Advertisement
০৪ মে ২০২৪

গাঁধীর ফুটবল দল

আদতে পোরবন্দরের লোক দাদা আবদাল্লার জমজমাট ব্যবসা ছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়। একটি জালিয়াতির ঘটনায় মামলা ঠুকে আবদাল্লা পড়লেন মহা ফাঁপরে। সাক্ষীদের মধ্যে অনেকেই গুজরাতি ছাড়া এক বর্ণ ইংরেজি বলতে পারে না, আবার হাকিম গুজরাতি বোঝেন না। গুজরাতি আর ইংরেজি দুটো ভাষাই ভাল জানে এমন উকিল ছাড়া এ মামলা কেঁচে যাবে। দেশোয়ালি ভাইদের মুখে তরুণ মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর সুখ্যাতি শুনে আবদাল্লা তাঁকে চাকরির প্রস্তাব দিয়ে চিঠি লিখলেন।

বরুণ চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০১৪ ০০:১৮
Share: Save:

আদতে পোরবন্দরের লোক দাদা আবদাল্লার জমজমাট ব্যবসা ছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়। একটি জালিয়াতির ঘটনায় মামলা ঠুকে আবদাল্লা পড়লেন মহা ফাঁপরে। সাক্ষীদের মধ্যে অনেকেই গুজরাতি ছাড়া এক বর্ণ ইংরেজি বলতে পারে না, আবার হাকিম গুজরাতি বোঝেন না। গুজরাতি আর ইংরেজি দুটো ভাষাই ভাল জানে এমন উকিল ছাড়া এ মামলা কেঁচে যাবে। দেশোয়ালি ভাইদের মুখে তরুণ মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর সুখ্যাতি শুনে আবদাল্লা তাঁকে চাকরির প্রস্তাব দিয়ে চিঠি লিখলেন। ১৮৯৩ সালের মে মাসে গাঁধী এসে পৌঁছলেন ডারবানে। উকিল হয়েও মূলত দোভাষীর কাজ করতে হচ্ছিল, তাই অন্যান্য ভারতীয় দোভাষীদের সঙ্গেও আলাপ জমতে দেরি হল না। এঁদের মধ্যে হেনরি পল ছিলেন সবচেয়ে নামজাদা এবং প্রভাবশালী। চেন্নাইয়ের এক খ্রিস্টান পরিবারের সন্তান পল, কালা আদমি হয়েও বেশ জাঁকিয়ে বসেছেন নাটাল-এ। বছর দশেকের মধ্যেই তিন-তিনটি ফুটবল ক্লাবের মাতব্বর।

ঠিক এই সময়েই ভারতীয়দের বাণিজ্যের অধিকার কেড়ে নেওয়ার জন্য একটা বিল আনার তোড়জোড় চলছে পুরোদমে। বিলের খসড়ায় অমানবিক বৈষম্য আর জাতিবিদ্বেষ দেখে বিস্মিত মোহনদাস একটা মিঠেকড়া চিঠি লিখলেন ‘মার্কারি’ পত্রিকায়। এই তরুণের মধ্যে যে আগুন আছে, বুঝতে কারও দেরি হল না। বছরখানেকের মধ্যেই গাঁধীর নেতৃত্বে নাটালে ভারতীয় কংগ্রেসের একটি শাখা খোলা হল। ভবিষ্যতের নায়ককে চিনে নিল হেনরি পলের জহুরি চোখ। তাঁর অনুরোধেই কালো মানুষদের জন্য গড়ে তোলা আফ্রিকার প্রথম ফুটবল সংস্থা ‘ট্রান্সভাল ইন্ডিয়া ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন’ বা ‘টিফা’র সদস্য হলেন গাঁধী।

ছবি: সুমন চৌধুরী

তার পর, দক্ষিণ আফ্রিকায় আসার ছ’বছরের মধ্যেই, তিন-তিনটি ফুটবল দলের কর্তা হয়ে উঠলেন গাঁধী। যে অর্থে সৌরভ কলকাতার কিংবা অভিষেক চেন্নাইয়ের কর্তা ঠিক তেমনটা অবিশ্যি নয়, বরং প্রাণপুরুষ বললেই হয়তো সত্যের কাছাকাছি যাওয়া হয়। ডারবানের ফিনিক্স ফার্ম, জোহানেসবার্গের টলস্টয় ফার্ম এবং প্রিটোরিয়া শহর ছিল এই তিনটি ক্লাবের ঠিকানা। নাম অবশ্য একটিই: Passive Resisters Soccer Club.

নাটালের প্রবাসী ভারতীয়দের সমস্যা ও দাবিগুলি প্রকাশ্যে আনার জন্য ‘ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন’ নামে কাগজটি ছিল গাঁধীর প্রথম হাতিয়ার। ১৯০৩ সালে মনসুখলাল নজর-এর সম্পাদনায় একসঙ্গে চারটি ভাষায় এটি বেরোতে শুরু করে। মিহি সুরের হালকা চালের লেখাই এখানে বেশি ছাপা হত। গোড়া থেকেই গাঁধীর এই কাগজে ফুটবলের গুরুত্ব ছিল চোখে পড়ার মতো। ফুটবলকে সামনে আনাটা যে আসলে গাঁধীর কৌশল, সেটা আফ্রিকা সরকার তো দূরস্থান, তাঁর সহকর্মীরাই বুঝে উঠতে পারেননি। ১৯০৪ সালের ১০ অক্টোবর সব আড়াল ঘুচিয়ে ফুটবল হয়ে উঠল প্রকাশ্য রণনীতি। গাঁধী স্বনামে ‘অ্যান এঞ্জিন অব অপ্রেশন’ শিরোনামে এক সম্পাদকীয়তে যা লিখলেন তার মর্মার্থ: ট্রান্সভালে ভারতীয়দের যাতায়াতে বাধা দেওয়াটা দিনে দিনে সীমা ছাড়াচ্ছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রজা হোক বা না-ই হোক, শুধু গায়ের চামড়াটুকু সাদা হলেই যাবতীয় সুযোগসুবিধার অবাধ আয়োজন। অন্য দিকে শরণার্থীর বৈধ নথিপত্র পেশ করা সত্ত্বেও প্লেগ সংক্রমণের অছিলায় নাটাল, কেপ টাউন আর ডেলাগোয়া বে— সর্বত্রই ভারতীয়দের উপর পীড়ন। কিম্বার্লি ও ডারবানের দুটি ফুটবল দলকে অন্যায় ভাবে আটকে দেওয়াকে কেন্দ্র করে এই দমননীতি সবচেয়ে কদর্য রূপ ধারণ করেছে।...ব্রিটিশ ভারতীয় একটি ফুটবল দলকে না আটকানোর কী-ই বা আছে, সেটা নাকি ভারপ্রাপ্ত প্রধান সচিব মহোদয় বুঝেই উঠতে পারছেন না! ফুটবল খেলাটা যে আদতে ব্রিটিশদেরই জিনিস সেটা ভুলে গিয়ে মিস্টার রবিনসন কিনা ফুটবলকেই গালমন্দ করে বসেছেন! সর্বোচ্চ প্রশাসনিক মহল থেকে ভারতীয় ফুটবল দলটিকে যতই সম্মান জানানো হোক, ট্রান্সভালের কর্তৃপক্ষ হয়তো সেই মধ্যযুগেই পড়ে থাকবেন।

গাঁধীর বুঝতে দেরি হয়নি, খেলার মাঠ চালানোর আসল সুতোটি ধরে থাকেন ফুটবলসংস্থার কেষ্টবিষ্টুরা। তাই সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে নামলেন টিফা-র সভাপতি নির্বাচনের লড়াইয়ে। পক্ষে ভোট পড়ল ১০টি, বিপক্ষে ২৩টি। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার ফুটবল প্রশাসনের একটা বড় অংশ জেনে গেল, এই ছোটখাটো মৃদুভাষী ভারতীয় উকিলবাবুটি তিন তিনটি ফুটবল দল চালাচ্ছেন এবং সেখানেই তিনি থামতে চাইছেন না! ভোটে পরাজিত গাঁধীকে তারা অন্যতম আইনি পরামর্শদাতা হিসেবে আমন্ত্রণ জানাল। শেষ পর্যন্ত ১৯১২ সালের মে মাসে গাঁধী নাটালের কুলীনতম ফুটবল সংস্থার প্রথম ভারতীয় পেট্রন নির্বাচিত হলেন! দক্ষিণ আফ্রিকার ফুটবল প্রশাসনে সেই প্রথম প্রবেশ কোনও কালা আদমির। ২০১০-এ দক্ষিণ আফ্রিকা ফুটবল বিশ্বকাপের প্রস্তুতিপর্বে, এই লড়াইয়ের কথা বলতে বলতে বার বার আবেগপ্রবণ হয়ে পড়তেন নেলসন ম্যান্ডেলা।

অবশ্য এর দু’বছর আগে, ১৯১০ সালেই অপ্রতিরোধ্য ‘জোহানেসবার্গ রেঞ্জার্স’কে তাদের ঘরের মাঠ ‘মে ফেয়ার ময়দান’-এ রুখে দিয়েছিল প্যাসিভ রেজিস্টার্স। এক শ্বেতাঙ্গ কর্মচারী গায়ের জ্বালায় ‘র্যান্ড ডেলি মেল’ পত্রিকায় চিঠি লিখে ফেললেন, ‘নাটালের ভারতীয়রা কোনও কম্মের নয়। ওরা ফুটবল নিয়ে মেতে থাকবে, খবরের কাগজ বেচবে আর কেরানির কাজ করবে।’ সাদা চামড়ায় আরও ছ্যাঁকা বরাদ্দ ছিল। গাঁধীর ছেলে মণিলাল এবং তার সত্যাগ্রহ-সৈনিক বন্ধু সুরেন্দ্র রাই বাপুভাই মেধ মিলে, প্যাসিভ রেজিস্টারকে আরও দুরন্ত দল করে তোলেন। তখন আফ্রিকায় ‘স্যাম চায়না কাপ’ ফুটবলের সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত টুর্নামেন্ট। ১৯১১ থেকে ১৯১৩ পর্যন্ত এই কাপ জয়ের লড়াইয়ে প্রথম সারিতে উঠে আসে গাঁধীর ফুটবল বাহিনী।

রাজেন্দ্র শেট্টি এবং এরিক ইৎজ্কিন-এর লেখা থেকে জানা যায়, গাঁধীর ফুটবলপ্রীতিটা ‘প্যাসিভ’ ছিল না! নিজের দলের ফুটবল স্ট্র্যাটেজি ঠিক করার জন্য তিনি শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ দলগুলির খেলা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করছিলেন। তাঁর মনে ধরেছিল গ্লাসগো থেকে আসা মজদুরদের দ্রুত পাসের গতিময় ফুটবল। আফ্রিকা উপমহাদেশে সবচেয়ে পুরনো স্কটিশ ক্লাব ‘কুইনস পার্ক’ দলের এক খেলোয়াড় কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদের এই ঘরানায় ফুটবল প্র্যাকটিস করাতেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষবিরোধী আন্দোলন নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, অনেকে বলেন, ফুটবলের ধরনধারণ রপ্ত করার ব্যাপারে গাঁধী পরামর্শ করতেন তাঁর ফিনিক্সের প্রতিবেশী জন ডিউব-এর সঙ্গে। ডিউব ও গাঁধী, দুজনেই হয়ে উঠেছিলেন কালোমানুষদের স্বার্থরক্ষার আন্দোলনের প্রধান মুখ। দুজনের কাছেই ফুটবল ছিল আন্দোলনেরই এক ভাষা।

এই ২০১৪ সালেও, ফুটবল প্রশাসনে মহিলার সংখ্যা নিতান্তই হাতে গোনা। গাঁধী এ ক্ষেত্রেও একটা বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছিলেন। আন্দোলনে তাঁর ব্যস্ততা অনেক বেড়ে যাওয়ার কারণে, প্যাসিভ রেজিস্টারের প্রশাসনিক দায়িত্ব (আর এক জনের সঙ্গে) সামলাতেন তাঁর পি.এ. সোনিয়া স্ক্লেসিন। প্রিটোরিয়া শাখার খেলোয়াড়দের সঙ্গে রেঞ্জার্স ক্লাবের মাঠে তোলা একটি গ্রুপ ফোটোতে দেখা যায়, গাঁধীর পাশে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর সেক্রেটারি এই ইহুদি কিশোরী, শতবর্ষ আগে পুরুষসর্বস্বতার যুগে তিন তিনটে ক্লাবের প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত এক নারী।

barun.chattopadhyay@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

barun chattopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE