Advertisement
০৪ মে ২০২৪

জিমি হেনড্রিক্স

জিমি হেনড্রিক্সকে আমি প্রথম শুনি ১৫ বছর বয়সে। তার আগে রেডিয়োতে অন্য মিউজিক তো প্রচুর শুনেছি। কিন্তু এ-রকম তো শুনিনি! শরীর-মনে কী একটা হতে লাগল। সেটা ভাল না খারাপ বলতে পারব না। কারণ কিছুই বুঝছি না। শুধু বুঝছি, বিরাট কিছু হচ্ছে। তার পাঁচ-সাত বছর পর থেকে, একটু একটু ওকে চিনতে শুরু করলাম। কোনও জটিল ঘটনাই না। নিখাদ সিম্পলিসিটি দিয়েই জিমি এত অ্যাট্রাকটিভ হয়ে উঠেছে। এক জন জিমিকে সরাসরি জিজ্ঞাসাই করেছিল, ‘তুমি কি জিনিয়াস?’

অমিত দত্ত
শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০১৪ ০০:২৭
Share: Save:

জিমি হেনড্রিক্সকে আমি প্রথম শুনি ১৫ বছর বয়সে। তার আগে রেডিয়োতে অন্য মিউজিক তো প্রচুর শুনেছি। কিন্তু এ-রকম তো শুনিনি! শরীর-মনে কী একটা হতে লাগল। সেটা ভাল না খারাপ বলতে পারব না। কারণ কিছুই বুঝছি না। শুধু বুঝছি, বিরাট কিছু হচ্ছে।

তার পাঁচ-সাত বছর পর থেকে, একটু একটু ওকে চিনতে শুরু করলাম। কোনও জটিল ঘটনাই না। নিখাদ সিম্পলিসিটি দিয়েই জিমি এত অ্যাট্রাকটিভ হয়ে উঠেছে। এক জন জিমিকে সরাসরি জিজ্ঞাসাই করেছিল, ‘তুমি কি জিনিয়াস?’ জিমি বলেছিল, ‘টেকনিকালি আমি গিটার-প্লেয়ারই নই। আমি শুধু সত্যি বলি, আবেগকে কথা বলাই।’ আমিও সেটাই দেখেছিলাম ওর বাজনায়। ওর স্ট্রিংগুলোতে ইমোশন অনর্গল নিজের কথা বলত। পরে তো জন ম্যাকলকলিন, পাকো দি লুচিয়া’রা গিটারে প্রযুক্তি আর আবেগকে মিলিয়ে দিয়েছেন। তবু জিমি ওর জায়গাটা নিয়ে থেকেই গেল। ও যে পাঁচ নোট-এর স্কেলগুলো রোজ রোজ বাজাত, তার মধ্যে দিয়ে অনেকখানি সংবেদনভর্তি রক্ত-মাংসের জীবন দেখা যেত যে!

সেই জীবনের দেখা মেলে, সংগীতের অনেক গভীরে পৌঁছতে পারলে। দুঃখ-কষ্ট, রাগ-অভিমান আর ভালবাসার রোজকার জীবন। সেখান থেকেই জিমি বার করে এনেছিল তার গিটারকে, তার শিল্পকে। অসম্ভব চোখা অনুভূতি দিয়ে।

ও কিন্তু আসছে ব্লুজ মিউজিকের ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে। একটা ধারণা আছে, ব্লুজ বাজাতে গেলে তোমাকে স্লেভ হতে হবে। ওর ছেলেবেলাটা কিন্তু সে-রকম অসম্ভব নিষ্ঠুর ছিল না। চলে যেত ওদের। তবে ছোট্ট থেকেই জিমি জীবন দেখেছিল খুব। বাবা বক্সার ছিল, ঘুরে ঘুরে বেড়াত। মায়ের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল। সেই যন্ত্রণা, সেই প্রচণ্ড নিরাপত্তাহীনতা ফুটে উঠত ওর গিটারে। তাই সোজা রাস্তাতেও ওকে এত গোলকধাঁধার মতো মনে হয়। সাত-আট বছর বয়সে একটা ভাঙা ইউকেলিলি বাজাত ও। তার পর ওর বাবা ধার করে একটা গিটার কিনে দিয়েছিল। পরে যেটা ও বাজিয়েছে সেটা হল ফেন্ডার স্ট্র্যাটোক্যাস্টার। আমিও এটাই বাজাই, তাই জানি, এই গিটারের একটা দারুণ ফিচার আছে। কোনও আবেগ যখন তুঙ্গে পৌঁছয়, সেটা দুর্দান্ত বের করে আনে এই যন্ত্রটা। মানে, আপনি হয়তো কষ্টে বা রাগে আআআআ বলে প্রবল চেঁচাতে চাইছেন, সেই ইমোশন-বম্বটাকে বার্স্ট করানোর জায়গাটা এই গিটার দেবে। জিমি হেনড্রিক্স এক্সপিরিয়েন্সের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ কিন্তু এই গিটার। আর ও তো বাঁ-হাতি ছিল, তাই ডান হাতের গিটারটাকে উলটে বাঁ হাতে বাজাত। তাতেই অত ‘গডলি’ দেখাত।

ফাজ ফেস, ফ্ল্যাঞ্জার বাজানোর রাস্তাটাও ও দেখিয়ে দিয়েছে। তবে যতই কায়দাজানা যন্ত্র হোক, ওই ইমোশনটুকু না ঢাললে সে কাঠই থেকে যেত। আর ওই প্রাণ অনায়াসে আসে না। জিমির স্বরলিপি টুকতে পারা যায়, কিন্তু ওই ইমোশন তোলা, ওরেব্বাবা! আমার বেড়ে ওঠার সময় কলকাতার একটা ভাল ব্যাপার ছিল, ইউরোপ আমেরিকায় গানের অ্যালবাম আসামাত্র এখানেও চলে আসত। ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, পার্ক স্ট্রিটের কয়েকটা দোকানে ঘুরলেই জিমি কী বাজাচ্ছে, কোন ট্যুরে যাচ্ছে সব খবর পাওয়া যেত। আমি যখন ওকে স্টাডি করছিলাম, ওর কাজকর্ম অনুসরণ করছিলাম, ও কী ভাবে জীবন থেকে রসদ কুড়োয় লক্ষ করছিলাম, তখন আন্দাজ পাচ্ছিলাম কী শক্ত কাজ। ও তো বেশ লম্বা নোট বাজাত মাঝেমধ্যেই, অনেক ক্ষণ ধরে। তারগুলোকে বেঁকিয়েচুরিয়ে সে কী কাণ্ড! আর সেই বাজনা সংবেদন-সম্পদে এমনই ধনী যে সময়ের জ্ঞানই থাকবে না। রেশ চলতেই থাকবে। মনে হবে আপনারও হৃদয়টা নিংড়ে নিল!

জিমি কি সাধে ইংল্যান্ডে গিয়ে ওরকম হইচইটা বাধাল! ‘অ্যানিম্যাল’ ব্যান্ড-এর চ্যাস চ্যান্ডলার ছিল বন্ধু, ও-ই নিয়ে গেল ওকে। জিমি বাজাচ্ছে, আর ধার থেকে শুনছে এরিক ক্ল্যাপটন, জেফ বেক-রা। ওরা তখনই কিংবদন্তি। জিমিকে শোনার পর সবার মুখ ফ্যাকাসে। ব্রেকে পরস্পরকে শুধু বলতে পারল, এ কাকে দেখলাম? এ কে? ওর পর তিন-চার দিন, এক হপ্তা এরা কেউ বাজাতেই পারেনি, এমনি নাড়া খেয়েছিল।

ওই পর্যায়ে পৌঁছতে গেলে প্রচুর সাধনা করতে হয়। তবে সেই অমোঘ মুহূর্তকে পাওয়া যাবে। প্রচণ্ড পরিশ্রম লাগে। কিন্তু ফল পাওয়া যায় অনেক পরে। দশ বছর কৃচ্ছ্রসাধনের পর হয়তো চিলতে সুরটুকু বেরোল। সেখানেই স্বর্গ। আমার দাদু রাইচাঁদ বড়ালকে দেখেছি, একটা ম্যাজিক মোমেন্টকে পেতে হয়তো দশ ঘণ্টা টানা রেওয়াজ করে গেছেন। যা খুঁজছিলেন তা পেয়ে গিয়ে সে কী আনন্দ তাঁর!

তার জন্য অনেক সময়ই আরও বেশি দাম দিতে হয়। শিল্পীর জীবনটাও প্রচলিত কথায় ‘অদ্ভুত’ হয়ে যায় কখনও। জিমির ছোট্ট বায়োগ্রাফিটায় এমন আজব গল্প আছে প্রচুর। ওর নামটাই ধরুন। ওর আসল নাম তো জনি। বাবা এক দিন ভাবল মা ছেলের নাম রেখেছে নিজের কোনও বয়ফ্রেন্ডের নামে। দিল নাম বদলে, জেম্স করে দিল। আর মিড্ল নেম মার্শাল ওর এক অকালমৃত দাদা। ওই মার্শাল থেকেই আবার মার্শাল অ্যাম্পলিফায়ার!

ওর এই আলাদা পার্সোনালিটিটা ঠিকরে বেরোত ওর স্টেজ পারফরমেন্সে। শুধু বাজিয়েই না, ও তুখড় গাইয়ে ছিল। কী সব গানের কথা আসত ওর মাথায়! ভিয়েতনাম নিয়ে গানটা ভাবুন। আর পার্পল হেজ!

সন্তান জিমি হেনড্রিক্সকে আইডল করলে বাবা-মা মুষড়ে পড়ে। কারণ সে কালো লোক, গিটার বাজাত, একাধিক সঙ্গিনী, ড্রাগ নিত। গিটার বাজানোটাই তো টিপিকালি খারাপ কাজ। এ রকম অবুঝ চার পাশের মধ্যে গিটারিস্ট হতে গেলে দরকার চরিত্রের জোর। এমনিতে অসম্ভব লাজুক তো কী, জিমির মধ্যে সেই শক্তি উপচে উপচে পড়ত। ওর বাজনায় সেই তুমুল প্রাণশক্তিকেই শুনতে পাই।

পড়তে বসতে বলতে হয়, কাজ করতে খোঁচাতে হয়, কিন্তু বাজিয়েকে কি বলতে হয়, ওরে গিটারটা নিয়ে বোস? না। কারণ, গানে যে জাদু আছে সে আপনাআপনিই তাকে টানতে থাকে নিজের দিকে। জিমির ছবিতে দেখবেন, গিটার ওর কোলে, ওর বুকে। ওকে ছুঁয়ে আছে। যেন শরীরেরই একটা অঙ্গ। রক অ্যান্ড রোল মানে লম্বা চুল আর নারী নয়। রক অ্যান্ড রোল-এর স্থান অনেক উঁচুতে, যার কাছাকাছি পৌঁছতে পারলেও তিন নম্বর চোখ আর কান খুলে যায়, আর জিমি হেনড্রিক্স নামটা শোনামাত্র দু’হাত জড়ো হয়ে উঠে যায় কপালে।

amytdatta@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

amit dutta jimmy hendricks rabibasariya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE