সরকারি চাকরির ডাক পেয়ে প্রথম যখন গণেশ অ্যাভিনিউয়ের একটি সাতকেলে আপিসবাড়ির চারতলায় হাজির হই, দুপুর দেড়টা হবে। ঘোরানো সিঁড়ির লাগোয়া দেয়ালে লর্ড ক্লাইভের আমলের ঝুল। কোলাপ্সিব্ল গেট লাগানো খোলা লিফ্টে পেতলের একটি ব্লান্ট ইনস্ট্রুমেন্ট গোছের হাতল গুঁজলে তবে চলে, তাও লিফ্টম্যান দয়ারামের দয়া হলে।
ময়লা আলোমাখা ঘরে অজস্র রংচটা আলমারিই অস্থায়ী ঢাকা দেয়ালের কাজ সারছে। ঘন সবুজ রেক্সিনে ঢাকা কাঠের টেবিলগুলোর অধিকাংশই ফাঁকা। একটিতে গম্ভীর চশমা এঁটে এক মধ্যবয়সিনি ডবল থান-ইটের সাইজের একটি বইতে মগ্ন— কাছে গিয়ে দেখি ‘মহাভারত’। আরেকটিতে দুই শতরঞ্জ কে খিলাড়ি— দাবাযুদ্ধের এক মোক্ষম মুহূর্তে স্তব্ধ। এঁদের কেউ আমার মুখচোরা ‘এই যে শুনছেন’-এ বিন্দুমাত্র কান দিলেন না।
শেষমেশ সহৃদয় একটি কালোকুলো ছেলে এক কর্মচারী দাদার নাম বলে, তাঁর সঙ্গে দেখা করার উপদেশ দিল। কিন্তু ছেলেটির ডিরেকশন মেনে গিয়ে, লোক তো দূরস্থান, কোনও চেয়ারটেবিলও চোখে পড়ল না। আরও কাছে গিয়ে দেখি, দুটো ঘনসংবদ্ধ আলমারির ফাঁকে একটি বিন্দু থেকে সুপ্রচুর ধোঁয়া উঠছে। উড়াইয়া দেখি, সুচারু গোঁফ আর চশমার ও-পাশে জ্বলজ্বলে চোখের এক ভদ্রলোক। মানুষটি অচিরেই চা অফার করে হুকুম করলেন প্রথম মাসের মাইনে না পাওয়া পর্যন্ত টিফিনের পয়সা না দিতে, সে সব ওঁর দায়িত্ব। মুহূর্তে মন ফুরফুরে হয়ে গেল। এই মানুষটির কাছে পরে অনেক বকুনি খেতে হয়েছে, শিঙাড়া-কচুরিও অজস্র। দোষের মধ্যে বছরে দু’বার ম্যালেরিয়া তাঁর কাছে ভবিতব্যের মতো আসত, নিজের বায়োকেমিকের চিকিৎসায় তাঁকে রুখতে পারতেন না।
এক অতিগম্ভীর ভদ্রলোককে একটি টেবিলে দেখতাম, বিন্দুমাত্র ফাইলপত্রহীন অবস্থায় মাসের পর মাস বসে ভাবতে। তিনি যে বিজ্ঞানতাপস, তা বুঝতে অনেক সময় লেগেছে। এক দিন বড়বাবুকে তিনি অনুরোধ করলেন, জানলার পাশে মিঠে রোদ আসা তাঁর সিটটি পালটে দিতে। কী অসুবিধে? অফিসের ভেতরে গরম হাওয়া, বাইরে ঠান্ডা হাওয়া, এই রকম বেজায়গায় থাকা ওঁর পক্ষে অসম্ভব। সর্দিগর্মির ভয়? না, এই তাপমাত্রার তারতম্যে ওঁর শরীরে দুটি চৌম্বক-মেরু তৈরি হয়ে, তার মধ্যে দুম করে সাংঘাতিক বিদ্যুৎপ্রবাহ ঘটে উনি মারা পড়তে পারেন। ‘দুম’ করে শব্দ আর উনি এক মুঠো ছাই, এ নাকি হামেশাই বিদেশে ঘটছে।
এক দাদা তাঁকে জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘শুনলাম, বিশ্বের প্রতিটি বিন্দু প্রতিনিয়ত পরস্পরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে? তা হলে, আমার দু’কাঠা জমির তো এত দিনে বেশ কয়েক বিঘে হওয়া উচিত ছিল, তা তো হল না! আমিও যে পাঁচ ফুট ছ’ইঞ্চি, সেই পাঁচ ফুট ছ’ইঞ্চিই রয়ে গেলাম!’ দু’দিন গভীর ভাবনাচিন্তার সময় নিয়ে অবশেষে উত্তর দিলেন বিজ্ঞানভাবুক: ‘তোমার জমি বা তোমার হাইট সত্যিই বাড়ছে, কিন্তু তুমি যে ফিতে দিয়ে মাপছ, সেটাও একই হারে বাড়ছে, তাই এফেক্টটা বোঝা যাচ্ছে না।’
মহাভারত পাঠরতা যে চরিত্রটির সঙ্গে প্রথম দিনই দেখাশুনো ঘটেছিল, তিনিও আর এক বিস্ময়। এক দিন অফিসে দেরি করে এসে অফিসারের তোপের মুখে পড়ে বললেন, ‘ঠিক সময়েই আসছিলাম স্যর, ঠিক ট্রেনেই, হঠাৎ ট্রেন দাঁড়িয়ে গেল, আর ড্রাইভার ট্রেন থেকে হাতজোড় করে নেমে এসে বলল, জাস্ট এক জন যাত্রী এক্সট্রা হয়ে যাওয়ায় ইঞ্জিন আর টানতে পারছে না। একটি লোক যদি নেমে গিয়ে আত্মত্যাগ করেন, তা হলেই ট্রেন ছাড়বে।’ এই মোক্ষম ত্যাগ-মুহূর্তে আমাদের দিদিই যে এগিয়ে আসবেন, এ তো জানা কথাই।
অনেক দিন আগে, দিদিটি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন, তখন অপূর্ব সুন্দরী, তাকালে চোখ ফেরানো যেত না, হঠাৎ এক ভদ্রলোক মোড়ের মাথায় ধরে বললেন, ‘আমি একটা অফিসের ডিরেক্টর, দু’মাস হয়ে গেল এক জনও বিশ্বস্ত ক্যাশিয়ার পাচ্ছি না, আপনি দয়া করে এই ক্যাশের দায় নিয়ে আমায় বাঁচান।’ সরকারি দফতরে, তাঁর মতে, তিনি ছিলেন ‘এশিয়ার প্রথম মহিলা ক্যাশিয়ার।’ ‘গাইড’ ছবির শুটিংয়ে দেবানন্দের সঙ্গিনী ছিলেন, উত্তমকুমারকে আর্চ করতে শিখিয়েছিলেন, দেশবিভাগের সময় ও-পার বাংলা থেকে পরিশ্রম বাঁচাতে সোনার বাসনকোসন ফেলে আসা দিদিটির বাড়িতে সিনিয়ররা কথা বলতেন ‘স্পোকেন সংস্কৃত’তে!
বিকেলের দিকে, অফিসের মঞ্চে পাওয়া যেত নিরীহ পিয়নবাবুকে, যিনি রিকোয়েস্ট পেলেই, শৈশবে স্কুলে পড়া ‘ট্যাগোর’ সম্পর্কিত রচনাটি দুলে দুলে মুখস্থ বলে যেতেন, দাঁড়ি-কমা সমেত। ইনিই আবার ফিল্মি কায়দায় মাথা ঝুঁকিয়ে জিতেন্দ্রর ছবি থেকে ‘মস্ৎ বাহারো কা ইয়ে আশিক’ গাইতেন, দু-চারটে শিসও যে পড়ত না তা নয়, অবিশ্যি সায়েবদের কান বাঁচিয়ে। জাত কমেডিয়ানদের যেমন ট্র্যাজেডি, অফিসে থাকাকালীনই তাঁর হার্ট অ্যাটাক হয়, তখনও তাঁর কাতরোক্তির ভঙ্গি দেখে অফিসসুদ্ধ লোক হেসে খুন!
এক কলিগ এক বার তার বউয়ের লেখা দুটো চিঠি (একটা মা’কে, একটা শাশুড়িকে) দুটো খামে ভরে ফেলে, সেগুলো সেঁটে, সম্পূর্ণ গুলিয়ে ফেলল, কোনটা কার। মা’কে লেখা চিঠি যদি শাশুড়ির হস্তগত হয়, সর্বনাশ! টিফিনের সময় জরুরি মিটিং করে সবাই মাথা খাটিয়ে পরামর্শ দিলাম, নিজের মা’কে লেখা চিঠি নিশ্চয়ই বেশি মোটা হবে, সুতরাং ভারীও। এর পর অফিসের ডেসপ্যাচ সেকশনের আলমারিতে রাখা দীর্ঘ কাল অব্যবহৃত পুরনো পেতলের দাঁড়িপাল্লা বেরোল, ভালবাসার অক্ষরের ওজন মাপতে!
এক ব্যয়সংকোচী সহকর্মী অফিসসুদ্ধ সবাইকে বিয়ের নেমন্তন্ন করল, মৌখিক ভাবে, নির্দিষ্ট দিনের দু’বছর আগে! তখনও পাত্রী দেখা শুরুই হয়নি! আমাদের বিস্ময়কে অবহেলায় বসিয়ে দিল এক মন্তব্যে: ‘বিশ্বকাপের ফাইনাল কবে কোথায় হবে আগে থেকে ঠিক থাকে না? টিমগুলো পরে ওঠে। এখন থেকে দেখাশুনো হয়ে যে ফাইনাল হবে, ওই তারিখে তাকেই বিয়ে করব, অসুবিধে কী? মেনু আর ভেনু আগে থাকতে ঠিক হয়ে থাকল!’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy