Advertisement
E-Paper

এগ রোল

স্কুলের শেষ-জীবনে, ওই যেমন হয় আর কী, আমার দিদিকে ছক করতে শুরু করেছিল এক দঙ্গল ছেলে। স্কুলে যাওয়া-আসার সকাল-বিকেলে, কোচিং ক্লাসে যাওয়ার সন্ধেবেলায় ও ফেরার রাতে, তারা সব পালা করে দাঁড়িয়ে থাকত দিদির রাস্তায়। ছকু-খানসামাদের কারও সঙ্গেই দিদি দুর্ব্যবহার করে না, কিন্তু তাদের কারও দিকে সবুজ পতাকাও নাড়ে না। তাই কেউই বুঝতে পারছে না কে হিরো।

নীলার্ণব চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০১৫ ০০:০৩

স্কুলের শেষ-জীবনে, ওই যেমন হয় আর কী, আমার দিদিকে ছক করতে শুরু করেছিল এক দঙ্গল ছেলে। স্কুলে যাওয়া-আসার সকাল-বিকেলে, কোচিং ক্লাসে যাওয়ার সন্ধেবেলায় ও ফেরার রাতে, তারা সব পালা করে দাঁড়িয়ে থাকত দিদির রাস্তায়। ছকু-খানসামাদের কারও সঙ্গেই দিদি দুর্ব্যবহার করে না, কিন্তু তাদের কারও দিকে সবুজ পতাকাও নাড়ে না। তাই কেউই বুঝতে পারছে না কে হিরো। ফল: নাকানি-চোবানি, কনফিউশনে কিমাকার। সলিউশন পেতে আমাকেও ধরত তারা, আমি সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে তাদের থেকে আলপিন টু এলিফ্যান্ট আদায় করে নিতাম। তো, আমার দিদি ছিল ‘এগ রোল’-অন্ত-প্রাণ। রোডে-ঘোরা রোমিয়োদেরও জানতে বাকি ছিল না এই কথাটা। এক বার দুর্গাপুজোর সপ্তমীর সকালে, সেই প্রেমপ্রত্যাশীদের এক জন আমার কাছে এসে বলতে লাগল সন্ধেবেলা সে দিদিকে এগ রোল খাওয়াতে চায়। আমাকেও খাওয়াবে। আমি যেন দিদিকে গিয়ে এ ব্যাপারে রাজি করি। ছেলেটি ছিল পাড়া-দাপানো কমরেড এবং খুব গরিব। আমি তো আত্মহারা হয়ে বাড়ি এসে প্রোপোজালটা দিলাম। একটু কিন্তু-কিন্তু থাকলেও এগ রোলের গন্ধে রাজি হয়ে গেল দিদি। সন্ধে নাগাদ দুজনে এলাম স্টেশন-ঘেঁষা খাবারের দোকানে। অর্ডার হল দুটো এগ রোলের। দিদি আর আমার জন্য। এগ রোল শেষ হলে বহু অনুনয়ে ভাই-সহ দিদিকে ঠাকুর দেখানোর সুযোগও পেয়ে গেল সেই যুবক। আধ ঘণ্টা-মিনিট পঁয়তাল্লিশ এ দিক-ও দিক ঠাকুর-দর্শনের পর যুবকের ‘আর কিছু খাবে’ প্রশ্নে দিদির সোজা জবাব এগ রোল। সে আমার দিকে তাকাল। জানালাম, হ্যাঁ, আমিও... এতে একটু হতবাক ও পকেটে প্রচণ্ড টান লাগলেও, এগ রোল খাওয়ানো ছাড়া যুবকটির আর কিছুই করার রইল না। কিন্তু টিউশনি-র কষ্টার্জিত টাকায় দু’জোড়া এগরোলের দাম মিটিয়েও সে মাছ তুলতে পারল না জালে। তার প্রেম-প্রস্তাবে হাসতে হাসতে না করে দিয়ে বাড়ি এল দিদি। সে বার ওই ছেলেটিকে অনুসরণ করে অষ্টমী, নবমী, দশমীতে এক-এক জন করে ছেলে দিদি ও আমাকে এগ রোল খাওয়ায়। কিন্তু এগ রোল ছাড়া আর কোনও দিকেই দিদি দৃষ্টি দেয়নি।

এ বার আমাদের পাড়ার পরিমলের গল্প। মানুষের তো কত ফ্যান্টাসি থাকে। পরিমলের ছিল বড় হয়ে এগ রোলের দোকান দেওয়ার বাসনা। ফুটবল-ক্রিকেট-পিট্টু-ভলি-কাবাডি খেলার শেষে সন্ধেবেলায় পরিমল যখন মাঠের পাশে বসে সবার সঙ্গে গল্প করত, তখন সেই ইচ্ছেটাকেই বারবার করে বলত। আমরা কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ ব্যারিস্টার, অনেকেই ফুটবলার এমনকী কেউ কবি-টবিও হতে চাইতাম। কিন্তু পরিমল বলত, এগ রোলের দোকান দেবেই দেবে। আমরা ওকে ‘এগ রোল’ বলেই ডাকতে শুরু করলাম। এমন একটা অবস্থা হল, পরিমল নামটা আর কেউ মনে রাখল না, পরিমল হয়ে গেল এগ রোল বা শর্টে শুধুই এগ। প্রথম প্রথম পরিমল প্রচণ্ড রেগে যেত, পরে বেশ মেনেই নিল যে ওর নাম এগ রোল।

খেলাধুলোয় ভালই ছিল পরিমল। তাই বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় যখন নাম দেওয়া হত পাড়ার ক্লাবের, খেলোয়াড়ের তালিকায় কারও গাল-ভরা নাম, কারও কান-এঁটো-করা নাম লেখা হত। যদি ভাল নামের বদলে ডাকনাম লেখা হত কারও, তুমুল প্রতিবাদ করত সে। কিন্তু প্রায় সব খেলার তালিকাতেই যার নামটা কমন, সেই পরিমল থাকত শুধুই ‘এগ’ হয়ে। এই পরিমল দেখতে দেখতে এক দিন বড় হয়ে গেল। যারা বলেছিল বড় হয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্লেয়ার বা ব্যারিস্টার হবে তারা কেরানি, লিডারের ল্যাজ কিংবা টিকিট-ব্ল্যাকার হল; কিন্তু পরিমল ঠিক রেলের পড়ে থাকা ফাঁকা জমিতে এ দিক-ও দিক থেকে বেড়া-তক্তা-স্টোভ-তাওয়া ইত্যাদি চেয়েচিন্তে জলজ্যান্ত এগ রোলের দোকান দিয়ে বসল পুজোর আগে! দোকানের নাম দিল পরিমলের রোল। এখনও হুবহু মনে আছে, পঞ্চমীর দিন সেই দোকানের শুভ সূচনায় ফ্রি’তে ফার্স্ট কাম ফার্স্ট সার্ভ বেসিসে ১০০ জনকে এগ রোল খাইয়েছিল পরিমল। সে এক এলাহি ব্যাপার হল বটে।

কিন্তু পরিমল, থুড়ি এগ রোলের এই উন্নতিতে অনেকেই খেপে লাল হয়ে গেল। তারা পরিমলের পিছনে লাগতে শুরু করে দিল। ‘অ্যাই এগ, তোর রোলটা খাব!’ অল্প বয়সে এগ রোল বলে খচানো হলেও যে তেমন রেগে যায়নি, সেই পরিমল কিন্তু এ বার তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতে লাগল। দোকানের সামনে এসে কেউ ওই কথাটা বলে পালিয়ে যেত, আর তাওয়ায় ছড়ানো ডিম, হাতাটাতা সব ফেলে বাইরে বেরিয়ে এসে চার-পাঁচ-ছয় অক্ষরের খিস্তি করতে থাকত পরিমল। এর ফলে পরিমলের দোকানের কাস্টমার কমতে লাগল হু-হু করে। কমতে কমতে এক সময়ে শূন্যে এসে ঠেকে গেল। সন্ধেবেলা দোকান সে নিয়মিত খুলত, কিন্তু খদ্দের নেই। শুধু পিছনে-লাগা, সঙ্গে খিস্তির তুবড়ি।

ওভারহেড বিদ্যুতের তার থেকে হুক করে পরিমল আলো জ্বালিয়েছিল দোকানের। এক দিন ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের লোক এসে সেই তার কেটে দিয়ে পরিমলকে শাসিয়ে গেল ‘এ বারের মতো তোকে ছেড়ে দিলাম, পরের বার কিন্তু হাতকড়া!’ কারও কাঠিতেই এই কাণ্ড, এগ রোলের বুঝতে বাকি রইল না। না হলে, আশপাশের সব দোকানেই তো এই ভাবেই আলো জ্বালানো হচ্ছে, শুধু তার বেলায়! শোনা যায়, সে দিন রাতে দোকান থেকে বাড়ি ফেরেনি এগ রোল। অনেক ক্ষণ কেঁদেছিল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। হ্যারিকেন জ্বালিয়ে দোকান খুলেছিল তার পরেও কয়েক দিন। খচানোর মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল আরও। এর পর এক দিন এগের বডি উদ্ধার হয় দোকান থেকে, বেড়ার দরজা মচকে ভেঙে। দুর্গন্ধে টেকা যাচ্ছিল না আশপাশে। এর পর দোকানদাররা চাঁদা তুলে ঘটা করে শ্রাদ্ধ করে পরিমলের। শ্রাদ্ধের পদে অবশ্যই ছিল এগ রোল। একমাত্র এই পদটাই যে য’টা চায় পেতে পারে, এমনও ঘোষণা করে দেওয়া হয় আগেই। পাড়ার দাদারা দাবি করে, এর ফলেই এগের আত্মা শান্তি পাবে। মালা-পরা পরিমল, সামনে ধূপ, একটা প্লেটে রাখা এগরোল এমন ছবিও পোস্ট করা হয় ফেসবুকে, নীচে লেখা হয় এগ রোল, আরআইপি।

সে সময় ভাল কোনও চাকরি মিলছে না, তাই ঢুকে পড়তে হয় সেল্সের জবে। ইংরেজি পেপারের সাবস্ক্রিপশন বিক্রির কাজ। ভোরবেলা হলেই স্যুটেড-বুটেড হয়ে চলে যাওয়া গড়িয়াহাট। তার পর কাজ-টাজ বুঝে বেরিয়ে পড়া দৈনিকের অফার বেচতে। মানে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নক হ্যালো আই অ্যাম ফ্রম... (তোতা-কায়দায় এইটুকু ইংরেজি বলেই, সোজা বাংলায়) আমি কাগজের কয়েকটি সাবস্ক্রিপশন অফার সম্পর্কে জানাতে চাই, দয়া করে যদি... বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দরজাটা মুখের উপর বন্ধ হয়ে গেলেও, কেউ কেউ এন্টারটেন করতেন এবং তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই বৃদ্ধ। সামনে বসিয়ে যৌবনের সাফল্যের কাহিনি বলে যেতেন, কিংবা ব্যর্থতার, বা ছেলেবউয়ের একটানা নিন্দে করতেন। এক দিন আমাকে ‘আসুন আসুন’ করে গভীর সম্ভাষণে তাঁর ড্রয়িংরুমে জামাই-যত্নে বসালেন এক বৃদ্ধ। আমি বুঝতে পারলাম, এই বার শুরু হবে কথার কেত্তন। না, তিনি কোনও কথাই বলছেন না, সোফায় বসার পরই কেমন গুম মেরে গেছেন। বুঝতে পারছি না কী করব, উঠে পড়ব কি না এই সময় উনি পরিচারিকাকে হাঁক দিলেন। বললেন, খাবারটা দিয়ে যা। আমি বললাম, না না দাদু, আমি কিছু খাব না।

আপনার জন্য নয়...

ও, আচ্ছা...

তখন সকাল সাড়ে ন’টা, বৃদ্ধ ব্রেকফাস্ট করবেন নিশ্চয়ই। কিন্তু কেউ সামনে বসে খাবেন, আর আমি দেখব, এ তো অস্বস্তিকর!

বললাম, দাদু আজ তা হলে উঠি, আর-একদিন এসে নাহয়...

না না, বসুন বসুন, খেতে-খেতেই কথা হবে।

অগত্যা...

দেখলাম সাদা একটা প্লেটে করে খাবার চলে এল এ যে এগ রোল! ইনি ব্রেকফাস্টে এগ রোল খাবেন? বেশ রসিক লোক তো! দাদু এগ রোলে একটা বাইট দিয়ে খাবার-ভর্তি গলায় বললেন, ‘যৌবন থেকেই বড্ড ভাল লাগে এগরোল খেতে। বাড়ি থেকে বের হলে কিছু খাওয়া মানেই তো এগ রোল।’ পরমানন্দে চিবোতে থাকলেন চোখ বুজে। মুখেরটা গিলে ফের একটা কামড় ‘এখন তো আর কোথাও বেরনো হয় না, সারা দিনই বাড়িতে। ছেলেরা বিদেশে থাকে। কিন্তু এগ রোল না হলে এখনও চলে না, তাই আমার কাজের লোক প্রায় রোজই হোম-মেড এগ রোল বানিয়ে দেয়, বুঝলেন...’ বেশ বুঝতে পারছিলাম, তাঁর বাঁধানো দাঁত, কিন্তু তা দিয়েই বিন্দাস চিবিয়ে নিচ্ছেন এগ রোলের হাড়মাস। এ কি কোনও সেডিস্ট প্লেজার? না হলে কোনও অচেনা লোককে এই ভাবে সামনে বসিয়ে কেউ এমন তারিয়ে তারিয়ে খেতে পারে!

এগ রোল অনেক রূপকথা তৈরি করেছে। এগ রোলের দোকানদার, গরিব গায়ক, নামী চ্যানেলের রিয়েলিটি শো মাতিয়েছে। নাম ছড়িয়েছে সারা দেশে। আবার ছোট এগ রোলের দোকান থেকে দিনে দিনে বিশাল রেস্তোরাঁ হয়ে গেছে কারও। বছরে বহু কোটির টার্নওভার। কিন্তু এগ রোল নিয়ে গোটা একটা ফ্যান ক্লাবের কথা শুনে চমকে গিয়েছিলাম এক দিন।

দানেশ শেখ লেনে একটা দোকানে দাঁড়িয়ে সে দিন এগ রোল খাচ্ছি, এক জন আমার পিঠে টোকা দিল। ঘুরে দেখি, মধ্যবয়সি লোক। হাই-পাওয়ারের চশমা। পরনে সাদা গেঞ্জি, উপরে আঁকা এগ রোল। ভাবলাম, কোনও খাবারের কোম্পানির সেল্সম্যান বোধহয়। ভদ্রলোক বললেন, দাদা, একটা দরকার আছে, একটু সময় হবে? একটা বড় লিফলেট-মতো জিনিস হাতে ধরিয়ে দিলেন। ল্যামিনেশন করা ঝকঝকে সেই লিফলেটের একেবারে উপরে লেখা ‘এগ রোল ফ্যান ক্লাব’। নীচে ক্যাচলাইন ‘সব খাওয়ার সেরা বাঙালির তুমি এগ রোল।’ তার নীচে ‘এগ রোল ফ্যানক্লাব কী ও কেন’।

এই ‘কী ও কেন’-টা আবার সাধু ভাষায় লেখা: বঙ্গবাসীর জীবনযাপনের সঙ্গে এগ রোল নামক খাদ্যটি ওতপ্রোত ভাবে জুড়িয়া গিয়াছে। এই কারণেই আমরা এগ রোলের ভক্তেরা একটি ফ্যানক্লাব গঠন করিবার পরিকল্পনা নিই।... আজ এই ফ্যানক্লাবের সদস্য সংখ্যা সহস্রাধিক। আপনি/ আপনারা যদি এগ রোল ভক্ত হইয়া থাকেন, তাহা হইলে এই ক্লাবের সদস্য হইবার জন্য আহ্বান জানাইতেছি।

আমার মুখের অবস্থা দেখেই বোধহয়, ভদ্রলোক প্রথমেই আশ্বস্ত করলেন, আমাদের ক্লাবের মেম্বার হতে টাকা লাগে না। তখন আমি একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে তাঁর দিকে হাসি-হাসি মুখে তাকালাম। তিনি বললেন, মাসে চারটে গ্যাদারিং হয় আমাদের। প্রত্যেক গ্যাদারিংয়ে এগ রোল খাওয়ানো হয়। মাঝে মাঝে সেমিনার হয়। এগ রোলের একটা ব্রড হিস্ট্রি আছে তো তা ছাড়া নানা দেশে এই রোল নানা রকম... পুজোর সময় বিভিন্ন জায়গায় ফ্যান ক্লাবের পক্ষ থেকে স্টল দেওয়া হয় সংস্থার খরচ-খরচা এ ভাবেই উঠে আসে অন্য সময়তেও এগ রোলের স্টল দেওয়ার প্ল্যান হচ্ছে... যদি কখনও মনে হয়, ফোন করবেন... আপনার ফোন নম্বরটা...

না মানে...

ঠিক আছে, দিতে হবে না... ফোন করবেন... ক্লাবের নম্বর দেওয়া আছে কাগজটায়...

আন্দুল রোডের দিকে হাঁটা দিলেন। দেখলাম, তাঁর গেঞ্জির পিছনেও জ্বলজ্বল করছে এগ রোলের ছবি। সেটাকে কামড় দিতে আসছে বড় একটা হাঁ।

ছবি : বিশ্বনাথ বণিক।

nilarnab1@gmail.com

anandabaxar rabibasariya nilarnab chakraborty egg roll
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy