Advertisement
১৬ মে ২০২৪
রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ৪....

ইনিonউনি

গ্লোরিয়া স্টাইনেমদুনিয়ায় হরেক রকম নারীবাদ আর নারীবাদী। সব নারীবাদ আর নারীবাদীকে আমার পছন্দ নয়। যে ক’জন নারীবাদীর প্রায় সব মতের সঙ্গে আমি একমত, তাঁদের মধ্যে গ্লোরিয়া স্টাইনেম অন্যতম। গ্লোরিয়া মিষ্টি হেসে গা-জ্বলে-যাওয়া অপ্রিয় সত্য কথাগুলো বলেন।

তসলিমা নাসরিন
শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:০০
Share: Save:

দুনিয়ায় হরেক রকম নারীবাদ আর নারীবাদী। সব নারীবাদ আর নারীবাদীকে আমার পছন্দ নয়। যে ক’জন নারীবাদীর প্রায় সব মতের সঙ্গে আমি একমত, তাঁদের মধ্যে গ্লোরিয়া স্টাইনেম অন্যতম। গ্লোরিয়া মিষ্টি হেসে গা-জ্বলে-যাওয়া অপ্রিয় সত্য কথাগুলো বলেন। গা-জ্বলে-যাওয়া অপ্রিয় সত্য কথা, লোকে বলে, আমিও বলি। তবে আমার মুখে হাসির বদলে বড্ড রাগ থাকে, এই যা তফাত। অপ্রিয় সত্য বলতে শুরু করেছি খুব অল্প বয়স থেকেই, গ্লোরিয়া স্টাইনেমের নামই তখন শুনিনি, ওঁর সম্পর্কে কিছু জানার তো প্রশ্ন ওঠে না।

গ্লোরিয়াকে এক দিন কথায় কথায় বলেছিলাম, আপনার ওই কথাটা দারুণ লাগে। ওই যে বলেছিলেন না, ‘উইমেন উইদাউট মেন, ফিশ উইদাউট বাইসাইকেল’! গ্লোরিয়া হেসে বললেন, ‘ওটি কিন্তু আমার কথা নয়।’ ‘আপনার নয়? বলছেন কী? তামাম দুনিয়া জানে, আপনি বলেছেন!’ ‘ওটি অস্ট্রেলিয়ার এক মহিলার কথা। কে যে আমার নামে প্রচার করেছে, জানি না!’ শুনে মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ওই মাছ আর সাইকেলের চমত্‌কার ওয়ান-লাইনারটা গ্লোরিয়ার নামের সঙ্গে এমন সেঁটে আছে যে, গ্লোরিয়া বললেও আমার বিশ্বাস হতে চাইছিল না ওটি ওঁর নয়।

তা হঠাত্‌ বিয়ে করতে গেলেন কেন, এই প্রশ্নটা আমি করেছিলাম। সবাইকে যে উত্তর দেন, আমাকেও সেটাই দিয়েছেন। ‘তিরিশ বছর ধরে বিয়ের নিয়মটিয়মগুলো বদলাবার জন্য সংগ্রাম করেছি, সেই সংগ্রামের ফলে বিয়েতে নারী-পুরুষের সমতা এসেছে। সেই সমতাটা উপভোগ করার জন্যই বিয়ে করেছি। আর বিয়ের কারণে ডেভিডের নাগরিকত্ব পেতে সুবিধে হয়েছে। বেচারার ব্রেন লিম্ফোমার চিকিত্‌সায় আমার ইনশিয়োরেন্সটা কাজে লেগেছে।’ ডেভিড বেল-এর বিয়ে হল, দু’বছরের মাথায় ব্রেন লিম্ফোমা হল, তিন বছরের মাথায় মৃত্যু হল। বেঁচে গেছেন ডেভিড। গ্লোরিয়াকে আজও পাঠকের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়, জবাব দিতে হয়, কেন তিনি বিয়ে করেছিলেন। আমি অতশত সংগ্রাম, সমতায় না গিয়ে বরং বলব, প্রথাটা কিন্তু চমত্‌কার ভেঙেছিলেন। বিয়ের সময় গ্লোরিয়ার বয়স ছিল ৬৬, ডেভিডের ৫৯।

বিয়ে নিয়ে গ্লোরিয়া কি কম বলতেন! ‘যদি পায়ে জুতো না আঁটে, তবে কি পা-টা কেটে ফেলা উচিত?’ আমরা জানি, পা কেটে ফেলা উচিত নয়, জুতোটা বরং ফেলে দেওয়া উচিত। জুতো বলতে গ্লোরিয়া সম্ভবত স্বামী বুঝিয়েছেন! আমরাও জানি, স্বামীর সঙ্গে না বনলে, সংসারে অশান্তি হলে স্বামীকে ত্যাগ করাই উচিত। কিন্তু জুতোর প্রসঙ্গ আনায় জুতসই হয়েছে উপমা। গ্লোরিয়া বলেছেন, ‘স্বাধীন নারী সে-ই, যে বিয়ের আগে সেক্স করে আর বিয়ের পরে চাকরি।’ যেহেতু পুরুষতান্ত্রিক নিয়ম অনুযায়ী বিয়ের আগে সেক্সটা আর বিয়ের পরে চাকরিটা মেয়েদের জন্য বাধা ছিল, তাই প্রতিবাদ করেছেন। আজকাল অবশ্য মধ্যবিত্ত পুরুষরা চাকরিরতা মেয়েদের বিয়ে করতে ব্যাকুল। আগে পরনির্ভর স্ত্রীর ওপর তারা কর্তৃত্ব খাটিয়ে পৌরুষের আরাম নিত। এখন স্বনির্ভর স্ত্রীর টাকাকড়ি কোথায়, কী খাতে ব্যয় হবে, সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে পুরুষ হওয়ার সুখটা ভোগ করে। গ্লোরিয়ার সেই বাণীটি মনে আছে? ‘সব মেয়েই সংসার, সন্তান আর চাকরি কী করে সামলাবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করে। আমি এখনও অপেক্ষা করছি সেই পুরুষের জন্য, যে জানতে চাইবে চাকরিটা আর সংসারটা একই সঙ্গে কী করে সামলাবে!’ সত্যিই, পুরুষরা যদ্দিন না বুঝবে নারী-পুরুষের বৈষম্য ঘুচলে, শুধু নারী নয়, পুরুষও লাভবান হবে, অথবা নারীর চেয়ে বেশি লাভবান পুরুষই হবে, তদ্দিন সম্ভবত তারা সমানাধিকারে বাগড়া দিয়ে যাবে। গ্লোরিয়া প্রায়ই বলেন, ‘পুরুষেরা যে সব কাজ করতে পারে, দেখিয়েছি যে আমরা মেয়েরাও সে সব করতে পারি। কিন্তু পুরুষেরা এখনও দেখাল না, মেয়েরা যা করতে পারে, তা তারাও করতে পারে। এখনও প্রমাণ করল না যে, পুরুষেরাও শিশুদের লালন-পালন করতে পারে।’ চাইল্ডকেয়ারটা পুরুষরা করতে চায় না, কারণ তারা মনে করে এটি মেয়েদের কাজ। পুরুষরা অন্ধকারেই পড়ে থাকবে যদ্দিন না যে সব কাজকে মেয়েদের কাজ বলে তারা বিশ্বাস করে, সে সব কাজ করে তারা গৌরব বোধ করে। মেয়েরা জেলে থেকে জেলার, মিস্ত্রি থেকে মিলিটারি, শ্রমিক থেকে শাসক কী-ই না হয়েছে! প্রমাণ করেছে, পুরুষের কাজ বা মেয়েদের কাজ বলে আলাদা কিছু নেই। কিন্তু কেবল মেয়েরা এগোলে তো চলবে না। পুরুষকেও লজ্জা, দ্বিধা, ভয় সরিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

রবিন মর্গান আর জেন ফন্ডা-কে সঙ্গে নিয়ে গ্লোরিয়া ‘উইমেন মিডিয়া সেন্টার’ খুলেছেন সারা বিশ্বের মেয়ে-সাংবাদিকদের দুঃসময়ে পাশে থাকার জন্য। ‘উইমেন আন্ডার সিজ’ নামেও একটা সংগঠন তৈরি করেছেন যুদ্ধে আক্রান্ত মেয়েদের সাহায্য করবেন বলে। সমাজটাকে সভ্য করছেন, মানুষগুলোকে ভাবতে শেখাচ্ছেন, আশি বছর বয়সে পৌঁছেও গুনে-শেষ-হয় না এত কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছেন। এই জীবনকেই বলে অর্থপূর্ণ জীবন! নারীবিদ্বেষী নিন্দুকেরা গ্লোরিয়াকে ডাকে ‘ফেমিনাত্‌সি’ বলে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে হেনস্তা না হওয়া মানে তুমি ঠিকমত সমাজটাকে ঠ্যাঙাওনি। সে দিক থেকে গ্লোরিয়া সার্থক।

গ্লোরিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অনেক কালের। পঞ্চাশের দশকে স্কলারশিপ নিয়ে ভারতে এসেছিলেন, বছর দুই ছিলেন। ভারত তাঁকে, তিনি বলেন, অনেক কিছু শিখিয়েছে। এখনও সুযোগ পেলেই গ্লোরিয়া ভারতে বেড়াতে আসেন। আজকাল আসেন রুচিরা গুপ্তর ‘অপনে আপ’-এর কাজে। এই সংগঠনটির কাজ হল মেয়ে-পাচার আর পতিতাবৃত্তি থেকে মেয়েদের বাঁচানো। বিল গেট্স আর মেলিন্ডা গেট্স যা করছেন, তার ঠিক উলটোটা করছেন গ্লোরিয়ারা। গেট্সরা পতিতাবৃত্তি বরণ করতে যে মেয়েদের বাধ্য করা হয়েছে, তাদের চিকিত্‌সা-টিকিত্‌সার জন্য টাকা খরচ করছেন, পতিতাবৃত্তি বিলুপ্তির জন্য নয়। ‘অপনে আপ’-এর উদ্দেশ্য পতিতাবৃত্তির বিলুপ্তি। পতিতাবৃত্তিতে, গ্লোরিয়ার মতে, কেউ শখ করে আসে না, যারাই আসে প্রতারিত হয়ে আসে, বা আসতে বাধ্য হয় বলে আসে। কিছু মেয়ে অন্য রোজগারের আরও পথ খোলা থাকা সত্ত্বেও শরীর বেচার রোজগার বেছে নেয়। এদের সংখ্যাটা অতি সামান্য। পতিতাপ্রথা অনেকটা ক্রীতদাস প্রথার মতো। দুই প্রথারই মূলে আছে খাঁটি দাসত্ব। শুধু পরিচয়টা দু’ক্ষেত্রে ভিন্ন হতে হয়। পতিতাপ্রথার জন্য দরকার যৌন পরিচয়, ক্রীতদাসপ্রথার জন্য বর্ণ পরিচয়।

গ্লোরিয়া পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধেও লড়ছেন। তিনি পর্নোগ্রাফিতে নয়, ইরোটিকায় বিশ্বাস করেন। তিনি মনে করেন, এদের নামের মধ্যেই আছে এদের পরিচয়। ইরোটিকার সঙ্গে সম্পর্ক ইরোটিক প্রেমের গ্রিক দেবতা ইরোস-এর। ইরোটিকায় দেখানো হয় ‘লাভ-মেকিং’। পর্নোগ্রাফিতে ‘লাভ-মেকিং’-এর প্রশ্ন নেই, কারণ ওতে প্রেম-ভালবাসার ব্যাপারই নেই। গ্রিক শব্দ ‘পর্নো’ মানে যৌনদাসী। পর্নোগ্রাফিতে যৌনদাসীর ওপর দেখি পুরুষের আধিপত্য। সোজা বাংলায়, পর্নোগ্রাফিতে একটি পুরুষ বা বা অনেকগুলো পুরুষ যেমন খুশি, যে ভাবে খুশি এক বা একাধিক মেয়েকে ধর্ষণ করে। শরীরে যন্ত্রণা হলেও মুখে হাসিটা রাখতে হয় মেয়েদের, ভেতরে ‘না’ বললেও বাইরে ‘হ্যঁা’ বলতে হয়। মেয়েরা তখন আর মেয়ে নয়, মানুষও নয়, পর্নোগ্রাফি তাদের আক্ষরিক অর্থেই যৌনবস্তু বানিয়ে ছাড়ে। ভায়োলেন্সের মাত্রা যত বাড়ে, পর্নো-দর্শক তত বাড়ে। নারীবিদ্বেষী সমাজ নারীর বিরুদ্ধে ভায়োলেন্সকে ‘ইরোটিসাইজ’ করে। গ্লোরিয়া আহ্বান জানিয়েছেন নারী-পুরুষের সমানাধিকারকে বরং ‘ইরোটিসাইজ’ করতে।

পর্নোগ্রাফি এবং পতিতাপ্রথার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে নারী আর শিশু পাচার। এ সবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন, এমন নারীবাদীর সংখ্যা খুব কম। যৌন-ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানগুলোর এখন বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য। আমাদের মতো ক’টা নারীবাদীকে গলা কেটে ফেলে রাখা তাদের কাছে কিছুই নয়। তার পরও আমরা মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকি না, যা বলার তা বলি। আমি বলি। গ্লোরিয়া তো বলেনই।

এই ‘ইনি on উনি’ কেমন লাগল? মন্তব্য করতে, এই ফেসবুক পেজ-এ যান: www.facebook.com/anandabazar.abp

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE