Advertisement
E-Paper

কেচ্ছা

বয়স তখন সবে দশ। কলকাতার এক ব্যবসায়ীর কলকাঠিতে টলমল করে উঠল নেহরু সরকার। প্রায় সওয়া কোটি ঘাপলা! গদি হারালেন দেশের অর্থমন্ত্রী। ফের প্রকাশ্যে উঠে এল নেহরু-গাঁধী পরিবারের কোন্দল। বলতে গেলে, সেই ছিল স্বাধীন ভারতের প্রথম বড়সড় আর্থিক কেচ্ছা। ‘মুন্দ্রা স্ক্যান্ডাল’।বয়স তখন সবে দশ। কলকাতার এক ব্যবসায়ীর কলকাঠিতে টলমল করে উঠল নেহরু সরকার। প্রায় সওয়া কোটি ঘাপলা! গদি হারালেন দেশের অর্থমন্ত্রী। ফের প্রকাশ্যে উঠে এল নেহরু-গাঁধী পরিবারের কোন্দল। বলতে গেলে, সেই ছিল স্বাধীন ভারতের প্রথম বড়সড় আর্থিক কেচ্ছা। ‘মুন্দ্রা স্ক্যান্ডাল’।

সুস্নাত চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০১৪ ১২:০৪
ছবি: সুমন চৌধুরী।

ছবি: সুমন চৌধুরী।

স্বাধীনতার বয়স তখন সবে দশ। কলকাতার এক ব্যবসায়ীর কলকাঠিতে টলমল করে উঠল নেহরু সরকার। প্রায় সওয়া কোটি ঘাপলা! গদি হারালেন দেশের অর্থমন্ত্রী। ফের প্রকাশ্যে উঠে এল নেহরু-গাঁধী পরিবারের কোন্দল। বলতে গেলে, সেই ছিল স্বাধীন ভারতের প্রথম বড়সড় আর্থিক কেচ্ছা। ‘মুন্দ্রা স্ক্যান্ডাল’।

‘মুন্দ্রা’ মানে, হরিদাস মুন্দ্রা। কলকাতা শহরের এক ধুরন্ধর মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ী। জীবন শুরু করেছিলেন পাতি বৈদ্যুতিক বাল্বের সেল্সম্যান হিসেবে। পেটে বিদ্যে ছিল না, বুদ্ধি ছিল ক্ষুরধার। সেই বুদ্ধি খাটিয়েই মেতে ওঠেন ফাটকাবাজির খেলায়। আর দেখতে দেখতে গড়ে ফেলেন নিদেন পক্ষে চার কোটি টাকার সাম্রাজ্য। কিন্তু শেয়ারের চক্করে যা হয়, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকাই থেকে যায় কাগজেকলমে। সেই ভার্চুয়াল সম্পত্তির ‘পিরামিড’ বানাতে গিয়ে তার ভেতরেই মমি হয়ে নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড় হয়েছিল মুন্দ্রার। সঙ্গে ছিল অপরিসীম লোভ আর প্রতিপত্তিজনিত প্রভাব। এমতাবস্থায় মুন্দ্রা করলেন কী, নিজের নামে থাকা ছ’টি কোম্পানির জাল শেয়ার বেচলেন। রিচার্ডসন ক্রুডাস, জেসপ্স, স্মিথ স্টেনস্ট্রিট, ওসলার ল্যাম্পস, অ্যাগনেলো ব্রাদার্স এবং ব্রিটিশ ইন্ডিয়া কর্পোরেশন সব ক’টিই তখন রুগ্নপ্রায়। সে সব নকল শেয়ার বেমালুম কিনেও নিল খোদ এল আই সি। দাম এক কোটি ছাব্বিশ লাখ ছিয়াশি হাজার একশো টাকা। আজ থেকে পঞ্চাশ-ষাট বছর আগের হিসেবে গচ্চা যাওয়া অ্যামাউন্টটা নেহাত হেলাফেলার নয়। লাইফ ইনশিয়োরেন্স করপোরেশন-এর সরকারিকরণের পর তখন দু’বছরও কাটেনি। স্বাধীনতার খোঁয়ারি আর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনের দিবাস্বপ্নের মধ্যে থাকা ‘নতুন’ ভারতে হরিদাস মুন্দ্রা ছিলেন এক জোর কা ঝটকা।

ঝুলি থেকে যে দিন লাফ দিল বেড়ালছানা, সেই দিনটা ভারতীয় সংসদের ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৫৭। বিরল এক বিতর্কের মঞ্চ হয়ে উঠেছিল সে দিনের সংসদ। শ্বশুরের মুখোমুখি জামাই। জওহরলাল নেহরুর সরকারকে কাঠগড়ায় তুলছেন তাঁরই দলের সাংসদ, ইন্দিরার স্বামী, ফিরোজ গাঁধী। স্বভাবতই মুন্দ্রা- বিতর্ক দেশজোড়া মুখরোচক চাটনি হয়ে উঠতে বেশি সময় নেয়নি। মারকাটারি বক্তৃতা করেছিলেন ফিরোজ ‘সংসদের অবশ্যই নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী যে আর্থিক সংস্থার জন্ম সে দিয়েছে, সেই লাইফ ইনশিয়োরেন্স করপোরেশন অব ইন্ডিয়ার ওপর... জনগণের পুঁজি নয়ছয় করার ব্যাপারটা আজ আমরা খতিয়ে দেখব।’ লোকে বলে, নেহরু আর ফিরোজের সম্পর্কের তিক্ততা আরও বাড়িয়ে দেয় এই ঘটনা। ইন্দিরার সঙ্গে ফিরোজের সম্পর্কের শীতলতার পিছনেও হয়তো কোথাও কাজ করেছিল এই বিতর্ক। কেন না, নেহরু চেয়েছিলেন এই বিতর্ক আড়ালেই মিটিয়ে নিতে। ফিরোজের কাণ্ডকারখানার পর আর তার উপায় ছিল না। উলটে মুখ পোড়ে সরকারেরই। বাধ্যত এক সদস্যের কমিশন গঠন করতে হয়। দায়িত্বে থাকেন বম্বে হাইকোর্টের বিচারপতি এম সি চাগলা।

শুরু হয় চাগলা কমিশনের জনশুনানি। শুনানির দিন নাকি জড়ো হতেন এত মানুষ, চোঙার সাহায্যে চালাতে হত শুনানি। ভিড় ঠেলে জে আর ডি টাটার মতো ব্যক্তিত্বরাও মুন্দ্রা-বিতর্কের হাল-হকিকত জানতে বার কয়েক হাজির থেকেছেন! স্ক্যান্ডালটি উঠে এসেছিল ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের পাতায়! তদন্তে একের পর এক প্রশ্ন সামনে আসতে থাকে। সংশ্লিষ্ট কমিটিকে এড়িয়ে তা হলে কি সরকারি চাপেই এল আই সি-কে শেয়ারগুলি কিনতে হয়েছিল? নির্বাচনের বছর, ওই ১৯৫৭-তেই উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসকে এক লক্ষ টাকা আর এ আই সি সি-কে দেড় লক্ষ টাকা অনুদান কেন দিয়েছিলেন মুন্দ্রা? তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী টি টি কৃষ্ণমাচারি সংসদে ফিরোজের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছিলেন, চাপের মুখে তাঁকেই ঢোক গিলে পদত্যাগ করতে হয়। কেন্দ্রের তৎকালীন অর্থসচিব, এল আই সি-র চেয়ারম্যান বা এম ডি-ও ছাড় পাননি। রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর এইচ ভি আর আয়েঙ্গার প্রবল চাপের মুখে পড়েন। আম আদমির কাছে নাকি তাঁর ডাকনামই হয়ে যায়, ‘লাই-অ্যাঙ্গার’। মুন্দ্রা প্রসঙ্গে কমিশন সাফ জবাব দিয়ে দেয়, ‘তিনি আদৌ ব্যবসায়ীই নন, বরং ফাটকাবাজ।’ শেষমেশ কলকাতার ‘শ্রী ৪২০’ হরিদাস মুন্দ্রাকে জেলের ঘানি টানতে হয় বাইশ বছর। কলকাতার অভিধানেও দীর্ঘ দিন পরস্পরের পরিপূরক হয়ে জোড়শব্দ হিসেবেই থেকে যায় ‘শেয়ার’ ও ‘কেলেংকারি’।

keccha susnata choudhory
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy