Advertisement
০২ মে ২০২৪

চুপ! শিশুশ্রম চলছে

একরত্তি কালো ছেলেটি ভূশণ্ডির কাক। রুখু-শুখু চেহারায় মাথায় কাকের বাসা। শরীরে চাপানো ঢের বড় একখানা গেঞ্জি। তেলচিটে কালি জ্যাবড়ানো। শরীরটাও গেঞ্জির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কালো কালিতে লেপা। হঠাৎ প্রশ্ন শুনে ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকে। হিন্দি সমঝ্তা হ্যায়, হিন্দি? নাম ক্যা হ্যায় রে? অনেক ক্ষণ চুপ করে থেকে যেন গভীর রহস্য ভেদ করে উত্তর খুঁজে পায় সে।

দেবাশিস দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০৫
Share: Save:

একরত্তি কালো ছেলেটি ভূশণ্ডির কাক। রুখু-শুখু চেহারায় মাথায় কাকের বাসা। শরীরে চাপানো ঢের বড় একখানা গেঞ্জি। তেলচিটে কালি জ্যাবড়ানো। শরীরটাও গেঞ্জির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কালো কালিতে লেপা। হঠাৎ প্রশ্ন শুনে ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকে।

হিন্দি সমঝ্তা হ্যায়, হিন্দি? নাম ক্যা হ্যায় রে?

অনেক ক্ষণ চুপ করে থেকে যেন গভীর রহস্য ভেদ করে উত্তর খুঁজে পায় সে।

রাম।

কী করিস এখানে? কোথায় থাকিস? চেহারার এমন ছিরি কেন?

গুটিসুটি মেরে যায় রাম। তার পর শরীরটাকে এক দিকে খানিক বেঁকিয়ে, মাথাটা নামিয়ে চলে যায় কোনও উত্তর না দিয়েই। কংক্রিটে বাঁধানো বিশাল চৌহদ্দি, সার দিয়ে ট্রাক দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার গলিপথে হারিয়ে যায় দিব্যি।

এই বিশাল-বিস্তৃত চৌহদ্দিরই নাম চেকপোস্ট। সেখানেই দিনভর কাজ করে রাম, রবি, সন্তোষ, শেখ আলতাফ, সতীশ, আফতাবরা। কারও বয়স সাত, কারও বারো। ট্রাকগুলোর কলকব্জার পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকে ওরা। কিংবা বলা যেতে পারে ওদেরকে ব্যস্ত রাখা হয়। ওরা সীমান্তের শিশুশ্রমিক।

খড়্গপুর ছুঁয়ে বেলদা হয়ে বাংলা-ওড়িশা চেকপোস্ট, লক্ষ্মণনাথ। কাছাকাছি শহর বলতে মিনিট কুড়ি দূরের জলেশ্বর। দেশের পুব থেকে দক্ষিণগামী ট্রাকগুলোর একটা বড় অংশকেই এই চেকপোস্ট পেরোতে হয়। এখানে থেমে পিঠে চাপানো পাহাড়প্রমাণ বোঝা-র হিসেব দিয়ে কাগজপত্র দেখিয়ে পারানির কড়ি গুনে ওড়িশা হয়ে অন্ধ্র প্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, তামিলনাড়ু ছড়িয়ে পড়ে ট্রাকগুলো। তবে, সীমান্ত পার হওয়া সহজ নয়। ঝক্কি আছে ঢের। দালালও রয়েছে বিস্তর। তারা ব্যস্তসমস্ত হয়ে মোটরবাইকে চেপে ড্রাইভারের থেকে কাগজ নিয়ে ছুট দেয় অফিসঘরে। সাঁইসাঁই মোটরবাইক ছুটতে থাকে চৌহদ্দির এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে। কখন তারা অনুমতিপত্র নিয়ে ফিরবে, সেই প্রতীক্ষায় না থেকে ট্রাকের ড্রাইভার-খালাসিরা রসুন-পেঁয়াজ ছাড়াতে বসে। এর পর রান্না-খাওয়া এবং তার পর লম্বা হয়ে ঘুম।

অবসরের এই সময়টাতেই কাজে নামে আলতাফ, রবি, রাম, সন্তোষরা। ট্রাকের বিভিন্ন যন্ত্রে গ্রিজ মাখিয়ে নরম রাখতে হয় ওদের। গ্রিজ লাগাতে হয় এয়ার প্রেশার যন্ত্রের মাধ্যমে। চাকা লাগানো দুটো ধাতব ড্রাম, তার একটায় গ্রিজ ভরা থাকে, অন্যটায় হাওয়া। রেগুলেটর বাড়ানো-কমানোর রাবারের পাইপ দিয়ে ভুসভুস করে গ্রিজ বের হতে থাকে। সেই পাইপ ট্রাকের বিভিন্ন জায়গায় ছুঁইয়ে গ্রিজ মাখিয়ে দেওয়াই ওদের কাজ। কাজ শেষ হলে ড্রাইভারের থেকে পয়সা গুনে নেয় ওদের ছোটে ওস্তাদ। সে-ই হল চেকপোস্টের শিশু শ্রমিকদের লোকাল গার্জেন। দিনের শেষে রোজগারের পুরোটাই চলে যায় আসল মালিকের হাতে। সারা দিনের রোজগার সব মিলিয়ে অন্তত পাঁচ-ছ’হাজার টাকা। আর রবি-রামেদের ভাগ্যে মজুরি জোটে কতটা? দিনপ্রতি ৫০ থেকে ১০০ টাকা।

চেকপোস্টের চৌহদ্দির বৈচিত্র কম নেই। হরেক কিসিমের ব্যবসাদার পসার জমিয়েছে এখানে। কান পরিষ্কারওয়ালা, দাঁত পরিষ্কারওয়ালা। আর আসে ঝালরওয়ালা শিখ। তার হাতে নানান স্টিকার, কাঁধে লাল-নীল সিল্কের ফিতে। ড্রাইভারের পছন্দসই দেবদেবীর স্টিকার সে গাড়িতে সাঁটিয়ে দেয়। এই লোকগুলোর মাঝে কী বেমানান হয়ে ওঠে খুদে আলতাফ, সতীশরা? না কি ওরা মিলেমিশে যায় ওদের সঙ্গে? ঠিক বোঝা যায় না।

এক গাড়ির কাজ শেষ হলে মেশিন ঠেলে ওরা চলে যায় অন্য গাড়ি-চালকের কাছে। দলে দলে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে যায় গোটা চৌহদ্দিটাতেই। ছোটে ওস্তাদ, যার বয়স অন্তত কুড়ি-বাইশ, মেশিন ঠেলবে না, হাঁটবে আগে আগে। তাকে অনুসরণ করবে খুদের দল, যাদের চেহারার থেকে মেশিনটাই বড়। হঠাৎ দেখলে মনে হয়, মেশিনটা বুঝি আপনিই চলে বেড়াচ্ছে। সাত বছরের ছোট্ট শেখ আফতাব যেমন। শরীরের সব শক্তি নিঃশেষ করে ও গ্রিজ মেশিনটা ঠেলে। দিন শেষে ৮০ টাকা ওর মাইনে। অবশ্য দিন শেষ না কাজ শেষ, সেটা বলা মুশকিল। কারণ, ওদের কাজের নির্দিষ্ট কোনও সময়সীমা নেই। ভোর ছ’টাতেও আফতাবকে দেখা যায়, আবার সন্ধে ছ’টাতেও আফতাব।

একটি ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে চেকপোস্ট টহলদারিতে বেরোয় ছোটে ওস্তাদ। পথ আটকে খেজুর শুরু করি। আচ্ছা, তুমি তা হলে এখানকার বাদশা। তা, নাম কী তোমার?

টম বিগেঞ্জা।

টম বিগেঞ্জা? আগে-পিছে কিছু নেই?

হ্যাঁ, শেখ। এ বার মেশিন-ঠেলা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে নাম জিজ্ঞেস করি। এক বার টমের দিকে তাকিয়ে সে নাম জানায়— সন্তোষ।

সন্তোষ, বয়স কত তোমার?

সন্তোষ বলে, বারো। উত্তর শুনে হা-হা হাসিতে ফেটে পড়ে টম।

কী হল, হাসছ কেন?

আরে তেরা উমর কেয়া বারা সাল? তু তো জোয়ান মর্দ হ্যায় রে শালা। ফের হাসতে হাসতে বয়সের প্রশ্নটাকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে চায় টম। চল্ চল্, ভাগ হিঁয়াসে। সন্তোষের রোজগার অন্যদের তুলনায় একটু ভাল। দিন প্রতি ১০০ টাকা। আমার দিকে ফিরে টম বলে, কেয়া কাম হ্যায় আপকা, উমর পুছনেসে কেয়া হোগা? আপ যাইয়ে ইধারসে।

কিছু ছবি তুলে ফেলি চটপট। মেশিন টানার ছবি। গ্রিজ লাগানোর ছবি। বিরাট ট্রাকের নীচে শুয়ে থাকা একা খেলা করা আফতাবের ছবি। ট্রাকগুলোর কোনওটায় দশ চাকা, কোনওটার বাইশ চাকা। চুয়াত্তর চাকার ট্রাকও রয়েছে। সেই ট্রাকগুলোর নীচে লিলিপুটের মতো ওরা সেঁধিয়ে যায়, শুয়ে-বসে থাকে।

চেকপোস্টের বিশাল চাতালে খাবারের লোভে উড়ে বেড়ায় শালিক, গোলা পায়রা, দাঁড়কাক। ওদের মাঝখান দিয়েই মেশিন ঠেলে হেঁটে যায় আলতাফ, রাম। চুপি চুপি জিজ্ঞেস করি, পড়াশোনা করেছিস? এখানে ক’টার সময় আসিস, কখন বাড়ি যাস? বাড়ি কোথায় তোদের? কিন্তু ওদের উত্তর আসার আগেই তিনটে মোটরবাইক ঘিরে ধরে আমাকে। সর্বাঙ্গ মেপে এক জন বলে, লগতা হ্যায় ইধার নয়া আয়া হ্যায়। বললাম, হ্যা।ঁ

রুক্ষ স্বরে বাইকওয়ালা বলল, আপনার এত কৌতূহল কীসের? যে কাজ করতে এসেছেন, সেটাই করুন। বাচ্চাদের ছবি তুলছেন কেন?

বললাম, বাচ্চা ভাল লাগে, তাই।

তা হলে যে দিকে কাশফুল আছে, রেললাইন আছে, সে দিকে দাঁড় না করিয়ে ট্রাকগুলোর সামনে ওদের দাঁড় করিয়ে ছবি তুলছেন কেন? আশপাশের আদিবাসী গ্রামগুলো থেকে ওরা আসে। আমরা নিয়ে আসি। এখানকার রোজগারে ওদের খাবার জোটে। আপনি ওদের খাওয়াতে পারবেন?

বললাম, এত কিছু ভেবে ছবি তুলিনি। ঠিক আছে, আর তুলব না।

এ বার ঠান্ডা গলায় বলল, শুনুন দাদা, এটা বর্ডার এলাকা। বেশি ত্যান্ডাইম্যান্ডাই করার চেষ্টা করবেন না। নিজের কাজ সেরে ফিরে যান। বাইকগুলো ফিরে যায়।

বোঝা যায়, নাবালক ছেলেগুলোকে হাড়ভাঙা খাটুনি খাটিয়ে অঢেল উপার্জনের সুযোগ ওরা ছাড়তে চায় না। কিন্তু কাজটা যে অনৈতিক, আইনবিরুদ্ধ, সে জ্ঞান টইটম্বুর। তাই হুমকি।

একটা ট্রাক এসে দাঁড়ায়। দরজা খুলে নেমে আসে ড্রাইভার। মহম্মদ মস্তান বেগ। বাড়ি অন্ধ্র প্রদেশের চিত্তুরের কামশালা পল্লিতে। মস্তানের সামনে মেশিন ঠেলে দাঁড়ায় আট বছরের রাম। গ্রিজ লাগানো বাবদ ১২০ টাকায় রফা হয়। কাজ শেষে রামের হাতে অতিরিক্ত দশটা টাকা গুঁজে দেয় মস্তান। বলে, এত ছোট বাচ্চা, কেউ কিছু বলে না! অন্ধ্রেও আগে এমন হত, তবে এখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন ওখানে এমন ঘটলে পুলিশ কড়া ব্যবস্থা নেয়।

রামের থেকে টাকাটা নিয়ে নেয় টম। অবশ্য ওর বকশিশের দশ টাকা বাদ দিয়ে। ফের মেশিন ঠেলতে থাকে রাম। চেকপোস্টের চাতালের পর খোলা মাঠ। তার পরই রেললাইন। সেখান দিয়ে হুইস্ল বাজিয়ে ছুটে যায় ট্রেন। চকিতে সে দিকে ঘাড় ঘোরায় রাম। কাশফুলের থোকা-থোকা সাদা পেরিয়ে তার চোখও ছুটতে থাকে। তবে কয়েক মুহূর্তের জন্যই। টমের চিৎকার তার ছোটা থামিয়ে দেয়।

কেয়া রে, ট্রেন কভি দেখা নেহি তু?

পট তো সাজানোই ছিল। সেই কাশফুল, সেই রেলগাড়ি। রাম তবু অপু হতে পারে না।

ddasgupta122@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

rabibasariya anandabazar debashis dasgupta
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE