Advertisement
০২ মে ২০২৪

ইশকুলের শাস্তি

কেউ ডাস্টার ছুড়ে মারতেন, কেউ পেছনে সপাসপ বেত। কেউ বিশেষ ধরনের নিলডাউন করাতেন। স্যররা বলতেন, মার না খেলে বড় হয়ে আতুপুতু হয়ে থাকবি।জীবনবিজ্ঞান বইয়ের ভাঁজে শ্রীদেবীর ছবি রেখে দেওয়ার অপরাধে নিজের হাতে নিজের গালে ঠাটিয়ে থাপ্পড় মারতে হয়েছিল ক্লাস সেভেনের ছেলেকে। স্যরের নিয়ম ছিল, থাপ্পড়ের জোর এমন হতে হবে, গালে লাল ছোপ পড়ে যাবে! যত ক্ষণ না গাল লাল হচ্ছে, নিজেকে মেরে যেতে হবে। শাস্তিটা বেশি প্রয়োগ হত ফরসা ছাত্রদের ক্ষেত্রে। গাল লাল হল কি না সেটা স্যর সহজে বুঝতে পারতেন। যথেষ্ট লাল না হলে, স্যর একটা ‘রাম থাপ্পড়’ মেরে কাজ শেষ করে দিতেন। স্যররা বলতেন, মার না খেলে বড় হয়ে ‘আতুপুতু’ হয়ে থাকবি। মাঝেমধ্যে মার খাওয়া ভাল। মন ও শরীর শক্ত হয়।

ছবি: সুমন চৌধুরী

ছবি: সুমন চৌধুরী

আর্যভট্ট খান
শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

জীবনবিজ্ঞান বইয়ের ভাঁজে শ্রীদেবীর ছবি রেখে দেওয়ার অপরাধে নিজের হাতে নিজের গালে ঠাটিয়ে থাপ্পড় মারতে হয়েছিল ক্লাস সেভেনের ছেলেকে। স্যরের নিয়ম ছিল, থাপ্পড়ের জোর এমন হতে হবে, গালে লাল ছোপ পড়ে যাবে! যত ক্ষণ না গাল লাল হচ্ছে, নিজেকে মেরে যেতে হবে। শাস্তিটা বেশি প্রয়োগ হত ফরসা ছাত্রদের ক্ষেত্রে। গাল লাল হল কি না সেটা স্যর সহজে বুঝতে পারতেন। যথেষ্ট লাল না হলে, স্যর একটা ‘রাম থাপ্পড়’ মেরে কাজ শেষ করে দিতেন।

স্যররা বলতেন, মার না খেলে বড় হয়ে ‘আতুপুতু’ হয়ে থাকবি। মাঝেমধ্যে মার খাওয়া ভাল। মন ও শরীর শক্ত হয়। পড়াশোনায় ভাল ছেলেরা আমাদের কাছে হিরো ছিল না। যারা স্যরের কাছে নিয়ম করে মার খেত ও অবলীলায় সহ্য করত, তারাই ছিল স্টার। আমাদের এক বন্ধু উপদেশ দিয়েছিল, স্কুলে যখন আসবি, একটু কম খেয়ে আসবি। তা হলে দেখবি মার খেলেও কম ব্যথা লাগবে। পেট ভর্তি খাবার খেয়ে মার খেলে, খুব লাগে।

স্কুলের মাঠে কবাডি খেলতে গিয়ে হাঁটু ছড়ে রক্ত বেরিয়ে গেলে যেমন পাত্তা দেওয়া হয় না, তখন সে রকমই মারকে পাত্তা দেওয়া হত না। বাড়িতে এ সব নিয়ে নালিশ করার প্রশ্নই ওঠে না। তা হলে বরং বাবা-মা আর এক চোট মারতেন।

মারার আগে এক জন স্যর বেশ স্টাইল করে ঘড়ি, মানিব্যাগ খুলে টেবিলে রাখতেন। পাঞ্জাবির পকেটে কিছু থাকলে সেটাও টেবিলে রাখতেন। তার পর হাতা গুটিয়ে বলতেন, এ দিকে আয়। এর পর কনুই দিয়ে, পিঠে মারতেন। যেন হাতুড়ি পড়ত। কনুই দিয়ে মারতেন বলে, যত জোরেই লাগুক, কোনও শব্দ হত না। এটা ছিল ‘সাইলেন্ট’ মার।

কয়েক জন স্যর অবশ্য পিঠে গুপগুপ করে এমন কিল মারতেন, ক্লাসের বাইরে থেকেও শোনা যেত। মনে হত ভাদ্র মাসে তালগাছ থেকে মাটিতে তাল পড়ছে। আমরা বলতাম ইংরেজি স্যরের ক্লাসে আবার তাল পড়া শুরু হয়েছে।

নিলডাউন তো অনেক স্যরই করান, কিন্তু এক জন একটা বিশেষ রকমের নিলডাউন করাতেন। হাঁটু গেড়ে বসে, হাত দুটোকে দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে নিয়ে গিয়ে কান ধরতে হবে। শাস্তি-পাওয়া ছাত্রকে দেখতে তখন অনেকটা ব্যাঙের মতো লাগে।

এক জন স্যর তো আবার ক্লাসে এসেই বই খোলার আগেই বলতেন, কোথায় গেল সব হিরো হিরালালরা? আজকে কী বদমাইশি করলি? লাস্ট বেঞ্চে তখন তটস্থ ভাব। সেখান থেকে কোনও একটা ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, বল দেখি ইংরেজিতে এরোপ্লেন বানান কী? সে হয়তো ভুল করে ঠিক উত্তর দিল। স্যর চমকে গেলেন, তবে হাল ছাড়লেন না। ফের একটা প্রশ্ন করলেন। সেটাও কোনও ভাবে হয়তো ঠিক হয়ে গেল। স্যরের তো হাত নিশপিশ করছে। ফের একটা প্রশ্ন। এ বারও ঠিক উত্তর। এ বার স্যর বললেন, তোকে গতকাল রাস্তায় দেখলাম বাজারের মধ্যে দাঁড়িয়ে হাঁ করে হিন্দি সিনেমার পোস্টার দেখছিলি। বড় বেশি পেকেছিস না? বলেই সাঁই সাঁই করে দুটো ছড়ির বাড়ি পড়ল পিঠে।

এক জন বন্ধু ছিল, মার খেয়ে খেয়ে মার খাওয়াটাকে জলভাতে পরিণত করেছিল। ক্লাসের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে বলে স্যর তার পিঠে একের পর এক কিল মেরে যাচ্ছেন, আর সে সমানে দাঁতে দাঁত চেপে বলে যাচ্ছে ‘জলভাত’। এক একটা কিল, আর তার জবাব, ‘জলভাত’। শেষ পর্যন্ত স্যর কিল মেরে ক্লান্ত কিন্তু তার জলভাত বলা থামল না। পরে ক্লাস থেকে বেরিয়ে সে বলল, দেখলি, কেমন জিতলাম?

এক জন স্যরকে অবিকল মিঠুন চক্রবর্তীর মতো দেখতে ছিল, তাঁকে আমরা নাম দিয়েছিলাম ‘মিঠুন স্যর’। এক অতি উৎসাহী ছাত্র এক বার আবিষ্কার করল স্যরের বান্ধবীর নাম। তাকে নাকি স্যরের মোটরবাইকের পেছনে দেখা গিয়েছে। এক দিন যখন স্যর ক্লাসে ঢুকছেন, কিছু ছেলে সমস্বরে স্যরের বান্ধবীর নাম চিৎকার করে বলে উঠল। স্যর বললেন, আজ আর তোদের নতুন পড়া পড়াব না। তোরা তো আমাকে মিঠুন বলিস, দেখি তোরা কে কে মিঠুনের দশটা সিনেমার নাম বলতে পারিস। আমরা তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। পাড়ার ভিডিয়ো হলে মাঝেমধ্যে পাঁচ টাকার ব্যালকনির সিটে বসে মিঠুনের সিনেমাও দেখেছি। কিন্তু দশটা সিনেমার নাম! অসম্ভব ব্যাপার। স্যর বললেন, ভেবেচিন্তে বল। তবে একটা বিশেষ পদ্ধতিতে ভাবতে হবে। প্রত্যেকে তার সামনের ডেস্কের নীচে মাথাটা ঢুকিয়ে দিয়ে মিঠুনের সিনেমার নাম ভাববে। এর পর ডেস্কের ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে ঘাড় গুঁজে ১৫ মিনিট থাকতে হয়েছিল। শাস্তিটা দেখতে অনেকটা হাড়িকাঠে মাথা দেওয়ার মতো। কষ্টটাও সে রকমই প্রায়। বেরিয়ে এসে ঘাড়ে হাত বোলাতে বোলাতে আমরা বলাবলি করলাম, বান্ধবীর নামটা কিন্তু ঠিক। না হলে স্যর এত রেগে গেলেন কেন?

অঙ্ক স্যরের মেজাজ খারাপ থাকলে ডাস্টার ছুড়ে মারতেন। টিপ খুব ভাল ছিল, টার্গেট ফসকাত না। এক দিন হঠাৎ একটা ছেলেকে ধাঁ করে ডাস্টার ছুড়ে মারলেন, তার কপাল ঢাউস ফুলে গেল। স্যর পাত্তাই দিলেন না। সমানে বলতে থাকলেন, শুধু বসে বসে সিরিয়াল দেখা হয়। পড়াশোনা করবি কখন? আমি খবর পেয়েছি, তুই সব সময় টিভি দেখিস। ছেলেটা হতভম্ব। ক্লাসের শেষে একটা বন্ধু বলল, আরে, ব্যাপারটা তোরা ধরতে পারিসনি। আসলে স্যরের বাড়িতে টিভি নেই। তোর আছে। স্যর টিভিতে মহাভারত দেখতে পাচ্ছেন না। তুই দেখতে পাচ্ছিস। এই ফ্রাস্ট্রেশনে তোকে পিটিয়েছেন। তুই স্যরকে মহাভারত দেখতে বাড়িতে নেমন্তন্ন কর, দেখবি আর ডাস্টার ছোড়ার কেস থাকবে না।

স্কুলের পাশ দিয়ে গ্রামের পিচরাস্তা চলে গিয়েছে। সেই রাস্তা দিয়ে বাসের বাম্পারে ঝুলতে ঝুলতে যাওয়ার রেওয়াজ ছিল। এক দিন বাম্পারে ঝুলতে ঝুলতে, বাসের ছাদে ওঠার মই ধরে বাড়ি ফিরছিল এক বন্ধু। দেখতে পেয়ে গেলেন ইংরেজি স্যর। পরের দিন ক্লাসরুমের জানলার গ্রিল ধরে ছেলেটাকে আধ ঘণ্টা ঝুলে থাকতে হল। ওই অবস্থায় পেছনে মাঝেমধ্যে বেতের ঘা, সেই সঙ্গে হুংকার: সিনেমায় নেমে যা। স্কুলে আসতে হবে না। সক্কলের বাম্পারে ওঠা তক্ষুনি বন্ধ।

ক্লাস চলাকালীন স্কুলের পেছনে মটরশুঁটির খেত থেকে চুরি করে মটরশুঁটি তুলে আনার অপরাধে আমাদের ফের স্কুলের মাঠে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন স্যর। বলেছিলেন, যখন চটপট মটরশুঁটি চুরি করতে পেরেছিস, স্কুলমাঠের চোরকাঁটাও নিশ্চয়ই তাড়াতাড়ি তুলতে পারবি। ছ’জন ছেলে মিলে, ওই ফুটবল মাঠের সাইজের স্কুলমাঠের চোরকাঁটা তুলতে গিয়ে কেঁদেকেটে একসা। হাতও কেটেছড়ে শেষ। তবু মাঠের সব চোরকাঁটা তুলে না ফেলা অবধি শাস্তি শেষ হয়নি।

নিলডাউন, হাতের আঙুলের ফাঁকে পেনসিল রেখে ঘোরানো তো ছিলই। এক জন আবার নাভির নীচটায় দু’আঙুলে চিপকে প্রকাণ্ড চিমটি দিতেন। তিনি একটা গার্লস স্কুলে পড়াতে চলে গেলেন, শুনলাম সেখান থেকে ক’দিনের মধ্যেই তাঁর চাকরি গেছে। ক্লাস টেনের মেয়েদেরও ওই চিমটি কাটতে গিয়েছিলেন অভ্যেসের দোষে।

শুনেছি এক আজব শিক্ষকের কথাও। কোনও ছাত্র পড়া না পারলে নিজেই নিজের গালেই চড় মারতেন। বলতেন, আমিই তোদের বোঝাতে পারিনি। তাই তোরা পড়া পারছিস না। এমনকী কখনও নিজেই নিজের কান ধরে দাঁড়িয়ে পড়তেন। তাঁর গল্প শুনে আমরা খুব হাসাহাসি করতাম। শ্রদ্ধা করতাম না।

অবশ্য, আজকের দিনে এ রকম শিক্ষকই জরুরি। পড়ানোর সময় সিসিটিভি-র ফুটেজে ওই স্যর কখনও ফেল করবেন না।

aryabhatta.khan@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

aryabhatta khan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE