ছবি: সুমন চৌধুরী
৬৫ থেকে ’৭৫ সালের মধ্যে উত্তরবঙ্গের এক মফস্সলে হাজারখানার বেশি শরীরে গড়ে পাঁচটা করে ধরলেও, মোট পাঁচ হাজার স্টিচ করতে হয়েছিল হাফেজ’দাকে। দারুণ স্টিচের সিক্রেট জানতে চাইলেই বলত— যৌবন। মানুষের শরীর নাকি সবচেয়ে খাসা সেলাইযোগ্য থাকে ১৫ থেকে ২৫-এর মধ্যে। নরম, তবে তুলতুলে নয়। আবার শক্ত, কিন্তু কটকটে নয়। তা স্টিচ প্র্যাকটিস করার এত তরুণ-হাত জোটে কী ভাবে? সরকারি হাসপাতালের আউটডোর থেকে গঞ্জশহরের একমাত্র কলেজের খেলার মাঠে পার্মানেন্টলি পোঁতা পতাকা তোলার বাঁশটার দিকে তর্জনীটা স্থির করত হাফেজদা। কলেজের কথা কইচি গো! ওইখানকার ছোকরাগুলোর হাত-মাথা সেলাই করেই তো এমন হাতযশ। একটা মিটিং-মিছিল হোক না! অন্তত দশটা কেস আসবে। লাল দলের হলে নাকি মাথা ফাটার কেস বেশি আসত, কারণ দূর থেকে ঢিল ছুড়ে ঘায়েল করাই ছিল তেরঙার মেজরিটির রণকৌশল। আর লালেরা তেরঙাদের মারত কাছ থেকে। হাত-পা-মাথায় তেলাবাঁশ বা রডের ঘায়ে ফাটা হতে পারে, আবার পিঠে ক্ষুরটানা ক্ষতও হতে পারে। ইনজুরি দেখেই হাফেজদা বলে দিত কোন পার্টির লোক।
হাফেজদা মারা যাওয়ার পর সেই চেয়ারে বসল তার ছেলে রবিউল। সে কান খাড়া করে শুনত সেলাইওয়ালাদের কথোপকথন।
তোরা রায়গঞ্জে প্রিন্সিপালকে মেরেছিস!
আর তোরা! তোদের বাপ-ঠাকুরদা সন্তোষ ভট্টাচার্যকে আদর করেছিল?
ছাড়! ছাড়! সেটা ছিল আন্দোলন!
অ, আর এটা কি দোলন!?
ফাটাকেষ্টও এক কালে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল নিয়ে কালীপুজোয় উত্তর কলকাতায় বহু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন। সে সব এখন পুরাণের পার্ট হয়ে গেছে বলে সত্তর পেরনো অনেকেই দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। কিন্তু সত্য এবং বিজ্ঞানসম্মত বামাবর্ত না এলে ছাত্রলীলা আজ এমন ধারাবাহিক হত না। স্ট্যালিনের কেলো সারা পৃথিবী জেনে যাওয়ার পরেও বেচারা ছাত্রছাত্রীরা স্ট্যালিনজয়ন্তীতে ‘ওই মহামানব আসে’ গাইতে বাধ্য হত। তবে বাবা-পার্টি বদলে গেলেও, ছাত্র সংগঠনের রবরবা সমানে চলেছে। তখন আস্ত একটা ইউনিভার্সিটি লোকাল কমিটি হয়ে গিয়েছিল। এখন প্রোফেসর শঙ্কু মিঃ ইউনিভার্স হয়ে গেছেন।
কলকাতায় এমন দিন গেছে, যে দিন কলেজ স্ট্রিটে মাওয়ের নামে, বেলেঘাটায় লেনিন ভার্সাস নেতাজির নামে, আর আমহার্স্ট স্ট্রিটে জাতীয়তাবাদের নামে একসঙ্গে ছাত্রদল ‘আমরা শক্তি আমরা বল’ গাইতে গাইতে যদুবংশের লীলাভিনয় দেখিয়েছে। রায়গঞ্জ আর মাজদিয়ার জেল-বেলে কদ্দিনেরই বা তফাত! কলেজ ইলেকশনের দিন কলেজের বারান্দায় চেন ঘোরাতে ঘোরাতে তন্নিষ্ঠ সমাজতন্ত্রী নেতাটি বিরোধী ছেলেমেয়েদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছেন, বা বিপ্লবী বক্তিমে-ঝাড়া নেতা কলেজ চত্বরে সবার সামনে ফেলে পেটাচ্ছেন এসইউসি-র মেয়েদের, এ সব দৃশ্য সব্বারই গা-সওয়া ছিল। কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের যে ছেলেটি ‘অন্য রঙের’, বা নিতান্তই ‘রংবিহীন’ ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভ হতে দাঁড়িয়েছে, তাকে বাড়ি ফেরার পথে সাত-আট জন মিলে ঘিরে ধরে থ্রেট করা প্রায় নিয়ম ছিল। তার পরেও সে না মচকালে, বেধড়ক ঝাড়, আবার কী? ইউনিয়ন ‘ঘেরাও’ করলে শিক্ষকেরা বাথরুম যাওয়ার অনুমতি চাইতেন কেঁচোর মতন। লালপার্টির মিছিল থাকলে কলেজ ফাঁকা করে সব্বাইকে ঝেঁটিয়ে নিয়ে যেত ইউনিয়নের দাদারা, ছাত্র শিক্ষক কেউই বাদ পড়ত না। আসলে আদর্শটা খুব জাঁকালো ছিল: ত্যান্ডাইম্যান্ডাই করলেই পিটিয়ে ছাল ছাড়িয়ে নেব। এক বার, বিকেলের দিকে এক কলেজের ইউনিয়ন-নেতারা দল বেঁধে হকি স্টিক নিয়ে বেরচ্ছে, একটি ক্যাবলা ছাত্র জিজ্ঞেস করল, হকি ম্যাচ আছে বুঝি? কী হাসি! না রে মদনা, ওই কলেজের নকশালদের পেটাতে যাচ্ছি। যাবি?
তিয়েন আন মেন স্কোয়ারে শিক্ষার্থীদের যে দিন ট্যাংক দিয়ে দুরমুশ করা হয়েছিল, সমাজতান্ত্রিক কিউবার কমিউনিস্ট পার্টিও বিনা দ্বিধায় নিন্দা করেছিল। কিন্তু র্যাডিকাল বঙ্গীয় ছাত্র-নেতাদের অনেকেই গাঁকগাঁক করে ওই ছাত্রপীড়নকে নির্লজ্জ ভাবে গ্লোরিফাই করতে ছাড়েননি, টানা বক্তৃতায় বলেছিলেন নিরস্ত্র ছাত্রদের খুন করে চিন বেশ করেছে দারুণ করেছে, কারণ তাঁদের এল.সি ওই বচন শিখিয়ে দিয়েছিল। এল.সি কি সোজা কথা? কলেজের কমন রুমে প্রায় প্রতি দিনই যে তিন জন টেবিল টেনিস খেলে যাচ্ছে, ইউনিয়ন রুমে বসে সারা দিন যে পাঁচ জন বিড়ি খাচ্ছে ও বাখোয়াজি করছে, ক্যান্টিনে যে সাত জন ডিমসেদ্ধ মুখে ভুবনভোলানো হাসছে ও কলেজের মাঠে যে বারো জন সারা দিন লেগস্পিন প্র্যাকটিস করছে, তারা কেউই কলেজে পড়ে না, তাদের কলেজে পড়া শেষ হয়েছে বহু বছর হল। কিন্তু তাদের হাত থেকে ক্যাম্বিস বল বা কলেজের স্টিয়ারিং ছিনিয়ে নেবে কে? তারা যে এল.সি-র লোক, ছাত্র ইউনিয়নের কানটি মুলে তারাই চালাচ্ছে ও রাজনীতি ঝালাচ্ছে!
আর এক মারাত্মক ব্যাপার কালচার! আগে ফ্রেশার্স ওয়েলকামে ‘ব্যাট্লশিপ পোটেমকিন’ দেখানো হত। কিছু দিন পর বোধহয় সানি লিয়োনি-র ছবি চালু হবে। কিন্তু কলেজ সোশ্যাল সবার কাছেই খুব ইম্পর্ট্যান্ট। তার চাঁদা তোলা হয় সোল্লাসে, অনুদান দিতে হয় আশপাশের দোকানপাটকেও। আর স্টেজে সে দিন যতই ক্লাসিক গান-আবৃত্তি কপচাও, আসল কথা হল, নেতারা সেলিব্রেট করতে রাত জেগে মাল খাও।
অ্যাডমিশনের সময়েই পাশে চাঁদার বিল হাতে দাঁড়িয়ে থাকত ইউনিয়নের দাদা। অ্যাডমিশনের ফি-র সঙ্গেই ওটাকেও কম্পালসরি ধরে নেওয়া হত। কলেজ কর্তৃপক্ষের মতোই, ইউনিয়নের গার্জেনি স্বতঃসিদ্ধ। সেটা প্রেম-ট্রেমের ব্যাপারে খুবই চমৎকার সেন্সরশিপের কাজ করত। কলেজের বাইরে রাস্তায় হাঁটার সময় কারা ঢলাঢলি করেছিল তাদের কড়কে দেওয়া থেকে শুরু করে আজকের সালোয়ার কামিজের নিষেধাজ্ঞায় ব্যাপার স্বাভাবিক টার্ন নিয়েছে। এক বার এক জি.এস আসার পর হঠাৎ আইন হল— বৃষ্টিতে ভিজে কোনও মেয়ে কলেজে আসতে পারবে না। ছাতা নিয়ে তো নয়ই, রেনকোট নিয়েও নয়। কেন? তখন সবে রাম তেরি গঙ্গা মইলি-তে মন্দাকিনী ভিজেছে। অতএব ভেজা বারণ।
ইমার্জেন্সির সময়, এক দিদিমণি সদ্য কলেজে পড়াতে ঢুকেছেন। ইমার্জেন্সিতে প্রেম নিষিদ্ধ হয়নি ভেবে এক সন্ধেবেলায় তাঁর ষোলোআনা নিরীহ কিন্তু মার্ক্স-লেনিন পড়া প্রেমিকটি দিদিমণির হাত ধরে ফেলেছিলেন নির্জন রাস্তায়। কিন্তু তিনি জানতেন না, মদনভস্মের অঙ্গীকার নিয়ে এক জ্যান্ত ছাত্রভৈরব দেশ ও দশের প্রবল চিন্তা আঁকড়ে ওই পথেই পায়চারি করছেন। তাঁদের অনেক দিনের টার্গেট ওই পড়ুয়া প্রেমিকটির ‘বেচাল’ দেখে তেরঙা ইউনিয়নের কত্তার কাছে কমপ্লেন হল। তৃতীয় নেত্র উদ্ভাসিত হয়ে তিনি দেখতে পেলেন, এর ফলে জনসংখ্যা বাড়তে পারে! তা তো ‘নাসবন্দি’-ক্যাম্পেনের থিম-বিরোধী! সাংঘাতিক পেটানো হল ছেলেটিকে। (‘আমাদের বোনের গায়ে কে হাত দিয়েছে!’) দিদিমণি তার পর থেকে একা একা অবসাদের ওষুধ কেনেন।
কলকাতা থেকে দূরে আবার মোড়লি’টার আঙ্গিক আলাদা। সুন্দরবন লাগোয়া একটি কলেজে বিনা পণে বিয়ে প্রোমোট করা হত। সাংঘাতিক সমাজসেবা সন্দেহ নেই। পাত্র-পাত্রী নির্বাচন, বিয়ের দিন, মায় মেনু পর্যন্ত ঠিক হয়ে যেত ইউনিয়ন রুমে। হুলটা ছিল মধুর শেষে। পণের জন্য যত বেঁচে গেল, তার ২০% ডোনেশন দাও ছাত্র ইউনিয়নে— এই বলে, একটা অ্যামাউন্ট ধরিয়ে দেওয়া হত। গার্জেন (অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়েদের), ওই ২০% ধরে হিসেব করে বিড়বিড় করে বলত— এত টাকা তো পণই চায়নি! তত ক্ষণে সাত পাক হয়ে আইসক্রিম হজম হয়ে গেছে।
দক্ষিণবঙ্গের একটি কলেজের খেলার মাঠ ছিল গোটা জনপদের সম্পদ। ওই এক মহকুমা থেকে ময়দান প্রতি বছর কম করে গোটা দশেক খেলোয়াড় পেত। কিন্তু হঠাৎ এক দিন ওই মাঠেই শুরু হল ১২ দিনের ছাত্রযুব উৎসব। তার পর মাঠেরও বারোটা পাঁচ। ফুটবলের মুখ চেয়ে বাসিন্দারা এক বার শেষ চেষ্টা করতে ছাত্র-যুবদের দ্বারস্থ হলেন। কিন্তু শুধু শুনলেন বীজমন্ত্রের মতো সংক্ষিপ্ত অথচ শক্তিশালী একটি শব্দ— দেখছি! ব্যস! যাঁরা অভিজ্ঞ তাঁরা বাইরে এসে বললেন— হয়ে গেল! প্রফেসি সত্য করে কিছু দিন পরেই মাঠের মাঝখানে নোটিস পড়ে গেল আর একটি রবিস্তম্ভের।
উলটো সুর গাইবে, কার ঘাড়ে মাথা? এক জন অপদার্থ গ্রীষ্মকালে রক্তদান শিবিরের বিরোধিতা করে বলেছিল, দূর মফস্সল থেকে এই ভ্যাপসা গরমে কলকাতার ব্লাডব্যাংক-এ পৌঁছাবার আগে রক্ত পচে যেতে পারে। এই ভয়ংকর মানবতা-বিরোধী পদক্ষেপের জন্য তার রক্তক্ষয় হয়েছিল। বার্লিনের দেওয়াল-পতনের পর এক ইন্টার-কলেজ ফেস্টে বিতর্কের বিষয় ছিল: কমিউনিজ্ম কি শেষ হতে বসেছে? ওই কলেজের লাগাম তখন লাল ইউনিয়নের হাতে ছিল না। বিতর্ক শুরু হওয়ার আগে প্রলয়: চেয়ার ভাঙা, র্যান্ডম মার, খিস্তি। (‘আমাদের মাকে কে ইনসাল্ট করেছে!’) বিতর্কে অংশ নিয়ে যুক্তি ভাঙার চেয়ে, তার্কিকদের মাথা ভাঙা ইউনিয়নবাজদের কাছে শ্রেয় মনে হয়েছিল।
ছাত্র সংসদ থেকে রাজনীতির ল্যাজ কেটে দিলে কেমন হয়, এ প্রস্তাব এলেই সাংঘাতিক সব ইতিহাসচেতনা ধেয়ে আসবে। কেন! নেতাজি যে ওটেনকে মেরেছিলেন! স্বয়ং স্যর আশুতোষ যে সুরেন বাঁড়ুজ্জের জেল আটকাতে পথে নেমেছিলেন! এই সব বড় বড় কথার আড়ালে দিব্যি রাজত্ব করে যাবে সেই সব শেয়ালেরা, যারা সহপাঠীকে নিত্যি বলে, আমরা একসঙ্গে পড়ি, কিন্তু ইচ্ছে হলেই আমি ইউনিয়ন রুমে তোকে ডেকে চড় মারব। তুই কেঁচো, আমি বাঘ। কারণ আমার গায়ে পার্টির ডোরা ডোরা দাগ।
barun.chattopadhyay@gmail.com
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy