস। ঝাঁকড়া, লম্বা চুলে, নীল-সাদা দশ নম্বর জার্সির গোল-মুখে দৌড় চোখের সামনে ভাসে এখনও।

’৭৮-এ, আমি কলকাতায়। জুনিয়র যুব ফুটবল খেলে ফেলেছি ওই ’৭৮-এই। চোখে স্বপ্ন, বল-পায়ে দৌড়তে দৌড়তে ভাবি, ভাল, আরও ভাল, খুব ভাল খেলতে হবে আমাকে। উঠতি-ফরোয়ার্ড হিসেবে তখন মাঠ থেকে, প্রতিটা ম্যাচ থেকে, আইকন-আইডল হিসেবে চোখে বা মনে যাঁরা তাঁদের থেকে আঁজলা ভরে তুলে নিচ্ছি স্বপ্নপূরণের যত উপকরণ। ভাবছি, এই শটটা ‘ওঁদের মতো’ কী ভাবে নেওয়া যায়, ওই মুভটা ঠিক ‘ওঁর মতো’ আমারও আয়ত্তে আসবে কেমন করে। ওঁদের খেলার ভঙ্গিমা, দৌড়, পজিশন-জ্ঞান, গোল চেনার ইনস্টিংক্ট, সব কিছুর ওপর আমার নজর। সেই সব কিছু নিয়েই আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন কেম্পেস। লম্বা, ঝকঝকে চেহারার ফরোয়ার্ড। শর্ট হাইটের স্ট্রাইকার-ফরোয়ার্ডদের আমার খুব একটা পছন্দ ছিল না। তখন আন্তর্জাতিক সব ম্যাচ দেখে বুঝছি, ফুটবলারদের উচ্চতাটা খুব জরুরি ফ্যাক্টর। শর্ট হাইটের খেলোয়াড়ের স্টেপিং আর লম্বা ফুটবলারের স্টেপিং-এর তফাত অনেকটা। মাঝমাঠ থেকে বা উইং ধরে ছুটবার সময়, এমনকী বক্সের মধ্যেও লম্বা স্ট্রাইডওয়ালা খেলোয়াড় দারুণ অ্যাডভান্টেজ পান। কম উচ্চতার ফুটবলারকে ডজ করা বা সহজেই নিজের গ্রিপে নিয়ে নেওয়াটা ওঁদের পক্ষে আসান হয়ে যায়। কেম্পেসের ওই আদর্শ ফরোয়ার্ডসুলভ হাইট আমার দারুণ লাগত।

খবরকাগজে পড়তাম, কেম্পেস প্রচুর গোল করতেন ডিফেন্ডারকে ডজ করে, বা ডাইভ-ইন কায়দায়। এখনকার ছেলেরা কেউ দেখি মাটিতে ডাইভ-ই দিতে চায় না! অথচ, এটা কিন্তু দারুণ একটা স্ট্র্যাটেজি। আমি যখন ডাইভ করে গোল করতে যাব, বিপক্ষের ফুটবলারকে হয় তখন আমাকে লাথি মারতে হবে, বা যেনতেনপ্রকারেণ বলটা ক্লিয়ার করতে হবে। ডাইভ-ইন করলে, মানে শরীরটাকে থ্রো করে দিলে স্বাভাবিক ভাবেই বলের কাছে আগে পৌঁছনো যায়, সেটাও মস্ত সুবিধে।

তিনটে বিশ্বকাপে খেলেছেন কেম্পেস: ’৭৪, ’৭৮ আর ’৮২। এর মধ্যে ’৭৮-এ আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন, আর অন্য দু’বার দ্বিতীয় পর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছিল। ’৭৮-এ কিংবদন্তি কোচ সিজার লুই মেনোত্তির বিশ্বকাপ স্কোয়াডে কেম্পেসই একমাত্র ফুটবলার যিনি বিদেশি ক্লাবে খেলতেন, স্পেনের ভ্যালেন্সিয়ায়। ওঁর জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়াও এক গল্প। কোচ ঠিকই করে নিয়েছিলেন, বিদেশে খেলা কাউকে বিশ্বকাপের দলে রাখবেন না। পরে কোচের মত-বদলে কেম্পেস সুযোগ পান। প্রথম পর্বে একটাও গোল করতে পারেননি, কিন্তু সেকেন্ড রাউন্ডে ওঠা দলগুলো দেখল ‘এল মাতাদোর’-এর জাদু। পোল্যান্ড ম্যাচে কেম্পেস চমৎকার দুটো গোল করেছিলেন, পেরু ম্যাচেও দুটো। তার পর ফাইনালে ডাচদের বিরুদ্ধে আবার জোড়া গোল, একটা প্রথমার্ধে, একটা অতিরিক্ত সময়ে। কেম্পেস ছাড়াও দলে ছিলেন ফরোয়ার্ড লিওপোল্ডো লুকে, বা মিডফিল্ডার ড্যানিয়েল বার্তোনি। কিন্তু সেই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার মুখ ছিলেন কেম্পেসই। সোনার বুট আর সোনার বল, দুটোই জিতে নিয়েছিলেন।

কেম্পেসের স্টাইল, ওঁর অ্যাটিটিউড, মাঠে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় চকিত শিফ্টিং, সব কিছু ছিল অসাধারণ। আমিও দেখে দেখে ফলো করার চেষ্টা করতাম। ’৭৮-এ তো আর এখানে ঘরে ঘরে টেলিভিশন ছিল না। পাড়ায় হাতে গোনা ক’টা বাড়িতে টিভি থাকত, বা দু’একটা স্কুলে, ক্লাবে। তা-ও দূরদর্শন শুধু কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল আর ফাইনাল দেখাত। আমরা খেলোয়াড়রা খেলার রেকর্ডিং বা রিপিট টেলিকাস্টই দেখতাম। এমনিতে দল হিসেবে ব্রাজিল আমার দারুণ পছন্দের, কিন্তু খেলোয়াড় হিসেবে জিকো-র চেয়ে কেম্পেসকেই ভাল লাগত। জিকো একটু ডিপ থেকে খেলতেন, বল-পায়ে দারুণ বুদ্ধি করে গোল করতেন। কিন্তু কেম্পেস যে ভাবে গতিকে ব্যবহার করতেন, দুর্দান্ত হেড করতেন, মাঠে পজিশন পালটাতেন, অভাবনীয়! এক কথায় বললে, আদর্শ স্ট্রাইকারের যা যা গুণ থাকা দরকার, সব ওঁর ছিল। স্ট্রাইকিং জোনটাকে চিনতেন হাতের তালুর মতো।

কেম্পেসের আর একটা বলার মতো বিষয় ছিল ওঁর ‘ফেয়ার প্লে’। গোটা আন্তর্জাতিক কেরিয়ারে এক বারও ‘বুক্ড’ হননি। মানে রেফারির কার্ড দেখে মাঠের বাইরে যেতে হয়নি কোনও দিন। অকল্পনীয়! আমার কাছে এ ব্যাপারটার আলাদা একটা গুরুত্ব আছে, কারণ ফুটবল-জীবনে আমিও কোনও দিন লাল কার্ড দেখিনি। নিজের ঢাক পেটানোর প্রশ্নই নেই, কিন্তু ফুটবলের জ্ঞানগম্যিওলা যে কেউ জানবেন, ফরোয়ার্ড পজিশনে খেলা এক জন ফুটবলার কতটা মাথা ঠান্ডা রেখে খেললে গোটা কেরিয়ারে একটাও লাল কার্ডের দাগ থাকে না!

পরে, ওঁর খেলার ভিডিয়ো ক্যাসেট করে নিয়ে ছেলেদের দেখিয়েছি। উদ্দেশ্য, উনি মাঠে কোথায় দাঁড়াচ্ছেন, কখন কোন পজিশনে যাচ্ছেন, কখন স্টার্ট নিচ্ছেন, কখন ‘অফ দ্য বল’ থাকছেন আর কখনই বা ‘উইদাউট বল’, এগুলো খুঁটিয়ে দেখে নিজের খেলায় মিশিয়ে নেওয়া। ওঁর মতো আমিও চেষ্টা করতাম ‘উইদাউট বল’টা বেশি খেলতে। মানে, যে আমাকে বলটা বাড়াচ্ছে, তাকে নতুন একটা জায়গা দেখিয়ে দেওয়া যে, তুমি ওখানে বলটা রাখো। আমিই খুঁজে বার করছি গোল করার জায়গাটা।

আশির দশকে অনেকগুলো খেলা-সংক্রান্ত বাংলা ম্যাগাজিন বেরোত। ‘খেলা’, ‘খেলার আসর’, ‘খেলার গ্যালারি’। সেখান থেকে, খবরকাগজ থেকে কেম্পেস-এর ছবি কেটে জমাতাম। ইস্টবেঙ্গলে যখন খেলছি, গ্যালারি থেকে আমাকে ‘জিকো’ বলে ডাকত। এ দিকে আমি মনে মনে কেম্পেসের মতো খেলার স্বপ্নে বুঁদ। ওঁর মতো বড় চুলও রেখেছিলাম সাধ করে।

ছিয়াশি বিশ্বকাপের মারাদোনা কিন্তু কেম্পেসেরই উত্তরাধিকার। মারাদোনাকেই কেম্পেস তাঁর দশ নম্বর জার্সি দিয়ে যান। বাকিটা তো ইতিহাস। আত্মজীবনীতে মারাদোনা লিখেছেন, বিশ্বের ফুটবল-মানচিত্রে আর্জেন্টিনাকে বসিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন যিনি, তিনি মারিয়ো কেম্পেস। এক কিংবদন্তিকে আর এক কিংবদন্তির শ্রদ্ধার্ঘ্য!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kartik sheth mario kempes
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE