Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
সুমনামি

গলার খেলা বোঝে ক’জন

গানের গলা তৈরি করতে গেলে স্বর থেকে স্বরে গলা চালানোর ব্যায়াম করতেই হবে। এই অনুশীলনকে ‘পালটা’ বলে। গানের শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের নানান পালটা লিখে দেন। অনেক শিক্ষকই বলেন এগুলি ‘আ আ আ’ করে গাইতে, তার পর সরগম করে। সাধারণত দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা যে যার স্কেলের মধ্যসপ্তকের ষড়জ বা সা থেকে শুরু করে ক্রমান্বয়ে ওপরের দিকে উঠছেন, তার পর তারসপ্তকের সা থেকে ফিরছেন, এই পালটাটাই তাঁরা করে যান খানিক ক্ষণ। তার পর বিভিন্ন শুদ্ধ স্বরের নানান কম্বিনেশন।

কবীর সুমন
শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

গানের গলা তৈরি করতে গেলে স্বর থেকে স্বরে গলা চালানোর ব্যায়াম করতেই হবে। এই অনুশীলনকে ‘পালটা’ বলে। গানের শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের নানান পালটা লিখে দেন। অনেক শিক্ষকই বলেন এগুলি ‘আ আ আ’ করে গাইতে, তার পর সরগম করে। সাধারণত দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা যে যার স্কেলের মধ্যসপ্তকের ষড়জ বা সা থেকে শুরু করে ক্রমান্বয়ে ওপরের দিকে উঠছেন, তার পর তারসপ্তকের সা থেকে ফিরছেন, এই পালটাটাই তাঁরা করে যান খানিক ক্ষণ। তার পর বিভিন্ন শুদ্ধ স্বরের নানান কম্বিনেশন।

ছেলেবেলা থেকেই খেয়াল করেছি, যে তাল যে লয়ে শিক্ষার্থী শুরু করছেন, সকালের গলা সাধার পালটা-অনুশীলন পুরোটাই চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি মোটামুটি একই তালে-লয়ে। তাল একই রেখে লয় একটু একটু করে বাড়ালে শিক্ষার্থীর গলা সচল রাখায় তা আরও সহায়ক হতে পারত।

আমাদের দেশে নানান ধরনের গানের সুর কণ্ঠের নমনীয়তা ও সচলতা দাবি করে। ইউরোপের বেশির ভাগ দেশ এবং উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার বেশির ভাগ গানে সুর-গলার কাজ বা গলার মুড়কি প্রায় থাকেই না। ওই সব দেশের লঘু সংগীত ও পল্লিগীতির সুর মোটের ওপর একমাত্রিক। গ্রিসের গান আবার অন্য রকম। তার একটা কারণ হয়তো— দক্ষিণ ভারত থেকে সম্ভবত হিন্দু বর্ণাশ্রম প্রথার আক্রমণের হাত থেকে পালিয়ে-বাঁচা জিপসিরা দক্ষিণ ভারতের সংগীতের বেশ কিছু ধরন ও কিসিম তাঁদের স্মৃতি ও অভ্যেসে পুরে নিয়ে ম্যাসিডোনিয়া অবধি চলে গিয়েছিলেন। ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক নৈকট্যের কারণে তাঁদের সঙ্গে গ্রিকদের সাংগীতিক লেনদেন হয়। কিংবদন্তি গ্রিক সুরকার (আধুনিক) মিকিস থিয়োডোরাকিসের রচনায় সূক্ষ্ম গলার কাজ ও গলার আন্দোলন পাওয়া যায়, যা গাওয়া সকলের কম্ম নয়। প্রশিক্ষিত কণ্ঠ থাকা দরকার।

গেল শতকের আশির দশকে আমেরিকান শিল্পী স্টিভি ওয়ান্ডারের ‘আই জাস্ট কল্ড টু সে আই লাভ ইউ’ গানটি বিশ্বজয় করে ফেলেছিল। কোন কণ্ঠতালিম ও রেওয়াজের বলে যে তিনি ওই ব্যতিক্রমী, দুরূহ কাজ ও মুড়কিগুলি অমন খেলার ছলে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন, কে জানে! আজকের অনেক আমেরিকান ও বাঙালি গায়ক ওই গানটি গেয়ে বিশ্বজয় তো দূরের কথা, নিজের বাড়ির বাথরুম জয় করতে পারবেন কি না সন্দেহ। আমি অন্তত পারিনি, অথচ লোকে তো আমার পরিচয় দিতে গিয়ে ‘গায়ক’ই বলেন।

আমি খুব সিরিয়াসলি বলছি, গেল শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে এবং আরও পরে, হাল আমলে পশ্চিম বাংলার যে পুরুষ শিল্পীরা নাম করেছেন ও করছেন (আমি সমেত), তাঁদের এক জায়গায় এনে স্টিভি ওয়ান্ডারের ওই গানটি বার বার শোনানো হোক। লিরিক ছাপিয়ে দিয়ে দেওয়া হোক হাতে হাতে। বার বার শুনে আমরা গানটি তুলি। এ বারে আমাদের গাইতে হবে। উচ্চারণে ভেতো-বাঙালি ভাব আসুক ক্ষতি নেই। স্টিভি ওয়ান্ডারের গায়কিতে গানটি আমরা এক-এক করে গাইতে শুরু করি। ঠিক ওঁর মতো সাবলীল ভাবে, স্বচ্ছন্দে ওই কাজগুলি করতে হবে সুর-তাল-লয় বজায় রেখে— নিখুঁত ভাবে। আমার ধারণা, আমাদের মধ্যে খুব কম লোকই তা পারবেন। মনে রাখতে হবে— সুরে, গলার কাজে, ঝোঁকে, প্রায় ঠুংরির মতো মুড়কিতে একরত্তি আপসও করা চলবে না।

অনেক ভেবেছি। কী ভাবে স্টিভি ওয়ান্ডার ওই গলাটা তৈরি করলেন! কী ধরনের কণ্ঠচর্চা ও অনুশীলন তিনি করেছিলেন। না কি গলার ওই কাজগুলি তাঁর জন্মগত। পাশ্চাত্যের ধ্রুপদী সংগীতে কিন্তু দস্তুরমত তান আছে। নানা ধরনের তান। ক্লাসিকাল অপেরায় শোনা যায়। স্টিভি ওয়ান্ডার কি তবে অপেরা গাওয়ার তালিম নিয়েছিলেন?

আমাদের দেশেও এমন মানুষ পাওয়া যায়, যাঁরা সূক্ষ্ম কাজ ও ছোটখাটো তান করার ক্ষমতা নিয়েই জন্মান। তাঁদের কি তা হলে গলা না সাধলেও চলে? না, তা নয়। ওই ক্ষমতা বাড়ানো ও ধরে রাখা দরকার। বিশেষ করে পুরুষদের ক্ষেত্রে ভারী গলার অধিকারীরা গলার আরোহণ ক্ষমতা ও জোর হারিয়ে ফেলতে থাকেন মধ্যবয়স পেরোলে। নিয়মিত কণ্ঠচর্চা করলে কালের এই ক্ষয় কিছুটা হলেও রুখে দেওয়া যায়। শুনেছি আরাধ্যা কেশরীবাঈ কেরকার সংগীতের পেশা থেকে সরে আসার পরেও দিনে ১২ ঘণ্টা রেওয়াজ করতেন। এমনই ছিল তাঁর খেয়াল গাওয়ার গায়কি যে মনে হত তবলার লয়ের দ্বিগুণ তো বটেই, চৌগুণেও তিনি সমানে একাধিক সপ্তকব্যাপী (প্রায়ই তিন সপ্তক) তান করে রেওয়াজ করছেন। তাঁর ক্ষেত্রে এমনকী ‘রেওয়াজ অঙ্গ’ কথাটাও বলা হত।

কি উত্তর ভারতীয় কি দক্ষিণ ভারতীয় সংগীতের অনেক ধ্রুপদী সংগীতশিল্পী দিনে পারলে চার ঘণ্টা ‘মন্দ্র-রেওয়াজ’ করতেন। কেউ কেউ হয়তো এখনও করেন। বাংলায় খুব কম সংগীতশিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের মন্দ্রসপ্তকে রেওয়াজ করতে বলেন ও রাস্তাগুলো দেখিয়ে দেন। আমি ভাগ্যবান। আমার পিতৃবন্ধু প্রয়াত নিখিলচন্দ্র সেন আমায় কৈশোরে বলেছিলেন, ‘বাবা, তানপুরা নিয়ে খালি নীচের দিকে সুর লাগিয়ে যাও, মন্দ্রসপ্তক ছেড়ে যেও না, রেওয়াজ করে যাও। তোমার প্রিয় আমীর খানও ওই ভাবে রেওয়াজ করেন।’ বাবার বয়ঃজ্যেষ্ঠ নিখিলচন্দ্র সেন প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছেও শ্রুতিসুখকর, গম্ভীর, চলমান ও ঈর্ষণীয় ভারসাম্যযুক্ত কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন বলে রহস্যটা জানতে চেয়েছিলাম তাঁর কাছে— কী ভাবে রাখছেন ওই গলা। উত্তরে তিনি আমায় যা বলেছিলেন, তা তাঁর আগে কেউ বলেননি আমায়। এই উপদেশ কিন্তু আজ ও আগামীর কণ্ঠসংগীত শিক্ষার্থীদেরও কাজে লাগবেই। প্রতি দিন সকালে-বিকেলে অন্তত ঘণ্টাখানেক মন্দ্রসপ্তকের ‘সা’ থেকে সমানে আরও নীচে যাওয়া এবং ওই সা-তে ফিরে আসা। তার ওপরে নয়। মানুষের গলা এমন যে, মন্দ্র ও অতিমন্দ্র সপ্তকে (ভারী গলা) গলা সাধলে চড়ার দিকটাও খুলে যায়। ক্রমাগত চড়ায় সাধলে ক্ষতি হয় গলার।

সাহেবরা ‘লিপ রোলিং’ (lip rolling) নামে যে পদ্ধতিটির চর্চা করে থাকেন, তাও খুবই কাজের। ছোটবেলায় আমরা যেমন ঠোঁট দুটো কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে হাওয়াটা জোরে ছেড়ে কাল্পনিক মোটরবাইক বা মোটরগাড়ি চালাই, ঠিক সেই ভাবে আওয়াজটা সুরে লাগানো নানান পরম্পরায়। আগ্রহীরা ইন্টারনেটে সার্চ করতে পারেন। অনেক ভিডিয়ো আছে। দেখে-দেখে শুনে-শুনে এই কণ্ঠচর্চা পদ্ধতি শিখে নেওয়া সম্ভব।

ছবি: সুমন চৌধুরী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anandabazar rabibasariya kabir suman sumanami
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE