Advertisement
০৩ মে ২০২৪
রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ২....

এক টানেতে যেমন তেমন

রূপক চক্রবর্তীএক দিন সকালে পার্বতী হঠাত্‌ই দেখেন, গাঢ় সবুজ আর কালো রঙের এক সাপ। দেখেই বুঝলেন এ হল নাগিনী। নির্ঘাত মহাদেবের জটা থেকে বেরিয়েছে। এর কামড় খেলে দেবাদিদেবের শরীর খারাপ হবেই হবে। যদিও তিনি নীলকণ্ঠ। কিন্তু তাঁর নীল আর বাড়ানোর কোনও দরকার নেই।

ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:০০
Share: Save:

এক দিন সকালে পার্বতী হঠাত্‌ই দেখেন, গাঢ় সবুজ আর কালো রঙের এক সাপ। দেখেই বুঝলেন এ হল নাগিনী। নির্ঘাত মহাদেবের জটা থেকে বেরিয়েছে। এর কামড় খেলে দেবাদিদেবের শরীর খারাপ হবেই হবে। যদিও তিনি নীলকণ্ঠ। কিন্তু তাঁর নীল আর বাড়ানোর কোনও দরকার নেই। পার্বতী গিয়ে তখন নিজে হাতে করে সেই নাগিনীকে ঢুকিয়ে দিলেন দেবাদিদেবের বসার আসন বাঘছালের নীচে। মহাদেব বোধহয় কোনও কাজে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে কিছুই না জেনে নিজের আসনে বসলেন। পর দিন সকালে মহাদেবের অসাক্ষাতে আসন তুলে পার্বতী দেখেন সেই নাগিনী মরে গিয়ে এক চিরচিরে পাতায় পরিণত হয়েছে। সেই পাতাই আজকের গাঁজা। আর তাকে ধারণ করার জন্য তৈরি হল ছিলিম। স্বয়ং শিবশম্ভুত্রিপুরারির ঘরে যার জন্ম, সে অতি পবিত্র— এতটা বলে থামলেন হারু ঠাকুর। বললেন, বুঝলে বাবা, খেলেই হবে না। জানতেও তো হবে।

পাণ্ডবেশ্বর শ্মশান। অনেক রাত। মুখোমুখি বসিবার—নারায়ণবাবা। রামানন্দীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের সাধক। পূর্বাশ্রমে, কলেজজীবনে, ছিলেন ছাত্র পরিষদের নেতা। আচমকা ডাক এল। চলে গেলেন পাহাড়ের দিকে। ওঁকেই প্রশ্ন ছিল এই যে এত এত জায়গা ঘুরলেন, কেমন বুঝলেন ছিলিমের মহিমা?

নারায়ণবাবার উত্তর এল—

মুঙ্ক কুলো কি ছাতি

বজ্র কি তালা

পাপীপাখণ্ড কি মুহ্‌ কালা

জ্যোতিসতী কি বোলওয়ালা

কর কি সমিরনি

হাত কি মালা

রাম নাম সে লাগা

রাম রগড়া সব সে তাগড়া।

পাশে ছিলেন মদনবাবাজি। মূলত তাঁরই অর্থদাক্ষিণ্যে চলে পাণ্ডবেশ্বর শ্মশানের এই আশ্রম। কোনও শোনা কথা নয়, একদম খাতায় কলমে বাবাজি অঙ্কে লেটার পেয়েছিলেন হায়ার সেকেন্ডারিতে (যদিও তাঁর সেটাই শেষ পরীক্ষায় বসা) এবং তিনি তো বলছেন, এখনও সেই নম্বর রেকর্ড। মদনবাবাজি বললেন, আজ এখানে চলবে রাত্রি একটারও বেশি। বসুন। পুরি-সবজি খাওয়া হবে। তবে আসল জিনিস তো ছিলিম।

জিজ্ঞেস করি, আচ্ছা, এত এত দিন জীবন কাটিয়েছেন সত্‌সঙ্গে। সাধুসন্ন্যাসী সঙ্গ করে। বলুন, এ ধোঁয়ার মধ্যে কী মুক্তি পেলেন? বাবাজি বলেন, ‘মানুষের মধ্যে যে তিনটে গুণ, তার সবচেয়ে ভাল গুণ— সত্ত্বগুণ রয়েছে এই গাঁজায়। এ শরীরকে উসকে দেয় না। শুধু তা-ই নয়। খাওয়ারও একটা নিয়ম-কানুন আছে। ভীষণ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে খেতে হয়। শুধু কি তাই? এ একান্তই নিরামিষ। আর নিরামিষ বলেই জানবেন সমুদ্র থেকে পাহাড়ে এর অবারিত দ্বার। শুনুন ভাই, ‘গাঁজা’ শব্দের অর্থ জ্ঞান অর্জন। আমি বারাণসী, উজ্জয়িনীতে দেখেছি, নামকরা সব সাধু ছিলিমের আশ্রয় নেন। কেননা কামভাব নষ্ট করে ছিলিম। এ সব চালু নাম। আমরা সন্ন্যাসীরা একে ‘সম্বিদা’ বলি। এ অত্যন্ত পবিত্র জিনিস। পুরো ব্যাপারটাই শুদ্ধতায় মোড়া। এই যে দেখুন, একে বলে সাফি। এক টুকরো লাল কাপড়। কেন ব্যবহার হয় বলুন তো? যাতে অন্যের মুখের থুতু বা লালা অন্যের না লাগে, সেই সঙ্গে এটা ফিল্টারের কাজ করে, কী বুঝলেন? নিন, ব্যোমশংকর বলে একটা টান দিন।’

নিমতলা শ্মশান। বাবা ভূতনাথের মন্দিরে ভিড়। ঘি মাখিয়ে লিট্টি বিক্রি হচ্ছে। দূরে জিলিপি-কচুরি। একটু হেঁটে এগোতেই রাস্তার দু’পাশে গোটা চার-পাঁচেক ছিলিমের দোকান। ছোট মাটির। সাদা পাথরের। বড়, মেজো হরেক রকমের মাপ। এমনকী কালো পাথরের অবধি। ক্রেতা না হলে বাক্যালাপ করা মুশকিল। তবু এ উত্‌সাহীর সরল প্রশ্ন শুনে হাবলুবাবু একটু চুপ করে রইলেন। তার পর বললেন, এ সব জেনে কী করবেন? এ হল ঠাকুর-দেবতার আশীর্বাদ। জানেন এর দাম কত? দশ হাজার টাকা কেজি। ভরি ১০০ টাকা। এই যে আপনারা কথায় কথায় বলেন মণিপুরী গাঁজা— ওটা ভুল। ওটাকে বলে মরপাইয়া।

শুনুন,ছ’টা জিনিস না হলে এ সাধনা হবে না। প্রথমেই চাই ছিলিম। আমরা পবিত্র ভাবে বলি, মকরদানি। দুই, গাঁজা। যা ওই মকরদানিতে দিতে হবে। তিন, গিটি। পোড়া মাটির ঢেলা। যা ছিলিমের শেষ প্রান্তে থাকবে। চার নম্বর, সাফি। মানে এঁটো হবে না ছিলিম। পাঁচ, কাটকাটনি। মানে যা দিয়ে গাঁজা ছোট থেকে ছোট করে কাটা হবে। ছ’নম্বর, গুল। অর্থাত্‌ ছিলিমের মাথায় যে আগুনের ঢেলাটাকে বসানো হবে। এত সবের পর খাওয়ার আয়োজন। এত সাধ্যসাধনা করে দেবাদিদেব তবে এই ছিলিম টানতেন। যদিও ওঁর এই কাজ সারা দিন ধরে করে দেওয়ার জন্য নন্দী-ভৃঙ্গী মহারাজরা ছিলেন।

আমি জিজ্ঞেস করি, প্রকাশ্য রাস্তায় সুন্দর সাজিয়েগুছিয়ে দোকান করছেন, কোনও আপত্তি?

—দূর মশাই, যারা আপত্তি করবে দেখছেনই তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। আপনাদের চুলকে দেবার জন্যই যত্ত ঝামেলা। যান যান, এ বার ফুটে যান।

ফুটে, যাই পিন্টুর দোকানে। দোকানি বলে, অসমের ভাল মাল আছে, সাদা পাথরের ছিলিমে দিচ্ছি।

কী ভাবে পেলেন অসমের মাল?

—কেন? আড়কাঠি আছে। এসে দিয়ে যায়। আমাদের আইন মোতাবেক দোকান। কোনও ঝ্যামেলা নেই। এমনও কড়া জিনিস আছে যে এক ছিলিম একা টেনে বসবেন, চোখ খুলবে আটচল্লিশ ঘণ্টা পরে।

আমি দাম দিতে যেতেই দোকানি বলে, সে কী? খাবেন না? না না। না খেলে পয়সা দেবেন না। ছিলিম অতি পবিত্র জিনিস। পয়সা দিয়ে একে হিসেব করা যায় না।

আমি বলি, না না বউনির জন্য।

উত্তর এল, দূর মশাই, আমাদের কোনও বউনির ব্যাপারই নেই। এ চলছেই। শ্মশানে আগুন নেভে না, ছিলিমেরও আগুন নেভে না। আচ্ছা ভাই

ফিরছি কুলু থেকে। বাসে সড়কপথে চণ্ডীগড়। তার পর ট্রেন। ভুন্তার এয়ারপোর্ট পিছনে ফেলে আমাদের ছোট সাদা বাস খানিক এগোতেই বাস থামিয়ে দেওয়া হল। বাসের দরজা খুলে উঠে পড়েছে চার-পাঁচ জন পুলিশ। দুজন হাতের লম্বা লাঠি দিয়ে বাসের পেছনের সিটের পাশে ঘাঁটাঘাঁটি করছে। অন্য দুজন স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র পিঠ থেকে নামিয়ে হাতে নিয়েছে। বাস থেকে একটু দূরে দুটো জিপ দাঁড়ানো। সেখানে আরও পুলিশ। লাগিয়ে দেওয়া হল রাস্তা আটকানোর রেলিং। পুলিশ নেমে যেতেই আমরা সাগ্রহে কন্ডাক্টরকে জিজ্ঞেস করি— ভাই, কী ব্যাপার, কী হয়েছে?

কন্ডাক্টর নিরুত্তাপ মুখে বলে, আসতে যেতে দু’বেলাই এ রকম হচ্ছে।

—কেন?

পাশের হিন্দিভাষী এক বয়স্ক বলেন (অবশ্যই হিন্দিতে): গাঞ্জা আর ছিলিম আসে মানালা থেকে। মানালার ওই জিনিস চণ্ডীগড়-দিল্লি হয়ে ছড়িয়ে যায় নানা দেশে। এর যে রকম দাম তেমনই কদর। তাই অনেকে মানালার গাঞ্জা-ছিলিম নিয়ে ব্যবসা করে। পুলিশ হামেশা রেড করে। ভুন্তার থেকে প্লেনে সব আসে-যায়। তাই পুলিশ ভুন্তারের কাছাকাছি বাস-গাড়ি সব চেক করে। সব শেষে কপালে হাত ঠেকিয়ে বললেন, মানালায় বাবা মহাদেব এসেছিলেন। তাঁর পুণ্যভূমির ওই জিনিস যে এক বার পেয়েছে, সে কোনও দিনও ভুলবে না।

কালীঘাটের মন্দিরকে পেছন দিকে রেখে আপনি যদি সোজা গঙ্গার দিকে মুখ করে দাঁড়ান, একটা সরু গলি। গলি দিয়ে ঢুকলে ছোট ছোট ঘর। বাইরে লেখা— এখানে বিবাহ দেওয়া হয়। আরও এগিয়ে গেলে ডান হাতে এক বিরাট শীতলা মন্দির। ডান পাশে দেখি, ছ’জন মিলে গোল হয়ে বসে গঞ্জিকা সেবন করছেন। কেউ শার্ট-প্যান্ট, কেউ ধুতি-শার্ট। স্মার্ট। কথাবার্তায় আড়ষ্টতা নেই। বললেন, বসে পড়ুন। বলুন কী জানতে চান। কারও নাম লিখবেন না।

দলের মধ্যে এক জন উবু হয়ে বসা। লালচে বড় চোখ। হেসে বললেন, লিখুন না আমাদের নাম উত্তমকুমার, সৌমিত্ত, পোসেনজিত, দেব, হাহাহা।

এর পর তত্ত্বে ঢোকা গেল। কালীঘাট থেকে অনেক খুচরো ব্যবসায়ী, যারা পাড়ায় পাড়ায় বেচে, বা নির্দিষ্ট জায়গায় গেলে তাদের পাওয়া যায়, তারা এখান থেকে একে নিয়ে যায়। ‘আমাদের এই আড্ডাটা যে দেখছেন, এটা শুরু হয় সকাল সাতটা থেকে। মনে রাখবেন, স্নান করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে এই চক্রে বসতে হয়। পুরিয়ার দাম কুড়ি টাকা থেকে শুরু হয়। কোথাকার মাল, তার ওপরে দাম নির্ভর করে। আমাদের এক দাদা আছেন। তান্ত্রিক। তিনি এক দমে ধোঁয়া টেনে ছিলিমের ওপরে এক ঝলক আগুন তুলতে পারেন।

‘আসুন, বসে যখন পড়েছেন তখন প্রসাদ হিসেবে সেবন করুন। এ নেশায় কোনও গন্ধ নেই। ঝামেলা নেই। এ সাক্ষাত্‌ দেবাদিদেবের নেশা, আর গোটা নেশাটাই দাঁড়িয়ে আছে ছিলিমের ওপরে। অনেকে সিগারেটে ভরে খায়। কিন্তু ও সব ছেলেমানুষি চ্যাংড়া ব্যাপারস্যাপার। আসল হচ্ছে ছিলিম। এই চক্র চলবে

রাত্রি বারোটা অবধি। তার মধ্যে কেউ কেউ উঠে গিয়ে নিজের কাজ করে আসে। খাবার খায়। হ্যাঁ ভাই, যা-ই করো না কেন, ভাল করে আঁচিয়ে তার পর বসবে। আর সন্ধের চক্রে বসার আগে আবার স্নান। শুদ্ধতাই সবচেয়ে বড় কথা।’

কলেজ কেটে চার জনের দল ঢুকেছিলাম হাড়কাটা গলির শেষ প্রান্তে একটা বাড়িতে। সারা বাড়ি বটের ঝুরি। নাম ছিল সাধুবাবার আশ্রম। একটা পেল্লায় ঘর ছিল গাঁজাপাতা, ছিলিমে ভর্তি। কয়েক জন লোক সারা দিন ছোট প্যাকেটে সে সব ভরত। সে বার সমস্ত দ্রব্য সংগ্রহ করে আমরা সোজা কলেজ স্কোয়্যার। তখনও স্কোয়্যারের জলে রাজহাঁসের দল দুপুরবেলা ঘুরত। আমরা খানিক নিরিবিলি দেখে মৌতাত মহেশ্বর। এর পর রাস্তায় বেরনো। ঠিক হয় ট্রাম ধরে ধর্মতলা। একটা ট্রাম এগিয়ে যেতেই আমরা চার জনে তার পিছনে দৌড়ই। ট্রাম থেমে নিজের মতো লোক নেয়। আমরা কিন্তু দৌড়ই। সঙ্গে প্রবল হাসি। ট্রাম ট্রামের মতো। আমরা আমাদের মতো। দৌড় দৌড়।

কৃতজ্ঞতা: সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়,

জয়দীপ মুখোপাধ্যায়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

rabibasoriyo rupak chakraborty
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE