Advertisement
১৬ মে ২০২৪

একটা ভয় কষ্ট [লজ্জা]

বিজয়ার পর আমাদের বাড়িতে লাগ ভেলকি লেগে যেত। তিন জন হয়তো প্রণাম সারতে এলেন, তাঁরা যাওয়ার আগেই আরও দুজন এসে পড়লেন, এই দুজনকে আপ্যায়ন শেষ করার আগেই ম্যাটিনি ফিরতি আরও এক দল বিজয়াটা টুক করে সারতে চলে এলেন। আমি চাইন্ড লেবারের ভূমিকায় পাড়ায় মিষ্টির দোকান যাচ্ছি আর আসছি। প্রণামের আর শুভেচ্ছা বিনিময়ের ঘটাপটায় আমরা অতিষ্ঠ। এমন অনেক আত্মীয় আসতেন যাঁদের আমরা বছরে এই এক বারই দেখতাম এবং তাঁরা আমাদের কে, এ বিষয়ে ন্যূনতম ধারণা ছিল না।

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

বিজয়ার পর আমাদের বাড়িতে লাগ ভেলকি লেগে যেত। তিন জন হয়তো প্রণাম সারতে এলেন, তাঁরা যাওয়ার আগেই আরও দুজন এসে পড়লেন, এই দুজনকে আপ্যায়ন শেষ করার আগেই ম্যাটিনি ফিরতি আরও এক দল বিজয়াটা টুক করে সারতে চলে এলেন। আমি চাইন্ড লেবারের ভূমিকায় পাড়ায় মিষ্টির দোকান যাচ্ছি আর আসছি। প্রণামের আর শুভেচ্ছা বিনিময়ের ঘটাপটায় আমরা অতিষ্ঠ। এমন অনেক আত্মীয় আসতেন যাঁদের আমরা বছরে এই এক বারই দেখতাম এবং তাঁরা আমাদের কে, এ বিষয়ে ন্যূনতম ধারণা ছিল না। ‘এ মা, এটা ছোড়দার ছোট মেয়ে না? আমি কে বল তো?’— আত্মীয়-আত্মীয় জেনারেল নলেজের খেলায় আমরা বোকা বোকা হাসি নিয়ে ডাহা ফেল।

এক জন অবশ্য আসতেন নিয়ম করে। বিজয়ার পর, কাঁধে মলিন ঝোলা ব্যাগ নিয়ে কখনও দুপুর সাড়ে তিনটে, কখনও রাত পৌনে দশটা নাগাদ বাড়িতে উদয় হতেন। তিনি ঠিক কে হতেন মনে নেই। তবে তিনি মনপ্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতেন যে, তিনি আমাদের ভারী প্রিয়। এই ঘটনাটা যে দিনের, সেটা সম্ভবত বিজয়ার পর পিক সিজন। একটা রোববার। বিজয়া-অতিথি সামাল দিতে সবাই হিমশিম, মনে একটাই বাসনা, ‘অতিথি তুম কব যাওগে?’ একটা আশার আলো দেখা গিয়েছে, সম্ভবত শেষ দল তখন সবে গলি পেরিয়েছে। এমন সময় তিনি উপস্থিত।

গদগদ মুখে বললেন, ‘ও, আমি আসব জেনেই বুঝি এত আয়োজন?’ কমিক স্ট্রিপের আঁআঁআঁঁক্ক্ক্ করার মতোই বুক ধড়াস এবং চকিতে সবার চোখ সেন্টার টেবিলের ওপর। আগের ব্যাচের চানাচুর-মিষ্টির থালার অবশিষ্টাংশ। সেগুলো তখনও তুলে রাখা হয়নি, যা পরের বা তার পরের ব্যাচকে সাপ্লাই করে দেওয়া যাবে। তবু ব্যাপারটা ম্যানেজ হয়ে যেত। তিনি আমাদের পরম প্রিয় ভেবে একটি রসগোল্লা ও কিছুটা চানাচুর বিজয়ার শুভেচ্ছা হিসেবে গ্রহণ করতে প্রস্তুতও ছিলেন। বাদ সাধলেন আমার জেঠিমা। হঠাত্‌ রান্নাঘর থেকে স্লোগান-ডেসিবেলে বলতে বলতে বসার ঘরে এলেন, ‘ওরে, ভন্তুদের ফেলে যাওয়া মিষ্টি-টিস্টিগুলো তুলে রাখ, কাল আবার কত গুষ্টি আসবে তার ঠিক নেই।’ আমাদের একগাল মাছি। আর জেঠিমার কী আশ্চর্য টাইমিং, ভদ্রলোক তখনই রসগোল্লাটি তুলে মুখে দিতে যাচ্ছেন। আমরা মুহূর্তে স্ট্যাচু। কেউ কারও দিকে তাকাচ্ছি না। সেই ভদ্রলোকের মুখের দিকেও না। কিন্তু বেশ বুঝতে পারছি তিনি হাতে রসগোল্লাটি ধরে ফ্রিজ শট, মুখ পর্যন্ত দূরত্ব কিছুতেই অতিক্রম করা যাচ্ছে না। আমরা তাঁর কাছে তখন চরম প্রতারক। বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠরা বোধহয় মন দিয়ে দেওয়ালের চুনকাম বিষয়ে নিজ নিজ ভাবনা সে দিনই প্রস্তুত করিয়া ফেলিয়াছিলেন।

জেঠিমাই মোটামুটি উতরে দিলেন। ছিঃ! তোমাকে এ সব দিতে যাব কেন? তুমি কি যে-সে? তোমার জন্য তো বাড়ির তৈরি নারকেল নাড়ু তোলা আছে। এই, কেউ প্লেটটা সরিয়ে নে। বাড়ির নাড়ুর দম কতটা ঠিক বোঝা গেল না। কারণ দশ মিনিটের বিজয়া সেরে সে ভদ্রলোক সটান দরজার ও-পারে।

তিনি চলে যাওয়ার পর একটা ছি-ছি রব রাউন্ড মারতে লাগল সারা বাড়ি জুড়ে। জেঠিমাকে যারপরনাই বকাবকি চলল। আর কিছু ক্ষণ অন্তর অন্তর এক বার করে সবাই আপশোস করল, ‘ইস! কী ভাবল!’

মধ্যবিত্তের সত্যবাদিতা যে কী ডেঞ্জারাস আর লজ্জাকর, তা জানে মাসের শেষ, আর বিজয়ার ঠেলা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sanchari mukhopadhyay bijoya bijaya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE